বাড়িতে সকলের বেশ গালভরা নাম – মেজঠাম্মা, সেজঠাম্মা, দিল্লির ঠাম্মা, ছোড়দিদা, ছোড়দাদু – কেবল ঠাম্মার বেলায় শুধুই ঠাম্মা। এ হেন অবিচার কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না! আবার এইরকম চমৎকার আবিষ্কারটির জনক যে সে ব্যক্তি নয় – স্বয়ং ঠাম্মার নাতিবাবু! সুতরাং এর তো একটা বিহিত করতেই হয়। বেশ আজ থেকে ঠাম্মার নাম ‘সাদা ঠাম্মা’; কেমন মাথা ভর্তি সাদা চুল। তাছাড়া সাদা শাড়ি, চোখের চশমাটাও সাদা সাদা। উঁহু ভাল নাম হল না – আচ্ছা ‘শুধু ঠাম্মা’। দোতলার বারান্দা থেকেই ভাইবোনে হাঁকডাক শুরু হল – “ও শুধু ঠাম্মা”, “ও সাদা ঠাম্মা” … শেষে “ও শুদু” – । অর্থাৎ ভেবে দেখতে গেলে বড়সড় নামটা মোটেই ডাকার পক্ষে সুবিধের নয়। কাজেই আবার সেই ঠাম্মাতেই ফেরা।
গোয়াবাগানে ঠাম্মার ঘ্যামই আলাদা – ‘বড়পিসি’ বলে কথা। কিন্তু আমার ‘ঠাম্মা’ আছে, বিল্লুর তো আর তাই বলে ‘ঠাম্মা’ নয়। আর ‘দিদা’ তো সকলের দিদা। ওর একটুও ভাল লাগে না ‘ঠাম্মা’কে বড়পিসি বলে ডাকতে। তাই বিল্লু ‘ঠাম্মা’র নতুন নাম দিল ‘বড়’। সেই বড় নামটা সব্বার এতও পছন্দ হল যে তারপর থেকে বাড়িতে সবাই – মানে ছোড়দাদু, কাননদিদি – সব্বাই ‘ঠাম্মা’কে বলতে লাগল ‘বড়’। এই নামটা ঠাম্মার একটা বিরাট privilege. কারণ ‘বড়’র দেখাদেখি ‘মেজো’, ‘সেজো’ নামগুলো কিন্তু মোটেই টিঁকল না।
ছোটবেলায় ঠাম্মার দেরাজের টানা খুলে দশ পয়সা, কুড়ি পয়সা নিয়ে আমার প্রথম একা একা দোকানে যাবার শিক্ষানবিশি। কুড়ি পয়সা হাতে নিয়ে প্রথম যেদিন ‘বাসুর দোকানে’ গেলুম দশ পয়সার মুড়ি আর দশ পয়সার চানাচুর কিনতে, তখন নিজেকে বেশ একটা মাতব্বর মনে হতে লাগল। অন্য সবার নকল করে আমিও বললুম, “এই বসু, দশ পয়সার মুড়ি আর দশ পয়সার চানাচুর দে তো”। তারপর বকুনি বলে আছে কোথায়! দোকানে যত্ত লোক ছিল সবাই চাঁদা তুলে জ্ঞানের বন্যা বইয়ে দিল। এতবড় একজন লোককে তুইতো-কারি! আরে আমি যে বড়দের মতো একা একা দোকানে এলুম – আমার বড় হওয়াটা কেউ মোট্টে পাত্তাই দিল না!
ছুটির দিন দুপুরে ঠাম্মার পাশে শুয়ে শুয়ে টুনটুনির বই আর পাগলা দাশু শুনতে শুনতে – মজন্তালি সরকার যে কখন মনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। বাঘের নাম ‘মজন্তালি সরকার’ কেউ কোনোদিন ভাবতে পারে! ডাকুদাদা আবার ঠাম্মার কাছে কাশীদাসী মহাভারত শুনতো। কিন্তু আমার অমন ছড়ায় গল্প ভাল লাগত না। আমার জন্যে ছিল উপেন্দ্রকিশোরের রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের গল্প। আবার বুড়িকে শোনাতে হত Little Red Riding Hood. বিল্লুর বেলা ঠাকুমার ঝুলি, বাংলার উপকথা। বেচারা ঠাম্মা বই পড়তে পড়তে যেই ঘুমিয়ে পড়তো আমরা ক্যাঁক করে ধরতুম – বই এর এ লাইনটা পড়লে না যে! রোজ রোজ এক গল্প শুনে শুনে দাঁড়ি-কমা শুদ্ধু তো আমাদের মুখস্ত।
তারপর আমার পুতুলের জামা, বালিশ-পাশবালিশ, সোয়েটার কত কি যে করতে হয়েছে ঠাম্মাকে! ঠাম্মা ছিল কুরুশ বোনায় expert. দুদিনে একেকটা লেস বোনা শেষ। উলবোনা আমার একদম ভাল লাগে না – বুনেই যাচ্ছি, বুনেই যাচ্ছি বাড়ছে আর না – ফলতঃ ইস্কুলের পরীক্ষায় সেলাই তে গোল্লা। সমস্ত দুষ্টুমি বেয়াড়াপণায় মা রাগারাগি বকাবকি করলে ঠাম্মার একটাই অভয়বাণী “বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে”। সেরকম বড় বোধহয় এখন হতে পারি নি। কিন্তু কুরুশে চেন-লং-সর্ট দিয়ে ছোট্ট ছোট্ট ব্যাগ আর ডেইসি নিটারের ফুল বানাতে ঠাম্মাই আমায় শিখিয়েছিল। আর সেই সঙ্গে সেলাই মেশিনের সব খুঁটিনাটি। সেই ‘ঠাম্মার দিদা’র ঐতিহাসিক হাত মেশিন চালিয়েই আমার সমস্ত সেলাইএর বাহাদুরী।
তাস খেলায় ঠাম্মাকে হারানো next to impossible. এত ঠাণ্ডা নরম ‘ঠাম্মা’ তাস খেলতে বসলে কিন্তু অন্য মানুষ। ছোটবেলার লুডো-ব্যাগাডুলি-চাইনিস চেকার আর গাধা পিটোপিটি ছেড়ে গোলাম চোর আর ব্রে-র জমানায় গোলাম আর ইস্কাবনের রাণীটিকে ঠিক ঠাম্মা গম্ভীর মুখে পাশিয়ে দিত পাশের জনকে। আর শত কেঁদে গড়িয়ে পড়লেও স্ক্রু খেলতে বসে ঠাম্মার হাত থেকে তাস বের করা যেত না। ঠিক দেখবে শেষ দানে যখন ঠাম্মা ‘ছয়’টা ‘ছাড়ল’ তখন আমার হাত ভর্তি ছবি – সাহেব-বিবি-গোলামের ছড়াছড়ি! 29 আর ব্রিজ খেলতেও ঠাম্মা একেবারে চ্যাম্পিয়ন!
শুধু উপেন্দ্রকিশোর আর সুকুমার রায়ই নয় – ছোটবেলায় দেবী চৌধুরাণী, দুর্গেশনন্দিনীর বঙ্কিমি বর্ণনা পড়তে গিয়ে যখনই হোঁচট খেতুম ঠাম্মার দ্বারস্থ হতুম। যে কোন বাংলা শব্দের মানে জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর একদম রেডি। রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা শেষ বয়সেও ঠাম্মা ঠিক ঠিক বলে দিতে পারত। হবে না কেন! মেজোঠাম্মা বলতেন “দিদির কম্বিনেশন ছিল অঙ্ক-সংস্কৃত-লজিক”। কি বাঘা বাঘা বিষয় ভেবে দেখ একবার! তবে রুগ্ন মেয়ে বলে ঠাম্মা প্রথম স্কুলে ভর্তি হয় ক্লাস নাইনে। থোড়াই কেয়ার। তার আগে অবধি ঠাম্মার মাস্টারমশাই যে স্বয়ং বাবা – বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ঠাম্মার কথায়, “বাবার কাছে পড়া তো নয় – একদিনে অঙ্কের পুরো একটা চ্যাপ্টার শেষ। যত theorem, যত extra আছে সব করিয়ে দিলেন। রঘুবংশের একটা সর্গ একবারে শেষ। বাবা পড়ে যেতেন। শুনতে শুনতে আমি হয়তো ঘুমিয়েই পড়েছি। তারপর মা ডাকতে এসেছেন নাওয়া-খাওয়ার জন্য। তখন ঘুম ভেঙ্গে দেখি বাবা গায়ে হাত বুলোচ্ছেন, আর বলছেন, “আহা রে মেয়েটা বড্ড রোগা””।
শুধু কি বাংলা – রোজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে ঠাম্মা বসতো চণ্ডী পড়তে। ঠাকুরঘুরে ঘন্টা পার করে বা নিয়ম করে পুজো করতে কোনদিনই দেখি নি। কিন্তু নিজের ঠকুমা-পিসিমার কথা মেনে প্রতিদিন চণ্ডীর দেবীকবচ পড়া চাই-ই। আর তারপর ইংরিজি খবরের কাগজ। তখনকার দিনের ‘আই এ’ পাশ ঠাম্মা যে কোন সময় এখনকার ইউনিভার্সিটির সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রীধারী আমাদের দুকান কেটে নেবার ক্ষমতা রাখত। কখনও সংস্কৃত শ্লোক, কখনও ইংরিজি শব্দের বানান বা মানে, আবার কখনও কোন কবিতার লাইন যখনই যা জানতে চেয়েছি উত্তর দিতে এক মুহুর্তও দেরী হয় নি। ঠাম্মার ‘হেল্প’ ছাড়া শব্দজব্দ ভাবতেই পারতুম না। আবার তেঁতুলের বিচি আর রিঠের দানা দিয়ে টোক্কা-ফোক্কা আর জোড়-বিজোড় খেলা শেখানোর নামে অঙ্কের মজাটাও ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
তবে ঠাম্মার কাছে কোন বাংলা সিনেমার গল্প শুনতে চাইলে চিরকাল একটাই উত্তর মিলত – “ওই তো শেষে মিল হয়ে গেল”। দল বেঁধে হাতিবাগানের সিনেমা হলে সিনেমা দেখার অভ্যাস থাকলেও আর রোজ বিকেলে নিয়ম করে টিভির সামনে বসলেও এর চেয়ে বেশি কোন গল্প কোনদিন ঠাম্মার কাছ থেকে উদ্ধার করা যায় নি। আমার দশা ভেবে দেখ – কার সঙ্গে যে কার, কেন অমিল হল কিছুই জানা গেল না শুধু ওই মিলের খবরেই খুশি হতে হত।
বরং ঠাম্মার ছোটবেলার গপ্পগুলো ছিল ঢের বেশি মজাদার। বাপের বাড়ি-শ্বশুর বাড়ি-মামার বাড়ি সবখানেই আবার ‘ভাগ্যবান ব্যক্তি’র এক্কেবারে ছড়াছড়ি! “অমুকের বাবার আবার দুটো বিয়ে – এ হল প্রথম পক্ষ, আর ওরা হল দ্বিতীয় পক্ষ…”… এই করতে করতে একদিন বলল “আরে অমুকের আবার চারটে বিয়ে ছিল” – ব্যস্, জটিল সম্পর্কের বেড়াজালে আমি এক্কেবার নাজেহাল! গল্পের খেই হারিয়ে যায়! অস্থির হয়ে শেষে বলতুম, “আচ্ছা, তোমার গল্পে কি কারুর একটা বিয়ে ছিল না!” তবে শুনে শুনে নেড়ুদ্দা, বুদ্ধাজেঠাবাবু, মরিপিসি-ঘড়িপিসি, টুলুকাকা-বুলুকাকা স-ব আমাদের একেবারে আপন হয়ে গিয়েছিল।
ঠাম্মার ছিল অসীম ধৈর্য আর অপরিসীম সহ্যশক্তি। ‘দাদু’র সর্বাধিক আদরের প্রথম সন্তান ‘নীলুবাবু’, ‘দিদা’র ‘মানিনী’ ‘লিলি’ আর সব ভাইবোনেদের আদরের ‘দিদি’ শ্বশুরবাড়ির একান্নবর্তী সংসারে অবলা বধূ হয়েই থেকেছেন। আবার কম বয়সে স্বামী হারিয়ে তারপরের দীর্ঘ বৈধব্য জীবনে কোনদিন কারুর প্রতি কোনও অভিযোগ করেন নি। নব্বই বছর বয়সে পড়ে গিয়ে কপাল ফুটো হয়ে যখন প্রায় ভেতর অবধি দেখা যাচ্ছে, আমরাই দেখে ভয়ে অস্থির – তখনও বলেছে, “কি দরকার আবার হাসপাতালে নিয়ে যাবার! ও আপনি আপনিই সেরে যেত”।
ঠাম্মার ভালবাসার প্রকাশ ছিল না। শুধু আমিই বেয়াড়া মেয়ে চিরকাল ঝগড়া করে গেছি “তুমি নাতিকে বেশি ভালবাস”। চুপ করে অভিযোগ মেনেও নিয়েছে। আবার নাতি হোস্টেল থেকে দেখা করতে এলে ঠোঙ্গা ভর্তি করে বাতাসাও সঙ্গে দিয়ে দিয়েছে – নাতি ভালবাসে। তবে আমাদের আদরের ভাগে কোনদিন কম পড়ে নি একটুও। বরং কাছে থাকার সুবাদে সবচেয়ে বেশি অত্যাচারও আমিই করেছি। জ্বর হলে ঠাম্মার ঠাণ্ডা হাতের মাথায় হাত বোলানো, হামের সময় ছোট্টো নিমের ঝাঁটার সুড়সুড়ি, সর্বোপরি রোজ রোজ কলেজ থেকে ফিরেই ‘একটু গায়ে হাত বুলিয়ে দাও’, ‘একটু চুল বেঁধে দাও’ – বিনা প্রতিবাদের এই স্নেহের স্পর্শের জন্য এখনও মাঝে মাঝেই মনটা হু হু করে ওঠে। কিন্তু সব মায়া কাটিয়ে চলে যাবার সময়ও শেষবারের মতো সেই নাতির সঙ্গেই কথা বলে যায়, “তুমি এসেছ?”
- P. S. : ঠাম্মার শতবার্ষিকীতে ঠাম্মার প্রতি এটাই আমার গঙ্গাজলে গঙ্গা পুজো।