Posted in Reflections

জিজ্ঞাসুর এক বছর

দেখতে দেখতে হৈ হৈ করে একটা বছর পার হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এই তো সেই দিন। নিজের দুশ্চিন্তার পাহাড়ে পুরোপুরি বিধ্বস্ত; রাতের ঘুম চোখ থেকে উধাও। দিনের বেলাও ‘দিন কাটে না’। সারাদিন শুয়ে শুয়ে বোকাবাক্সে একই সিরিয়ালের একই পর্ব দেখে চলেছি। রোজই সেই একই জিনিস। আসলে নিজের মুখোমুখি হতেই ভয়। এই বুঝি আবার গ্রাস করলো দুশ্চিন্তা। মূঢ়তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ যাকে বলে। এদিকে আবার বিবেক দংশনও হয়। কি করছি!

বই পড়তে যাই – দু চার লাইনের বেশি এগোয় না। অত যে প্রিয় শরদিন্দু সেও না। আচ্ছা শরদিন্দু না হয় সাধুভাষা, কিন্তু অন্য বই! লীলা মজুমদার, নবনীতা দেবসেন! নাহ্‌, তাও ভাল লাগে না। চেষ্টা যে করছি না তা নয়। তার সঙ্গে ইস্কুলের দাওয়াই – প্রার্থনা। হচ্ছে না!

কিসের দুশ্চিন্তা এত! বোঝাতে পারি না কাউকেই। নিজেকেই কি বোঝাতে পারি! আমাদের মস্ত বড় ভরসার জায়গা এই ‘পবিত্র শিশুপাল’ – অক্সিজেন সিলিণ্ডার না, যেন পুরো একটা অক্সিজেনের প্ল্যাণ্ট। কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই। দেখি সব বন্ধুই কম বেশি সেই আমার মতই ‘মন খারাপ’এর শিকার। কেউ বলল ‘Mid-life crisis’, ‘Separation anxiety’, ‘Hormonal change’, দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধি। বেশির ভাগেরই ছেলে মেয়ে বাইরে পড়তে চলে গেছে। তা পাখীর ছানা বড় হলে ডানা মেলে তো উড়বেই।  তার ওপর এই করোনার ছোবল। অনেকেই অনেক কাছের মানুষকে হারিয়ে দিশাহারা। কাজেই অক্সিজেন প্ল্যাণ্টও যথেষ্ট অক্সিজেন দিতে পারছে না। দেবে কি করে – কাঁচামালেই যে টান! কে কাকে উৎসাহ জোগায়! উলটে চারিদিকের এত ডিপ্রেসন যে কারুর সঙ্গে কথা বলতেই ভয় হয়। মন ভাল হবার বদলে আরও খারাপ হয়ে যায়।

নাহ্‌, এভাবে চলতে পারে না। কেন ভগবদ্গীতার ৬.৫ ভুলে গেলে!

উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ।

আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ॥

নিজেই নিজেকে উদ্ধার করতে হবে। তা নিজে করলেও সঙ্গীসাথী সঙ্গে থাকলে তো মন্দ হয় না। ওই বন্ধুদেরই শরণাপন্ন হলুম। সারাদিন ওই এক গাছ-ফুল, পোষাক-আশাক, রান্না রেসিপি, ঘোরা-বেড়ানো, পরচর্চা আর না হলেই সেই পরীক্ষার রেসাল্ট, এ ফার্স্ট ও লাস্ট। আরে বাবা কেউ না কেউ তো ফার্স্ট হবেই! চেনা নেই শোনা নেই তার রেসাল্ট জেনে আমি নিজের টেনশন বাড়াই কেন!

দুচারজনকে পাকড়াই। চল না অন্ততঃ একটা দিন একটা ঘন্টা একসঙ্গে কোনোও একটা বই পড়া শুরু করি? তা কিছু সঙ্গী জুটে যায়– সকব’র ভাষায় মুর্গী। কিন্তু কি বই পড়া যাবে? আরে আজ না রামনবমী? তা আদিকাব্য রামায়ণ দিয়েই শুরু করা যাক না! যতই সেই ছোটবেলা থেকে রামায়ণ শুনে বড় হই না কেন, রামায়ণের অনেক কিছু না জানা, না বোঝা, ভুল বোঝা রয়ে গেছে। আর অনেক প্রশ্নও। কেউ কেউ বলে তাই বলে রামজীর নিন্দা কিন্তু শুনতে পারব না! নিন্দা কেন হবে! দেখা যাক না যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে, হয়তো তাতে রামচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েও যেতে পারে। অন্ধ বিশ্বাস নয় – যুক্তিগ্রাহ্য শ্রদ্ধা। ভগবান রাম নন, মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম – শ্রেষ্ঠ মানুষ যিনি। যাঁকে দেখে নিজেদের জীবনটাকেও একটু tune করে নেওয়া যায়। শ্রদ্ধেয়া মুক্তিপ্রাণা মাতাজীর ‘রামায়ণ প্রসঙ্গ’ বইটা বাড়িতেই ছিল। এরকম কত বই যে কেনা আছে, কবে পড়া হবে জানা নেই! ছোট বই। শুরুটা ছোটই ভাল। আগে দেখা তো যাক পরীক্ষা কতটা সফল হয়!

দিদিমণি, বড়দিমণি, স্বরূদি, Master Chef, আর সঙ্গে সোমা – ছোট থেকে আমার মাথার সব উদ্ভট খেয়াল যে বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছে। আর এসেছে সেই আরেকজন! সেই সকব’র কথায় অসুস্থ বলে যাকে দেখতে তার বাড়ি গিয়েই কাল হয়েছে। বইএর আলমারীতে রাখা ভগবৎগীতার বই দেখেই পাগলীর মাথার পোকা নড়ে উঠেছে আর ‘খপাৎ খপাৎ’ করে ছেলেধরার মত মুর্গী ধরে ছোটু তার পাঠশালা ভর্তি করছে।  

জিজ্ঞাসুর প্রথম দিন সকব’র প্রতিক্রিয়া

তা জয়া ছাড়া কি বিজয়া থাকতে পারে!জয়াদিদিমণিও এসেছে। নবাংকুরের বাকিরা ইস্কুল অফিস নিয়ে ব্যস্ত, কাজেই তাদের ছাড় দিতেই হয়। এসেছে পরম পূজনীয় মহারাজের বড় আদরের ‘দিদি’। এসেছে সাড়ে বারো আর পিটিম্যামও। মুখপুস্তিকায় জীবনজিজ্ঞাসা ভরা পোস্ট দেখে লায়লাকেও ডেকে নিলুম দলে। বাকি পবিত্র শিশুপালেরা কেউ কেউ ‘এ রসে বঞ্চিত’ আর কেউ কেউ ‘কাজের মানুষ’। তাই ইচ্ছে থাকলেও তাদের উপায় নেই। প্রথম দিনে বই পড়া জমলো ভালই। আর উৎসাহরও শেষ নেই সবার মনে। তক্ষুণি হোয়াটস্‌আপে গ্রুপ তৈরী হয়ে গেল। তার বেশ গালভরা নাম – জিজ্ঞাসু।

সেই তো শুরু হল যাত্রা। এই যাত্রার শুরুতেই পেয়েছি পুজনীয় বিমোক্ষানন্দজী মহারাজের আশীর্বাদ। আমাদের উৎসাহ দেখে মহারাজ নিজে থেকেই এই বইটা কিনে একদিন আমাদের সঙ্গে রামায়ণের ওপর আলোচনা করতেও রাজী হয়ে যান। ওনার এই অযাচিত কৃপায় আমরা আপ্লুত। তবে কেউ কেউ একটু যেন আড়ষ্ট। কখনও এমন সামনাসামনি কোনো সাধুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার অভিজ্ঞতা নেই তো! কিন্তু মহারাজের এই আসার জন্যে আমাদের অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। একাধিকবার সব ঠিকঠাক হয়েও শেষ মুহুর্তে মিটিং বানচাল হয়ে গেছে। তখন মনে হয়েছে শ্রীরামচন্দ্র বুঝি আমাদের এইসব অর্বাচীনের মত প্রশ্নে কুপিত হয়েছেন।

ইতিমধ্যে আমাদের সাপ্তাহিক একদিনের ক্লাস বেড়ে দুদিন তারপর চারদিন, সোম থেকে বৃহস্পতি হয়েছে। আবার কখনও কখনও তাতেও হয় না। শুক্রবারেও হাত পড়ে। তারপর শুরু হয়েছে একাদশী উপলক্ষ্যে ‘রামনাম সংকীর্তন’। যত আমি রামচন্দ্রকে ‘মোট্টে পছন্দ করতুম না’ তত যেন রামচন্দ্র জড়িয়ে ধরেন আমায়! আর সেই দেখে নির্ঘাৎ সেই দাড়িওয়ালা ‘পেরবীন’ মানুষটিও মুখ টিপে টিপে হাসেন। ভাবেন ‘কেমন জব্দ’!

অবশ্য তাঁর সঙ্গে আরেকজনও হাসেন – উদ্দাত্ত কণ্ঠে ‘হা হা’ করে, যিনি ওই দাড়িওয়ালা পেরবীনকে বলেন ‘দোস্ত’! সেই ‘দোস্ত’কে জানতে গেলে তো তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্যকে পড়তে, জানতে, বুঝতে হবেই! ‘ভাষ্য’ না পড়লে কি ‘সূত্র’ বোঝা যায়! আর শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত তো নবযুগের ‘বেদ’। সেই বেদ জানতে গেলে স্বামীজীর লেখা তো পড়তেই হয়। আর সবাই মিলে একসঙ্গে ঝাঁপ দিলে ঠিক সাঁতরে পার হওয়া যাবে। একেই অন্যকে টেনে নিয়ে যাবে। নইলে বন্ধু কিসে!

আমাদের এমন অবস্থা, যে বই পড়তে যাই, হয় কিছুই বুঝি না, নয় অনেক প্রশ্ন। কাউকে তো চাই যাঁর কাছে এইসবের উত্তর পাওয়া যাবে। ভাষ্য বোঝার জন্যেও যেমন চাই টিকা, আমাদেরও তেমনি মহারাজদের ব্যাখ্যা বোঝার জন্যে আরও কোনো ব্যাখ্যাকার চাই। আমাদের স্তরে নেমে এসে যিনি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। একা SwV মাসের ওই একটা ক্লাসে আর কত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন! তাছাড়া অনেক সময় ওনার অন্য অসুবিধেও থাকে, ক্লাস নিতে পারেন না। এদিকে আমাদের প্রশ্নের পাহাড় তো ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে।

বিল্লু তো চিরকালই আমার মুশকিল আসান। বলল SwS কে জিজ্ঞেস করব? সে হলে তো খুব ভালই হয়। রাজিও হয়ে যান মহারাজ। ঠিক হয় মাসে দুদিন করে ক্লাস নেবেন মহারাজ। তা স্বামীজী কে দিয়েই শুরু করা যাক। কারণ স্বামীজীর লেখা পড়তে গিয়ে আমাদের শুধুই হোঁচট খেতে হচ্ছে। দুজন মহারাজ এক্কেবারে দুই মেরুর  – SwV যত ধীর স্থির, আসতে আসতে এগোন। যেকোনো জিনিসের একেবারে মূল থেকে শুরু করেন আর যতক্ষণ না সবার বোঝা হচ্ছে পরের বিষয়ে যান না, SwS-এর যেন তত তাড়া। থেকে থেকেই করুণ স্বরে বলতে হয় মহারাজ একটু সবুর করুন। ছোট মহারাজ প্রথমেই ডিক্রি জারি করে দিলেন systematically না পড়লে কিস্যু হবে নি। আর ঠাকুর-মা-স্বামীজীকে ঠিকমতো বুঝতে হলে একটু শাস্ত্র অন্ততঃ প্রকরণ গ্রন্থ পড়তেই হবে। আর সে সব উনি ইতিমধ্যেই অন্য জায়গায় পড়িয়ে ফেলেছেন। কাজেই সেসব বক্তৃতা শুনেই নিজেদের শিখে নিতে হবে।

সেই শুরু হল আরেক পর্ব। নিজেরা নিজেরা YouTube video দেখে বোঝার চেষ্টা। তবে ‘তত্ত্ববোধ’ জিজ্ঞাসুর বোধশক্তি বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে। আজকাল নিজেরা বই পড়তে গেলে মনে হয় শব্দগুলো যেন চেনা চেনা। আর না চেনা হলেও কুছ পরোয়া নেহি! মহারাজ তো আছেন পড়া বুঝিয়ে দেবার জন্যে। আর এমন মজার কাণ্ড – আমরা যখন যে পড়াটা পড়ি দেখি সব বইএর বিষয়গুলো কেমন এক! এ বাপু ওই ‘দাড়িওয়ালা’র কারসাজি ছাড়া কি!

এদিকে এত শক্ত শক্ত পড়ার ভয়ে পাঠশালা থেকে রোজই ছাত্রী পালায়। ছোটুর খপাৎ খপাৎ আর কোনওই কাজে আসে না। ফ্যাল ফ্যাল করে দেখে ছোটু – দুরুদুরু বুকে। শেষকালে এমন সাধের পাঠশালা উঠে যাবে না তো! ছোটু তাহলে বাঁচবে কি নিয়ে? এই যে রোজ সকাল থেকে ছোটুর ব্যস্ততা, আর এই যে নিয়মিত পড়ার বাইরে প্রায়শঃই বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান! কত নতুন নতুন গল্প, গান, স্তোত্র শোনা, পাঠশালা ছুটি হয়ে যাবার পরও আরও কতক্ষণ আড্ডা – এগুলোই তো ছোটুর আসল অক্সিজেন। আর একা ছোটুই বা বলি কেন, আফিঙ্গের মৌতাতে তো আরও অনেক ময়ূরই মজেছে।

ভরসা একটাই ওপর থেকে যিনি সব কলকাঠি নাড়ছেন, মহারাজদের মধ্যে দিয়ে যাঁর কৃপা জিজ্ঞাসুর ওপর ঝরে পড়ছে, প্রথম জন্মদিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের সব বিশেষ বন্দোবস্তও আসলে যিনি করছেন তিনিই টেনে নিয়ে যাবেন এই জিজ্ঞাসু – এটাই আশা, এটাই ভরসা আর এটাই প্রার্থনা।

Posted in Reflections

তব কথামৃতম্‌

তব কথামৃতং তপ্তজীবনং, কবিভিরীড়িতং কল্মষাপহম্‌।

শ্রবণমঙ্গলং শ্রীমদাততং, ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ।।

[গোপীগীতা, রাসপঞ্চাধ্যায়]

শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের একত্রিংশতি অধ্যায়ের নবম শ্লোক – বৈষ্ণবভক্তদের মধ্যে তো বটেই কিন্তু আজ সমধিক প্রচলিত ও প্রসারিত শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমণ্ডলীর কাছে। রামকৃষ্ণ ভাবাশ্রয়ীদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই ‘শ্রীম’, তাঁর রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রথমেই এই শ্লোকটির উল্লেখ করেছেন। রচনার মঙ্গলাচরণ করেছেন এই শ্লোক দিয়েই। আর আমরাও তোতাপাখীর বাঁধা বুলির মত কথামৃত পড়ার আগে এইটি আউড়ে যাই। কিন্তু সত্যিই কি ভেবে দেখেছি এই কথাগুলোর কি তাৎপর্য!

কথা মানে শুধুই কি ‘বাণী’? কথার তো আরেকটা মানে হয় গল্প বা আখ্যান। আসুন না ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের বাণীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনের আখ্যানের নিরিখে একটু আলোচনা করা যাক এই শ্লোকের মর্মার্থ।

কথামৃতকার মাস্টারমশাই ঠাকুরের ‘কথা’ কে শুধু ‘কথা’ বলেই ক্ষান্ত হন নি – বলেছেন ‘কথামৃত’। এই অমৃত জীবনদায়ী। কিন্তু কার কাছে? উত্তর!

১) তপ্তজীবনম্‌ –

সংসারের তাপে দগ্ধ ক্লান্ত মানুষ যখন দুঃখে কষ্টে মুহ্যমান – মনে করে আর কেন! শেষ করে দিই জীবনটা তখন ঠাকুরের কথা, ঠাকুরের জীবন নতুন করে তাদের বাঁচার রসদ জোগায়। বিশ্বাস না হলে স্বয়ং কথামৃতকারের জীবনের দিকেই একবার ফিরে তাকান না! জীবনের প্রতি হতশ্রদ্ধ মাস্টারমশাই তখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন কলকাতার কাছাকাছি এ বাগান, সে বাগান – জীবনটা মনের মত চলছে না, কিন্তু জীবনের ইতি টানার জায়গাটা তো মনের মত খোঁজা যায়! ঘুরতে ঘুরতেই এসে পড়লেন ‘রাসমণির বাগানে’। প্রথম দর্শনেই ঠাকুরকে দেখে তাঁর মনে হল ‘সাক্ষাৎ শুকদেব ভাগবৎ-কথা কহিতেছেন, আর সর্বতীর্থের সমাগম হইয়াছে। অথবা যেন শ্রীচৈতন্য পুরীক্ষেত্রে রামানন্দ স্বরূপাদি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন ও ভগবানের নামগুণকীর্তন করিতেছেন’। সেই পরিচয় ঠাকুরের সঙ্গে। সম্পূর্ণ বদল হয়ে গেল একটা জীবন। ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের কথাকার হয়ে গেলেন অমর।

ঠাকুরের অন্তরঙ্গ দলের শেষ সদস্য – ঈশ্বরকোটি তিনি – পূর্ণ তাঁর নাম। সংসারের জ্বালায় জর্জরিত। ঠিক করলেন এবার শেষ করে দিতে হবে এই জীবনটাকে। প্রস্তুত হয়ে ভাবলেন শেষবারের মত একটু ঠাকুরের কথা পড়ে নি। সেই চিন্তা করতে করতে পাড়ি দেওয়া যাবে পরপারে। কথামৃত হাতে নিয়ে অমনিই উল্টোলেন পাতা। দেখেন লেখা রয়েছে, ‘পূর্ণের বয়স পনর হইবে। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন’। ব্যস্‌, মনের মধ্যে ওঠে নতুন তরঙ্গ – ‘ঠাকুর সবসময় আমার মঙ্গল চিন্তা করেন! আর সেই আমি নিজের জীবন শেষ করার কথা ভাবছি!’ মৃত্যুচিন্তা মুছে গেল মন থেকে।

আদরের কন্যাটিকে হারিয়ে ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত জীবনের মানে খুঁজে পান না। যে মেয়ে এই ছিল এক লহমায় সে নেই হয়ে গেল! অস্থির মনে একদিন গিয়ে পড়েন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে। দুপুর থেকে সন্ধ্যে গড়িয়ে যায় কথায় কথায়। বাড়ি ফেরেন রাম দত্ত – যেন এক নতুন মানুষ।

শোকাতুরা বিধবা ব্রাহ্মণী হারিয়েছেন তাঁর একমাত্র মেয়েটিকেও। ঠাকুরের ঘরের বাইরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনেন ঘরের ভেতরের কথা। সেই কথাই শেষ পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয় তাঁর সে শোক। খুঁজে পান বেঁচে থাকার নতুন দিশা।

ঠাকুর আমাদের বালক স্বভাব। যেখানে যা নতুন কিছু শোনেন তাই দেখতে ছোটেন। নইলে কেউ কোনদিন শুনেছে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী থিয়েটার দেখতে যান! ‘নিমাই সন্ন্যাস’ পালা। দেখে বললেন ‘আসল নকল এক বোধ হল’। পালটে গেলো বিনোদিনী সহ আরও সব নটীদের জীবন। অমৃতের সন্ধান পেলেন তাঁরা। শুদ্ধতার মূর্তরূপ ঠাকুর যিনি এতটুকু অশুদ্ধ সহ্য করতে পারতেন না, সাহেবরূপী ছদ্মবেশী তারাসুন্দরীকে কৃপা করলেন – কোথায়? সেও সেই কাশীপুরে, শেষ অসুখের সময়। বারাঙ্গনা নটীদের তাপিত চিত শীতল হল সেই অমৃতের পরশে।

২) কবিভিরীড়িতম্‌ –

কবি অর্থাৎ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি, জ্ঞানী যাঁরা, তাঁরা প্রশংসা করেন যাঁর, হয়ে যান সেই অমৃতের ভাগী। সে তো সেই শুরুর কাল থেকেই। ভৈরবী ব্রাহ্মণীর উৎসাহে মথুরবাবুর ব্যবস্থাপনায় বৈষ্ণবচরণ সহ বড় বড় পণ্ডিতেরা আসেন তর্কসভায় ঠাকুরের অবতারত্ব প্রমাণ করতে। ইঁদেশের গৌরী পণ্ডিত সেদিন ছিলেন না। পরে এসে তিনি ঠাকুরকে বলেন, ‘বৈষ্ণবচরণ আপনাকে অবতার বলে? তবে তো ছোট কথা বলে। আমার ধারণা, যাঁহার অংশ হইতে যুগে যুগে অবতারেরা লোক-কল্যাণসাধনে জগতে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাঁহার শক্তিতে তাঁহারা ঐ কার্য সাধন করেন, আপনি তিনিই!’  বালক স্বভাব ঠাকুর বলেন, ‘কে জানে বাবু, আমি তো কিছু জানি না’।

পশ্চিমদেশ থেকে আসা দার্শনিক পণ্ডিত নারায়ণ শাস্ত্রী – তিনি ঠাকুরের মধ্যে ‘শাস্ত্রের সূক্ষ্ম বিষয় সমূহ উপলব্ধ’ লক্ষ্য করেছিলেন। তাই নবদ্বীপ থেকে নব্যন্যায়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করে ফেরার পথে আবার আসেন দক্ষিণেশ্বরে। জেদ ধরে শেষ পর্যন্ত ঠাকুরের কাছে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ঠিক চিনেছিলেন ঠাকুরকে।

সে সময়ের বিদগ্ধ বক্তা শ্রী কেশব চন্দ্র সেন। স্বয়ং ইংল্যাণ্ডের রাণী যাঁর বক্তৃতা শুনতে আগ্রহী, তিনি সময় পেলেই ছুটে আসেন ঠাকুরের কথা শুনতে। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনিই প্রথম প্রচার করলেন ঠাকুরের কথা। সেই লেখা পড়েই সে সময়ের কলকাতার বড় বড় বিদ্বান-বুদ্ধিজীবী থেকে কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা একে একে আসতে শুরু করল ঠাকুরের কাছে।

রামচন্দ্র দত্ত ঠাকুরের বাণী প্রচার করতে লাগলেন পুস্তিকার আকারে, বক্তৃতার মাধ্যমে। নাট্যাচার্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর বিভিন্ন নাটকে ঠাকুরেরই ভাব, তাঁরই কথা প্রচার করলেন। তিনি বলতেন ‘নাটক লিখতে তিনিই শিখিয়েছেন’।

স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলার পর বলেন ‘আজ একটি নতুন কথা শিখলাম ‘।

৩) কল্মষাপহম্‌ –

ঠাকুরের কথামৃত মানুষের দেহ-মন থেকে কালিমা-কলুষ দূর করে দেয়।

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ নিজের সম্বন্ধে বলতেন তিনি নাকি এত পাপ করেছেন যে তিনি যেখানে দাঁড়ান সেখানে মাটি সাত হাত নিচে নেমে যায়। ঠাকুরের পবিত্র পরশে সেই গিরিশ চন্দ্র হয়ে উঠলেন ‘ভক্ত ভৈরব’। ঠাকুরের কৃপা স্পর্শে তিনি মনে করতেন তিনি গঙ্গাস্নান করলে মা গঙ্গা তাঁর পাবনী শক্তি ফিরে পাবেন।

সেই রকমই অপরিচিত জনৈক ভক্ত একদিন দক্ষিণেশ্বরে এসে ঠাকুরের ঘরের দরজার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। নিজেকে মনে করেন ক্ষমাহীন পাপী। বাইরে থেকেই ঠাকুরের কথা শোনেন আর চোখের জল ফেলেন। পরম কারুণিক ঠাকুর নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসেন তাকে। বলেন, ‘বল, আমি মাদুর্গার ছেলে। আমার কোনও পাপ নেই! আর আজ থেকে আর কোনও পাপ কর্ম কোরো না’। ব্যস্‌, তুমি শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত – এত সহজ!

কালীপদ ঘোষ, সুরেশ মিত্র আকণ্ঠ মদ্যপানে মাতাল। ঠাকুর একবারও বললেন না তাঁদের মদ খাওয়া ছাড়তে। শুধু বললেন মা কালীকে নিবেদন করে খেতে। মায়ের ছেলে মাকে কি খারাপ জিনিস দিতে পারেন! ধীরে ধীরে দুজনেরই মনের পরিবর্তন হতে দেখা যায়। একসময় সুরেশ মিত্র হয়ে ওঠেন ঠাকুরের অন্যতম রসদদার। তিনি না থাকলে আমরা আজ এই রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ পেতুম কি!

ঠাকুর ও মা মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। একটি ভক্ত মেয়ে হঠাৎ বেশ কিছুদিন মায়ের কাছে আসে না। করুণাময়ী জননী খবর নিতে পাঠান। শোনেন সে এগজিমা রোগে আক্রান্ত তাই মায়ের কাছে আসতে পারে না। ডেকে পাঠালেন তাকে। ঠাকুরের চরণামৃত দিয়ে রোজ দু ফোঁটা করে খেতে বলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই সেই মেয়েটি রোগমুক্ত হয়ে ওঠে।

মদ্যপ পদ্মলোচন – গভীর রাতে তার মাতলামিতে অতিষ্ঠ সবাই। সে কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়েই গান শুরু করে মায়ের ঘরের বন্ধ জানলার দিকে চেয়ে। ‘ওঠ গো করুণাময়ী, খোলো গো কুঠির দ্বার’। ভক্তের সে ডাকে জননী কি সাড়া না দিয়ে পারেন! খুলে যায় মায়ের ঘরের জানলা। দূর থেকেই মা কে দেখে চলে যায় সে। রাস্তার মাঝেই পড়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কিন্তু করুণাময়ী যার সহায় তার আর চিন্তা কিসের! মা বলেন পদ্মলোচনকে ঠাকুর এসে নিয়ে গেছেন।

পরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দ ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছেছেন রাজস্থানের খেতড়িতে। রাজ অতিথির মনোরঞ্জনের জন্যে রাজা গানের আসর বসান। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, একজন বাঈজীর গান শুনবেন!আসর ছেড়ে উঠে যান স্বামীজী। ঘর থেকে শুনতে পান ভেসে আসছে যমুনা বাঈএর সেই বুকফাটা আর্তি – ‘প্রভু মেরে অবগুণ চিৎ না ধরো। সমদর্শী হ্যায় নাম তোহারো চাহে পার করো’। ঘোর ভাঙ্গে স্বামীজীর। কি একজন মানুষকে ঘৃণা করছেন তিনি! তিনি না সন্ন্যাসী! সেই মহান সন্ন্যাসীর দর্শনেই পালটে গেল যমুনা বাঈএর জীবনও। এরপর বাকি জীবন তিনি এক ছোট্ট কুটিয়ায় থাকতেন আর গান শোনাতেন শুধুমাত্র তাঁর কৃষ্ণ ভগবানকে।

৪) শ্রবণমঙ্গলম্‌ –

শ্রীম বলতেন ঠাকুরের সব কথাই মন্ত্র। যা ত্রাণ করে তাই তো মন্ত্র। সেই মন্ত্র সব সময়ই মঙ্গলপ্রদ। তবু তারও মধ্যে থেকে যদি বিশেষ কোনো আখ্যান বলতে হয় তবে সেই মাস্টার মশাইকে দিয়েই শুরু করতে হয়। সেই সে শুরুর দিনের কথা। তখনকার দিনের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ পাস মাস্টারমশাই এক গরীব নিরক্ষর পূজারি ব্রাহ্মণের কাছে সেই প্রথম দিনেই শুনলেন ‘এককে জানার নাম জ্ঞান আর বহুকে জানার নাম অজ্ঞান’। জানলেন ‘নিরাকারও সত্য আবার সাকারও সত্য’। শুনলেন, জানলেন ‘মানব জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ’।

ঘর ভর্তি লোক; বৈষ্ণবদের সম্বন্ধে বলতে বলতে ঠাকুর ভাবস্থ। বললেন, ‘জীবকে দয়া করার তুই কে? দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীব সেবা’। সেদিনের সেই এক ঘর ভক্তের মাঝে এক কলেজে পড়ুয়া ছেলে নরেন্দ্রনাথের প্রাণে বাজলো সে কথা। বললেন ‘যদি কোনওদিন সুযোগ হয় আজ যা শুনলুম তা কাজে করে দেখাবো’। উত্তরকালে সেই আদর্শই জন্ম দিল ‘রামকৃষ্ণ মিশন’।

নিরাকারবাদী কেশব সেন, ব্রাহ্মনেতা। ঠাকুরের প্রভাবে ধীরে ধীরে মানতে আরম্ভ করলেন ব্রহ্মের শক্তি – মা কালী। পরিবর্তন হল তাঁর মত প্রভাবশালী মানুষের জীবন দর্শন।

যুবক ভক্ত যোগীন্দ্র। প্রশ্ন করে বসে ঠাকুরকে ‘কাম যায় কি করে?’ ঠাকুরের সহজ দাওয়াই – ‘হাততালি দিয়ে হরিনাম করলেই কাম যাবে’। এত সহজ! বিশ্বাস হয় না যোগীন্দ্রের। তারপর ভাবে ঠাকুর যখন বলছেন একবার করেই দেখা যাক। কি আশ্চর্য! কিছুদিনের মধ্যে সত্যি সত্যিই মিলে গেল ঠাকুরের কথা, ফল পেলেন হাতে নাতে।

পরম আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ কৃষ্ণকিশোর। দেওঘরে গিয়ে জলতেষ্টায় কাতর। জল তুলছিল সে এক মুচি। ব্রাহ্মণ বললেন ‘বল শিব। তুই শুদ্ধ’। নির্দ্বিধায় খেলেন সেই ‘মুচির হাতের জল’। ঠাকুরের মুখে শোনা এ ঘটনারই পরবর্তী ধাপ মায়ের কথা – ভক্তের কোনো জাত হয় না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই তো সেই সমন্বয়ের বাণী!

বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক গরীব বিধবা বধূ শ্রীশ্রীমা। তীর্থে গেছেন দক্ষিণ ভারত। মায়ের অমোঘ আকর্ষণে ব্যাঙ্গালোরে আশ্রমে উপচে পড়া ভক্তের ভিড়। সবাই মায়ের কথা শুনতে চায়। কিন্তু কেউ তো কারুর ভাষা জানেন না। কুছ পরোয়া নেই। নীরবতাই যেখানে অন্তরের ভাষা সেখানে শব্দও কম পড়ে যায়। সেদিন সব ভক্ত বাড়ি ফিরেছিলেন মনের মধ্যে পরম পরিতৃপ্তি নিয়ে।

৫) শ্রীমদ্‌ আততম্‌ –

শ্রীমৎ – অর্থাৎ, ভগবানের কথা শ্রী বা সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ। আর তা আততম্‌ – মানে, সুদূরপ্রসারী এবং সহজপ্রাপ্ত।

ঠাকুরের কথা যে সুদুরপ্রসারী তা তো ঠাকুরের জীবনী থেকেই দেখা যায়। সাধনকালে সারা দেশের কোথা কোথা থেকে একে একে এসেছেন ভৈরবী ব্রাহ্মণী, তোতাপুরী, রামাইত সাধু। আবার কোথা থেকেই বা এসেছেন নারায়ণ শাস্ত্রী, বৈষ্ণবচরণ, গৌরী পণ্ডিত! আবার কেশব সেনের সঙ্গে এসেছেন ক্যাপ্তেন কুক। এসেছেন নেপালের রাজকর্মী ক্যাপ্তেন উপাধ্যায়, এসেছেন সিন্ধুপ্রদেশের হীরানন্দ। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, শশধর পণ্ডিত তাঁরাও এসেছেন ঠাকুরের কথা শুনতে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অধর সেন তো ঠাকুরের পরম প্রিয় ভক্তদের একজন। আর যিনিই এসেছেন তিনিই সমৃদ্ধ হয়েছেন তাঁর জীবনে।

চিকিৎসা করতে শ্যামপুকুরে থাকার সময় হঠাৎই একদিন এসেছিলেন এক খ্রীষ্টান ভক্ত; যিনি ঠাকুরের মধ্যেই দেখেছিলেন তাঁর প্রভু যীশুকে।

সেরকম মায়ের আকর্ষণও কিছু কম নয়। সিনেমা জগতের বিধর্মী পার্সী সোরাব মোদি কিসের টানে এসেছিলেন মায়ের কাছে? দুজনে তো দুজনের ভাষা জানতেন না! তবু পুর্ণ হয়েছে সবার হৃদয়, ধন্য তাঁদের জীবন।

৬) ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ –

যাঁরা বহু সুকৃতি সঞ্চয় করেছেন, উদার চিত্ত যাঁরা, সংসারের ভোগবাসনা যাঁদের চলে গিয়েছে, একমাত্র ব্রহ্মানন্দ ভোগ করতে চান যাঁরা, তাঁরাই এই অমৃত পানে পরম আনন্দ ভোগ করেন এবং অন্যকেও এই অমৃতের আস্বাদন করান।

ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানেরা অহোরাত্র কেবল ঠাকুরের ভাবেই বুঁদ হয়ে থাকতেন। যতিশ্রেষ্ঠ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন পশ্চিমে তিনি কেবল ঠাকুরের কথাই বলেছেন। কথামৃতকার শ্রীম বলতেন ঠাকুরের কথা ছাড়া আর কি জানি! তাই শুধু কথামৃত রচনা নয়, তাঁর কাছে যখনই কেউ আসতেন পরিচিত কি অপরিচিত তিনি সবার কাছে শুধুই ঠাকুরের কথাই বলতেন। সেই অমৃতবারি সিঞ্চন করতেন সবার ওপর।

আমাদের অনেকেরই হয়তো কখনও কখনও মনে হয়েছে, আমরা কেন এত পরে জন্মালুম। ঠাকুরের পার্ষদ, ঠাকুরের সন্তান, ঠাকুরের ভক্ত – যাঁরা এই চর্মচক্ষে দেখেছেন ঠাকুর-মা-স্বামীজীকে, শুনেছেন তাঁদের মধুর অমৃতময়ী বাণী, ধন্য হয়েছে তাঁদের জীবন সে অমৃত ধারায় – তার থেকে আমরা কি চির বঞ্চিতই থেকে গেলুম! কিন্তু না, অহৈতুকী কৃপাসিন্ধু ঠাকুর হঠাৎ করেই নিজে থেকে ধরা দিয়েছেন কোনোও কোনোও ভক্তের কাছে, আজও এই সময়ও।

এক মহারাজ কথায় কথায় বলেন ‘কাঁচাখেকো ঠাকুর’ – কখন কি ভাবে যে কার মনের মধ্যে ঢুকে পড়েন কেউ টেরটিও পায় না। তাই তো শুধু কথামৃতকার বা বালক ভক্ত পূর্ণই নন আজও শোনা যায় কোনো মহিলা আত্মহননের জন্য অনুকূল মুহূর্তের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে আনমনা ভাবেই খুলে পড়েন পাশে রাখা একটা বই আর সেই বই আমূল পরিবর্তন করে তার সম্পুর্ণ জীবনবোধ, কোথায় চলে যায় নিজেকে শেষ করে দেবার সেই পরিকল্পনা। বলাই বাহুল্য সে বই আজকের যুগের বেদ – শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত।

সাহিত্যিক জরাসন্ধ তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতিগ্রন্থ লৌহকপাটেও জানিয়েছেন এমন এক দুর্ধর্ষ মহিলা  কয়েদীর কথা। যে নাকি জেলখানার সমস্ত কর্মী এবং বাকি কয়েদীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল তার ব্যবহারে। আর কোনো উপায় না দেখে জেলার সাহেব তাকে জেলের লাইব্রেরী থেকে একটা বই পড়তে দেন। তারপর লাইব্রেরী থেকে সেই মেয়েটির নামে নালিশ জানানো হয়। সে কিছুতেই সেই বই ফেরৎ দেয় না, উলটে গালিগালাজ মারধর করে সেই লোকেদের তাড়িয়ে দেয়। মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করে জেলার সাহেব জানতে পারেন সেই বইএর মধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছে জীবনের মানে। তাই কোনোওভাবেই সে সেই বইটি আর কাছছাড়া করতে রাজি নয়। এই তো সেই মধু যা সবাইকে সত্যের পথে, আলোর পথে, অমৃতের পথের সন্ধান দেয়।

তথ্য সূচীঃ

  1. শ্রীম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত
  2. শ্রীমৎ স্বামী সারদানন্দজী বিরোচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ
  3. শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দজী রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-প্রসঙ্গ
  4. শ্রীমৎ স্বামী চেতনানন্দজী লিখিত ধ্যানলোকে শ্রীরামকৃষ্ণ
  5. শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত – প্রতিদিনের প্রয়োজন, বক্তাঃ- শ্রীমৎ স্বামী বিমোক্ষানন্দজী, SARAS অনলাইন সৎসঙ্গ ১০ই এপ্রিল ২০২৪
  6. কথামৃতের জাদু, বক্তাঃ- শ্রীমৎ স্বামী নিখিলেশ্বরানন্দজী, কথামৃত ভবন ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৯
Posted in Reflections

শ্রীরামকৃষ্ণ-স্তোত্র দশকম্‌

শ্রীরামকৃষ্ণ-স্তোত্র দশকম্‌

-স্বামী বিরজানন্দ

ব্রহ্ম-রূপমাদি-মধ্য-শেষ-সর্ব-ভাসকম্,
ভাব-ষটক-হীন-রূপ-নিত্য-সত্যমদ্বয়ম্।
বাঙমনোঽতি-গোচরঞ্চ নেহি-নেতি-ভাবিতম্,
ত্বং নমামি দেব-দেব-রামকৃষ্ণমীশ্বরম্।।১

আদিতেয়ভীহরং সুরারি-দৈত্য-নাসকম্
সাধু-শিষ্ট-কামদং মহী-সুভার-হারকম্।
স্বাত্মরূপ-তত্ত্বকং যুগে যুগে চ দর্শিতম্,
ত্বং নমামি… ।।২

সর্বভূত-সর্গ-কর্ম-সূত্র-বন্ধ-কারণম্
জ্ঞান-কর্ম-পাপ-পুণ্য-তারতম্যসাধনম্।
বুদ্ধি-বাস-সাক্ষী-রূপ-সর্ব-কর্ম-ভাসনম্,
ত্বং নমামি… ।।৩

সর্ব-জীব-পাপ-নাশ করাণং ভবেশ্বরম্,
স্বীকৃতঞ্চ গর্ভবাস দেহধানমীদৃশম্।
যাপিতং স্ব-লীলয়া চ যেন দিব্যজীবনম্,
ত্বং নমামি… ।।৪

তুল্য-লোষ্ট্র-কাঞ্চনঞ্চ হেয়-নেয়-ধীগতম্,
স্ত্রীষু নিত্য-মাতৃভাব-শক্তিরূপ ভাবুকম্।
জ্ঞান-ভক্তি-ভুক্তি-মুক্তি-শুদ্ধ-বুদ্ধি-দায়কম্,
ত্বং নমামি… ।।৫

সর্ব-ধর্ম-গম্য-মূল-সত্য-তত্ত্ব-দেশকম্,
সিদ্ধ-সর্ব-সম্প্রদায়-সম্প্রদায়-বর্জিতম্।
সর্ব-শাস্ত্র-মর্ম-দর্শি-সর্ববিন্নিরক্ষরম্,
ত্বং নমামি… ।।৬

চারুদর্শ-কালিকা-সুগীত-চারু-গায়কম,
কীর্ত্তনেষু মত্তবচ্চ নিত্য-ভাবহিহ্বলম্।
সূপদেশ-দায়কং হি শোক-তাপ-বারকম্,
ত্বং নমামি… ।।৭

পাদপদ্ম-তত্ত্ব-বোধ-শান্তি-সৌখ্য-দায়কম্
সক্ত-চিত্ত ভক্ত-সূনু নিত্য-বিত্ত-বর্ধকম্।
দম্ভি-দর্প-দারণন্তু নির্ভয়ং জগদগুরুম্,
ত্বং নমামি… ।।৮

পঞ্চবর্ষ-বাল-ভাব-যুক্ত-হংস-রূপিণম্,
সর্ব লোকরঞ্জনং ভবাব্ধি-সঙ্গ ভঞ্জনম্।

শান্তি-সৌখ্যসদ্ম-জীব-জন্মভীতি-নাশনম্,
ত্বং নমামি… ।।৯
ধর্ম-হান-হারকং ত্বধর্ম-কর্ম-বারকম্,
লোক-ধর্ম-চারণঞ্চ সর্ব-ধর্ম-কোবিদম্।

ত্যাগি-গেহি-সেব্য-নিত্য-পানাঙ্ঘি-পঙ্কজম্,
ত্বং নমামি… ।।১০
স্তোত্রশূন্য-সোমকং সদীশ-ভাব-ব্যঞ্জকম্,
নিত্য-পাঠকস্য বৈ বিপত্তি-পুঞ্জ-নাশকম্।

স্যাৎ তদাপি জাপ-যাগ-যোগ-ভোগ-সৌলভম্,
দুর্লভন্তু রামকৃষ্ণ-রাগ-ভক্তি-ভাবনম্।।১১

ইতি শ্রীবিরজানন্দ-রচিতং ভক্তি-সাধকম।
স্তব-সারং সমাপ্তং বৈ শ্রীরামকৃষ্ণ-তূণকম্।।১২

১। পরব্রহ্মরূপঃ

শ্রীরামকৃষ্ণ সেই নির্গুণ নিরাকার পরব্রহ্ম যাঁর আলোয় সৃষ্টির আদি-মধ্য-অন্ত আমাদের কাছে প্রতিভাত হচ্ছে। তিনি জন্মাদি ষড়বিকাররহিত কারণ তিনি স্বরূপতঃ ব্রহ্ম। তিনি নিত্য-সত্য স্বরূপ, তিনি অদ্বয় – তাঁর কোনোও দ্বিতীয় নেই। তিনি বাক্য ও মনের অগোচর – পঞ্চইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নাম-রূপাদি কোনো বস্তুদ্বারাই তাঁকে ব্যাখ্যা করা যায় না।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

২। সগুণ-সাকার অবতাররূপঃ

পাপের ভারে পৃথিবী যখন ভারাক্রান্ত তখন যুগে যুগে তিনি অবতাররূপ পরিগ্রহ করে দেবতাদের শত্রু দৈত্যদের নাশ করে আদিত্যাদি দেবতার ভয় দূর করেন এবং সাধু মহাত্মাদের কাম্যবস্তু দান করেন। তিনি নিজের আত্মরূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও অবতার রূপে জন্ম নিয়ে তিনি সাধারণের মতই ব্যবহার করেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৩। কর্মফলদাতা সাক্ষীরূপঃ

তিনি সৃষ্টি ও জীবের কর্মফলের নিয়ন্ত্রা। পঞ্চভূতের সংমিশ্রণে সৃষ্টির রহস্য, পরা-অপরাবিদ্যা সব তাঁর অধিগত এবং জীবের জ্ঞান ও কর্ম অনুসারে তিনি তাদের ফলদান করেন। তিনি বিবেক-বুদ্ধিরূপে জীবের অন্তরে বাস করেন এবং সাক্ষীরূপে তাদের সকল কর্ম অবলোকন করেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৪। অবতারত্ব ও নরলীলাঃ

তিনি জগতের ঈশ্বররূপে শরণাগত জীবের সর্ব পাপ নাশ করে তাদের কর্মফল থেকে মুক্তি দিতে পারেন। তিনি কর্মবন্ধনরহিত হয়েও স্বেচ্ছায় মানবজন্ম স্বীকার করে ধরায় অবতীর্ণ হন এবং জীবকল্যাণে এক অনবদ্য দিব্যজীবনের চিত্র আমাদের সামনে রেখে গেছেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৫। ব্রহ্মজ্ঞানী লক্ষণ – স্থিতপ্রজ্ঞরূপঃ

তিনি দ্বৈতবুদ্ধিরহিত। তাঁর কাছে লোহা ও সোনা সমান এবং কোনও কিছুই ত্যাজ্য বা গ্রাহ্য নয়। তিনি সর্বাবস্থায় সকল স্ত্রীলোককে মাতৃরূপে, জগজ্জননীর প্রকাশরূপে দর্শন করেন। তিনি পরা-অপরা বিদ্যা, বিবেক বুদ্ধি, জ্ঞান-ভক্তি দান করতে পারেন। আবার তিনি জীবকে তাদের কামনা অনুযায়ী একাধারে জাগতিক সম্পদ ও জন্ম-মৃত্যুচক্র থেকে মুক্তিও দান করতে পারেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৬। শাস্ত্ররূপী শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তিনি সর্বধর্মের মূলে যে প্রকৃত সত্য – সেই তত্ত্বের জ্ঞাতা। কারণ তিনি সব পথ দিয়েই সেই সত্যকে নিজে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি কোনও সম্প্রদায়কেই অশ্রদ্ধা করেন না কিন্তু নিজে সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধে। তিনি আপাত দৃষ্টিতে নিরক্ষর হলেও সর্ব শাস্ত্রের প্রকৃত মর্মদর্শী ও সর্বশাস্ত্রের রক্ষক।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৭। সিদ্ধসাধক শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তিনি তাঁর ভক্তিপূর্ণ সঙ্গীতে মা কালীকে প্রসন্ন করে মায়ের দর্শন লাভ করেছিলেন। তিনি অহোরাত্র ঈশ্বরের ভাবে বিহ্বল হয়ে থাকতেন এবং ভাবের ঘোরে কীর্তনানন্দে মত্ত হয়ে যেতেন। তিনি তাঁর শিষ্যগণকে সম্যক উপদেশ দিতেন যাতে তাঁরা সংসারের শোকতাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৮। অভয় ও করুণামূর্তি, ভক্তবৎসল শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তাঁর মহিমা জেনে যাঁরা তাঁর পাদপদ্মে শরণ নিয়েছেন তিনি তাঁদের সুখ ও শান্তি প্রদান করেন। আবার জাগতিক বিষয়ে আসক্ত ভক্তকে তিনি নিত্য জাগতিক সম্পদ দান করেন। তিনি জগৎগুরুরূপে নির্ভীক হস্তে জীবের দম্ভ ও দর্প হরণ করে তাদের সঠিক মার্গ দর্শন করান।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৯। ঈশ্বররূপী শ্রীরামকৃষ্ণ – বাল্যলীলাঃ

পাঁচবছর বয়সে আকাশে কালো মেঘের গায়ে সাদা বকের সারি দেখে তাঁর প্রথম ভাব হয়েছিল। তিনি সেই বালক বয়সেই তাঁর রঙ্গপ্রিয়তা ও সরস বাক্যালাপের মাধ্যমেই তাঁর গ্রামের মানুষের সংসারাসক্তি ও মোহবন্ধন মোচন করেন। শান্তি ও সুখের মূর্তপ্রতীক তিনি লোকের মন থেকে জন্ম-মৃত্যুর ভয় দূর করেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

১০। ধর্মসংস্থাপক শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তিনি ধর্মের হানি, ধর্মের গ্লানি নাশ করেন এবং অধর্ম কর্ম দূরীভূত করেন। তিনি সর্বধর্মের মূল সত্য জেনেও প্রচলিত লোকাচার সমূহ মেনে চলেন। ত্যাগী ও গৃহী, ভক্ত-অভক্ত সকল মানুষেরই সংসারের সকল কলুষ ও সংসারাগ্নি থেকে মুক্তিলাভের জন্য তাঁর পবিত্র, পাবনী চরণকমলই একমাত্র আশ্রয়।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

১১। ফলশ্রুতিঃ

নিত্য স্তোত্রপাঠে লোকের সকল বিপত্তি নাশ হবে ও তাদের মনে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি দুর্লভ অনুরাগ ও ভক্তিভাব জাগ্রত হবে এবং তাদের জপ-যোগের সকল ফললাভ হবে ও সুকৃতির ফল বহুগুণে বর্ধিত হবে।।

Kind acknowledgement :

Swami Shantivratanandaji, Minister-in-Charge, EIRE Vedanta Society, Ireland.

Posted in Reflections

ঠাকুর আর আমি

টালায় যেতে না যেতেই গোলদাদি এক্কেবারে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ম্যাডামের কাছে ইস্কুলে ভর্তি করতে। টাইনি টট নার্সারি স্কুল – লোয়ার নার্সারি ক্লাস। ইস্কুলে সক্কলকে একটা করে ডায়রি দেওয়া হল। তার প্রথম পাতাতেই পাতা জোড়া একমুখ দাড়িওয়ালা একজনের ছবি। শুনলুম ইনি হলেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব। পরের পাতায় একটা গান লেখা – ‘ওম্‌ জয় জগদীশ হরে …’। রোজ সকালে ইস্কুলে গিয়েই গাইতে হত। যদিও আমি যেতে যেতে বেশিরভাগ দিন গান শেষ! সেই আমার ঠাকুরের সঙ্গে দেখা।

তবে পড়াশোনা ব্যাপারটা কোনওদিনই আমার মোট্টে ভাল লাগে না। কাজেই বইখাতা খোলার মত বিরল ঘটনা তখন কচ্চিৎ কদাচিৎই ঘটতো, ডায়রি তো দূরের কথা। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক সেই ডায়রিটা বহুদিন পর অবধিও আমার খেলনার ঝুড়িতে থেকে গিসল। তাই মাঝে মাঝে সেই ছবিটার দিকে নজর পড়ত। মহারাজ তো বলেইছেন ‘কাঁচাখেকো ঠাকুর’ – ওই ছবির মধ্যে দিয়েই কোন ফাঁকে টুক করে মনের মধ্যে ঢুকে পড়েন। এক্কেবারে ঠিক কথা। পাতাজোড়া একমুখ দাড়িওয়ালা ঠাকুর কেমন করে যেন মনের অবচেতনে ঢুকে গিয়েছিলেন।

তুলনায় গানটা কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারে নি। ওই প্রথম দু লাইনেই থমকে গিয়েছিল। বাকি কথাগুলো কিছুই বুঝতে পারতুম না। আর তখন ‘জগদীশ’ শুনলেই আমার গোলদাদির ‘কেতকীর বর’এর কথা মনে হত। আর ভাবতুম রোজ ইস্কুলে খামোখা গোলদাদির জগদীশকে নিয়ে গান হয় কেন? সে কি কেবল ম্যাডামের চেনা লোক বলে! তখন আমার ওইরকম অনেক বেয়াড়া প্রশ্ন মনে হত। ‘বিল্লুর’ নাম ‘বিল্লু’ কেন? মা কে ‘মা’ বলে কেন? এইরকম সব। আর কুমারকান্তি, অরুন্ধতী, নন্দিনীপ্রিয়দর্শিনী, মালবিকা – এই সব বড় বড় নামের পাশে আমার চন্দ্রানী নামটা নেহাৎই পাতে দেবার অযোগ্য মনে হত। এক্কেবারেই বিচ্ছিরি – না আছে কোনও সুর, তাল, ছন্দ! মানে ওইখানেই আমার self esteemএর দফা রফা – হীনমন্যতার শুরু।

যাহোক, টালা থেকে মাঝে সাঝে বাবার সময় থাকলে দাদি নদাদি সবাই মিলে শ্যামনগরে মামুর জুটমিলে যাওয়া হত। একদিন সকালে শুনলুম আজ দক্ষিণেশ্বর যাওয়া হবে। শুরু হল আমার হাজারো প্রশ্ন। সেখানে কি আছে? কতদূর? আর কতক্ষণ লাগবে? কালীবাড়ি তো গোয়াবাগানেই আছে নদাদির সঙ্গে যাই, এখানে কেন? তা সেখানে গিয়ে দেখলুম ঠাকুরের ঘর – সেখানে পাশাপাশি দুটো খাট। দাদির ঘরেও তো দুটো খাট – একটা দাদার, একটা দাদির। কিন্তু এখানে দুটোই ঠাকুরের! একজন মানুষের দুটো খাট কি দরকার! তাও গায়ে গায়ে লাগা। আবার দুটো খাটের ওপরই টানটান করে পাতা সাদা ধবধবে চাদর, বালিশ, পাশবালিশ, ওপরে মশারী। দুটো খাটেই ঠাকুরেরই ছবি রাখা!

গোলদাদির ঠাকুরঘরেও ছোট্ট একটা খাটে মশারির মধ্যে আদ্যামার ছবি শয়ন দেওয়া হত। ছবিকে শয়ন দেবার ব্যাপারটা বেশ অন্যরকম যা হোক। আর কোথাও তো দেখি নি! মায়ের ঠাকুরের ছবি তো শয়ন দেয় না! মায়ের ঠাকুরের তো কোনও খাটই নেই! দাদির গোপালের অবশ্য সিংহাসন, খাট, তোষক, বালিশ, পাশবালিশ, শীতকালের লেপ – সবই আছে। কিন্তু গোয়াবাগানে কোনও মশা নেই বাপু, তাই নিজেদেরও মশারি নেই, গোপালেরও নেই।

ঠাকুরের ঘর থেকে বেরোলে পেছনের দিকে নহবত। তার নিচের ওই ছোট্ট ঘরটায় মা সারদা থাকতেন। দেখছ তো কতটুকু ঘর! ওরই মধ্যে ঠাকুরের খাবার, সিকেতে মিষ্টি, জিয়োলো মাছ – সব সব থাকত। তবে এই ঘরটা আমার বেশ ভাল লাগত। কেমন ছ’কোণা ঘর, ছোট্ট দরজা! তখন তো আর বুঝি না ঠাকুর কি মা আমাদের মতই রক্তমাংসের মানুষ। মা ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী। ওই দরজা দিয়ে ঢুকতে বেরতে মাথা ঠুকে যেত। আমার ধারণায় ঠাকুর ঠাকুরই। আর বাড়ির ঠাকুরের তো ছোট ছোট থালা, গেলাস,খাট পালঙ্ক। মানে আমার পুতুলের সংসারের সঙ্গে মা-দাদির ঠাকুরের সংসারের বিশেষ তো কোনও ফারাক নেই। কাজেই ছোটখাট নহবতখানা আর তার বিচিত্র ছ’কোণা ঘর আমার কাছে তখন উলটে মনে হত বেশ বড় সড় পুতুলের বাড়ি।

নহবতের পাশে মায়ের বকুলতলার ঘাট। কালীবাড়ির বড় বাঁধানো ঘাটের থেকে বেশ আলাদা, বেশ একটা নিজের মত। তারপর ছিল পঞ্চবটি। এই দেখো এই পঞ্চবটিতে বসে ঠাকুর ধ্যান করতেন। কিন্তু পঞ্চবটি তখন ফিরিওয়ালাদের দখলে। আর বড় বড় গাছের ছায়ায় বেশ অন্ধকার। সেখানে রামচন্দ্রের সেনাবাহিণীর তখন প্রবল প্রতাপ!

দক্ষিণেশ্বরে প্রায়ই যাওয়া হত। সেখানে মাকালীকে দর্শন করার বড়ই ভিড়। পাশে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। সেখানে আবার আলাদা ঘরে একটা কৃষ্ণের মুর্তি রাখা, যার নাকি পা ভেঙ্গে গিসল। ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজে হাতে সেই ভাঙা পা জুড়ে দিয়েছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে গেলে সেই কৃষ্ণের মুর্তি দেখার একটা বিরাট আকর্ষণ। কিন্তু কোথায় যে পা ভাঙ্গা আর কেমন করে সেটা জোড়া হল কিছুতেই বুঝতে পারি না। দিব্যি সুন্দর ঠাকুর! উল্টোদিকে সারি সারি শিবমন্দির এক্কেবারে ফাঁকা। ভেতরে গিয়ে শিবলিঙ্গ স্পর্শ করে পুজো করা যায়। কখনও কখনও ঠাকুরমশাই একা একা বসে বসে পুজো করতেন। আর মন্দিরের পেছনদিকে দাঁড়ালে দেখা যায় ভরা গঙ্গা। অবশ্য দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছেই প্রথমেই যাওয়া হত গঙ্গার ঘাটে গঙ্গা স্পর্শ করে নিজেকে শুদ্ধ করতে। দূরে দেখা যেত বালী ব্রীজ, কখনও কখনও ট্রেন যেতেও দেখা যেত। হাওড়া ব্রীজ দিয়ে বড়জোর ট্রাম চলে। তবে বালী ব্রীজের ট্র্যাফিক জ্যাম তখন বিখ্যাত। একবার সেই জ্যামে আটকালে হয়েছে আর কি! দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার আমার আরেকটা আকর্ষণ ছিল ‘C’ লেখা শাঁখের আংটি। যদিও বাড়ি আসতে আসতেই সেটা কোথাও না কোথাও ধাক্কা লেগে শেষ!

রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-মা সারদা নামগুলোর সঙ্গে আরেকটু পরিচয় বাবার ছোটবেলার গল্পের মাধ্যমে – বিবেকানন্দ ইস্কুলে বাদলবাবুর গাওয়া গান, বেলুড় বিদ্যামন্দিরের বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সময়, মাঝে মাঝে ইস্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা অথবা বিদ্যামন্দিরের রি-ইউনিয়নে যাওয়া। দাদুর বাড়ির দোতলার মাঝের ঘরে কথা বলতে বলতে বাবা একদিন আমাদের বলল – ‘ও মা, তোরা এ গানটা শুনিস নি! মা আছেন আর আমি আছি ভাবনা কি আছে আমার!’ বাবার নিজস্ব সুরে গাওয়া গান শুনে শুনে আমরাও শিখে গেলুম সে গান। কখনও বলত বিদ্যামন্দিরে সবাই মিলে ধুতি পরে প্রেয়ার করতে যাওয়া। আমরা যখন বাড়িতে আমাদের ইস্কুলের সকালের গান বা প্রার্থনা বলতুম বাবাও নিজের ভুলভাল সুরে গাইত ‘গুরুদেব দয়া করো দীনজনে’। কিংবা হাত তালি দিয়ে গাইত ‘খণ্ডন ভব বন্ধন’…। তাই এ দুটো গানের টুকরো টুকরো কথা আর সুর সেই ছোটবেলাতেই মনে গেঁথে গিয়েছিল।

দক্ষিণেশ্বর মন্দির যেমন বেশ ‘চেনা জায়গা’ হয়ে উঠেছিল বেলুড় মঠ কিন্তু তা ছিল না। বিদ্যামন্দিরে তো আর আমরা যেতে পারতুম না! ছোট্‌ঠাম্মারা এলে ছুটির দিন বাবা একবার বেলুড় মঠে নিয়ে গেল। সেই প্রথম আমার ঠাকুরের খাস তালুকে যাওয়া। হাল্কা হাল্কা মনে পড়ে বিকেল বেলা স্বামীজীর মন্দিরের ওপরে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছি। তখন সবে মন্দির খুলছে। বাবা বলল, ‘স্বামী ব্রহ্মানন্দের মন্দিরে চলো’। নামটা কোনওভাবে ‘কানের ভিতর দিয়ে মরমে’ পশেছিল। তারপর আবার বলল স্বামীজীর ঘর দেখতে যেতে হবে। কি confusing ব্যাপার রে বাবা! এই বললে স্বামীজীর মন্দির দেখা হল আবার এই বলছ স্বামীজীর ঘর! আবার স্বামী ব্রহ্মানন্দের মন্দির দেখালে কিন্তু তার ঘর দেখালে না! মায়ের মন্দির, ঠাকুরের মন্দির – কত মন্দির রে বাবা! কত হাঁটতে হবে! আবার দেখি বাবা ওখানে কোন মহারাজের সঙ্গে কথা বলছে – আমি বিদ্যামন্দিরের ছাত্র ছিলাম। এই মহারাজ এখন কোথায় আছেন? ওই মহারাজ কেমন আছেন?

তখন আমার বেড়াতে যাওয়া ব্যাপারটাই ভাল লাগতো না। রাজ্যের ভীড়, ট্যাঁংশ ট্যাঁংশ করে ঘোরা, এই দেখো, সেই দেখো! বসার জায়গা নেই, খাবার জল নেই, গরম, ঘাম! তবে কন্যাকুমারিকায় গিয়ে খুব ভাল লেগেছিল। সমুদ্রের ধার থেকে দেখা যাচ্ছে ওই দূরে বড় পাথর। ভারতবর্ষের শেষ প্রান্ত। উত্তাল সমুদ্র সাঁতরে পার হয়ে ওই পাথরের ওপর বসে স্বামীজী তিনদিন ধরে ধ্যান করেছিলেন। তবে ওই বিবেকানন্দ স্মৃতি মন্দিরে যেতে সমুদ্রের ঢেউ তে যখন নৌকো দুলতে লাগল, এই বুঝি উলটে যায়‌, তখন প্রাণ পাখী খাঁচা ছাড়া দশা! আর ওখানে এত্তো হাওয়া যে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঠাম্মা তো পড়েই গেল। কিন্তু ভেতরে গিয়ে ওই শান্ত, শীতল ধ্যানকক্ষের স্তিমিত আলোয় সবার মন আপনিই জুড়িয়ে যায়।

ঠাকুর মানে তো আর একা ঠাকুর নন। ঠাকুর মানে ঠাকুর-মা-স্বামীজী, ঠাকুরের সব পার্ষদ – ত্যাগী, গৃহী – ঠাকুরের সংঘ শরীর। ততদিনে কিছু কিছু নাম শুনে শুনে জানা হয়ে গেছে। মানাদিদির পিসিমা রোজ বিকেল হলেই বলরাম মন্দিরে যান ‘পাঠ শুনতে’। সেই ‘পাঠ শোনাটা’ যে ঠিক কি তা অবশ্য জানি না। তবে এক এক দিন গাড়ি করে আসতে আসতে রাস্তার ঠিক মঝখানে গিরিশ ঘোষের স্ট্যাচু আর বাড়ি দেখেছি। আর তার পাশেই সেই বলরাম মন্দির। গিরিশ ঘোষের বাড়িটাও ভারি অদ্ভুত! রাস্তার মোড়ে অনেক জায়গায় কারুর মূর্তি থাকে আর তার দু পাশ কেন চার পাশ দিয়েই চারদিকে গাড়ি চলে। আর শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে তো বলাই হচ্ছে পাঁচটা রাস্তা। মামার বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরতে রোজই তো ওই পাঁচ মাথার মোড় পেরোতে হয়। তাই বলে রাস্তার মাঝখানে আস্ত একটা বাড়ি! যেন তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। আর বাড়িটাও যে কি অদ্ভুত! এই শুরু এই শেষ। এখানে মানুষ থাকে কি করে? আরেকটা নামও তখন খুব শোনা যেত। গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন আর স্বামী লোকেশ্বরানন্দজী। পিসিমা এসে বলতেন মহারাজ মানাকে খুব ভালবাসেন মাঝে মাঝে ডেকে পাঠান।

একদিন বাবার সঙ্গে সন্ধ্যেবেলা গাড়ি করে সিমলে পাড়ায় স্বামীজীর বাড়ি খুঁজতে যাওয়া হল। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে, ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রিট, ভাঙ্গাচোরা হলদে রঙের দেওয়াল, আধভাঙা রংচটা কাঠের দরজা – সামনে লেখা ‘স্বামী বিবেকানন্দের পৈত্রিক বাড়ি’ – মনটা বেশ খারাপই হয়ে গেল। স্বামীজীর ছোটবেলার কত গল্প শুনেছি। ঝকঝকে দক্ষিণেশ্বরের পাশে এটা যেন একেবারেই বেমানান।

ইতিমধ্যে একদিন সন্তুদিদা এসে মা কে বললেন সারদা মঠে নতুন মন্দির হয়েছে। গৌতম তার দায়িত্বে আছে। ওরা আমায় দেখতে নিয়ে যাবে তুমি যাবে? তা মা কি বাবা কোথাও যাওয়া মানেই তো সঙ্গে আমি ফুচকার ফাউ। সেই প্রথম সারদা মঠে যাওয়া। শ্রীমায়ের বিরাট বড় করে নতুন মন্দির তৈরী হয়েছে। তাতে অপূর্ব সুন্দর কারুকাজ। তবে সারদা মঠের ভেতরে তো ছেলেদের যাওয়া বারণ, তাই বাবার সঙ্গে ওখানে বিশেষ যাওয়া হত না। যদিও সেবার ছোট্‌ঠাম্মা আসার পর ছোট্‌ঠাম্মা, পিসি, মা, বিল্লু, আর্ণি সবাইকে নিয়ে বাবা সারদা মঠে গিয়েছিল। আমরা মেয়েরা সবাই যখন পুরনো মন্দিরের দিকে মাতাজীদের প্রণাম করতে গেছি তখন বাবা আর আর্ণি গেটের কাছে টুলে বসে মশার কামড় খাচ্ছে! 

তখন ক্লাস ফাইভ। প্রথম দিন ক্লাসে এসেই ছোট তৃপ্তিদি বলেছেন সবাইকে নিজের নিজের নামের মানে জেনে আসতে হবে। আবার ক্লাসে এসে একেকজনকে জিজ্ঞেসও করেন তাদের নামের মানে। আমি পড়লুম মহা সমস্যায়। বাড়ি এসে জিজ্ঞেস করায় শুনলুম নাম তো রেখেছে মুনদিদি। ইস্কুল থেকে শুনে এসে বলেছিল ‘চন্দ্রানী রাখতে পারো’। আর বাবার জগৎ তো খেলার জগৎ। ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচে  ইডেন গার্ডেন্সে ইন্ডিয়া জিতেছে আর চন্দ্রশেখর দারুণ ফর্মে – কাজেই ‘চন্দ্র’ওয়ালা নাম ফাইনাল। তার অন্য কোনও মানের প্রয়োজন থাকতেই পারে না! কেউ কেউ বলত চন্দ্রানী – চাঁদের রাণী। এতদিন আমি সেই শুনে দিব্যি খুশি ছিলুম। এখন নামের সত্যিকারের মানে খুঁজতে গিয়ে পড়লুম মুশকিলে। চাঁদ কি একটা দেশ যে তার রাণী থাকবে! তখন অবশ্য আমার নিজস্ব একটা উঁচুদেশ ছিল। আবার কেউ বলল চন্দ্রের স্ত্রী। এটাও ঠিক পছন্দ হল না। কোথায় কোন বইতে লেখা আছে শুনি!

আমার তখন প্রাণের বন্ধু সোমা দেবনাথ। ক্লাসে পাশাপাশি বসি আবার এক বাসেও যাই। তবে প্রতি পিরিয়ডে দুজনের একশোবার করে আড়ি হয় আর ভাব! একদিন সোমা এসে বলল ‘সোমা’ মা দুর্গার নাম। সেই শুনে আমার আরও মন খারাপ! ও তো বেশ মা দুর্গার নাম পেয়ে গেল।তা সারদা মঠে মাতাজীরা তখন আমাদের সবার নাম জিজ্ঞেস করছেন। এখনও আবছা আবছা মনে পড়ে তখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। আর কলকাতার তখনকার রোজকার নিয়ম মেনে ঝপ করে লোডশেডিং। পুরনো মন্দিরের সিঁড়ির সামনে আমরা কজন। আর উল্টোদিকের বাড়িতে তখন বোধহয় মিস্ত্রি কাজ চলছে। মাতাজীরা ওই আধো আলো আধো আঁধারিতে গরমে সামনের বারান্দায় বসে। আমি বড় মাতাজীকে প্রণাম করে নাম বলতেই ওনার সেবিকা মাতাজী বলে উঠলেন ‘চন্দ্রানী তো মা দুর্গার নাম। তাই না মাতাজী?’ হুররে, কি যে আনন্দ হল! আমার নামের মানেও মা দুর্গার নাম! মঠে মাতাজীরা যখন বলে দিয়েছেন তখন এর ওপর তো আর কোনও কথা হতেই পারেনা! কালই ইস্কুলে গিয়ে সোমাকে বলতে হবে।

এখন লিখতে বসে মনে হচ্ছে ঠিক কথাই তো! সোম থেকে সোমা যদি মা দুর্গা হন তাহলে চন্দ্র থেকে চন্দ্রানীও তো তাইই হবে! সবাই বলে ওই তো ‘ইন্দ্রানী-চন্দ্রানী’। না বাপু, ইন্দ্রকে আমার মোটেই বিশেষ সুবিধের মনে হয় না। কেউ একটু তপস্যা করতে বসলেই তার মনে ভয়! অমনি তপস্যা ভঙ্গ করতে ঊর্বশী-মেনকা-রম্ভাকে পাঠান। এতো ভয় কেন রে বাপু! এতোদিনে বুঝেছি ইন্দ্র আসলে তো কোনও একজন দেবতা নন – ওটা একটা পোস্ট। ‘রাজা’ মানেই ইন্দ্র। তাই এতো গদি হারানোর ভয়!

তখনও মাঝে মাঝে চন্দ্রানীর সঙ্গে মা দুর্গার সম্পর্কটা খোঁজার চেষ্টা করি। ঠাম্মা তো রোজ সকালে চন্ডী পড়ে – দেবী কবচ। ঠাম্মাকেই পাকড়াও করি, চন্ডী থেকে মা দুর্গার সমস্ত নাম আমায় লিখে দাও। নাঃ, চন্দ্রানী কোথাও পাওয়া গেল না! তখন বলল আরে চন্দ্র তো শিবের জটায় থাকেন। তাই চন্দ্রের ‘বস’ শিব, কাজেই চন্দ্রানী দুর্গা। হ্যাঁ এটা বেশ মনের মত কথা! শিবঠাকুর আমার বেজায় পছন্দের – কেমন একটুতেই খুশি, আশুতোষ। কেষ্টবাবুর মত অত প্যাঁচ পয়জার নেই, আর রামচন্দ্রের মত সীতাকে বনবাসেও পাঠান না, অগ্নিপরীক্ষাও নেন না। পার্বতীকে নিয়ে কৈলাসে ‘সুখের সংসার’। তাই তো ছোটবেলায় শিব-পার্বতী খেলতে অত ভাল লাগত।

কিন্তু সবাই যে বলে ‘যেই রাম, যেই কৃষ্ণ এযুগে তিনিই রামকৃষ্ণ’! একদিন কথায় কথায় মণিমালা কাকিমা বললেন ঠাকুর তো শিব তাই জন্মের পরেই গড়িয়ে গড়িয়ে রান্নাঘরে ছাইএর গাদায় চলে গিয়েছিলেন। ঠাকুর শিব! ঠাকুর শিব! হ্যাঁ তাই তো – সেই যে ছোটবেলায় গ্রামে শিবরাত্রির যাত্রাপালায় শিব সেজে অভিনয় করতে করতে ঠাকুরের সমাধি হয়েছিল! উঃ, কি মজা, কি আনন্দ, কি শান্তি!

বাড়িতে একটা বই ছিল – রসিক বিদ্যাসাগর। সেই বই পড়ে তখন ঠাকুরের সঙ্গে বিদ্যাসাগর মশায়ের অনেক কথা জেনেছি। ঠাকুর বলেছেন ‘এতোদিনে খাল বিল ছেড়ে এবার সাগরে এসে পড়েছি’। বিদ্যাসাগরও বলেছেন ‘তাহলে একটু নোনাজল নিয়ে যান’। তাতে ঠাকুর বলেছেন ‘এ তো যে সে সাগর নয় এ হল বিদ্যার সাগর’। কখনও মনে হত এ সব নিশ্চয় লেখকের কল্পনা প্রসূত। পরে কথামৃত পড়ে দেখি আর এক্কেবারে ঠিক ঠিক এই কথাগুলোই তো লেখা! তাহলে এসব তো বানানো গল্প নয়!

পয়লা জানুয়ারী মানেই দাদুর জন্মদিন। সকাল থেকে গোয়াবাগান যাওয়া। কত লোক আসা, কত হৈ হৈ। কিছুদিন পর শুনলুম পয়লা জানুয়ারী ঠাকুরের কল্পতরু উৎসব। ওইদিন ঠাকুর কাশীপুর উদ্যানবাটিতে সব ভক্তদের আশীর্বাদ করেছিলেন ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। যদিও কাশীপুরেই শিবুজেঠুদের বাড়ি, কাশীপুর পেরিয়েই দক্ষিণেশ্বর যেতে হয়, বাবা প্রায়ই ‘ফল্ট’ সারাতে অফিসের কাজে নিউ কাশীপুর যায়, কিন্তু উদ্যানবাটিটা যে ঠিক কোথায় আমি কোনদিন দেখি নি। আর ভীড়ের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দেওয়া – তাও বিল্লুদের বাড়ির হৈ চৈ ছেড়ে –  একেবারেই অসম্ভব! তাই মা যখন কল্পতরু উৎসবে কাশীপুর যেত আমি কোনদিনই সঙ্গে যাই নি। আমাদের, বিশেষ করে ঠাম্মাকে গোয়াবাগানে নামিয়ে দিয়ে বাবা যেত মা কে একটু ‘এগিয়ে’ দিতে। একবার মা তো সেই সকাল থেকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছে। বাবা দুপুরে খাবার সময় একবার গেল আনতে। ফিরে এসে বলল ‘ওরে বাবা, সে বিশাল লাইন। এখনও ভেতরে ঢুকতেই পারে নি।‘ খাওয়া দাওয়ার পর আবার গেল বাবা। সেবার বোধহয় মা ঘণ্টা ছয়েক লাইন দিয়ে ঠাকুরের দর্শন পেয়েছিল। পরের দিকে গোয়াবাগান যাওয়ার আগে মা আর আমি যোগোদ্যানে গিয়ে কল্পতরু উৎসবের দিন ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম।

এই ভীড় আর লাইনের ভয় বলরাম মন্দিরে রথ টানতেও আমার যাওয়া হয় নি কখনও। এই লকডাউনের আগে অবধি মা যেত। অনেক সময় উল্টোরথের দিন। না যেতে পারলে মায়ের মন খারাপ হয়ে যেত। আর মায়ের সঙ্গে গোপালের একটা অলিখিত চুক্তি ছিল – মা যখনই বাগবাজার স্ট্রিট দিয়ে বলরাম মন্দিরের দিকে যেত ঠিক তখনই গোপালের রথও ওইখান দিয়েই যেত।

হায়ার সেকেণ্ডারী পড়ার সময় প্রাণের বন্ধু হল বর্ণালী – বেলুড়ে বাড়ি, মঠের ঠিক পেছনে। ওর বাবা বেলুড় মঠের ডাক্তার। এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে! বর্ণালীকে বললুম ছুটির মধ্যে তোর বাড়ি যাব। কিন্তু আমায় বেলুড় মঠে নিয়ে যেতে হবে আর সন্ধ্যারতি দেখাবে হবে। ওর সঙ্গে গিয়ে পুজনীয় প্রেসিডেন্ট মহারাজের দর্শন প্রণাম। মায়ের মন্দির, স্বামীজীর মন্দির, রাজা মহারাজের মন্দির ঘুরে তখন সন্ধ্যারতি দেখার পালা। ভাবছি ভেতরের দিকে একটু সামনে করে যদি কোথাও বসা যায়। বর্ণালী বলেছে ওর একটা special ভাল জায়গা আছে। ও বাবা, নিয়ে গিয়ে বসাল মন্দিরের বাইরে গর্ভমন্দিরের দিকে একটা দরজার আড়ালে। ব্যস্‌, শুরু হয়ে গেল দুই বন্ধুর খিটির মিটির। আমি বলি দুর্‌, এখান থেকে ঠাকুরের মুখটাই দেখা যায় না! ও বলে ভেতরে আরতিটাই তো দেখা যায় না অত পেছন থেকে – সামনে সব সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী তারপর লম্বা লম্বা পুরুষের ভীড় পেরিয়ে মহিলাদের জায়গা! মহারাজ এত ভাল আরতি করেন এখান থেকে সেটা খুব সুন্দর দেখা যায়। তবে কিনা আমার সব কথাই বর্ণালী তখন শেষ পর্যন্ত মেনে নিত, তার ওপর আমি guest. কাজেই প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভেতরে গিয়েই বসা হল। কি লাভ হল! এর ওর ফাঁক দিয়ে কোনরকমে ঠাকুরকে দেখা – যত ভীড় তত গরম! এর চেয়ে বাইরে থেকে আরাতিটাও ভাল দেখা যেত গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়াও ছিল। কিন্তু বেলুড় মঠের সন্ধ্যারতি দেখা আর ভজন শোনার অভিজ্ঞতাই অন্যরকম। আরত্রিকের ওইরকম গমগমে আওয়াজ আর কোনও আশ্রমে পাওয়া যায় না। ঠাকুরের হেড অপিস বলে কথা!

বেলুড় মঠে পরে টুকটাক যাওয়া হয়েছে, কিন্তু আরতি পুরো শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করা যায় নি। দক্ষিণেশ্বর থেকে লঞ্চ পেরিয়ে গেলে ততক্ষণে ফেরী বন্ধ। আর ফেরার গাড়ি পাওয়া যায় না। রাস্তায় বাসে তখন অফিস ফেরতা জনতার প্রচন্ড ভীড়। গাড়ি নিয়ে গেলেও বালীব্রীজ হাওড়া ব্রীজের ট্র্যাফিক জ্যামের ভয়।

মন্দিরের ভোগ প্রসাদ পেতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। বাবুরাম মহারাজ যেমন বলেছিলেন প্রসাদ খাইয়ে উনি ভক্তদের ঠাকুরের কাছে টেনে আনেন। একবার বেলার দিকে বেলুড় মঠে গেছি। মন্দির দর্শন করে বেরিয়ে সামনেই দেখি বাবার ‘অরুণদা’, মঠের অনেক পুরনো কর্মী। আমাদের দেখে তিনিই প্রসাদ পাবার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরে বিয়ের পর ছোটকাকা-কাকিমার সঙ্গে গিয়েও প্রসাদ পাওয়া গেছে।

আর সারদা মঠে গেছি পিসির সঙ্গে, কানাইজেঠু-ইলাজেঠিমার সঙ্গে। সকালের দিকে যাওয়া মানেই মাতাজীর দর্শন প্রণামের পর প্রসাদ পাওয়া। পিসি আবার বলত শনি-মঙ্গলবারে গেলে মঠে সেদিন আমিষ প্রসাদ। প্রসাদ যা-ই হোক তার স্বাদই আলাদা। তাতে ঠাকুরের দৃষ্টি পড়ে কি না। একবার মনে হল ছোটবেলা থেকে এত যে দক্ষিণেশ্বর যাওয়া হয় রাণী রাসমনির ব্যবস্থাপনার মা ভবতারিণীর প্রসাদ পাব না? সেই রকম আদ্যাপীঠেও প্রসাদ পেয়েছি। আর কালীঘাটের মন্দিরের নিরামিষ মাংসও বাপী আমার ইচ্ছেপূরণ করতে বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করেছেন।

সারদেশ্বরী আশ্রমে গেলে যত সন্ধ্যেই হোক মাতাজীরা লালজীর প্রসাদ না পেয়ে আসতে দেন নি। কি যে ভাল লাগত মাতাজীদের পরম যত্ন করে সামনে বসে খাওয়ানো। ঠিক সেই রকমই পুণায় সারদা মঠে বা দিল্লীতে মিশনে গিয়ে দেখেছি মাতাজীদের কাছে ভক্তদের অবারিত দ্বার। কলেজ ফেরতা যাই বলে কক্‌খোনো শুধু মুখে ফিরতে দেন না। ভেতরে খাবার ঘরে বসিয়ে গরম চা, সঙ্গে মুড়ি, চানাচুর, চাকলি, বিস্কুট, মিষ্টি – যা হয় কিছু না কিছু খাইয়েছেন। হঠাৎ গিয়েও দিওয়ালীর আগে ভক্তদের করে আনা ‘খাউ’ (স্ন্যাক্‌স), দুর্গাপুজোয় volunteerদের সঙ্গে বসে ডাল-ভাত বা খিচুড়ি না খাইয়ে মাতাজীরা ছাড়েন নি। প্রবাসে থেকেও এই ‘মায়ের আদর’ শুধু আমি একা নই আমার শাশুড়ি মাও খুব ভালবাসতেন।

স্বামী স্তবপ্রিয়ানন্দ মাঝে মাঝে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কড়া ভাষায় বলেন ‘রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা নেওয়াটা আপনাদের একটা status symbol, craze!’ একেকসময় হয়তো আমারো সেই রকম মনে হত। চারপাশে সবাই দীক্ষা নিয়েছে। বিয়ের আগে বাবাকে বললে বলতো ‘কি হবে?’ সত্যি যে ‘কি হবে’ তখন কিছুই বলতে পারতুম না। তবে কোনদিন কোনও মঠে গেলে – মায়ের বাড়ি, যোগোদ্যান – দেখতুম লোকজন কেমন একটা ডাঁটের মাথায় ঘুরছে। যেন একটা authority, sense of belongingness. পরে বুঝেছি ওটা নিছকই আমাদের ভক্তদের নির্বুদ্ধিতা। শুধুই দীক্ষা নেওয়ায় ঠাকুর-মা-স্বামীজী বা মহারাজ-মাতাজীদের কিচ্ছু আসে যায় না! হ্যাঁ যে কেউই রোজ গেলে অবশ্যই তার সঙ্গে একটা পরিচিতি হয়ে যায়, তার বেশী কিছুই নয়।

যাই হোক, হয়তো কিছুটা হুজুগে পড়েই একে তাকে জিজ্ঞেস করি দীক্ষা নিতে গেলে কি করতে হয়? খুব ছোটবেলায় দু-একবার দাদিকে দেখেছিলুম ঠাকুরঘরে বসে ‘জপ’ করতে। সেই টাইনি-টটের ঠাকুরের ছবিটার মতই দাদির ওই জপ করার ছবিটাও মনের কোনও এক কোণে জমা হয়ে গিয়েছিল। আর ট্রেনে করে কুলটি যেতে ‘বেলানগর’ স্টেশন এলেই মা বলত ‘এখানে দাদির গুরুদেবের আশ্রম’। সেই গুরুদেব কথাটাও মনে গেঁথে গিয়েছিল। একবার সোমাকে জিজ্ঞেস করলুম কি করে ‘কড় গুণতে’ হয় বল তো? সোমা দেখিয়ে দিল। নিজের মনে নিজের খেয়াল খুশী মত অং বং মন্ত্র বলে মাঝে মাঝে ‘কড় গুণতুম’। বড় হয়ে একবার পিসিও দেখালো ‘কড় গোণা’। মণিমালা কাকিমার কাছ থেকে এনে ঠাকুর-মা-স্বামীজীর ছোট জীবনী পড়া হল আর কিছুটা কথামৃত। সব কিছুর খেয়ালের মত বই পড়ারও খেয়াল। স্বামীজীর কর্মযোগ আর অন্য দু একটা লেখাও ‘পড়ে ফেলা’ গেল। কিন্তু ‘সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে’ শুনে যে মেয়ের মাথা খারাপ হয়ে যায়, সাপ বিধাতার সঙ্গে কি করে লুডো খেলতে পারে ভেবে, স্বামী বিবেকানন্দের লেখা পড়ে বোঝা যে তার মোটা মাথার কম্মো নয় বলাই বাহুল্য। মনে হয় সামনে বসিয়ে কেউ লাইন বাই লাইন পড়ে বুঝিয়ে দেয় তো বেশ হয়।

সব সন্তানেরই ‘শেষ আশ্রয়’ ‘মা’। ওই জন্যেই বোধহয় বাবা প্রথমেই শিখিয়ে দিয়েছিল ‘মা আছেন আর আমি আছি ভাবনা কি আছে আমার?’। নিত্যদিনের সংসারে যখন কোন দিশা পাই না, মন যখন কোন কারণে এক্কেবারে জর্জরিত, ভারাক্রান্ত, মায়ের কাছে গিয়েই চোখের জলে ভেসেছি। আশ্চর্যজনকভাবে সাড়াও পেয়েছি। মায়ের ওপর অনেক সময় অনেক অভিমানও করেছি – সবাইকে কাছে ডাকো, আমি বুঝি তোমার সন্তান নই! আমি বুঝি সবার অধম, সবার চেয়ে খারাপ! তা তুমিই তো বলেছো ‘আমার সন্তান ধুলোকাদা মেখে এলে আমিই তাকে কোলে তুলে ধুলো ঝেড়ে দেবো’।

একবার কোন একজনের সাক্ষাৎকারে পড়েছিলুম তাঁর ঘরের একদিকের দেওয়াল জুড়ে শ্রী শ্রী মায়ের ছবি আর একদিকের দেওয়াল জুড়ে স্বামীজীর ছবি। যাতে বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি মাকে আর স্বামীজীকে দেখতে পান। কিন্তু ঠাকুর এতই বড়, এতই বিশাল যে ঠাকুরকে রাখার মত কোনও দেওয়াল তাঁর ঘরে নেই। স্বামী সমর্পণানন্দজী বলেন ‘Person, personality, principle’. কিন্তু টাইনি-টটের সেই ছোট্ট বোকা মেয়েটা তো কোনওদিন বুঝতেই পারে নি যে ডায়রির ওই দাড়িওয়ালা মানুষটা এত্তো বিশাল!!

Posted in Reflections

Who am I?

The Twin Vidyas – Para and Apara

When my elder son was around one and a half years old, one afternoon while playing with his grandma he was continuously repeating ‘ami ke? Bibu’ – ‘Who am I? Bibu’ – for quite a long time. I was so amused that he was learning to identify himself with the name. Most of us are habituated to identify ourselves with our name and our physique. So much so it becomes the main cause for all the fights of our ‘little ego’. From the childhood we love our name and the identity so much that one fine day when we Indian ladies are getting married and are told that from now on you have a new name, new family, new identity it takes us quite some times to recover from the shock.

But do we know who really we are! Sri Ramakrishna says that the knowledge about our ‘reality’ is veiled by ‘egotism’ which is what called ‘Maya’. Jiva is the embodiment of Satchidananda. Advaita Vedanta tells us ‘Jiva is non-different from Brahman.’ It tells we are not just this name & form and the actual purpose of our life is to search ‘Who am I?’ In many of his talks Swami Vivekananda said, “If only you knew who really you are!” Sri Sri Thakur told to his inner circle “you should only know who am I? Who are you? and what is the relation between you and me.” Panchadasi tells then we would experience that permanent unchanging bliss. Because then we would complete what we could do in this life, we would achieve what we could get and we would know what is there to be known.

Any type of knowledge that helps us in this mundane world is ‘apara vidya’, as they just give us some information. It does not become real knowledge unless it goes into the being. Inside each one of us there is a ‘being’ called ‘Atman’. This knowledge of self does not require anything else, not even the belief in the existence of God.

Am I the ‘Body’?

There are different techniques in different Upanishads to get this knowledge. In the Thirteenth Chapter of Bhagavad Gita Sri Krishna tells Arjuna ‘this name and form is not the real you – it is just the ‘Kshetra’ or the field of knowledge and the inner dweller who knows this, is the ‘Kshetragna’.

We must realize that the ‘field’ and the ‘knower of the field’ are different – just as the eye is different from the things it sees. We always need some distance to see an object. Also the scene or the object of knowledge can change but the seer or the knower is eternal and unchanging.

So we can never be the body as the body is changing with time. One famous Hollywood actress was once asked about the secret of her beauty. She replied “Oh, its all pasta.” This gross body or ‘annamaya kosh’ is just made up of the food we eat. It passes through ‘Shadavikara’ – it borns, exists, grows, changes, decays and die. So it can never be the true ‘I’.

Am I the ‘Mind’?

Then can it be our mind? But we witness the changes of the mind as well. As we grow old our mind gets new ideas and we become matured and our perceptions change.  Something inside us witnesses these changes.

Every religion in this world believes a life after death. The death occurs to the gross body. But something inside lives even after the body dies, that is the sukshma sarira or the subtle body.  This subtle body is made up of the ‘pranamaya kosha’, ‘manamaya kosha’ and the ‘vignanmaya kosha’ – the five pranas (the life forces) and the mana (mind), chitta (the storehouse of experiences), buddhi (intellect) and ahamkara (‘I’ness).  When we take rebirth this subtle body takes up another new gross body just like we put on a new cloth when we outgrow the older one. So this subtle body also cannot be the real ‘I’. Even the Karana sarira or the causal body made up of the ‘anandamaya kosha’ is not the real ‘I’. The indweller also experiences that ‘bliss’ in the ‘sushupti’ or the deep sleep state. So the real ‘I’ is beyond all the five sheathes.

The cycle of birth and death goes on and on unless we get the knowledge of the real ‘I’. But we know that somewhere there is an eternal life which death cannot deter. Like a masked deer we look around here and there in search of the ‘sweet fragrance’, ignorant of the fact that it is actually right inside us.

What is ‘Atman’?

Ignorance is darkness and the knowledge is light. If the knowledge that ‘I am that ‘Atman’ ‘Aham Brahmasmi’’ dawns on us the darkness of ignorance would vanish at once. It is like the room locked for thousand years is illuminated by just igniting one match stick.

Once we have the knowledge of ‘Atman’ we realize that the same ‘Atman’ dwells everywhere. The perception of seeing the world also changes altogether. Sri Ma said, “I see Thakur has become all.” Once Swami Vivekananda was standing at the balcony of New York Railway Station looking at the people passing by the road below with a beaming face. His companion asked him whether he is amused to see so many people clad with different colored dresses! Swamiji immediately replied that he was wondering to see the same ‘Chaitanya’ taking so many different forms. We say one Sun in the sky and the ten reflected suns into the ten pots. Similarly, a man of knowledge sees one indivisible indestructible ‘Atman’ is reflected into every object of the universe. As Sri Bhagaban says in the Bhagavad Gita –

नैनं छिन्दन्ति शस्त्राणि नैनं दहति पावकः ।
न चैनं क्लेदयन्त्यापो न शोषयति मारुतः ॥

The soul can never be cut into pieces by any weapon, nor can he be burned by fire, nor moistened by water, nor withered by the wind.

Reflection on ‘Who am I’

We have the civil laws to punish the criminals and prevent the recurrence of the crime. But Vedanta says a man of knowledge can never do any wrong to anybody because he knows that the ‘other person’ is just ‘me in another form’. The last advice of Holy Mother was, “But I tell you one thing—if you want peace of mind, do not find fault with others. Rather see your own faults. Learn to make the whole world your own. No one is a stranger my child: this whole world is your own!”

All the religions preach this same truth. The 13th Century Persian poet Rumi said, ‘Not that you are a drop in the ocean but you are the ocean in the drop.’ The Sufi saint says in the search of ‘who am I’, I found my ‘Allah’. This is why Jesus could never utter any word of condemnation against anyone. He taught us to ‘Love thy neighbor as thyself.’

But for us, ‘samsari jivas’, these are just words of scriptures. The samskaras gathered over all the previous births veil the real truth and prevents us to realize our real ‘self’. We superimpose the idea of ‘snake’ on the ‘rope’ and thought the snake to be real.

With selfless works and prayers and meditation only we can prepare our mind to actually be fit enough to ask the question ‘who really am I?’

Finally, I finish with the prayer –

যদি   তোমার দেখা না পাই, প্রভু, এবার এ জীবনে
তবে  তোমায় আমি পাই নি যেন সে কথা রয় মনে।
যেন   ভুলে না যাই, বেদনা পাই   শয়নে স্বপনে॥

If it is not my portion to meet thee in this life then let me ever feel that I have missed thy sight— let me not forget for a moment, let me carry the pangs of this sorrow in my dreams and in my wakeful hours.

Reference:

1. Swami Sarvapriyananda: Ami ke? Advaita Ashram, Kolkata, 2015. https://youtu.be/8ZCJcsNI-Vg

2. Swami Vimokshananda: Part 3 of talk “ Four Yogas of Bhagavad Gita”; Nivedita House, Dublin, 2020. https://youtu.be/0_0uIjgwWyk

Posted in Reflections

A God cares only for your inner spirit not where you are placed

“I, the LORD, search the heart, I test the mind, even to give to each man according to his ways, according to the results of his deeds.” – Jeremiah 17:10.

What an amazing truth; what wonderful love. If “the LORD looks at the heart,” then He sees every bruise and every battering and while others may not see beyond our skin and into our pain, God is aware of our deepest wounds, our greatest needs.

We all have heard the story of the fierce Vyadha, who had gone hunting into a deep forest on one Shivachaturdashi day and was forced to take shelter on a Bilva tree for the night. Drenched in rain, hunger and thirst, cold and fear kept him shivering and awake throughout the night. Accidentally few leaves fell on a Shiva Linga that happened to be there at the bottom of the tree. This inadvertent worship of Lord Shiva won him the gate pass to the Shivalok after his death. But, it is Lord Shiva after all, who is ever ready to be pleased by his devotees!

Sri Ramakrishna used to tell the story of the two friends going to the Bhagavatam recital, but on the way one friend stopped to enjoy the company of women while the other one went to the recital. But the first one kept on thinking how his friend is enjoying the holy company while he is engaged in petty sense pleasures. The second one on the other hand was cursing himself for coming to the ‘unexciting’ recital leaving his ‘clever’ friend to enjoy the merriment of life! It so happened that, after their death the first one was taken to the Vishnulok but the second to the Yamalok.

Are these mere stories that God sees our heart and not our social position! The lives of avatars show that these are not.

The story of Rama and Shabari is a demonstration to the efficacy of true devotion and divine grace from the treasure house of Hindu mythology. Shabari, though born in a hunter’s family, loathed the cruelty to animals either for fun or food. She rendered a selfless service to sage Mathanga with a great sense of devotion and dedication for many years. At the final moments of the sage he said that her good deeds and penance over the years had earned her a great fortune of having the darshan of Sri Rama on his way in search of Mother Sita. The sage asked her to wait for those blessed moments. Years together Shabari was waiting for Rama, gathering wild fruits with great devotion. Rama came to the hermitage with Lakshmana in due time. In order to source the best ones, she would bite the fruits and check before offering them to the Lord. Her innocent devotion pleased the Lord who granted her liberation before leaving the place.

Many such incidents are also scattered in the pages of Mahabharata and Srimad Bhagavat. In the 4th Chapter of Bhagavad Gita Lord Krishna says:

vīta-rāga-bhaya-krodhā man-mayā mām upāśhritāḥ
bahavo jñāna-tapasā pūtā mad-bhāvam āgatāḥ

‘Being freed from attachment, fear and anger, becoming fully absorbed in me, and taking refuge in me, many persons in the past became purified by knowledge of me, and thus they attained my divine love.’ Thus, the sovereign recipe to cleanse the mind from the defects of lust, anger, greed, envy, and illusion, is to detach it from the world and attach it to the Supreme Lord.

Sri Krishna’s bal-leela at Vrindavan with the gopas and the gopis are the testimony of the Divine grace. Also we see that before the great battle of Kurukshetra, when Sri Krishna visited Hastinapur, he refused the royal hospitality of the proud Prince Duryadhana and went to the petite dwelling of Vidura and readily accepted the meagre food that was rich in true love, devotion, purity and spirit of service.

Shree Aurobindo put it very nicely: “You must keep the temple of the heart clean, if you wish to install therein the living presence.”

Sri Chaitanya told, ‘Chandalapi dwijasheshtha haribhakti parayana.’ He accepted Haridas, the muslim, as one of his closest disciples along with Roop Goswami and Sanatan Goswami the former court men of Sultan Hussain Shah and Raghunath Goswami, the son of a fabulously rich landlord. Lakshmi Hira the prostitute, the notorious pair Jagai-Madhai, the muslim kaji – no one was deprived of his blessings and love.

The Bible states: “Blessed are the pure in heart, for they shall see God.” (Matthew 5.8)  Christ selected few so called ordinary fishermen to give his highest teachings, i.e. Sermon on the Mount.

People tend to judge the character and worth of others by looking at outward appearances, which could be deceiving. Physical looks don’t show us a person’s value or character or integrity or faithfulness to God. So the LORD said to Samuel, “Do not look at his appearance or at the height of his stature, because I have rejected him; for God sees not as man sees, for man looks at the outward appearance, but the LORD looks at the heart.”  – Samuel 16:7.

Moral and spiritual considerations are far more important to God. Everything we do flows from our hearts. The heart is the core, the inner essence of who we are.

To everyone who saw him, Judas looked like a faithful disciple, but Jesus was the only one who knew Judas’s heart: “Have I not chosen you, the Twelve? Yet one of you is a devil!” (John 6:70).

King David, who committed adultery and murder, was far from perfect. But God saw in David a man of deep, abiding faith and love who was wholly committed to the Lord and worshiped his Lord with all his being. A man who would depend on the Lord for strength and guidance and had come to understand the depths of God’s love for him. God saw a man with a sincere and personal relationship with his Creator.

Pride can never approach to where thou walkest in the clothes of the humble among the poorest, and lowliest, and lost. My heart can never find its way to where thou keepest company with the companionless among the poorest, the lowliest, and the lost.” (Gitanjali)

There are so many anecdotes in Thakur’s life. Once during the time of worship, Sri Ramakrishna sensed that Rani Rashmoni was engrossed in the thoughts of law suits and commercial matters and he slapped her in front of other people. The outraged, astonished people demanded the dismissal of Sri Ramakrishna from his priestly job. But the pious lady Rashmoni realized the Divine mediation in the matter.

Surendranath Mitra was one of the prominent devotee and patrons of Thakur and very dear to him. One day he invited Sri Ramakrishna and his devotees to his house and tried to impress Thakur with a very costly garland that was a sign of his wealth and egotism. But Thakur at once threw it away. When Surendra realized his mistake and repented for his action the ever compassionate Sri Ramakrishna picked it up and obliged Surendra.

In various occasions intoxicated Girish Chandra Ghosh uttered many filthy words to  Sri Ramakrishna, but ever-forgiving and ever compassionate Thakur always spoke high of the faith and devotion of Girish and accepted him as one of his closest disciples.

Sri Ramakrishna never touched the money offered to him by the wealthy businessmen but he asked the devout ‘Gopaler ma’ and other women disciples to cook some simple Bengali dishes for him. He sanctified the temple sweeper Rashik and even acknowledged the complete stranger Christian devotee.

During the time of Sri Ramakrishna no women of good families came for stage acting. But after watching the play ‘Nimai Charit’, Thakur, who could not even stand the touch of women, told that he saw the real and the reel persons to be identical and blessed Binodini dasi for realization of highest truth.

Being a devout Hindu lady of eighteenth century, obliged by many village rules and rituals, Ma Sarada Devi never hesitated to call the fierce dacoit as ‘baba’ (father) or Amjad as her son. To her Swami Saradanandaji and dacoit Amjad were equal. The drunkards like Padmalochan or Danakali, Parsi stage and film actor Sohrab Modi or Bengali theatre actresses like Tarasundari, all were equally welcome and none were deprived of her unconditional love and blessings. Sri Ma was the first person to accept Sister Nivedita as her ‘Khuki’. The compassionate Mother even took food with the western women disciples of Swamiji. Even in the present day so many people are receiving her grace, only we just have to call Her with all our heart.

We can always befool others through tweaking our speech and actions. But before The Lord, we are stripped naked of the cover-ups. God is not swayed by appearances; with a smile he asks suddenly, “What hast thou to give to me?” At that moment, do we have the heart to give Him our all!