৬
পরদিন সকালে উঠেই তৈরী হবার হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। এদিনের গন্তব্য সুন্দরী Sentosa. দিনের প্রধান আকর্ষণ Cable Car. তারও টিকিট আগেই কাটা আছে। আজ আমরা আর নতুন নই মোটেই! প্রথমদিনে Universal Studio ঘুরে রাস্তা সবই চেনা। শুধু Vivo City থেকে Monorail না চড়ে পাশের Harbour Front Station থেকে Cable Car মানে Rope way তে চড়তে হবে।
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
তিন দিন ধরে একই রাস্তা দিয়ে Kallang এ গেলেও আমার ছাই রোজই রাস্তার ডানদিক, বাঁদিক গুলিয়ে যায়! Outram Park থেকে ট্রেন বদলে Harbour Front এ এসে তো পৌঁছলুম। সেখান থেকে গটগটিয়ে এগিয়ে গেলুম Cable Car Stationএ। ওমা সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আবিষ্কার হল ওই Mail এর E-ticket redeem করাতে হবে সেই Vivo City থেকেই। আমাদের বসিয়ে রেখে সকব তো গেল টিকিট আনতে। ওদিকে বেলা যত বাড়ছে গরমও তত অসহ্য হয়ে উঠছে। প্রায় ৪৫ মিনিট পরে টিকিট নিয়ে ফিরল যথারীতি মাথা গরম। চুপচাপ সব বকুনি হজম করে ওপরে গেলুম Cable Car চড়তে। ওমা ওই ২৬ তলা লিফ্টে ওঠার পর বলে কিনা হাতের ব্যাণ্ড চাই, শুধু টিকিট দেখালে চলবে না! কত্তামশাই আবার নিচে গেল Wrist Band আনতে। আর এ সবই যে আমার অতিরিক্ত ‘Map reading’ এর ফল – সে সুনাম ততক্ষণে কপালে জুটেছে!
Cable Car এ ওঠা বেশ ঝঞ্ঝাট। চলন্ত ডিব্বায় এক লাফে উঠে পড়তে হবে। থামাথামির কোনোও ব্যাপারই নেই। ওরে বাবা রে – কি মুস্কিলে পড়া গেছে! কিন্তু সে ডিব্বা যখন একটু পরেই সমুদ্রের ওপর দিয়ে চলতে শুরু করল – আহাঃ, আহাঃ। চারিদিকে থৈ থৈ জল, আর দূরে দেখা যাচ্ছে সিঙ্গাপুর হারবার। সেখানে সারি সারি জলযান দাঁড়িয়ে। আরে ওটা কি ওই দূরে? ওটাও কি সিঙ্গাপুর! আরে না, না, ওটা ইন্দোনেশিয়া! ও মা! আরে এদিকে যে Sentosa Island এসে গেল!
কি সুন্দর! এতো ওপর থেকে নিচের কটেজগুলো কি সুন্দরই না লাগছে! ওই দেখো কটেজের মাঝে আবার Swimming pool, টলটলে নীল জল। ছোট্ট ছোট্ট পুতুলের মতো মানুষেরা সেখানে জলকেলী করছে। দ্যাখো, দ্যাখো Universal Studio. এই তো দুদিন আগেই ঘুরে গেলুম। এই এসে গেল Sentosa, Imbiah Lookout. একরাশ বিস্ময়মাখা চোখে এদিক ওদিক চেয়ে প্রথমেই গেলুম Butterfly Park and Insect Kingdom.
সেই লোহার শেকল ঘেরা পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখি ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ে বেরাচ্ছে। ও মা! ওদিকে গাছের আড়ালে ওটা কি! কালো কুচকুচে ময়ূর যে!! গা থেকে আবার গাঢ় নীল রঙের ঝিলিক। ছবিতোলার লোভ সামলানো দায়। এতো কাছ থেকে ময়ূর দেখি নি তো কখনো – মানে এমন খাঁচার বাইরে।ওদিকে আবার সেই ফেলুদার সাবধান বাণী – ময়ূরের ঠোঁটে খুব জোর, একবার ঠুকরে যদি দেয় -। ভয়ে ভয়ে যতদূর সম্ভব কাছে গিয়ে ছবি তোলা হল।
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
এদিকে দুদিনের ঘোরাঘুরিতেই পা-হাঁটু জানান দিচ্ছে। আবার চিরকেলে লেট-লতিফদের সময়ের সঙ্গে যুদ্ধও চলেছে। তাই তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়লুম মিউজিয়াম দেখতে। সেখানে সেই শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতির জীবনচক্র, রকম রকম লার্ভা, পিউপা …। ওরে বাবা, আবার অন্য সব পোকামাকড়ও আছে দেখি! টারান্টুলার পাশাপাশি আরেকটা পোকা দেখলুম এক্কেবারে অবাক করা! এমন বড় বড় সবুজ পাতার মতো ডানা তার যে কিছুতেই পাতার ভীড়ে তাকে খুঁজে পাওয়ার জো নেই – কোথায় লাগে গিরগিটি এর কাছে! ভাগ্যিস একটু নড়ে উঠল! ইস্, মায়ের জন্যে কি যে মনকেমন করছে! এইসব মিউজিয়াম, পোকামাকড় – মা দেখলে কি খুশীটাই না হোতো!
এবারে হল ভর্তি মাউন্টেড বাটারফ্লাই। আহাঃ, কি রঙের বাহার! ‘কোথায় পেলি ভাই এমন রঙিন পাখা; প্রজাপতি, প্রজাপতি” – । আমার তো দেখা আর শেষই হয় না! পারলে সবগুলোকেই ক্যামেরাবন্দী করে রাখি! কেন যে পারি না খুব সুন্দর মনের মতো ছবি তুলতে!
প্রজাপতির রাজ্যের বাইরে উপহারের দোকান। সুন্দর সুন্দর প্রজাপতি আর রংবেরঙ্গের মিনে করা সব চাবির রিং, কানের দুল, গলার হার, লকেট – দাম এই S$2/3/5। সেখান থেকে দুটো লকেট আর নিজের জন্যে একটা সুন্দর মিনেকরা প্রজাপতি দুল পছন্দ করতেই বেলা কাবার। “তাড়াতাড়ি কর! 4D শো শুরু হয়ে যাবে, তখন লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে”। ওরে বাবা! দুদিন ধরে লাইনে দাঁড়াবার খুব অভিজ্ঞতা হয়েছে, আর না! অবশ্য বকুনি খাওয়াটা আমার ছেলেবেলার অভ্যেস। যে যখন পারে আমাকে বকুনি লাগায় – ওটা না খেলেই চিন্তা হয়, কি হল সব ঠিক আছে তো!
পরপর তিনটে শো। প্রথম হল ‘Journey to the Mysterious Island’ । আজ আর কোনোও চিন্তা নেই। Universal Studio ঘুরে 4D শোয়ের খুব অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে। তাই সিটে বসে আগেই পা গুটিয়ে নিয়েছি। জঙ্গলের লতাপাতা ঘেরা পথ দিয়ে যেতে সিটের নিচে ঝুলে থাকা লোহার শিকলের সুড়সুড়ি বা মুখে ছিটকে আসা জলের ছিটায় তাই আজ বেশ মজাই লাগে। কিন্তু আচমকা সিটের পেছন থেকে আসা গদাম করে বর্শার ফলার ধাক্কা – উফ্, বেজায় বিরক্তিকর! একে বলে কোমরে-পিঠে ব্যথা! দূর হ’ 4D শো!
SONY DSC
SONY DSC
এরপরে ‘Extreme Log Ride’। সেখানে গপ্পো তুমি বেশ একটা ছোট্ট বাঁশের টুকরো। সেটা ওপরে যাচ্ছে, নিচে নামছে, উঁচু পাহাড় থেকে খাদে পড়ছে – এক্কেবারে হুলুস্থুল। তবে হুঁ হুঁ বাবা, আর বোকা বানাতে পারবে নি – বলে মিশরের মমির প্রতিশোধ পেরিয়ে এসেছি! এতো সামান্য বংশদণ্ড! ‘আমি কি ডরাই সখী …”।
যা হোক এরপর হলুম গিয়ে Mexican Cow Boy. এবার আর গাড়ী চড়া নয়। ছোটবেলার সেই ঘুর্ণী-নাগরদোলার মতো ঘোড়ার পিঠে চেপে বসতে হবে – চোখে 3D কালো চশমা আর হাতে বন্দুক নিয়ে। ‘ইন্জিরি সিনিমা’র দু পাড়ার মস্তানদের লড়াই। ‘ঘোড়া-সিট’ যথেচ্ছ ঝাঁকুনি দেবে আর সেই ঝাঁকুনি সামলে একহাতে ঘোড়ার রড আর অন্য হাতে বন্দুক ধরে সামনের স্ক্রিনে ফুটে ওঠা নম্বর দেখে গুলি ছুঁড়তে হবে। খেলার শেষে আবার স্কোরকার্ড সহ সবার নাম ও ছবি র্যাঙ্কিং অনুযায়ী দেখানো হচ্ছে। নীলবাবু দেখি সেখানে 4th । সোহম আর আমিও বেশ ভালই করেছি। কেবল আমাদের দলপতিমশাই ঝাঁকুনির চোটে বন্দুক-টন্দুক ছেড়ে দিয়ে দু হাতে রড ধরে চুপচাপ বসে ছিলেন!
এরপর ঠিক হল আমাদের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ Madame Tussaudsর Wax Museum দেখতে যাওয়া হবে।আরে সেটা তো এই Imbiah Lookout এই বলছে ম্যাপে। কিন্তু কোথায়? লোককে জিজ্ঞাসা করতে বললে – এই তো নিচে, এদিক দিয়ে চলে যাও। নিচে নেমে দেখি আরে এ তো Nature walk trail। দুর্, এখন কে খামোখা হাঁটতে যাবে! যা গরম আর প্যাচ্প্যাচে ঘাম। সামনেই দেখি বাস ধরার লাইন।
আমাদের যদিও Unlimited cable car ride ticket কাটাই ছিল, কিন্তু সেই Cable car station টাই বা কোথায়! Sentosaএ বাপু সব ভাল, কেবল কোত্থাও একটা Help-desk নেই! আর রাস্তায় কোথাও ম্যাপও নেই। এ ভাই সিঙ্গাপুরের ভারি বিচ্ছিরি সিস্টেম! সবাই বুঝি আগে থেকে সব জেনে যাবে! মরুক গে, বাস যখন আসছে চল না হয় Sentosa Beach এই যাওয়া যাক।
Sentosa Beach এ Fort Siloso।আর আছে Trick Eye Museum. সব চেয়ে বড় কথা beach আছে। Adventure Cove Waterparkও দেখা যাবে বেশ! Sentosa Island-র মধ্যে এই যে বাস – এ হল ফ্রি। যতবার ইচ্ছে যেখানে খুশী যেতে পার। Siloso Point-এ গিয়ে কিন্তু এক্কেবারেই হতাশ হলুম। Waterpark এবং সমস্তরকম watersports ‘Haze’-র জন্যে বন্ধ। ওদিকে Fort Siloso তেও কোন এক Birthday Party চলছে বলে সেও বন্ধ।
লিফটে করে এগারোতলা উঠে ‘Fort Siloso Skywalk’s viewing platform’-এ তো পৌঁছনো গেল। সেখানে কাঁচের তৈরী floor. তোমার বুকের পাটা যে কতখানি, হবে তার পরীক্ষা। ওই কাঁচের ওপর দাঁড়ালে নিচে তাকালে দেখা যাচ্ছে রাস্তা-গাছপালা-মানুষ – সেই রিয়া-রিম্পার কথায় ‘ম্যাগির বাড়ী’র মতো। আর তার পর মুহুর্তেই মনে হবে ‘ওরে বাবা শরীরের ভারে কাঁচ যদি ভেঙে যায় – তাহলে ‘পপাত চ মমারো চ’ -। সেই Skywalk Trail ধরে সবে একটু এগিয়ে গিয়েছিলুম দুই ছেলে নিয়ে ‘আমি দি গ্রেট’ – সঙ্গে সঙ্গে বকুনি। একে পায়ে ব্যথা, তারওপর অকারণে দেরী করার কোনও মানেই হয় না।
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
SONY DSC
কাঁচুমাচু মুখ করে নিচে নেমে এবার এগোই beach-র পথে। কিন্তু সেখানেও ব্যথা পায়ে বালিতে হাঁটা দুঃসহ হয়ে ওঠায় করুণ মুখে আবার বাসের লাইনে এসে দাঁড়ালুম। বলি একবার cable car চড়লে হয় না! টিকিট ও তো আছেই। এদিকে পেট তো চুঁইচুঁই। বাস আসতে দেরী দেখে ওখানে Super Market থেকে স্যাণ্ডউইচ আর কাপ নুডুলস দিয়ে পেটের ছুঁচোগুলোকে থামানো গেল।
এখানে আরেক মুশকিল কোত্থাও খাবার জল পাওয়া যায় না। মানে আগের দিন Universal Studio তে যেমন প্রচুর জলের কল ছিল যেখান থেকে বোতলে ঠাণ্ডা জল ভরা গিয়েছিল, এখানে জল মানেই কিনতে হবে। আর আধা লিটার জল মানে S$2 অর্থাৎ কিনা একশ টাকা। গরীব দেশের মানুষ আমরা। তাই যথেষ্ট গায়ে লাগে বই কি।
SONY DSC
SONY DSC
এদিকে আসার পথে আমাদের প্রায় এক ঘন্টা Harbour Front এ বসিয়ে বাসুসাহেব যে Vivo City তে টিকিট আনতে গিয়েছিলেন, আর আমরা গরমে গলদ্ঘর্ম হয়ে টেনশনে অস্থির হচ্ছিলুম তখন বাবু টিকিটের সঙ্গে সঙ্গে নিজের জন্যে Crocodile Tee-Shirt কি্নছিলেন। এবার Siloso Point এ বাস ধরার তাড়ায় সেই বিখ্যাত প্যাকেটটি পড়ে রইল ওই Supermarket র টেবিলের পাশে। ভাগ্যিস বাস ছাড়ার আগে সেটা খেয়াল হয়েছে। ড্রাইভার সাহেবকে অনেক তুতিয়ে পাতিয়ে বাস দাঁড় করিয়ে অবশেষে সেই প্যাকেট উদ্ধার হল। প্যাকেট হারানোর বকুনিটা অবশ্য নীলের ভাগ্যেই জুটল। খিদের মুখে সামনে খাবার পেয়ে হাতে ধরা প্যাকেটখানি দায় ও দায়িত্ব সে পুরোই হজম করে ফেলেছিল।
আর এদিক সেদিক ঘুরে সময় নষ্ট নয় – এবার বাসে চড়ে সোজা Universal Studio চত্তরে S.E.A. Aquarium দেখতে।
(ক্রমশঃ)