Posted in Uncategorized

‘শুদু ঠাম্মা’

 

বাড়িতে সকলের বেশ গালভরা নাম – মেজঠাম্মা, সেজঠাম্মা, দিল্লির ঠাম্মা, ছোড়দিদা, ছোড়দাদু – কেবল ঠাম্মার বেলায় শুধুই ঠাম্মা। এ হেন অবিচার কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না! আবার এইরকম চমৎকার আবিষ্কারটির জনক যে সে ব্যক্তি নয় – স্বয়ং ঠাম্মার নাতিবাবু! সুতরাং এর তো একটা বিহিত করতেই হয়। বেশ আজ থেকে ঠাম্মার নাম ‘সাদা ঠাম্মা’; কেমন মাথা ভর্তি সাদা চুল। তাছাড়া সাদা শাড়ি, চোখের চশমাটাও সাদা সাদা। উঁহু ভাল নাম হল না – আচ্ছা ‘শুধু ঠাম্মা’। দোতলার বারান্দা থেকেই ভাইবোনে হাঁকডাক শুরু হল – “ও শুধু ঠাম্মা”, “ও সাদা ঠাম্মা” … শেষে “ও শুদু” – । অর্থাৎ ভেবে দেখতে গেলে বড়সড় নামটা মোটেই ডাকার পক্ষে সুবিধের নয়। কাজেই আবার সেই ঠাম্মাতেই ফেরা।

গোয়াবাগানে ঠাম্মার ঘ্যামই আলাদা – ‘বড়পিসি’ বলে কথা। কিন্তু আমার ‘ঠাম্মা’ আছে, বিল্লুর তো আর তাই বলে ‘ঠাম্মা’ নয়। আর ‘দিদা’ তো সকলের দিদা। ওর একটুও ভাল লাগে না ‘ঠাম্মা’কে বড়পিসি বলে ডাকতে। তাই বিল্লু ‘ঠাম্মা’র নতুন নাম দিল ‘বড়’। সেই বড় নামটা সব্বার এতও পছন্দ হল যে তারপর থেকে বাড়িতে সবাই – মানে ছোড়দাদু, কাননদিদি – সব্বাই ‘ঠাম্মা’কে বলতে লাগল ‘বড়’। এই নামটা ঠাম্মার একটা বিরাট privilege. কারণ ‘বড়’র দেখাদেখি ‘মেজো’, ‘সেজো’ নামগুলো কিন্তু মোটেই টিঁকল না।

ছোটবেলায় ঠাম্মার দেরাজের টানা খুলে দশ পয়সা, কুড়ি পয়সা নিয়ে আমার প্রথম একা একা দোকানে যাবার শিক্ষানবিশি। কুড়ি পয়সা হাতে নিয়ে প্রথম যেদিন ‘বাসুর দোকানে’ গেলুম দশ পয়সার মুড়ি আর দশ পয়সার চানাচুর কিনতে, তখন নিজেকে বেশ একটা মাতব্বর মনে হতে লাগল। অন্য সবার নকল করে আমিও বললুম, “এই বসু, দশ পয়সার মুড়ি আর দশ পয়সার চানাচুর দে তো”। তারপর বকুনি বলে আছে কোথায়! দোকানে যত্ত লোক ছিল সবাই চাঁদা তুলে জ্ঞানের বন্যা বইয়ে দিল। এতবড় একজন লোককে তুইতো-কারি! আরে আমি যে বড়দের মতো একা একা দোকানে এলুম – আমার বড় হওয়াটা কেউ মোট্টে পাত্তাই দিল না!

ছুটির দিন দুপুরে ঠাম্মার পাশে শুয়ে শুয়ে টুনটুনির বই আর পাগলা দাশু শুনতে শুনতে – মজন্তালি সরকার যে কখন মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। বাঘের নাম ‘মজন্তালি সরকার’ কেউ কোনোদিন ভাবতে পারে! ডাকুদাদা আবার ঠাম্মার কাছে কাশীদাসী মহাভারত শুনতো। কিন্তু আমার অমন ছড়ায় গল্প ভাল লাগত না। আমার জন্যে ছিল উপেন্দ্রকিশোরের রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের গল্প। আবার বুড়িকে শোনাতে হত Little Red Riding Hood.  বিল্লুর বেলা ঠাকুমার ঝুলি, বাংলার উপকথা। বেচারা ঠাম্মা বই পড়তে পড়তে যেই ঘুমিয়ে পড়তো আমরা ক্যাঁক করে ধরতুম – বই এর এ লাইনটা পড়লে না যে! রোজ রোজ এক গল্প শুনে শুনে দাঁড়ি-কমা শুদ্ধু তো আমাদের মুখস্ত।

তারপর আমার পুতুলের জামা, বালিশ-পাশবালিশ, সোয়েটার কত কি যে করতে হয়েছে ঠাম্মাকে! ঠাম্মা ছিল কুরুশ বোনায় expert.  দুদিনে একেকটা লেস বোনা শেষ। উলবোনা আমার একদম ভাল লাগে না – বুনেই যাচ্ছি, বুনেই যাচ্ছি বাড়ছে আর না – ফলতঃ ইস্কুলের পরীক্ষায় সেলাই তে গোল্লা। সমস্ত দুষ্টুমি বেয়াড়াপণায় মা রাগারাগি বকাবকি করলে ঠাম্মার একটাই অভয়বাণী “বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে”। সেরকম বড় বোধহয় এখন হতে পারি নি। কিন্তু কুরুশে চেন-লং-সর্ট দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট ব্যাগ আর ডেইসি নিটারের ফুল বানাতে ঠাম্মাই আমায় শিখিয়েছিল। আর সেই সঙ্গে সেলাই মেশিনের সব খুঁটিনাটি। সেই ‘ঠাম্মার দিদা’র ঐতিহাসিক হাত মেশিন চালিয়েই আমার সমস্ত সেলাইএর বাহাদুরী।

তাস খেলায় ঠাম্মাকে হারানো next to impossible. এত ঠাণ্ডা নরম ‘ঠাম্মা’ তাস খেলতে বসলে কিন্তু অন্য মানুষ। ছোটবেলার লুডো-ব্যাগাডুলি-চাইনিস চেকার আর গাধা পিটোপিটি ছেড়ে গোলাম চোর আর ব্রে-র জমানায় গোলাম আর ইস্কাবনের রাণীটিকে ঠিক ঠাম্মা গম্ভীর মুখে পাশিয়ে দিত পাশের জনকে। আর শত কেঁদে গড়িয়ে পড়লেও স্ক্রু খেলতে বসে ঠাম্মার হাত থেকে তাস বের করা যেত না। ঠিক দেখবে শেষ দানে যখন ঠাম্মা ‘ছয়’টা ‘ছাড়ল’ তখন আমার হাত ভর্তি ছবি – সাহেব-বিবি-গোলামের ছড়াছড়ি! 29 আর ব্রিজ খেলতেও ঠাম্মা একেবারে চ্যাম্পিয়ন!

শুধু উপেন্দ্রকিশোর আর সুকুমার রায়ই নয় – ছোটবেলায় দেবী চৌধুরাণী, দুর্গেশনন্দিনীর বঙ্কিমি বর্ণনা পড়তে গিয়ে যখনই হোঁচট খেতুম ঠাম্মার দ্বারস্থ হতুম। যে কোন বাংলা শব্দের মানে জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর একদম রেডি। রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা শেষ বয়সেও ঠাম্মা ঠিক ঠিক বলে দিতে পারত। হবে না কেন! মেজোঠাম্মা বলতেন “দিদির কম্বিনেশন ছিল অঙ্ক-সংস্কৃত-লজিক”। কি বাঘা বাঘা বিষয় ভেবে দেখ একবার! তবে রুগ্ন মেয়ে বলে ঠাম্মা প্রথম স্কুলে ভর্তি হয় ক্লাস নাইনে। থোড়াই কেয়ার। তার আগে অবধি ঠাম্মার মাস্টারমশাই যে স্বয়ং বাবা – বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ঠাম্মার কথায়, “বাবার কাছে পড়া তো নয় – একদিনে অঙ্কের পুরো একটা চ্যাপ্টার শেষ। যত theorem, যত extra আছে সব করিয়ে দিলেন। রঘুবংশের একটা সর্গ একবারে শেষ। বাবা পড়ে যেতেন। শুনতে শুনতে আমি হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছি। তারপর মা ডাকতে এসেছেন নাওয়া-খাওয়ার জন্য। তখন ঘুম ভেঙ্গে দেখি বাবা গায়ে হাত বুলোচ্ছেন, আর বলছেন, “আহা রে মেয়েটা বড্ড রোগা””।

শুধু কি বাংলা – রোজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে ঠাম্মা বসতো চণ্ডী পড়তে। ঠাকুরঘুরে ঘন্টা পার করে বা নিয়ম করে পুজো করতে কোনদিনই দেখি নি। কিন্তু নিজের ঠকুমা-পিসিমার কথা মেনে প্রতিদিন চণ্ডীর দেবীকবচ পড়া চাই-ই। আর তারপর ইংরিজি খবরের কাগজ। তখনকার দিনের ‘আই এ’ পাশ ঠাম্মা যে কোন সময় এখনকার ইউনিভার্সিটির সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রীধারী আমাদের দুকান কেটে নেবার ক্ষমতা রাখত। কখনও সংস্কৃত শ্লোক, কখনও ইংরিজি শব্দের বানান বা মানে, আবার কখনও কোন কবিতার লাইন যখনই যা জানতে চেয়েছি উত্তর দিতে এক মুহুর্তও দেরী হয় নি। ঠাম্মার ‘হেল্প’ ছাড়া শব্দজব্দ ভাবতেই পারতুম না। আবার তেঁতুলের বিচি আর রিঠের দানা দিয়ে টোক্কা-ফোক্কা আর জোড়-বিজোড় খেলা শেখানোর নামে অঙ্কের মজাটাও ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।

তবে ঠাম্মার কাছে কোন বাংলা সিনেমার গল্প শুনতে চাইলে চিরকাল একটাই উত্তর মিলত – “ওই তো শেষে মিল হয়ে গেল”। দল বেঁধে হাতিবাগানের সিনেমা হলে সিনেমা দেখার অভ্যাস থাকলেও আর রোজ বিকেলে   নিয়ম করে টিভির সামনে বসলেও এর চেয়ে বেশি কোন গল্প কোনদিন ঠাম্মার কাছ থেকে উদ্ধার করা যায় নি। আমার দশা ভেবে দেখ – কার সঙ্গে যে কার, কেন অমিল হল কিছুই জানা গেল না শুধু ওই মিলের খবরেই খুশি হতে হত।

বরং ঠাম্মার ছোটবেলার গপ্পগুলো ছিল ঢের বেশি মজাদার। বাপের বাড়ি-শ্বশুর বাড়ি-মামার বাড়ি সবখানেই  আবার ‘ভাগ্যবান ব্যক্তি’র এক্কেবারে ছড়াছড়ি! “অমুকের বাবার আবার দুটো বিয়ে – এ হল প্রথম পক্ষ, আর ওরা হল দ্বিতীয় পক্ষ…”… এই করতে করতে একদিন বলল “আরে অমুকের আবার চারটে বিয়ে ছিল” – ব্যস্‌, জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে আমি এক্কেবার নাজেহাল! গল্পের খেই হারিয়ে যায়! অস্থির হয়ে শেষে বলতুম, “আচ্ছা, তোমার গল্পে কি কারুর একটা বিয়ে ছিল না!” তবে শুনে শুনে নেড়ুদ্দা, বুদ্ধাজেঠাবাবু, মরিপিসি-ঘড়িপিসি, টুলুকাকা-বুলুকাকা স-ব আমাদের একেবারে আপন হয়ে গিয়েছিল।

ঠাম্মার ছিল অসীম ধৈর্য আর অপরিসীম সহ্যশক্তি। ‘দাদু’র সর্বাধিক আদরের প্রথম সন্তান ‘নীলুবাবু’, ‘দিদা’র ‘মানিনী’ ‘লিলি’ আর সব ভাইবোনেদের আদরের ‘দিদি’ শ্বশুরবাড়ির একান্নবর্তী সংসারে অবলা বধূ হয়েই থেকেছেন। আবার কম বয়সে স্বামী হারিয়ে তারপরের দীর্ঘ বৈধব্য জীবনে কোনদিন কারুর প্রতি কোনও অভিযোগ করেন নি। নব্বই বছর বয়সে পড়ে গিয়ে কপাল ফুটো হয়ে যখন প্রায় ভেতর অবধি দেখা যাচ্ছে, আমরাই দেখে ভয়ে অস্থির – তখনও বলেছে, “কি দরকার আবার হাসপাতালে নিয়ে যাবার! ও আপনি আপনিই সেরে যেত”।

ঠাম্মার ভালবাসার প্রকাশ ছিল না। শুধু আমিই বেয়াড়া মেয়ে চিরকাল ঝগড়া করে গেছি “তুমি নাতিকে বেশি ভালবাস”। চুপ করে অভিযোগ মেনেও নিয়েছে। আবার নাতি হোস্টেল থেকে দেখা করতে এলে ঠোঙ্গা ভর্তি করে বাতাসাও সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে – নাতি ভালবাসে। তবে আমাদের আদরের ভাগে কোনদিন কম পড়ে নি একটুও। বরং কাছে থাকার সুবাদে সবচেয়ে বেশি অত্যাচারও আমিই করেছি। জ্বর হলে ঠাম্মার ঠাণ্ডা হাতের মাথায় হাত বোলানো, হামের সময় ছোট্টো নিমের ঝাঁটার সুড়সুড়ি, সর্বোপরি রোজ রোজ কলেজ থেকে ফিরেই ‘একটু গায়ে হাত বুলিয়ে দাও’, ‘একটু চুল বেঁধে দাও’ – বিনা প্রতিবাদের এই স্নেহের স্পর্শের জন্য এখনও মাঝে মাঝেই মনটা হু হু করে ওঠে। কিন্তু সব মায়া কাটিয়ে চলে যাবার সময়ও শেষবারের মতো সেই নাতির সঙ্গেই কথা বলে যায়, “তুমি এসেছ?”

 

  1. P. S. : ঠাম্মার শতবার্ষিকীতে ঠাম্মার প্রতি এটাই আমার গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো।
Posted in Uncategorized

দাদু

 

SNB (Please click here to read the full story)

Posted in Uncategorized

অসুখের সুখ

জ্বর হলে মা কেমন ‘খড়খড়ে রুটি’ বানিয়ে দিত। কাঁচকলা-পটল-পেঁপে দেওয়া নিরামিষ ঝোল আর খড়খড়ে রুটি। কখনও কখনও আলু মরিচ। দুটো মজা – এক মাছ খেতে হত না আর দুই ভাত। উফ্‌, ভাতটা যে কে আবিষ্কার করেছিল!

মা তো বাড়ির কাজ নিয়ে সবসময়ই ব্যস্ত। কিন্তু ঠাম্মা – জ্বর হলে পাশে শুয়ে শুয়ে কতক্ষণ ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিত। আর ঠাম্মার হাতটা ছিল যেমন নরম, তেমনি ঠাণ্ডা। আলাদা করে জলপটি দেবার দরকারই হত না।

তারপর কখনও গপ্পের বই পড়ে শোনাত, কখনো আবার ছোটবেলার গপ্পো বলত। একটু ভাল থাকলে কোনসময় তাসও খেলত, কিংবা মোনোপলি। আবার ছোটবেলায় যখন হাম হয়েছিল তখন ছোট্ট ছোট্ট নিমের ঝাঁটা বানিয়ে গায়ে-হাতে-পায়ে সুড়সুড়ি দিয়ে দিত।

ক্লাস টুতে যখন জণ্ডিস হল – দু মাস ইস্কুল বন্ধ। সিস্টার অ্যানি স্কুল থেকে চলে যেতে কেঁদে কেঁদে আমাদের চোখ মুখ ফুলে গেলেও সিস্টার আঞ্জেলার হাসি মুখ হয়তো সবার মনের দুঃখ একেবারেই ভুলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু প্রথম দিনের পর থেকেই তো আমি absent.  তারপর স্কুলের এগজিবিশানে মায়ের হাত ধরে যেই গিয়ে ঢুকেছি – একগাল হাসি নিয়ে সিস্টার বললেন, “এসো চন্দ্রানী”। কি যে অবাক হয়েছিলুম বলার কথা নয়! আমি তো স্কুলে যেতেই পারি নি এতও দিন। তবু কি করে সিস্টার ঠিক আমায় চিনে নিলেন! সেই দিন থেকেই মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসে ফেললুম সিস্টার আঞ্জেলাকে। তবে সুস্থ হয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করার পর রোজ যখন ক্লাসের মধ্যে সিস্টার আমার টিফিনবক্স চেক করা শুরু করলেন আর ক্লাসসুদ্ধু বন্ধুদের সামনে আমায় রোজ রোজ বাকি টিফিন খাওয়াতে শুরু করলেন – আর মাও সেই সুযোগে রোজ ছানা আর আপেলসেদ্ধ দেওয়া চালু করল – তখন এক্কেবারে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি দশা।

মনে আছে ক্লাস সেভেনে যখন চিকেন পক্স হল – মুনদিদি তখন কলকাতায়। আমি তখন নিজেকে ‘বড়’ ভাবার চেষ্টা করছি, আর মুনদিদি তো বড়ই। একদিন এসে বলল ‘ইন্দিরা’ সিনেমা দেখে এসেছে। কিন্তু যত বলি গল্পটা বল, কিছুতেই বলে না – সে নাকি বড়দের গল্প। ভা-রি রাগ হয়েছিল। আমি কি ছোট খুকি নাকি। জ্বরের মধ্যেই বঙ্কিম রচনাবলী বের করে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললুম গল্পটা – ইস্‌, ভারি তো গল্প – বলবে না তো বয়েই গেছে!

এখন ছেলেদের একটু অসুখ করলে তাদের বাবাকে যখন অস্থির হতে দেখি আমারও মনে পড়ে যায় বাবা কেমন অস্থির হয়ে আমাকেই বকাবকি শুরু করত। যেন অসুখ করেছে সেটা আমারই দোষ! যখন পক্স হল তখন খাটের পাশেই ফোল্ডিং খাট পেতে মশারি টাঙ্গিয়ে আমার শোবার ব্যবস্থা হল। এদিকে মশারি টাঙ্গানো মহা সমস্যা। তিন দিকে যদি বা দড়ি লাগানোর ব্যবস্থা হল, চার নম্বর খুঁটটা লাগানো হল একটা চুম্বক দিয়ে গোদরেজ আলমারির মাথায়। এদিকে একটু পাশ ফিরতে গেছে কি দড়িতে টান পড়ে সে চুম্বক ছিটকে পড়ে যায়। একবার পড়ে, দুবার পড়ে তারপরই বাবা বেজায় বকুনি লাগালো। খুব মন খারাপ হয়ে গেল। আমার কি দোষ! তারপর বুঝলুম আমার অসুখে কষ্ট পাওয়াটাই বাবার রাগের আসল কারণ। তখন থেকে পারতপক্ষে বাবাকে বলতে চাইতুম না শরীর খারাপ। অপিস থেকে ফিরেই “কেমন আছিস?” জানতে চাইলেই আমার চট্‌জল্‌দি জবাব, “ভালো”।

এই চিকেন পক্সটা এমন বিচ্ছিরি বেয়াড়া দিনে ধরা পড়ল – পরের দিনের স্কুলের পিকনিকে যাওয়াটাই মাটি হয়ে গেল। কেন রে বাপু – আর একদিন পরে হলে কি ক্ষতি হোত! সেই প্রথম স্কুলের পিকনিক বাদ! সে দুঃখ আমি জীবনেও ভুলব না। তবে পুরো তিন সপ্তাহই আমার বন্ধুরা – সোমা-পতু-রুপু – রোজ বিকেলে এসে আমায় সঙ্গ দিয়ে যেত। আবার বন্ধুরা আমায় চিঠিও পাঠাতো। কোনোদিন আমায় একা মনে হতে দেয় নি। এখনও সব বন্ধুরা বাড়ির কারুর অসুখে অথবা অন্য কোন আপদে-বিপদে যে ভাবে মানসিক জোর দেয় অনেক ভাগ্য করলে এরকম পাওয়া যায়।।

Posted in Uncategorized

A… – the Great!

আমাদের অনিবেবির মনে ভারি  দুঃখু। দোষের মধ্যে এই একটু ঘুরে ঘুরে বাজার দোকান করতে ভালবাসে। আর সেটা হাতিবাগান হলে তো কথাই নেই। উত্তর কলকাতার লোকেদের আবার ‘Elephant Garden’ -এর ওপর আলাদা একটা টান। যেমন ধর না কেন আমার মা। দাদা বলতেন, “তোদের পাড়ায় কি কিছুই পাওয়া যায় না! ঠিক দুক্কুরবেলা নাওয়া-খাওয়ার সময় হাতিবাগানে এসেছিস বাজার করতে!শুধু শুধু অবেলা করা”। আমার দাদির অবশ্য ওই ‘Elephant Garden’ একদম চলত না। শৌখিন মানুষ ছিলেন। তাই সেই আমলেও হিরে হতে জিরে কিনতে সোজা হগ সাহেবেরই শরণ নিতেন।

তো যে কথা বলছিলুম। অনির আবার হাতিবাগানের হকার ভাইদের সঙ্গে বেজায় ভাব। দুদিন ওকে না দেখলেই খোঁজ খোঁজ রব পড়ে যায়। আর সেখানে গিয়ে দর করার সময় যখন করুণ মুখ করে ভাইদের বলে ‘এর চেয়ে বেশি দাম দিয়ে কিনলে বাড়িতে ফিরে শাশুমার কাছে বেদম বকুনি খেতে হবে’ – তখন সেই অত্যাচারিত-লাঞ্ছিত-নিপীড়িত বোনটির কথা শুনে কোন ভাই-এর না বুকে শেল বেঁধে! যতই হোক তাদেরও তো বাড়িতে মা-বোন আছে, না কি! কাজেই যে কোনো জিনিস শেষ পর্‍্যন্ত অবিশ্বাস্য কম দামে অনির ঝুলিবন্দি হয়ে যায়। আর বাড়িতে বেচারি নিরিহ শাশুমাটি এসবের কিছুই আদ্যোপান্ত না জেনে রোজ রোজ বিষম খেয়ে অস্থির হন।

বন্ধুরা তাই এক যোগে ঠিক করেছে যে কোন উৎসবে-ব্যসনে বাজার করার কন্ট্র্যাক্টটা অনিকেই দেওয়া হবে। তা বলে যে সে বাজারে হবে না। কোথায় সিকিমে বেড়াতে গিয়ে প্রায় পুরো সিকিম ও শিলিগুড়ি মার্কেট স্যুটকেশবন্দি করে ফেলেছে – তখনও হাতিবাগানে লক্ষ্মীনারায়ণের তেলেভাজা পার্টি মিস্‌ হয়ে গেল বলে সব্বার ওপর কি রাগ! সেখানে গিয়ে বিদেশী জিনিস-কস্‌মেটিক্স হাতে নিয়েও চুলচেরা হিসেব কষতে লেগে যায় হাতিবাগানে হলে আরও কতটা সাশ্রয় হতে পারত! শুধু কি তাই ! মোহময়ী সৌন্দর্য নগরী প্যারিসের সুসজ্জিত Shopping Mall এর পাগল করা পারফিউমের সুবাসের মাঝেও হাতিবাগানের ফুটপাতের হাতছানি উপেক্ষা করতে পারে না।

এ ব্যাপারে একমাত্র আমাদের সকব অনিকে টেক্কা দিতে পারেন। তিনি আবার কোথাও বেড়াতে যাবার আগেই খবর নিয়ে নেন সেখানে আশেপাশে দোকান-বাজার Shopping Archade, Mall  কোথায় কি আছে। এমন কি দলে পড়ে একবার মহারাষ্ট্রের কোয়েনা নদি, বাঁধ-জলাধার দেখতে যাওয়া হয়। সেখানে বাকি সবাই যখন বর্ষার উদ্দাম চঞ্চল পাহাড়ী ঝর্নার রূপের ঘোর কাটিয়ে বাড়ির পথ ভুলতে বসেছে, সকবমশাই ঠিক খুঁজে খুঁজে সেই নির্বান্ধব দেশে এক নাম না জানা জ্যামজেলি ফ্যাক্টরী আবিষ্কার করে ইয়া বড় এক টিন স্ট্রবেরি জ্যাম, হরেক রকম সিরাপ, লোকাল বেকারির কেক-বিস্কুটে গাড়ি বোঝাই করে পরিতৃপ্ত মনে বাড়ি ফিরে এলেন। কতবার যে মহাবালেশ্বরে ঘুরতে গিয়ে পথের Mapro Garden এ পৌঁছে জ্যাম-জেলি কিনেই ফিরে আসা হয়েছে!

যা হোক, ফিরে আসি অনির কথায়। তা এ হেন হাতিবাগানপ্রিয় অনির কিন্তু ওখানকার দর্জিভাইদের ওপর মোটেই ভরসা নেই। তার জন্যে সেই ঠেলে যেতে হয় হগসাহেবের আখড়ায়। ‘French’ ছাড়া আবার tailor আছে নাকি! কিন্তু বিধি বাম। আমাদের জাম্বুর কথায় Manufacturing defect. পায়ের তলায় সর্ষে ছড়িয়ে দেবার সময় ভগবান পায়ের পাতাটি একেবারে ভূমিস্পর্শী করে দিয়েছেন – মানে সাদা বাংলায় Flat Feet. তাতে অবশ্য অনিকে দাবিয়ে রাখা যায় না। তবু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পায়ের ব্যথাও চক্রবৃদ্ধিহারে বেড়েই চলেছে। এমন কি হকার ভাইদের চোখের জলে মন ভিজলেও পা চলছে না।

দুঃখে আমাদেরই বুক ফেটে যায়। ‘ওরে ডাক্তার দেখা’, ‘ওরে জুতোয় প্যাডিং লাগা’, ‘ওরে পায়ে রোদ লাগা, ভিটামিন ডি চাই’। বাঙালি গৃহবধুদের সবচেয়ে বড় দোষ নিজেদের দিকে তাকাবার সময় নেই। দোকান-বাজার করা যেতে পারে, কিন্তু ছেলেমেয়েদের ইস্কুল-টিউশন, নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, বরেদের আপিস-আদালত্‌ টিফিন-রান্নাঘর সব সামলে নিজেদের নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবার সময় মেলে না। কুছ পরোয়া নেহি। মহম্মদ পর্বতের কাছে না গেলে পর্বতই মহম্মদের কাছে আসবে। বন্ধুরা আছে কি করতে!

বর্তমানের ভেজালের যুগে পায়ে ব্যথা, পিঠে ব্যথায় কম-বেশি সবাই কাবু। অর্থাৎ কমবেশি সবাই expert.  তাই কলকাতার এবারের চল্লিশ ডিগ্রি গরমে গলদ্‌ঘর্ম হয়ে যখন প্রাণান্তকর দশা, তখন সবাই মিলে পরামর্শ দিল, ‘ওরে পায়ে রোদ লাগা’। বাড়িতে যখন একটা সুন্দর বারান্দা আছে আর সেখানে যখন সূয্যিমামার কৃপাও আছে তখন এক কাজ কর না কেন – মাথায় একটা ছাতা দিয়ে ঠ্যাং ছড়িয়ে ওই বারান্দাতেই বসে পড়। সময় নষ্ট! আহা তা কেন! গানের মত এমন বন্ধু আছে! পড়িস নি সুকুমার রায় তো লিখেই গেছেন – ‘গান জুড়েছে গ্রীষ্মকালে…’। তুই ও শুরু করে দে – ছাতার আড়ালে কেউ দেখতে পাবে না দুপুরবেলা কার ‘চাঁদের হাসির বাঁধ’ ভাঙ্গল।

আমাদের সমবেত প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হল, তখন হাল ধরলেন আমাদের গুগলিদি। রোগভোগের ব্যাপারে বেজায় সিরিয়াস। আর ঠিক জানে কোন রোগের কি ওষুধ! প্যারামাউন্টের সরবৎ খাওয়াবার নাম করে খপ করে ধরে নিয়ে গেছে Orthopedic  জুতোর দোকানে। সঙ্গে করে জুতোর মাপ জোপ দিইয়ে আবার সরবৎ খাইয়ে শরীর-মন-মাথা ঠান্ডা করিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। তা বাপু মাথা গরম হবারই কথা! পুজোর মরশুমে কোথায় ঘুরে ঘুরে মার্কেটিং করবে – তা না একগাদা গ্যাঁটের কড়ি গচ্চা দিয়ে কি, না ইস্কুলের জুতো! আহা ওই টাকায় একটা সুন্দর সিল্কের শাড়ি হয়ে যেত গো! রোজ রোজ বরের পকেটকাটা কি সোজা কথা! দিন মাস গড়িয়ে যায়। দোকান থেকে ফোনের পর ফোন। দিদি আমাদের কিছুতেই আর জুতো আনতে যান না! অগত্যা – আবার সেই গুগলিদি। আবার বগলদাবা করে নিয়ে যায় দোকানে আর trial দেবার নাম করে নতুন জুতোজোড়া পরিয়েই ঝপাঝপ পায়ের চটিজোড়া ব্যাগে পুরে ফেলে। তারপর প্র্যাক্টিসের নাম করে দুই মক্কেলে ট্যাঙ্গস ট্যাঙ্গস করে সেই বড়বাজার। আহাঃ, বাজার দোকানের নামে মা চণ্ডী আমাদের ‘জলে গল’! দুজোড়া কানের দুল, একসেট কুশন কভার আরও কি কি না জানি খরিদ করে অনি আমাদের একগাল হাসি নিয়ে বাড়ি ফিরে এল। নতুন জুতোয় পায়ের ফোস্কা তখন কোথায় ভ্যানিশ!

আর সেই আলেকজাণ্ডারীয় জুতো পরে বড়বাজার জয় করে মসমস করতে করতে অবশেষে যখন অনি বাড়ি ফিরল তখন পরাজিত পুরু রাজার মতোই আমাদের জাম্বু নিজের মানিব্যাগখানি অনির হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলেন যাতে আমাদের বীর যোদ্ধা পরের দিনই তার অর্ধসমাপ্ত পুজোর বাজার শেষ করতে বেরিয়ে পড়তে পারে হাতিবাগান থেকে হগ মার্কেট।।

 

 

 

 

 

Posted in Uncategorized

কিস্‌সা দাওয়াই ডাব্বে কা

Tablets-medicines

জেরোম সাহেব নৌকো করে বেড়াতে বেরিয়ে আমার মতো পাঠককুলকে কি বিপদেই যে ফেলেছিলেন! প্রতি লাইনের হাজারো উপাখ্যানের ঠেলা সামলাতে সামলাতে এক্কেবারে নাজেহাল। আবার শুধু নিজে পড়েই পার পাই নি – এখন দুই ছেলেকেই একই সঙ্গে পড়াতে হচ্ছে জর্জ-হ্যারিস-মন্টমরেন্সির গপ্পো। ভাবছ বুঝি পৃথিবীতে একা জেরোম সাহেবই জিনিসপত্র নিয়ে ল্যাজে গোবরে হয়েছেন! ভুল ভাবছ হে গোলাম হোসেন! এবারের গপ্পোটা তোমাদের জেরোম সাহেবকেও হার মানিয়ে দেবে।

অসুস্থ বাপি আর মাকে নিয়ে বাসুসাহেব তো এসে পৌঁছলেন আমার এক সপ্তাহ ধরে গোছানো ফ্ল্যাটে। তা পরের দিন রাতে খোঁজ পড়ল মায়ের ওষুধের বাক্সর। এ সুটকেস ও সুটকেস, এ ব্যাগ ও ব্যাগ ঘেঁটেও কিছুতেই আর পাওয়া যায় না সেই ‘দাওয়াই কা ডিব্বা’।

ওদিকে আবার হয়েছে কি – ওনারা পুণে থেকে রওনা হবার একটু আগেই গাড়ি নিয়ে আসার জন্য লোক এসেছিল। তখন সেই গাড়ি করেও আবার কিছু সুটকেস পাঠানো যেতে পারে – এ হেন চমৎকার চিন্তাটা কারুর মাথায় আসে। ফলে পড়ি কি মরি করে গাড়ির মধ্যে একটা ব্যাগ তুলে দেওয়া হয় রান্নাঘরের অবশিষ্ট কিছু জিনিস সহ। সে ব্যাগে যে শেষ পর্‍্যন্ত ঠিক কি কি গেছে সে অবশ্য কেউই জানে না।

ফাঁক পেয়ে বিদায় জানাতে আসা অতিথিরা মিলে ঝপাঝপ মায়ের হাতবাক্স গুছিয়ে ফেলে। ব্যস্‌, আর যাবে কোথায়! হারানো ওষুধের খোঁজে মা বলেন, ‘এক্ষুনি সীতুকে ফোন করো। আমার স্পষ্ট মনে আছে আমি ওষুধের বাক্স সামনেই আমার ব্যাগে রেখেছি। ও ঠিক বলতে পারবে ওষুধের বাক্স কোথায়’। মাথা খারাপ নাকি! রাত সাড়ে এগারোটায় সবাই শুয়ে পড়েছে, এখন ফোন! আপনিই একটু মনে করে বলুন না কি কি ওষুধ খেতেন। সকালবেলা এখান থেকেই কিনে নেব। ‘সে আমি বলতে পারব না; বাপীকে জিজ্ঞাসা করো। ওই তো সকালে জলখাবারের পর খাই আর রাত্তিরে খাবার পর। আর দুপুরের ওষুধ – সে অন্য পুঁটলিতে ছিল। সেটা আছে’। সুগারের রুগী, তার ওপর প্রেসারের সমস্যাও আছে। কতদিন ওষুধ ছাড়া চলে! বাপীকে জিজ্ঞাসা করে সুরাহা কিছুই হল না। অসুস্থ শরীরে ঠিকঠাক কিছুই বলতে পারেন না। যে ওষুধই নাম বলি, বলেন ‘ওটা আমার’। আরে লালমোহনবাবু হয়ে গেলেন নাকি!

নার্সিং হোমে সঙ্গে থাকার সুবাদে ততদিনে আমি একটু একটু জানি কোনগুলো বাপীর ওষুধ। তবু অনেক ওষুধ পাল্টানো হয়েছে। তাই ঠিকমতো না জেনে এ সব ওষুধ তো আর দুমদাম দিয়ে দেওয়া যায় না! শেষে বৌদিকেই ফোন করলুম। ভেবে দেখলুম পড়শীর কাঁচা ঘুম ভাঙ্গানোর চেয়ে বৌদির ওপর জুলুম করাটা বেশি শোভন। আর বৌদি তখন ফোনে অনলাইন দেখাচ্ছে। কিন্তু হায়! বলল – ‘ওষুধের বাক্স তো আমি দেখি নি রে। আমার তো যেতে দেরী হয়েছে, ততোক্ষণে সব ব্যাগ গোছানো শেষ’।

এবার তবে কি করা! কোনো ডাক্তারের পক্ষে প্রতিটি রুগীর সব ওষুধ সঠিক dose সহ মনে রাখা সম্ভব নয়। তবু এতদিনের সম্পর্কের ভিত্তিতে তাঁকে একটা Whatsapp message  করা হল।

ইতিমধ্যে বুদ্ধি করে পুণার ওষুধের দোকানেও ফোন করা হয়েছে। এত বছর যখন এত ওষুধ নেওয়া হয়েছে এটুকু উপকার আশা করা যেতেই পারে! ‘ভাইয়া, প্লিজ বাতাইয়ে না, আঙ্কেলজি আন্টিকে লিয়ে কৌন কৌন সা দওয়াই লেতে থেঁ’। সুরেশ আমাদের ভা-রী ভাল ছেলে। সে পুরনো বিল দেখে তার সাধ্যমতো সব ওষুধের নাম বলল। তবে তার বক্তব্য আঙ্কেল আর আন্টির ওষুধ একসঙ্গেই নেওয়া হত, কাজেই কোনটা কার বলতে পারবে না।

যা হোক, সুরেশের দেওয়া লিস্টি হাতে নিয়ে এবার পুলিশি জেরা শুরু হল। মা তো আগেই হাত তুলে দিয়েছেন। নাম বলতে পারবেন না। কাজেই বাপীকে পাকড়াও করা হল। কিন্তু সেই এক ব্যাপার। যেটাই জিজ্ঞাসা করা হয় ‘এটা আপনার না মায়ের’ – বলেন ‘আমার’! কি মুস্কিল!!!

এদিকে মায়ের ছেলে রেগে আগুন। এসব সুগার, প্রেসার-হার্টের ওষুধ নিয়ে ছেলেখেলা! প্রেস্ক্রিপসন বের করো। সে তো আগেই গায়েব। পুরো ফাইলই হাওয়া। আমার একেকবার মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছি ফাইলটা! কিন্তু উত্তেজনা আর চেঁচামিচির মাঝে ভরসা করে সে কথা বলতেও পারছি না।

কাঁচুমাচু মুখ করে মা এসে বললেন, ‘রাগ করছিস কেন? তোরাই তো বলছিস সামনেই ওষুধের দোকান। দেখালে আমি ঠিক আমার ওষুধ চিনতে পারব। এই এত্তোটুকু সাদা বড়ি। চল না, একটু গিয়ে ওদের বলি ছোট সাদা বড়িগুলো একটু বার করে দিক, আমি তার মধ্যে থেকে ঠিক খুঁজে বের করতে পারব’। এই কথা শুনে আমার পেটের মধ্যে সেই সোডার মতো ভুসভুসিয়ে হাসি উঠতে লাগল। ভেবে দেখো একবার – একটা ওষুধের দোকানে হাজার হাজার ছোট সাদা বড়ি ছড়ানো, তার মধ্যে মা খুঁজে চলেছেন তাঁর বিশেষ একটি ছোট্ট সাদা বড়ি! নায়ক সিনেমার সেই টাকার চোরাবালিতে ডুবে যাওয়ার মতো ছোট্ট সাদা বড়ির চোরাবালি!

কিন্তু সব ভাল যার শেষ ভাল। পরেরদিন মাথা ঠাণ্ডা হতে সেই প্রেস্ক্রিপসনের ফাইল উদ্ধার হল। আর সঙ্গে সঙ্গেই সেটা মবাইলের কামেরাবন্দী। বলা তো যায় না! আবার কখন গা ঢাকা দেয়! কিন্তু সেই বিখ্যাত বাক্সর কি হল?! আর বলো না; সাতদিন পরে যখন গাড়ি এসে পৌঁছল তখন দেখা গেল গাড়ির ভেতরের বাড়তি জিনিসের ব্যাগের মধ্যে তিনি উঁকি দিচ্ছেন!!

PC: Google images.

Posted in Uncategorized

চল্‌ মুসাফির

যদি আমি লীলা মজুমদার কি নবনীতা দেব সেনের মতো লেখক হতুম; কিংবা নিছক সুচেতনার মতো, তবে আমাদের এই গুরগাঁও আসাটাই এক অনবদ্য রম্য রচনা হয়ে উঠতে পারত। দশ বছরের প্রবাস জীবনে মারাঠাদেশকেই সবাই মিলে আপন করে নিয়েছিলুম। তাই আবার ঠাঁই বদলের কথায় সবার মনেই হাজার দ্বন্দ্ব-দ্বিধা-দোলাচাল। বহু স্বপ্ন-বাস্তবের সংশয়-সংঘাত।

যে ভাবে গেঁড়ে বসেছিলুম পুণায়, তাতে প্যাকিং করতে এসে লোকেদের তো চক্ষু চড়ক গাছ! একটা তিন কামরার ফ্ল্যাটে এতো জিনিসও ধরতে পারে! জিনিসের বোঝায় এতটুকু খালি জায়গা নেই যেখানে কিছু সময়ের জন্য প্যাকিংবাক্সগুলো রাখা যায়। ফলে কাজে হাত দিয়েই দেখা গেল চূড়ান্ত হতাশাগ্রস্ত লোকগুলো সব আলাদিনের দৈত্যে পরিণত হয়েছে। চোখের সামনে যা দেখছে ঝপাঝপ বাক্সে পুরে ফেলছে। এতই তাড়া প্রথমেই আমার আলমারির চাবিটি তারা পুরে ফেলল বাক্সের মধ্যে। এদিকে আলমারি তখনও জিনিসে বোঝাই। বেশ হয়েছে! খোলো আবার! পুরো বাক্স খালি করে শেষ পর্‍্যন্ত বের হল সে চাবি।

তাদেরই বা দোষ দিই কেন! প্যাকিং হবার পরও অন্ততঃ দশ বারো দিন আমাদের পুণায় থাকার কথা। তাই কিছু জিনিসপত্র জামাকাপড় বাসনকোসন কদিনের প্রয়োজনে ওখানেই থাকার কথা। বাকি আসবে নতুন জায়গায়। ধর না কেন যে ব্যাগগুলো ওখানেই থাকার কথা, অন্ততঃ পাঁচবার সেগুলো বাক্সবন্দী হয়েছে আর আবার বার করতে হয়েছে।

রান্নাঘরে আবার আরেক কেলো। পুরোনো হাঁড়ি কড়া থালা বাটি – যাদের কিনা নতুন শহরে জায়গা হবার কথাই নয় – ‘নো এন্ট্রি’ উপেক্ষা করে তারা নিঃশেষে প্যাকিং হয়ে গেছে! কদিনের জন্যে আবার নতুন বাসন কেনার উপক্রম। আর পুঁটলি বাঁধা ডাল-মশলা, পোস্ত, পাঁপড় সব পড়ে রইল পুণার ঘরে!

তবু দুদিনের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত যখন মালপত্র গোছগাছ করে নিচে নামানো হল, বাক্সের সংখ্যা দেখে নিজেদেরই বাক্‌রুদ্ধ দশা। ছেলেদের বিস্মিত প্রশ্ন ‘আচ্ছা, আমাদের এতও জিনিস কেন?’ কি করে বোঝাই যে ‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা’ – তাই ডেও ঢাকনা সব কিছু, মায় বেহালার যোগ্যিবাড়ির হাতা আর খুন্তিটিও গোলেমালে বাক্সবন্দি হয়ে মালের মধুসূদন দাদার ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে।

রাত দুটোর সময় দুগ্‌গা দুগ্‌গা করে ট্রাকতো রওনা করা হল। কিন্তু এত সবের পরেও দেখা গেল মোবাইল ফোনেরা তো রয়েছে কিন্তু তার সব চার্জার বেরিয়ে পড়েছে গুরগাঁও এর পথে। এখন বন্ধ মোবাইল চালু করতে পাড়াপ্রতিবেশীর দ্বারস্থ হতে হয়।

যা হোক, দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ‘বীর রমণী মাতঙ্গিনী হাজরা’ হয়ে থাকতে তো শুরু করলুম ‘একা একা’ অচেনা শহরে। ছেলেদের প্রশংসা করতেই হয়। যৎপরোনাস্তি চেষ্টা করে চলেছে নতুন শহরে মানিয়ে নেবার। আগরওয়াল প্যাকার্সের কৃপায় পুরো ফ্ল্যাট তখন শুধু থরে থরে প্যাকিং বাক্সে বোঝাই। তার মধ্যে কোন বাক্সে যে কি আছে বোঝা দায়। প্রথম রাতের নৈশভোজ সারা গেল pizza র সদ্‌ব্যবহার করে। কিন্তু বাক্সের ভিড় ঠেলে রাতে শোবার জোগাড় তো করতেই হয়! প্যাকিং কোম্পানি শুধু খাটটুকু পেতে দিয়েই পিঠটান দিয়েছে। গদি-তোষক তখনও বন্দিদশায়। আমাদের নতুন বাড়ির প্রথম অতিথি পুতু বেচারিকে বাড়ি দেখতে আসার ভালই গুণগার দিতে হল। আমার করুণ মুখ দেখে বেচারি আর থাকতে পারল না। হাত লাগাল তোষক-বালিশের বন্দিত্ব ঘোচাতে। ভারী ভারী তোষক-গদি। তায় আবার ইয়া বড়া বড়া বস্তায় মোড়া। ‘মারো ঠেলা হেঁইয়ো, সাবাস জওয়ান হেঁইয়ো’! বাঁধন কেটে এঘর থেকে ওঘরে নিয়ে আসাই দুষ্কর। উফ্‌, রাত্তিরবেলা ছেলেদের সে কসরৎ যদি দেখতে! আমি তো কোমরে হাত দিয়ে almost retired hurt!

পরদিন রান্নাঘরে অবস্থা আরও শোচনীয়। আমি তখন থৈ থৈ বাসনের মাঝখানে বসে এক্কেবারে চোখের জলে নাকের জলে। ভাগ্যিস কুসু ছিল মুশকিল আসান! কুসু বললে, “শোন এত সব কৌটোবাটা এক্ষুনি কিছু লাগবে না। তুই গ্যাসটা বরং আগে চালু করার ব্যবস্থা কর”। আমাদের উৎসাহী ছোটবাবু আর কুসু মিলে ঝপাঝপ চাট্টি প্লাস্টিকের কৌটো-বাটি টিফিনবক্স পুরে ফেলল স্টোররুমের মধ্যে। এবার গ্যাস চালু করার পালা। প্রথম দিনেই গ্যাসের দু দুটো সিলিণ্ডার এসে গেছে বাড়িতে। নতুন পাইপ লাগিয়ে গ্যাসের বার্ণারও ফিট। খালি -। হ্যাঁ এই খালিতেই যত সমস্যা। বার্ণার তো রয়েছে। কিন্তু বার্ণারের মুখের ঢাকা দুটো আর ওপরের লোহার চাকতি দুটো গেলো কোথায়! হায় ভগবান, এই সোয়া শো প্যাকিং বাক্সর মধ্যে থেকে কোথায় তাদের খুঁজি এখন! তারা আবার পুণায় রয়ে গেল না তো!

সেদিনের মতো আমরা না হয় কেয়ার অফ কুসু – তাই নো চিন্তা। কিন্তু তারপর! পরের দিন ভোর না হতেই শুকনো পাঁউরুটি চিবিয়ে ছেলেরা তো স্কুলে ছুটল আর আমি বসলুম সংসার গোছাতে। জুলজুল চোখে একবার করে গ্যাসের দিকে তাকাই, একবার মাইক্রো ওভেনের দিকে। কি করা যায়!

‘ইউরেকা’, পেয়েছি! উফ্‌, আর্কিমিডিসেরও বোধহয় এতটা আনন্দ হয় নি! চান করাতেই যদি পৃথিবীর সব সমস্যার এরকম সমাধান পাওয়া যেতো! হায় রে!! ওই তো অ্যালুমিনিয়ামের বালতির ভেতরে উঁকি মারছে ঝকঝকে দুটো পেতলের ঢাকা আর কুচকুচে কালো দুটো লোহার চাকতি! উহ্‌, কি শান্তি! ফিরে এসে ছেলেগুলোর কপালে খাবার জুটবে তাহলে।

রান্না করতে গিয়ে দেখি চাল-ডাল-তেল-নুন তো এনেছি, কিন্তু হলুদ-লঙ্কা-গুঁড়ো মশলা তো আনতে ভুলে গেছি। এদিকে নতুন শহরে প্রথম দিনে একা একা বেরোই কি করে – ছোটবেলায় সেই ছেলেধরা ধরার পর থেকে একা যেতে আমার ভীষণ ভয়। আহা কি আর এমন বড় হয়েছি!! যাক গে, আজ নাহয় সাহেবি ডালই খাওয়া যাবে! ফটফটে সাদা বিনা হলুদে! বুড়ো বয়সে ছেলেদের রান্না শেখানোর কালে এসে সমস্ত theory পড়া ছেড়ে হাতে কলমে রান্না করতে বসলুম নতুন শহরে, নতুন পরিবেশে, নতুন উদ্যমে। একদিন তো শুরুটা করতেই হয়! তাই না কি!

এরপর ধীরে ধীরে এই নতুনই পুরোনো হয়ে উঠছে। বাক্সর ঘেরাটোপ ছেড়ে একে একে সব জিনিসই বাইরের আলোর মুখ দেখছে। জিনিসপত্র মানুষজনে এবাড়িও ভরে উঠছে। বহু জিনিসের লুকোচুরিখেলা – হারানো-প্রাপ্তিতে আমাদের বহু সময় কেটেছে। আবার ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বিদায়ও দিতে হয়েছে অতি প্রিয়জনকে। নতুন জিনিসের সঙ্গে বাড়তি পাওনা কিছু নতুন মানুষের বন্ধুত্বও লাভ। আসা-যাওয়া কান্নাহাসির দোলায় চড়ে ভালোমন্দ সুখেদুখে দিন কেটে যাচ্ছে স্মৃতিমেদুর অতীত থেকে অনাগত ভবিষ্যতের পথে।।

 

 

 

Posted in Uncategorized

Cab Ride

রিম্পা এক্কেবারে বদ্ধপরিকর – কাকীমাকে মানুষ করতেই হবে। তা সে ‘কাকীমা’টি মানে আমি পুরোপুরি মধ্যযুগীয়, মানে এ যুগে নিতান্তই অচল। তবে প্রাণে শখকেও বলিহারি। ঘ্যান ঘ্যান করেই যাই – এই বল না রে, তোরা কি এত blog লিখিস। কি হয় ওসব লিখে? আমিও লিখব। অন্য কেউ এসবে বিশেষ পাত্তা দেয় না। তবে কি না রিম্পার কথা আলাদা। রাস্তার কুকুর বেড়ালের প্রতিও ওর যা মায়া – কাকীমাটিকে তাই ফেলতে পারে না। বলে আচ্ছা আমি তোমায় শিখিয়ে দেবো খন। এ তো গেল প্রথম পর্ব।

এবারে নতুন জায়গায় এসে বিশ্বহাবা কাকীমাটি বাড়ী থেকে বেরোতে পারছে না। দয়ার অবতার এসে বলল, “কেন Uber Cab  ডাকো না। যেখানে যেতে চাও নিয়ে যাবে”। আবার আস্থা জন্মানোর জন্যে নিজে সঙ্গে কতে একদিন সেই Uber Cab চড়িয়েও নিয়ে এল।

এই অসহ্য গরমে এসি গাড়ী – আহা বেশ বেশ। তারপর আবার হিসেব কষে দেখিয়ে দিল অন্য যানবাহনের তুলনায় এই গাড়ী কত ভাল ও সস্তা। যেমন কাঙ্গালকে শাকের ক্ষেত দেখানো। শুরু হল ঘ্যান ঘ্যান। আমাকেও শিখিয়ে দে না কি করে কি করতে হয়।

নিজের সময় নষ্ট করে বেচারি আমার ফোনে Apps download করে activate করে দেয়। আবার উৎসাহ দেবার জন্যে বলে তোমার ৫০ টাকা করে তিনটে ফ্রি রাইড। আমি তোমায় গিফ্‌ট করলুম। বাহ্‌, বেশ ভাল কথা।

তো পর দিন সকালে আমি বেরোলুম নতুন শিক্ষার পরীক্ষা করতে। বলেছে Uber Pool –এ আবার টাকা কম লাগে। বেশ কথা। সক্কালবেলা (মানে এই দশটার সময়) খুব গম্ভীর মুখ করে ফোনে Uber Pool  Book করা হল। যাব এই বাড়ী থেকে মেট্রো স্টেশন। অটো করে গেলে এই সত্তর-আশি টাকা লাগে আর সময় সাকুল্যে দশ থেকে পনেরো মিনিট। এসি গাড়ী বলেছে ৪৮.৫০ টাকা লাগবে। কি মজা! সময় যে বলে চব্বিশ মিনিট! দেরী হয়ে যাবে যে! যা হোক, সোসাইটির গেটের মুখে যেতেই দেখি গাড়ী হাজির! আমিই তার প্রথম সওয়ারী। তারপর গাড়ী এদিক ঘুরে ওদিক ঘুরে এগলি ওগলি হয়ে আরও দুজনকে তুলে নিয়েছে। দেখেই বোঝা যায় এ ধরনের সফরে তারা রীতিমত পোক্ত। এদিকে আমি পড়েছি মহা ফ্যাসাদে। আরে ওই ফ্রি কুপনগুলো নিতে হয় কি ভাবে? এদিকে আবার প্রেস্টিজ আছে ষোলো আনা। ড্রাইভার কে জিজ্ঞাসা করলে সহযাত্রীরা যদি বোকা ভাবে!

যা হোক, আধা ঘন্টা গুরগাঁও এর অলি গলি চক্কর মেরে পৌঁছলুম তো মেট্রো স্টেশন। কিছু না বলে গম্ভীর মুখ করে একখানি পঞ্চাশ টাকার নোট ধরিয়ে দিলুম ড্রাইভারের হাতে। এবার কি receipt দেবে! এক মুহুর্ত থতমত খেয়ে ড্রাইভারের দিকে চেয়ে এগিয়ে গেলুম মেট্রো স্টেশনের মধ্যে। অবশ্য আমার সান্ত্বনা যে Uber থেকে একটা মেসেজ এসেছে – You have taken your very first ride… bla bla bla… rate your driver.

এবার পরের ঝঞ্ঝাট ফোন নিয়ে। ফোনে যেটুকু চার্জ আছে তাতে দিনভর চলে কি না সন্দেহ। তাই ট্রেনে উঠেই ভয়ে ভয়ে Net connection off করে দিয়েছি। এদিকে একা একা cab ও মেট্রো চড়ে মনটা নিতান্তই ফুরফুরে। যাচ্ছি কিনা দিল্লি – তাও আবার একা একা – হুঁ হুঁ বাবা!

প্রথম পর্ব সমাধা করে পরের গন্তব্য আকবর ভবন। নাহ্‌, তার এক্কেবারে পাশে কোনোই মেট্রো স্টেশন নেই। কিছুটা অটো বা গাড়ী করতেই হবে। কুছ পরোয়া নেহি। Uber  আছে কি করতে। দিল্লীতে নাকি হেড অপিস, কাজেই প্রচুর গাড়ী। ফোনের বন্ধ mobile data চালু তো করা গেল। কিন্তু রাস্তার রোদের তেজে কিছুই দেখা যায় না। তাই Pick up location যে হৌস খাসের বদলে গুরগাঁও মেট্রো স্টেশন হয়ে বসে আছে সেটা যতক্ষণে মগজে ঢুকলো ততক্ষণে cab booking confirm হয়ে গাড়ী পৌঁছে গেছে। ওরে booking cancel কর!উফ্‌, ফোনের নেট্ ওয়ার্ক নেই!! ভয়ে ভয়ে ফোনটাই বন্ধ করে দিই।

এবার তাহলে অটোই ভরসা। এই রে Lunch time!  কেউ যেতে চায় না। গরমে রোদ্দুরে গলদ্ঘর্ম হয়ে অতি কষ্টে একজনকে রাজী করানো গেল। আবার সেই গম্ভীর মুখে বসে বসে রাস্তার দুপাশে দেখতে দেখতে চলেছি। ও হরি এই বুঝি সেই দিল্লী হাট! আচ্ছা আসবখন একদিন। ও মা কি সুন্দর structure  একটা। এটা বুঝি সফদরজঙ্গের সমাধি! ASI দেখভাল করছে। তারমানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলতে হয়! আরে সফদরগঙ্গ এয়ারপোর্ট! কি মজা কত্ত দিল্লী ঘোরা হচ্ছে। কিন্তু আর কতদূর। GPSটা চালাই তো! এই তো আকবর রোড। কিন্তু আকবর ভবন কই! লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞাসা করেই ফেলি – “ভাইসাব কিতনা দূর হ্যায় ইয়ে আকবর ভবন?” শুনে তো সে আঁতকে ওঠে। “আকবর ভবন!!! আপ নে তো বোলা আকবর রোড!” বোঝো ঠেলা! আকবর ভবন যে আকবর রোডে নয়!! সে বলে পেছনে যেতে হবে। আমি বলি সে আর কি করা যাবে দাদা। যেতে হলে যেতে হবে। তাই বলে আকবর ভবনে যেতে গিয়ে আকবর রোডে ঘুরে বেড়ালে তো আর চলবে না!

অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে সে আমায় অবশেষে আকবর ভবনে নামিয়ে দেয়। জেনে নিই কাছাকাছি মেট্রো স্টেশন বলতে রেস কোর্স, অটোয় চল্লিশ টাকা। লোকটা হয় আমার ওপর ভরসা রাখতে পারে না, আর নয়তো এমন মুরগী হাতছাড়া করতে চায় না। তাই আমার আকবর ভবন অভিযান সাঙ্গ করে যখন আধঘন্টা পর সামনে দাঁড়ানো অটোয় উঠে বসি, ড্রাইভারের মুখ দেখে কেমন যেন মনে হয় সেই মক্কেল মনে হচ্ছে! আমি অবিশ্যি একবার দেখে কিছুই মনে রাখতে পারি না; বড়বাবু কি তার বাবা হলে ঠিক বলে দিত!

যা হোক, এবার ফিরতি ট্রেন। আবার দেখি স্টেশন থেকে বাড়ি Uber Pool  পাই কি না! ও মা, ফোনের চার্জ যে মাত্র ১০%। এদিকে নেট চালু করতেই শ’ইয়ে শ’ইয়ে WA message. মেসেজ তো পড়ছি খুব মনযোগ সহকারে। এদিকে ট্রেন যে কুতুব মিনার স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়েছে! আহা কি সুন্দর – ট্রেন থেকেই কেমন কুতুব মিনার দেখা যায়! ছেলেদুটোকে নিয়ে একদিন আসতে হবে। ইস্‌, ফোনে ছবি ভাল আসছে না – বেশ zoom থাকলে ভাল হত। আমার তন্ময়তা ভাঙ্গিয়ে একজন লোক শেষে বলেই ফেলল – আরে নেমে পড়ুন, এ ট্রেন আবার উল্টোদিকে যাবে। মানে!! তাই তো – সব লোক নেমে যাচ্ছে দেখি! মানে যারা উঠছে তারা সব দিল্লীগামী। আর নিজের ওপর ভরসা রাখতে পারি না। সামনের একটি মেয়েকে পাকড়াও করি। Huda City যাব গো। বলে নিচে নেমে ওপাশের প্ল্যাটফর্মে চলে যাও। আরে তাই তো! এ তো দিল্লীমুখী লাইনই বটে! যা হোক সে যাত্রায় কোনোক্রমে ফাঁড়া কাটিয়ে নির্দিষ্ট স্টেশনে পৌঁছই।

কিন্তু অভাগা যেদিকে যায়! লাইন দিয়ে বেরতে গিয়ে দেখি এ লাইন শুধুই কার্ড মেম্বারদের জন্যে। টোকেন চ্যানেল বন্ধ। পাশের লাইনে এসে টোকেন তো মেশিনের গব্বে ঢুকে গেল, এদিকে invalid এর লালবাতি জ্বলে – চিচিং বন্ধ!! কি ফ্যাসাদ রে বাবা! এবার কি WT বলে পুলিশে ধরবে! দরদরিয়ে ঘেমে এক গার্ডকে পাকড়াও করি। এরকম আজব চিড়িয়া দেখে সে নেহাতই দয়া পরবশ হয়ে আমায় এক বিশাল বস্তাওয়ালার চিচিং ফাঁকের ভেতরেই গলে যেতে দিল।

ওদিকে সে Uber Pool তো গেটে হাজির। দুমিনিটের মধ্যে গাড়ীতে ওঠার সতর্কবার্তাও এসে গেছে। এদিকে ফোনের অবস্থা তিন পার্সেন্ট। Screen পুরোই অন্ধকার। ফোন তো বেজে চলেছে ধরা যাচ্ছে না! কেটে দেওয়াও যাচ্ছে না!! পুরো ল্যাজে গোবরে হয়ে সবে ভাবছি – ঢের হয়েছে বাপু, এবার একটা অটোতে চেপে বসি – অবশেষে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত গাড়ী এসে দাঁড়ালো। দুগ্‌গা, দুগ্‌গা। ভালয় ভালয় বাড়ি পৌঁছতে পারলে বাঁচি। পেটে ছুঁচোর ডন, মাথা ঝিমঝিম। বাড়ী পৌঁছে বলে কিনা দিন এবার আশি টাকা। অ্যাঁ! এই যে বললে পঞ্চাশ! হ্যাঁ হ্যাঁ তাই। কিন্তু এটা হল আগের outstanding bill। মানেটা কি! মামদো বাজি! সঙ্গের যাত্রীটি অভয় দেন – চিন্তা নেই, গন্ডগোল হলে ওরা পরেরবার ঠিক করে দেবে। একটা email  করে দিলেই হবে। মনের দুঃখে কড়কড়ে আশিটি টাকা দিয়ে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতে দিতে এলুম যে যাক গে, এই গরমে অটোতে গেলে যাতায়াতে এর চেয়ে বেশীই লাগতো – এ আবার এসি গাড়ী।

কিন্তু আমার এ হেন দুর্গতিতে রিম্পা মোটেই খুশী নয়। এ যেন ওরই প্রেস্টিজ পাংচার। বললে শিগ্‌গিরি মেইল করো। এরকম আমার কত্তো হয়েছে। ওরা refund করে দেবে। ঝুড়ি ঝুড়ি sample email পাঠাতে থাকে। আবার আমি যে সকালে দু—টাকা বেশী দিয়েছি, যেটা নাকি আবার free ride হিসেবেও ধরা হয়েছে, শুনে তো রেগেই আগুন। এদিকে আমি ভাবছি, ‘হায় হায় এ তো আমারই মূর্খোমি। কোম্পানি যদি এমন দ্যাখতো না দ্যাখতো সব্বাইকে refund দেয় তবে ব্যবসা তো লাটে উঠল বলে!’

যা হোক, এই ফ্রি রাইড আর রিফান্ডের চক্করে এর পরের দুশো ষোলো টাকার যাত্রা আমার মাত্র বিয়াল্লিশ টাকায় সারা হল এই যা।।

PC: Google images.

Posted in Uncategorized

অমূল্য ধন

ছোটবেলাটা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সেই যে সেই বৃষ্টি পড়ে রাস্তায় যেই জল দাঁড়াতো অমনি কাগজের নৌকো বানিয়ে জলে ভাসাতুম কেমন। কাগজের নৌকোটা মনে হয় বাবা বানাতে শিখিয়েছিল। আর কাগজের পাখা। সিগারেটের প্যাকেটের রুপোলী রাংতাটা দিয়ে বানানো সুন্দর রুপোলী পাখা। সেই আমার শেখা প্রথম অরিগ্যামি। তখন অবশ্য অরিগ্যামি নামটা জানতুম না মোটেই। তবে সারাদিন বসে থাকতুম কখন বাবা বাড়ি আসবে আর আমায় প্যাকেট থেকে রাংতাটা দেবে। আবার কোন কোনো সময় সোনালি রাংতা পেতুম। ‘মাম্‌মাম’ এর জন্যে শিবুজেঠুর দেওয়া। সেদিন যেন বাড়তি মজা। সোনালি পাখার হাওয়াটা যেন একটু বেশি বেশি।

সিগারেটের কি শুধুই রাংতা! উঁহু। অ্যাস্ট্রে থেকে ফেলে দেওয়া পোড়া টুকরোগুলো  বার করে কি মনযোগ দিয়ে যে বাড়তি তামাকটুকু আর ফিল্টারের তুলোটা আলাদা করতুম – উফ্‌, যেন অর চেয়ে দরকারি কাজ পৃথিবীতে আর নেই। সে সেই গোয়াবাগানের যুগে। মায়ের মুখে শুনেছি আমার এই সিগারেটের ফিল্টার প্রীতি দেখে দাদু নাকি মাকে বলেছিলেন “তোর মেয়েটা বড় হয়ে সিগারেট টিগারেট খাবে”। দাদু মানে বাবার দাদু বিজ্ঞানাচার্‍্য্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। জীবনের শুরুর বছরটায় ওনারই ছত্রছায়ায় থাকার সুবাদে দাদুর অসীম ভালবাসা আর প্রশ্রয় পাবার সৌভাগ্য হয়েছিল কিনা। দাদুর আস্ট্রেও আমার কবল থেকে ছাড় পায় নি। পরে বড় হয়ে যখন বাবার সিগারেটেই দু এক টান দিয়ে দেখতে গেছি, কাসির দমকে মনে হয়েছে – যাক দাদুর কথার মান থাকল!

বর্ষাকাল আমার মোট্টে ভাল লাগে না। সে রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন না কেন। আর যেদিন সারাদিন মেঘের আড়ালে আকাশের মুখ ভার, দিনভর ঘ্যাঙ্ঘ্যানে বৃষ্টি – মেজাজটা সেদিন আপনিই তিরিক্ষি হয়ে যায়। তবে ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ে স্কুলে যেদিন রেনি ডে হয়ে যেত – সেদিন যে কি মজা, কি মজা! আর ছোটবেলায় যখন রাস্তায় জল দাঁড়াতো তার মধ্যে ছপাং ছপাং করে চলতে যে কি রোমাঞ্চ! জল জমতো গোয়াবাগানে। কিন্তু বাড়ির বড়রা মোটেই সে জলে নামতে দিতে চাইতো না। সে নাকি নোংরা ড্রেনের জল। মামারবাড়ির তিনতলায় নদাদির ঘরের জানলা দিয়ে দেখতুম্ নিচে বাচ্ছারা কেমন মজা করে জলে খেলা করছে। আর নদাদি মায়ের ছোটবেলার গপ্পো বলতো, কেমন এক গলা জল ঠেলে মা ইস্কুল থেকে ফিরত ওই সামনের রাস্তা দিয়ে। শুনতে শুনতে আমি যেন দেখতে পেতুম ওই তো মা আসছে।

আর দাদুর ঘরের জানলায় বসে আমি আর বিল্লু ওই জানলা থেকেই জলে নৌকো ভাসাবার তাল খুঁজতুম। সামনে বড় কাউকে দেখতে পেলেই বায়না করতুম নৌকোটা জলে ভাসিয়ে দাও না গো।  আমি তো চিরকালের হাঁদা – আমার নৌকোগুলো স-ব কাত হয়ে পড়ে যেতো। বিল্লুরগুলো তবু এক একটা বেশ ভাসতো জলে।

সেই ছোট থেকেই দাদুর ঘরের জানলাগুলো আমাদের অনেক গোপন ষড়যন্ত্রের সাক্ষী। ওই জানলা দিয়েই দেখতুম কেমন করে সামনের কয়লার দোকানে লরি থেকে কয়লা ঢালা হচ্ছে। ইয়া বড় বড় বাটখারা চাপিয়ে পেল্লায় দাঁড়িপাল্লায় ওজন হচ্ছে। সামনের ছোট মিষ্টির দোকানের দানাদার আর গুঁজিয়াগুলো কেমন টুকটুক করে ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে। ও মিষ্টিদাদু আমাদের দুটো দানাদার দাও না গো।

ওই জানলায় বসেই দুজনে সারাদুপুর ধরে যুক্তি হত প্রথম দিন চশমা চোখে কি ভাবে ক্লাসে ঢোকা যায়। কথা বলার জন্য বাংলা ক্লাসে বকুনি খেয়ে ভারি রাগ হয়েছিল। তাই সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে দিদির সাদা জামায় যখন কাঁচা সবুজ রঙ লাগল তখন সব বন্ধুদের সহানুভূতি সুচক কথার মাঝে বিল্লুর ‘বেশ হয়েছে মাতঙ্গিনী হাজরা’ – (তখন ক্লাসে মাতঙ্গিনী হাজরা পড়ানো হচ্ছিল কি না) – এই মন্তব্য ঘিরে যত জল্পনা কল্পনা সবই ওই জানলার ওপর। ওই জানলায় বসেই সারাদিন ধরে মাথা খাটিয়ে দুই মক্কেলে এক গোপন ভাষা তৈরী করেছিলুম। তখন আমরা ক্লাস ফাইভ। নন্দিনীদির বদলে কয়েকদিনের জন্য তপশ্রীদি এসেছেন ইংরিজি পড়াতে। সপ্তাহখানেক পর চলে যাবার সময় আবার বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বর দিয়ে গেছেন। দিদির বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বর পাওয়া – সে উত্তেজনাটাই আলাদা! দাদুর ঘর থেকে ফোন নম্বর যে একবারও ঘোরাই নি মোটেই তা নয়। তবে কেউ ধরার আগেই ফোন রেখে দিয়েছি। আবার বাবার গাড়ি করে দুজনে শ্যামবাজারের গলি গলি খুঁজতেও গিয়েছিলুম তপশ্রীদির বাড়ি! তবে আমাদের সেই গোপন ভাষায় সারাদুপুর ধরে দুজনে মিলে দিদিকে চিঠি লেখার  যে উৎসাহ আর রোমাঞ্চ সে কথা কোনোদিন ভোলার নয়। প্রথম কৈশোরের সেই প্রথম চিঠি দিদির হাতে না পৌঁছলেও নিজেদের সেই চূড়ান্ত গোপন তথ্যটি লাল ডায়রীর অন্তরে আজও সযত্নেই রক্ষিত আছে ছোটবেলার আর সব অমূল্য সম্পদের মাঝে।।