Posted in Uncategorized

দাদা দাদিয়োঁ কি কাহানি

ছোটবেলার দিনগুলোয় নানান দুষ্টুমির মাঝে পুরোটাই নদাদিময়। যত গল্প, যত আবদার, যত শলাপরামর্শ – সব, সব নদাদির কাছে। মামার বাড়িতে তখন ঘরে ঘরে শুধুই বুড়োবুড়ি-থুত্থুড়ি। তাঁরা সবাই নিজেদের দুনিয়ায় থাকেন। বারবাড়ি শুনশান – বন্ধ দরজার মেলা। সদর দরজা সারাদিন খোলা। দরজার মাথায় একটা গণেশের ছবি – মেজমামু সকালে বেরোবার সময় সিদ্ধিদাতা গণেশকে প্রণাম করে বেরোতেন। দেয়ালে থাকতো সব দাদুদের নাম লেখা ফলক। তাতে নামের পাশে পাশে ‘In-Out’ এর বোতাম। বাইরে বেরোনোর সময় দাদুরা নিয়ম করে সেটা ব্যবহার করতেন। গ্যারেজের ওপরের ঘরটা নাকি ছোটবেলায় মামাদের পড়ার ঘর ছিল। কিন্তু তখন সেটা নরেনদা ও তার দেশওয়ালি ভাইদের দখলে। সন্ধ্যের পর বারবাড়ি তো বটেই, একতলা পুরোটাই অন্ধকার। রান্নাঘরে রাতের রান্না দিন ফুরোনোর আগেই শেষ। আর রাঙ্গাদাদু তাঁর সান্ধ্যভ্রমণ সেরে তখনও ফেরেন নি। সেই আটটা বাজলে রাঙ্গাদাদু আর ছোড়দাদু মাঝের ঘরে আলো জ্বেলে খেতে বসবেন।

দোতলায় উঠেই নতুনদাদু নিজের ঘরে খাটে বসে একা একাই তাসের ‘ধৈর্য পরীক্ষা’ দিতে ব্যস্ত। আমরা ছোটরা ঘরে ঢুকলেই তাড়াতাড়ি তাস গুটিয়ে ফেলতেন। তারপর গম্ভীর গলায় দুচারটে কুশল বিনিময় চলত। তারপর বড়দাদু-বড়দাদি। তাঁরা বয়সের ভারে ক্লান্ত। বিকেল সাড়ে পাঁচটা-ছটার মধ্যেই দুজনের রাতের খাবার সারা। মেজমামুর বেড়ালদের ভয়ে ঘরের দরজা সবসময়ই বন্ধ। ছুটির দিন দুপুরে আমি আর বাবুদাদা যেতুম বড়দাদিকে ‘জ্বালাতন’ করতে। মুনদিদি তখন নদাদির ঘরের সমস্ত জানালা-দরজা আষ্টেপিষ্টে বন্ধ করে অন্ধকার ঘরে কানে বালিশ চাপা দিয়ে ঘুমোচ্ছে। অবশ্যই দুষ্টুবুদ্ধিটা আমার। তখন একটু বড় হয়েছি, ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি। ততদিনে বড়দাদু চলে গেছেন। দুপুরবেলা চুপিচুপি ঘরে ঢুকে খাটের তলায় বসে আমি ‘মিউ মিউ’ আওয়াজ করতুম আর বাবুদাদা বলত ‘এই রে, বড়দাদি খাটের তলায় বেড়াল ঢুকেছে’। বড়দাদি অস্থির হয়ে উঠতেন ‘তাড়া, তাড়া’। খাটের তলায় ডালডার কৌটোয় থরে থরে খই, মুড়ি, চিঁড়ে সাজানো। বসে বসে একদিন সব খই খতম করে ফেলেছি। আবার বলেছি ‘বেড়ালে তোমার খই খেয়ে গেছে’। কি বুদ্ধি! মা এদিকে জানতে পেরে এই মারে কি সেই মারে। বুড়োমানুষ একটু খই দুধ খেতে গিয়ে পাবেন না! সেই পরেরদিন বিকেলের দিকে ময়নামাসি আসবেন, তবে এনে দেবেন। বড়দাদি আমাকে বলতেন ‘চুমকা’। কেন যে ‘টুম্পা’ বলতে পারতেন না আমার খুব অবাক লাগত। কোনও কোনদিন গল্প বলতে বললে ওনার ছোটবেলার গল্প, বাপের বাড়ির গল্প, মামা-মাসিদের ছোটবেলার গল্প বলতেন। আবার গান গাইতে বললে ছড়া কাটতেন – ‘একে-লা এসেছি ভবে, একে-লা যেতে হবে, কেউ তো সঙ্গে যা-বে- না—‘। সে ছড়ার মানে বোঝার বয়স তখন আমার হয় নি। কখনো শোনাতেন ‘কোথায় সীতা, কোথায় সীতা, জ্বলছে বুকে স্মৃতির চিতা’। DC supply এর টিমটিমে আলোয় ওই দুঃখুর গান আমার ভারি মন খারাপ করে দিত।

ওই কোণের ঘরে নতুনদাদি একা একা রান্নাবান্না কি পুজোপাঠ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। অনেক সময় বিকেলের দিকে মঠেও যেতেন। আবার কোনদিন হয়তো কল্যাণীমাসি-তরুণমামু দেখা করতে আসতেন। কিন্তু সবাই বড় চুপচাপ। আসলে আমি এতোই ছোট যে আমার সঙ্গে ‘কি রে কেমন আছিস?’-এর পর কেউ আর কোনও কথা পেতেন না। মেজমামু-মেজমাইমা তখনও কাজ থেকে ফেরেন নি। তবে বিকেলবেলা হেঁদুয়ায় যাবার সময় একেকদিন মেজদাদু আমাকে আর বিল্লুকেও সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন। পরে যখন মেজমাইমা মেজদাদুর ঘরে টিভি নিয়ে এলেন তখন তারই মধ্যে একটু বৈচিত্র্য। ছোড়দাদুও এসে বসতেন টিভির আসরে। তবে সেই দূরদর্শনের জমানায় খবর আর সাহিত্য সংস্কৃতি, শিল্প জগৎ ছেড়ে আমাদের উপযোগী অনুষ্ঠান কোথায়!

এবার তিনতলা -। আমার জ্ঞান হওয়া থেকেই দেখেছি দাদি অসুস্থ। হাই ব্লাডপ্রেসার, হাঁপানি আর হার্টের অসুখের ত্রহস্পর্শে এক্কেবারে শয্যাশায়ী। সন্ধ্যেবেলা দাদা নিজের ডিভানে বসে এক মনে চাল কি গম বেছে চলেছেন। আসলে বৃথা আলস্যে সময় কাটানো দাদার ধাতে নেই। তারপর ছোড়দাদুর ঘর। ঢুকলেই আমাদের জন্যে হরলিক্সের শিশিতে রাখা বাদামভাজা। একটু আধটু গল্প হত। রাঙ্গাদাদু আমায় ‘গাবলু’ বলে ডাকতেন ছোটবেলায়। আর ছোড়দাদু বলতেন, ‘তোকে আর গাবলু বলা যাবে না, এবার পেংলু বলতে হবে’। আবার বলতেন, ‘বুঝলি, প্রাণ রাখিতে সদাই প্রাণান্ত!’ ভারি তো বুঝতুম! অনেক সময় ছোড়দাদু traction নিতেন বলে কথা বলতে পারতেন না। কখনও দেখতুম কিছু পড়ছেন। কি তখন বুঝতাম না। তবে বাদামভাজা বাদ যেত না। ছোড়দাদু ছিলেন মিলিটারী মানুষ। National Medical College এর নামকরা Radiologist. ডঃ সরোজ গুপ্তের মাস্টারমশাই। প্রথম দিকে cancer-এর চিকিৎসায় Ray-therapy র পথিকৃৎ। মিলিটারীর ডাক্তার হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন। ছাড়া পেয়ে একা একা পায়ে হেঁটে গঙ্গোত্রী-গোমূখ ঘুরে এসেছিলেন। খাবার ঘরে গঙ্গোত্রীতে গেরুয়া পোশাকে ছোড়দাদুর একটা রঙিন ছবি ছিল। নিজের dark room এ develop  করা ছবি।

খাবার ঘরে আর একতলার দালান জুড়ে কত না ছবি! দুপুরবেলা হাতুড়ি, পেরেক, ছবি, কাগজ, ছবির ফ্রেম – সব নিয়ে রাঙ্গাদাদু ছবি বাঁধাতে বসতেন। রান্নাঘরের মরা আঁচে তুঁতের আঠা তৈরী করতেন নিজেই। সে আঠায় আমার হাত দেওয়া বারণ। তুঁতে বিষ কিনা! দূর থেকে দেখতে পারো, কোনও কিছুতে হাত দেওয়া চলবে না। গাঢ় নীল রঙের কি যে গুঁড়ো মিশিয়ে হালকা সবজে রঙের আঠা তৈরী হয়ে যেত – দেখে আমার বিস্ময়ের সীমা পরিসীমা থাকতো না! সেই সব ছবির হাত ধরেই আমার পরিচয় নেতাজী, ঋষি অরবিন্দ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে। বাইরের ঘরে টাঙ্গানো দাদাদের মা-বাবার ছবি। বাবার ছবির তলার লেখা ‘পিতা স্বর্গঃ, পিতা ধর্মঃ, …’। পরের অংশটা পড়তে গিয়ে ছোটবেলায় আমার জিভ টিভ জড়িয়ে যেত!সে তুলনায় মায়ের ছবিতে লেখা ‘জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরিয়সী’ অনেকটা সহজ মনে হত। একতলার দালানে ছিল বাবার দাদুর ছবি – বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু। পরীক্ষার দিন সকালবেলা নদাদি বলত দাদুর ছবিতে ভাল করে প্রণাম করে যা।

সিঁড়ির মাথায় বড় পেণ্ডুলাম ক্লক – তার সময় ধরে সারা বাড়ি চলছে। এর সঙ্গে দেওয়ালে লাগানো বাঘের আর হরিণের মাথা – জব্বলপুরের ‘মিনিস্টার দাদু’র শিকার। দোতলার দালানে সেই মৃত বাঘের মাথায় পা দিয়ে বন্দুক হাতে দাঁড়ানো মিনিস্টার দাদুর ছবি। ততদিনে বাঘছাল, বাঘনখ, হরিণের চামড়া – সব চোরেদের জিম্মায়।

খাবার ঘরের দেওয়ালে আরেকটা জিনিস টাঙ্গানো ছিল – বসুবাড়ির বংশতালিকা। সেই একনম্বর পুরুষ দশরথ বসু থেকে শুরু করে ২৮ নম্বরের বাবুদাদা অবধি। সতেরো নম্বরে ‘মদনমোহনের ছয় পুত্র’। দাদারা ‘মদনমোহনের দ্বিতীয় পুত্র’এর বংশধর। নিকটতম জ্ঞাতি বলতে ‘মদনমোহনের তৃতীয় পুত্রের …’, মনোহরপুকুরের জ্যাঠামশাইরা। এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব মুখ্যতঃ রাঙ্গাদাদুর। মামুর পুরো বংশতালিকা মুখস্থ ছিল। আমরাও মাঝে মধ্যে ব্যর্থ চেষ্টা করতুম মুখস্থ করার।

রাঙ্গাদাদু বাবার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ‘গুইন্‌ ক্যাটারারের’ খাবার খাওয়ালেন সব ভাইপো-ভাইঝি, ভাগ্নে-ভাগ্নীদের সপরিবারে। এরকম মাঝে মধ্যেই খাওয়াদাওয়া হত। রাঙ্গাদাদুর জন্মদিন, ছোড়দাদুর জন্মদিন। একবার আমাকে তো বাড়ি থেকে শিখিয়ে নিয়ে গেছে গিয়ে বলবি ‘Happy Birthday and many happy returns of the day’.  আমিও গিয়ে বললুম ‘Happy New Year’. তারপর সবাই মিলে যা ঠাট্টা করতে লাগলেন আমার সঙ্গে! আহা, আমার কি দোষ। পয়লা জানুয়ারী দাদুর জন্মদিনে বিল্লুদের বাড়ি গিয়ে সবাই তো বেশ সবাইকে ‘Happy  New Year’ বলে! আর আমি বললেই সেটা ভুল!! মামুর খুব ইচ্ছে ছিল দাদা-দাদির পঞ্চাশ বছরের বিবাহবার্ষিকীও খুব ঘটা করে পালন করবেন। কিন্তু তখন দাদি এতোটাই অসুস্থ শয্যাশায়ী যে বাড়িতে দুবেলা আয়া রাখা হয়েছে।

ছোটবেলায় রাঙ্গাদাদু আর ছোড়দাদু যখন একসঙ্গে দুপুরে খেতে বসতেন আমি অবাক হয়ে দাদুদের খাওয়া দেখতুম। রাঙ্গাদাদু বড় কাঁসার থালায় ভাতের ঠিক মাঝখানে গর্ত করে তার মধ্যে কাঁসার বাটি থেকে ডাল ঢালতেন – ঠিক যেমন করে বাড়ি তৈরীর সিমেন্ট-বালির মশলা মাখা হয়। তারপর ওই মাঝখান থেকেই খেতে শুরু করতেন। ডালের পরে মাছ…। রাঙ্গাদাদু নাকি এতও পরিষ্কার করে খেতেন যে একবার খাওয়া থালাটাও মাজা বাসনের সঙ্গে তুলে রাখা হয়েছিল! দাদা পাতের মাথায় দু-চার দানা ভাত রেখে দিতেন। এদিকে ছোড়দাদুর সব এক্কেবারে আলাদা। স্টিলের থালার মাঝে ছোট স্টিলের বাটি উল্টোনো ভাত, পাশে রাখা একটা বিরাট মাপের করলা সেদ্ধ। তার পাশে কল্মিশাক ভাজা। তারও পাশে এক টুকরো মাছ সেদ্ধ – বড় কই বা তেলাপিয়া। থালার পাশে একটা স্টিলের বাটিতে শুধু সেদ্ধ মুসুর ডাল, আরেকটায় সেদ্ধ সয়াবীন, সব রান্নাই হলুদ ছাড়া। আর শেষে এক বাটি টক দই। স্টিলের কাঁটা-চামচে করে ছোড়দাদু খাবার খেতেন। প্রথমেই করলা সেদ্ধটার ওপর আঙ্গুলের ডগা দিয়ে একটু নুন মাখিয়ে কট্‌কট্‌ করে কাঁটা দিয়ে কেটে নির্বিকার মুখ করে যখন ওই করলাটা খেতেন দেখে মনে হত পৃথিবীতে ওর চেয়ে সুস্বাদু আর কোনও খাবার হয় না! কাঁটা দিয়ে কিভাবে যে মাছের কাঁটা বাছতেন সেও সমান বিস্ময়কর। খাওয়া শেষ হত ওই টক দই এর বাটিতে এক চামচ শুকনো ইসব্‌গুল ছড়িয়ে চামচে করে সেটা খেয়ে। আহা যেন অমৃত! তবে শনিবার শনিবার বিকেলে নরেনদা গরম গরম মুচ্‌মুচে সয়াবীনের বড়া করত – আমরা অধীর আগ্রহে শনিবারের অপেক্ষা করতুম।  খেতে বসে দাদুরা কেউ জল খেতেন না। খাবার পর জানলায় রাখা জলের বড় জালা থেকে হাতল দেওয়া ঘটি করে জল নিয়ে খেতেন। আর দাদা খেতেন ঘড়ি ধরে খাবার এক ঘন্টা পর ছোট গেলাসের ঠিক দেড় গেলাস জল। সব কিছুই মাপমতো।

দাদারা সবাই নিজেদের জামাকাপড় তো নিজেরা কাচতেনই, মেজমামু, মেজমাইমা, এমন কি মেজদাদুও দুবেলা খাবার পর যে যাঁর নিজের থালা বাটি ধুয়ে রাখতেন। শিখলুম এর নাম ‘স্বাবলম্বী’ হওয়া। একমাত্র কখনও সখনও বাড়িতে নকুলদাদা আসতো, রাঙ্গাদাদুর চুল কাটতে। বাকিরা রাস্তার ধারে নাপিতের কাছেই চুল কাটতেন – দাদার ভাষায় ‘ইঁটালিয়ান’ সেলুন। তা রাঙ্গাদাদুর চুল কাটা ছিল দেখার মতো – এক্কেবারে ‘টিনটিন’ ছাঁট। টকটকে ফর্সা টিকল মুখে দেখতে লাগতো এক্কেবারে বইএর পাতা থেকে উঠে আসা টিনটিনই। বাবুদাদা বলত ‘ওটুকুই বা রাখলে কেন?’ হেঁকে উঠতেন – ‘লোকে নেড়া বলবে নাঃ!’ ছোটবেলায় আমায় দেখলেই বলতেন, ‘আয় তোর নাকটা টেনে দিই’। এই বলে দুই আঙ্গুলে সাঁড়াশির মতো ধরে নাক টেনে দিতেন। তা তাতে আমার আকর্ণবিস্তৃত নাক খানিকটা ‘উঠেছিল’ বই কি! আবার বলতেন, ‘তোকে এবার থেকে তারা বলে ডাকব। মুন, বাবু তো ছেলে সান, আর তুই স্টার – তারা’। বলে ডাক পাড়তেন, ‘তারা-, তারা-, তারা-’।

আমাদের মনটা কিন্তু পড়ে থাকত নদাদির ঘরে – ‘আমাদের রাজ্যে’। সেখানে যে অঢেল প্রশ্রয়! ‘কি খাবি? কি করবি?’ ‘গরম গরম লুচি-আলুভাজা করে দেব?’ সকালে আমার খাবার নদাদির সঙ্গে – গরম গরম ইক্‌মিক্‌ কুকারের ভাত, কড়ায়ের ডাল আর আলুপোস্ত। মা একেকসময় বকত। দাদা কষ্ট করে বাজার থেকে মাছ এনেছেন সেগুলো কি হবে! দুর্‌, মাছ কে খাবে! দুপুরে স্টোভ জ্বালিয়ে ঘরে গরম ছানা। ছানা খেতে যদিও আমার একটুও ভাল লাগতো না, কিন্তু নদাদির করা গরম ছানা অল্প একটু নুন দিয়ে খেতে মন্দও না! চা এর জল ফুটলে আগেই ওই কেটলির গরম জলে জানলার কার্নিশে রাখা খুচরো পয়সা ধোওয়া হবে – ‘হাত দিস নি, হাত দিস নি! রাস্তার রাজ্যের লোকের হাত লেগেছে!’ টাকার নোটও  এক্কেবারে কড়কড়ে নতুন না হলে নদাদি নেবেই না! আর যেখান থেকে যত নতুন জিনিস পাবে স-ব রাখা থাকবে আমাদের জন্যে।ঝুলি থেকে কখনও বেরতো পপিন্স, মৌরিলজেন্স, পিপারমিন্ট, কখনও লাল মশলা। লুডো, চাইনিজ চেকারের সঙ্গে গাধা পেটাপিটিরও সঙ্গী নদাদি। তাসের বাড়ি করতেও শিখিয়েছে নদাদি। আবার পরে ক্যারাম খেলাতেও নদাদি আছে। তবে এসব খেলার চেয়ে আমার বেশি উৎসাহ গল্প শোনায়। মায়ের ছোটবেলার গল্প, নদাদির নিজের ছোটবেলার গল্প, ইস্কুলের দুষ্টুমির গল্প – সে সব লিখতে গেলে একটা গোটা বই হয়ে যাবে। নদাদি লম্বা বলে কেমন করে নদাদির বড়দা ছোড়দা পকেটে সুতো নিয়ে পাত্র দেখতে যেতেন, কেমন করে ছোড়দির পোশা বাঁদরটা ঠাশ করে মেজদির গালে চড় মেরে বসেছিল – সে সব গপ্পো যে কতবার শুনেছি!

কোনোদিন দাদির শরীর একটু ভাল থাকলে লোডশডিং এ মোমবাতির আলোয় মামুর ঘরে হারমোনিয়াম বাজিয়ে দাদি, নদাদি আর মা গাইতো ‘আগুনের পরশমণি ছোঁওয়াও প্রাণে এ জীবন পুণ্য করো’, ‘ধন-ধা্ন্য-পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা … সে যে আমার জন্মভূমি’। বড়দের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সে গান কবেই আমার মনের কোণে গাঁথা হয়ে গেছে!

দাদি ছিলেন perfectionist.  অত অসুস্থতার মধ্যেও একটু ভাল থাকলেই ঘরের সামনে তিনতলার দালানে ‘নূতন’ জ্বালিয়ে রান্না করতে বসতেন। জামাই আসবে, নাতনি খাবে। দাদির করা টমেটোর জেলীর স্বাদ এখনও যেন মুখে লেগে আছে। সুস্থ থাকলে দাদি নিজের ঠাকুর ঘরে গিয়ে পুজো করতেন। অন্য সময় নিত্য পুজোর ভার ছিল ‘পুরুতঠাকুরের ছোট ছেলে’ চন্দনের ওপর। এদিকে চন্দন তো সারাদিন লাট্টু হাতে রাস্তায় খেলে বেড়ায়। পুজো করতে এলে বেচারাকে প্রথমেই দাদার প্রশ্নের মুখে পড়তে হত – ‘কি রে, পুজো করবি যে কিছু মন্ত্র জানিস!’ দাদির গোপালের ছোট্ট খাট, বালিশ, পাশবালিশ, লেপ-তোষক, রকম রকম ঘাঘরা দেখে আমার তো মাথা খারাপ। আমার পুতুলেরও এসব চাই। পরের বছর চড়কের মেলা থেকে কেনা হল খাট, আলমারি, ড্রেসিং টেবিল – সব। ঠাকুর ঘরে চোখবন্ধ করে ‘জপে বসা’ দাদির ছবি এখনও আমার মানসপটে গাঁথা হয়ে আছে।

একবার দাদি আমায় গান শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। তখন আমি ক্লাস টু তে – ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতায় নিজের অপমান’। আমি তো সুরে অসুর। দাদি মা কে বলেন – ‘তোর মেয়েটার গলায় একটুও সুর নেই। এখানে সা বলে তো ওখানে রে’। অথচ পরে এক সময় একলাইন গান শুনে বলেছন, ‘তোর মেয়েটা কি সুন্দর গান গায়’। আসলে দাদির সব কিছু নিখুঁত না হলে চলত না। অথচ আমরা নাতনিরা এতটুকু কিছু করলেও বলে বলে শেষ করতে পারতেন না।

দাদির একটা খাতা ছিল। তাতে প্রতি লক্ষ্মীপুজোর চৌকির আলাদা আলাদা আলপনা আঁকা।মা সেই খাতা দেখে আলপনা দিত আর ‘মায়ের মতো হল না’ বলে খুঁতখুঁত করতো। অথচ চালের গুঁড়ো দিয়ে মেঝেতে একটানে মা যে ফুল লতাপাতা আঁকত সেটা আমি কিছুতেই শিখতে পারি নি! কালীপূজোর দিন ঠাকুর গড়া কিন্তু শত অসুস্থতার মধ্যেও দাদি নিজের হাতে করতেন। মনে পড়ে হাঁপের টানে ঠিক করে বসতে পারছেন না, মা রাগারাগি করছে ‘হয়েছে এবার ছেড়ে দাও’। কিন্তু দাদি তবুও লক্ষ্মীঠাকুরের শাড়ির পাড়, নারায়ণ-কুবেরের হাতের শংখ-চক্র-গদা-পদ্ম নিখুঁত করে গড়েই চলেছেন। মনমতো আর কিছুতেই হচ্ছে না! কেবলমাত্র শেষ বছরে যখন এক্কেবারেই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারলেন না, সেবার মাইমা ঠাকুর গড়েছিলেন আর আমি আর বাবুদাদা মিলে ভালমানুষ মাইমাকে ‘শাঁখটা এরকম করো, পদ্মফুলটা ওরকম করো’ করে ব্যস্ত করে তুলেছিলুম। ভাগ্যিস আমাদের হাত দেওয়া বারণ ছিল, নইলে সেবার ঠাকুর গড়া হয়েছিল আর কি!

ক্লাস টুর হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় এক কাঠি সোজা আর এক কাঠি উল্টো মাফলারের নমুনা বানাতে গিয়ে আমি তো পুরো গলদ্‌ঘর্ম হয়ে লাল কালি নিয়ে বাড়ি এলুম। Annual এর আগে দাদি নিজের সেলাইএর বাক্স থেকে সরু ছুঁচ বের করে আমায় শেখাতে বসলেন ছোট ছোট রান সেলাই, সুতো তুলে রুমালের ধার মোড়া। ইস্কুলের আলপনা আঁকায় লাল কালির বদলে আমার আঁকা প্রজাপতি দেখে দাদি উচ্ছ্বসিত। কবে নাকি বঁটি দিয়ে শসা কেটে দিয়েছি দাদিকে। আমার তো মনেই নেই। দাদি সব্বাইকে বলে বলে পারেন না – ‘কি ভাল শসা কেটেছে। কি ভাল সেবা করতে শিখেছে’। হায় রে, সংসারে সবাইকে খুশি করা যদি এতও সহজ হতো!

তবু আজ সবার থেকে আলাদা করে যে মানুষটির কথা বিশেষভাবে বলতে ইচ্ছে করছে তিনি আমার দাদা। Discipline আর punctualityর মূর্ত প্রতীক। অযথা সময় নষ্ট করা ধাতে নেই। বেয়াড়াপনা মোট্টে পছন্দ করেন না। কাজেই ছোটবেলায় দাদাকে যে এড়িয়ে চলতুম বলাই বাহুল্য। কিন্তু গম্ভীর মুখ করে পেছন থেকে দুম করে পিঠে কিল মেরে দাদা বলতেন ‘কই আমার হাত তো এখানে!’ আমাকে খেপিয়ে দাদার মহা ফুর্তি। নতুন ইস্কুলে ঢুকে দিদিমণিদের কারুকে চিনিও না আর যমের মতো ভয় পাই। মায়ের মুখে সে কথা শুনে দাদা ছড়া কাটতেন ‘মোটা দিদিমণি, দেবে পিটুনি আর ঠ্যাঙ্গানি’। আমি সেই শুনেই ভয়ে কেঁদে আকুল।

ভোরবেলা দিনের আলো ফোটার আগে খাটাল থেকে সামনে দুইয়ে দুধ এনে দাদার দিন শুরু হতো। তারপর একটু বেলায় বাজার যাওয়া। কোনও কোনোদিন দুপুরের দিকে রেশন দোকান। কাজের লোকের অভাবে একতলা থেকে তিনতলা দু হাতে দুটো পিতলের বালতি করে খাবার জল বয়ে নিয়ে গেছেন দিনের পর দিন। পায়ের ব্যাথা কোনদিন গ্রাহ্য করেন নি। একবার অফিসের দরজা হাতে পড়ে ডান হাতের আঙ্গুলের একটা গাঁট উড়ে যায়। আরেকবার ডাব কাটতে গিয়ে আরেকটা আঙ্গুলের দুটো গাঁট। কিন্তু কোনও কিছুই দাদাকে কাবু করতে পারে নি। কেউ সাহায্য করতে গেলে বলেছেন ‘তুই আবার কি করবি!’ একটু বড় হবার পর মা আর দাদি আমাকে বলতেন ‘যা বাবুর হাত থেকে একটা বালতি নিয়ে আয়’। আমি যেতে দাদা ভারি মজা পেলেন। ‘তুই নিবি। আচ্ছা, নে দেখি। ফেলে দিস নি যেন’। দাদা মনে মনে বেজায় খুশি। যাক, নাতনি একটু কাজ শিখছে।

দাদি এক্কেবারে উঠতে না পারলে দাদা রান্নাও করেছেন। পেঁয়াজ ভাজা দিয়ে মুসুর ডাল দাদার মতো কেউ করতেই পারে না। আহা, যেন অমৃত! দাদা ছিলেন ঠিকঠাকের লোক। কাঠের আলমারির বাঁদিকের টানায় দাদার টাকাপয়সা রাখা থাকতো। প্রতি মূল্যের নোট আলাদা তো বটেই, রঙ বেরঙএর ধূপের বাক্সে আলাদা আলাদা করে সাজানো থাকতো এক পয়সা, দু পয়সা, তিন পয়সা, পাঁচ পয়সা আর দশ পয়সা। দোকান বাজারের হিসেব এক্কেবারে পাই-পয়সায় মেলানো। খুচরো নেই বলে কেউ দু এক পয়সাও বেশি নিতে পারত না। পয়সা সস্তা নাকি! দাদির সঙ্গে অবশ্য এই নিয়ে দাদার মাঝে মধ্যেই খিট্‌মিট লেগেই থাকতো। দাদার মতে দাদির যত্ত ‘বাজে খরচ’। আর দাদির মতে দাদার ‘শুধু কিপ্‌টেমি’। তবে আমরা খাব বলে চাচা বা রূপবাণী থেকে ‘ফাউল কাটলেট’ আনাতে চাইলে দাদা কোনদিন ‘না’ বলেন নি। একবার ভাইফোঁটায় নদাদি নদাদুর ছবিতে ফোঁটা দিইয়ে আমায় একশো টাকা দিল। সে অবশ্য নদাদি সব সময়ই কিছু না কিছু দেবার অজুহাত খুঁজতো। আমার তখন দুর্বুদ্ধি হল অন্য দাদুদের কাছেও ফোঁটা দিয়ে টাকা পাওয়া যেতে পারে। দাদিও মহা খুশি। বললেন ‘দাদার কাছে একশো টাকার কম একদম নিবি না’। দাদাও বললেন ‘পঞ্চাশ টাকাই দিই, কি বলিস্‌’। আমি তো এহেন অকস্মাৎ আমদানিতে যারপরণায় অভিভূত। তখন একশোই বা কি আর পঞ্চাশই বা কি! আবার কাজের লোক যখন আলমারি খুলে ব্যাঙ্ক থেকে সদ্য নিয়ে আসা দশহাজার টাকা নিয়ে চম্পট দিয়েছে, বাড়ির সবার মাথায় হাত – দাদা বললেন, ‘গেছে, গেছে, আবার আসবে’। কত বড় কথা। এ যদি অনাসক্তি না হয় তবে অনাসক্তি কি! আবার থানা পুলিশ করে সেই টাকা যখন উদ্ধার হল তখনও দাদা নির্বিকার।

শেষের দিকে ইচ্ছে হয়েছে দু একবার ‘ফাউল কাটলেট’ খাবার। কিন্তু দোকানের কেনা নয়। মা কে বলেছেন, ‘আমি টাকা দেবো। তুই বানাতে পারবি নাঃ!’ আরেকটা ইচ্ছে ছিল সেই আগেকার যোগ্যি বাড়ির মতো বড় আট দশ কেজি্র রুই মাছের ভাজা খাবেন। বাবা ও মামু কলকাতার বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়েও চার পাঁচ কেজির চেয়ে বড় মাছ পায় নি। আমার অদ্ভুত খাওয়া দেখে দাদা বলতেন, ‘পেঁচার সকলি উল্টা! তুই কি আগে পায়েস খাবি, তারপর মাছ খাবি আর শেষকালে শুক্তো!’ দাদার আরেকটা ইচ্ছেও পূর্ণ করা সম্ভব হয় নি। খুব ইচ্ছে ছিল মেট্রোরেলে করে টালিগঞ্জে গিয়ে সেখান থেকে ‘কমলা’র নতুন বাড়ি দেখতে যাবেন। কিন্তু মেট্রোপরিষেবা তখনও এত উন্নত ছিল না যে দাদাকে মেট্রোয় চড়ানোর ব্যবস্থা করা যায়।

দাদি যখন শেষকালে নার্সিং হোমে, তখনও দাদা ধীর-স্থির। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই মনের মধ্যে কি ঝড় চলছে। শুধু শেষ খবর শুনে ‘হে মা কালী, হে মা কালী’ করে নিজের মনের আর্তি জানিয়েছেন। আর তারপর আটটা বছর কাটিয়েছেন সমান শান্তভাবে। কোনোদিন দাদার মধ্যে কোনও অভিযোগ, অশান্তি, অস্থিরতার লেশমাত্র দেখা যায় নি। নিজেই নিজের সময় কাটানোর হরেক রকম অভিনব উপায় বের করে নিয়েছেন। কখনও সারাদিন আপনমনে ছড়া কেটেছেন, ‘নেচে নেচে চলে যায়, আয় আয় আয়…’। বাবুদাদা বলত দাদা তুমি সারাদিন ‘আয় আয়’ করে কাকে ডাক? বলেছেন ‘চোয়ালের exercise করি’। কখনও ছাদে দাঁড়িয়ে গাড়ি গুনেছেন। গিয়ে বলেছি ‘দাদা ঘরে যাবে না’। বলেছেন – ‘দাঁড়া, একশোটা গাড়ি হোক, তারপর যাব’। পরে যখন রাস্তায় গাড়ি বাড়ল দাদার খেলাও পাল্টালো। আমায় বললেন, ‘তুই এদিকের গাড়ি গোন, আমি ওদিকের গাড়ি গুনি। দেখি কার আগে একশো হয়’। কখনো প্রাইভেট গাড়ি আর ট্যাক্সি আলাদা করে গুনেছেন। কোনও কোনোদিন গিয়ে দেখেছি একা একা ঘরে বসে রবীন্দ্ররচনাবলী খুলে জোরে জোরে কবিতা আবৃত্তি করছেন।

মোটা মোটা মাণিক গ্রন্থাবলী একেকখণ্ড একেকদিনে শেষ। পড়তে পড়তে দিন-রাতের হিসেব থাকতো না। ছোট থেকে দেখেছি রাত্তিরবেলা নটা বেজে গেলে মামার বাড়ির সদর দরজাই শুধু বন্ধ হয়ে যায় না – কাজের লোকেরা সুদ্ধু সবাই ঘুমিয়ে কাদা। বাবার অফিস থেকে ফিরতে কোনদিন দেরী হলে রাঙ্গাদাদুকে বলে রাখতে হত দরজা যেন বন্ধ না করা হয়। সাড়ে আটটা বেজে গেলেই ‘রাঙ্গাকাকা শুতে পারছেন না’ বলে বাড়ি ফেরার হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। একবার এই তাড়াহুড়োয় প্রায় বাড়ি পৌঁছে দেখা গেল মা ব্যাগ ফেলে এসেছে, আর বাড়ির চাবি ব্যাগের মধ্যে। গাড়ি ঘুরিয়ে আবার ফেরা তো হল কিন্তু ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ন’টা পেরিয়েছে। প্রচুর হাঁকাহাঁকি, ডাকাডাকি করেও কারুর ঘুম ভাঙ্গানো যাচ্ছে না। রাস্তায় লোক জড় হয়ে গেছে। তখন আজকের মতো মোবাইল ফোন ও নেই, এমন কি দোতলার দালানে রাখা ফোন ধরারও কেউ নেই। বহু কষ্টে রাঙ্গাদাদুর জানালায় বাইরে থেকে ধাক্কা মেরে ঘুম ভাঙ্গিয়ে সে যাত্রায় চাবি উদ্ধার হল।

সেই দাদা তখন কদিন আমাদের বাড়িতে রয়েছেন। মন দিয়ে মাণিক গ্রন্থাবলী পড়ছেন। ন’টা থেকে মা দু-একবার খেতে ডেকেও সাড়া পায় নি। শেষকালে দশটা বেজে যেতে মা বলেছে, ‘বাবা দশটা বাজে, এবার খেতে এসো’। দাদা বই থেকে মুখ তুলে বললেন ‘মোটে!’ ভেবেছেন সকাল দশটায় ভাত খেতে ডাকা হচ্ছে। এই একাগ্রতার এক ছিঁটেফোঁটাও যদি আমরা পেতুম!

বেলার দিকে মামার বাড়ি গেলেই মাকে বকতেন, ‘কি সেই হাতিবাগানে এসেছিলি? তোদের পাড়ায় কি কিছুই পাওয়া যায় না! দুপুরবেলা নাওয়া-খাওয়ার সময়! যা বাড়ি যা!’ আবার সন্ধ্যেবেলা সব সময় যাবার সু্যোগ হত না। তবে দাদা নিজের স্বভাবসিদ্ধ গাম্ভীর্যের খোলস ছেড়ে একদিন আমার সঙ্গে অনেক গল্প করেছিলেন। নিজের জীবনের গল্প, হয়তো কিছু অভিমানের কথা – যা হয়তো কোনদিন কাউকে বলেন নি। সেদিন আমার নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল আমি ‘বড়’ হয়ে গেছি।

‘রাখোবাবু’র কথাই ছিল ‘অস্থির হওয়া লাগবে না!’ পরীক্ষার আগের দিন ভয় পেলে বলতেন,- “‘সার’, ‘সার’ করো, ‘সার’ কে দেখে শিখতে পারো না! ‘দুঃখেষু অনুদ্বিগ্নমণা সুখেষু বিগতস্পৃহ’”। সেই রাখোবাবুকেও ভেঙে পড়তে দেখেছিলুম ওনার স্ত্রীবিয়োগের পর। যে কথার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ক্লাস টেনের বাংলা বইয়ের পাতায়, মুজতবা আলির দেশে বিদেশের হাত ধরে – মনে হয়েছিল এ তো বইয়ের কথা। বাস্তবে এ কখনও সত্যি হয় না কি! দাদাকে দেখে বুঝেছি প্রকৃত স্থিতধী ব্যক্তি, প্রকৃত অনাসক্ত পুরুষ নিছক বইয়ের কথা নয়, বাস্তবেও থাকেন দুএকজন।

অনিয়ম, অসময় পছন্দ করতেন না কোনকালে। খুব ভালবাসতেন মাছ খেতে। তাই যাবার বেলায়ও মামুর হাতে মায়ের রান্না করে নিয়ে যাওয়া মাছ খেয়েছেন। সবার খাওয়া হয়েছে কিনা খবর নিয়েছেন। শেষ কথা বলেছেন ‘ক’টা  বাজে?’ তারপর বলেছেন, ‘শেষ করে দে, শেষ করে দে’। সম্পুর্ণ সজ্ঞানে সবার কাছে বিদায় নিয়েছেন। তার আগে নিজের সঙ্গে সঙ্গে সবাইকেও তৈরী করেছেন। দাদার শেষযাত্রায় আমি সামিল হয়েছি, নিজের চোখে দেখেছি মানুষের শেষ পরিণতি। যেতে যেতেও দাদা তাঁর বেয়াড়া অবাধ্য নাতনীকে শেষ শিক্ষা দিয়ে গেছেন এই পৃথিবীতে কিভাবে থাকতে হয় আর ছেড়েই বা যেতে হয় কিভাবে!