Posted in Uncategorized

অঙ্ক-সফর

অঙ্ক আমি ভালবাসি। কি ভালবাসি, কেন ভালবাসি বলতে পারি না। হয়তো পূর্বজন্মের সংস্কার। কি জানি! ছোটবেলায় নদাদি বলতো দাদুর ছবিতে ভাল করে প্রণাম কর। বড় হয়ে দাদুর মতন অঙ্ক করতে হবে। হয়তো কথাটা নিজের অজান্তেই  মনে গেঁথে গিসল। ‘দাদুর মতন অঙ্ক’ করব, বিজ্ঞানী হব। তাই অঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে অঙ্কের শিক্ষক শিক্ষিকারাও মনের মাঝে বিশেষ জায়গা জুড়ে থেকেছেন। সেই কেজি টুর ‘মোটা দিদিমণি’ – দাদা যাঁকে নিয়ে বলতেন ‘দেবে পিটুনি আর ঠ্যাঙানি’ – যমের মতো ভয় পেতুম। কিন্তু ক্লাস ওয়ানে উঠে একদিন আদর করলেন – সে কি বিস্ময়! অঙ্কর মতই গুরুগম্ভীর অঙ্কের দিদিরা – রাজলক্ষ্মীদি, মন্দিরাদি, অবলাদি! প্রাইমারীর সুচিত্রাদি তুলনায় কম রাগী। কিন্তু এদের সবার কাছে কোথাও একটা প্রশ্রয় ছিল। দিনের পর দিন অবলাদির ক্লাসে স্বাস্থ্য পড়া পারিনি। তবু অঙ্ক পারার দৌলতে শাস্তি ক্ষমাও পেয়ে যেতুম। তাই সদাহাস্যমুখী ইন্দ্রানীদি নয় – রাগী অবলাদিকেই বেশি ভাল লাগত।

প্রাইমারীর দিদিরা বেশিরভাগই ‘মায়ের দিদিমণি’। তাঁরা সবাই বহুদূরের মানুষ। ক্লাস ফাইভে উঠে লায়েক হলুম। কিন্তু সেখানেও ছোটতৃপ্তিদি কে মনে হত বড্ড নরম। কাউকে বকতেই পারেন না। আল্পনাদি মনটা জুড়ে বসলেন। ক্লাস সিক্সে রোজ ক্লাসে কম্পিটিশন হত সূর্মার সঙ্গে – কে আগে অঙ্ক খাতা দেখাবে। বলাই বাহুল্য বেশিরভাগ দিন সূর্মাই জিতত। তারপর এলেন আরতিদি। কিন্তু সবার ওপরে সুচিত্রাদি – অঙ্কের মতই perfect.  যদিও স্কুলজীবনের প্রিয় শিক্ষিকা যিনি তাঁর বিষয় অঙ্কের এক্কেবারে বিপরীত মেরুতে – ‘যার সঙ্গে যার মজে মন!’ কিন্তু কোথাও যেন তাঁর মধ্যেও খুঁজে পেয়েছি অঙ্কের গুরুগম্ভীর অসীমতা।

সুচিত্রাদি অসুস্থ হয়ে ছুটি নিলেন। সে যে কি দুশ্চিন্তায় আমাদের দিন কেটেছে! প্রভু যিশু মা মেরির কাছে সকাল-বিকেল কত প্রার্থনা কত মানত। কিন্তু এ সব ভালবাসাই ছিল একতরফা। আর এসবের সঙ্গেই জড়িয়ে ছিল অঙ্ক – সূত্রে মণিগনা ইব।

তাই বলে যদি মনে করা হয় আমি পরীক্ষাতেও ‘দশে দশ’, ‘একশোয় একশো’ – সে হবে মস্ত ভুল। দশে দশ কখনও সখনও কপালে জুটলেও একশোয় একশো চিরকালের অধরা। উৎসাহ দিতে বাবা অনেক টোপ দেখিয়েছে – ‘ঘড়ি পেন’ কিনে দেবো। তা সেই না পাওয়া ‘ঘড়ি পেন’ নিয়ে কল্পনার জগতে এতই মশগুল যে বাস্তবে পরীক্ষায় কোনক্রমে পাস। নাহ্‌, সববার বাঁচতে পারি নি। সে সেই ক্লাস এইটে – প্রথম বার সেকেন্ড টার্ম পরীক্ষা। প্রথমেই দুদুটো শক্ত পাটিগণিতের অঙ্ক। কিছুতেই মিলাতে পারি না! ব্যাস্‌, সেই চিন্তায় পরের প্রায় সব কটা বীজগণিত গুবলেট। মায়ের সঙ্গে বাড়ি ফেরার পথে বাসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ‘তারে জমিন পর’এর ঈশানের মতো আমার চোখের সামনেও ভুলেরা নেচে নেচে ভেসে বেড়াতে শুরু করল। আর নিস্তার নেই! বেচারি মা। চিরকাল নিজেকে দোষারোপ করছে – মা আনতে গেছে বলেই পরীক্ষা খারাপ! কোনও মানে হয়! না মতটা মায়েরই। তাই এর পর থেকে আমার কোনও পরীক্ষায় মা কক্‌খনও যেতে পারে নি। বাবার কাজ বেড়েছে। উচ্চমাধ্যমিকে যেখানে সব্বার মায়েরা ডাবের জল নিয়ে টিফিন খাওয়াতে আসতেন সেখানে অপিসের কাজ ফেলে আমার বাবাকে আসতে হয়েছে।

আরও আছে। ‘Best of luck’ বলা যাবে না। ক্লাস নাইনে অঙ্ক পরীক্ষার দিন সকাল থেকে কান্নাকাটি। তারপর বাসে ওঠার সময় মোহর এক তো বলেছে best of luck!  উত্তর না পেয়ে আর আমার অতি শাসনের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে বলেছে সবার পরীক্ষা ভাল হবে শুধু চন্দ্রানীদির হবে না! শিশু নারায়ণের এ হেন অভিসম্পাৎ! কিন্তু নাঃ উৎরে গেছি উৎরে গেছি। কিন্তু সেই ক্লাস এইট – উৎরোতে পারি নি।

শেষদিনের ভৌতবিজ্ঞান পরীক্ষা দিয়ে খুশি মনে বেরোচ্ছি – গেটের সামনে আরতিদির মুখোমুখি। ‘কি করেছিস কাল!’ আবার মনে পড়ে গেল সেই ভুলের নাচ। ‘দিদি শুধু বলুন পাস করেছি!’ উত্তর এল ‘আমি জানি না!’ শুরু হল প্রশ্নপত্র খুলে নম্বর গোণা। যেন বার বার গুণলেই নম্বর বেড়ে যাবে! হে ভগবান, ছোট থেকে তো কত প্রার্থনা শুনেছো। উৎরে দাও। সব প্রার্থনা ভগবান শোনেন না। শুধু জ্যামিতি দিয়ে কি আর পাস নম্বর ওঠে! সারা ক্লাস ভয়াবহ রেজাল্ট। সিস্টার রোমানা রেগে আগুন। নিজের হাতে সবাইকে রেজাল্ট দেবেন। এক একজন করে নাম ডাকছেন আর ওনার বিখ্যাত চাঁচাছোলা ভাষায় তার আড়ন ধোলাই হচ্ছে। ‘ভাল মেয়ে’ ‘মন্দ মেয়ে’ কেউই বাদ যাচ্ছে না। আমার নাম ডাকলেন। বলির পাঁঠার মতো ঠকঠক করে কাঁপছি। আমার অবস্থা দেখে বিল্লু সুদেবী সবারই মুখ ছোট। সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা চলছে। ওমা! সিস্টার কিচ্ছুটি বললেন না! শুধু হাতে রিপোর্ট কার্ডটা ধরিয়ে দিলেন!

এরপর স্বভাবতই অঙ্কের ওপর অভিমান হয়। নাহ্‌, কিছুতেই অঙ্ক Additional নেব না! ঢের ভাল ফিজিক্স। আর দাদু কি শুধু অঙ্কই করেছেন! ফিজিক্সও তো দাদু! সূর্মা কিন্তু অঙ্কের ভালবাসা ছাড়ে নি। সারা ক্লাসে একমাত্র Additional Maths  সূর্মা।

এরপর লেডি ব্রেবোর্ন। বাংলা মিডিয়াম থেকে এক্কেবারে ট্যাঁসগরুদের মাঝে! উফ্‌, সব্বাই কি সবজান্তা! ক্লাসে কোনকিছু বলার আগেই তাদের ঠোঁটের ডগায় উত্তর! হোলি চাইল্ডের দিদিদের সেই পরম স্নেহ, অপরিসীম ধৈর্য – কোনটাই পাই না। আইভির ‘Honey Bangle’, IDর কথাকলি আর SMর  ‘yes’। Parabola, hyperbola, ellipseএর জটিল ধাঁধার চেয়ে   ‘ yes’ গোণা ঢের সহজ! ফল যা হবার তাই! ক্লাস টেস্টে পঞ্চাশে পনেরো আর পাঁচ। তবু তার মধ্যেও ক্লাস টুয়েল্ভে নতুন করে ভালবেসে ফেললুম ‘Calculus’ – limits, continuity, derivatives.  Physicsএর থিওরী যতই আকর্ষণীয় হোক প্রব্লেম ততটাই দুর্বোধ্য। বইএর simple problem এই দাঁত ফোটাতে পারি না, harder problem কা কথা!

সবেরই ভাল দিক আছে। ঘরের ছেলে – থুড়ি মেয়ে – অভিমান ভুলে ঘরে ফিরে এলুম। আর কোনও দ্বিধা নয় – অঙ্ক অনার্সই পড়ব। তবে লেডি ব্রেবোর্ন আর নয়। যাদবপুরের হবু ইঞ্জিনিয়ার বিশ্ব বাউড়ে সল্ট লেকে এসে বলে গেল ‘অঙ্ক নিলি কেন? আমরা তো সবাই জানি অঙ্ক তোর আতঙ্ক!’ মনে মনে বলি ‘কচু জানো!’ মুখে বলি ‘কি করব বল। অঙ্ক নিলে যদিবা কোনদিন পাস করি, অন্য কিছু নিলে সেটাও করব না!’

কলেজে মণিবাবু ফিজিক্সের হেড। একদিন ক্লাসের পর ডেকে পাঠালেন। ‘তুমি ফিজিক্স অনার্সে apply করোনি?’ ‘করেছিলুম স্যার’। ‘নাম ওঠেনি?’ ‘উঠেছিলো স্যার’। ‘তাহলে অঙ্ক নিলে কেন?ফিজিক্স পড়তে চাও?’ মনে মনে বলি ‘পাগল!’ ততদিনে বুঝে গেছি অঙ্কই আমার ‘টুরু লাভ’। ‘নেচো বুড়ো’র সারা ক্লাসে শুধু হাতে চক ঘুরিয়ে ‘suppose’ বলার পরও মনে হয়েছে analysis এর মতো ভাল কিছু নেই! তবে আবারও ধাক্কা খেয়েছি। যত রাজ্যের statics, dynamics জীবনটা দুর্বিসহ করে তুলেছিল। পরীক্ষার হলে মাথা ঝিমঝিম, পেট গুড়গুড়, করা অঙ্ক আধখানা করে মাথা blank!  আবারও বেঁচে গেলাম। Physics Hons এর মতো  Applied Mathematicএর  glamour নয় – আমার সহজাত প্রবৃত্তি বিশুদ্ধ গণিত।নিজের ভালবাসা আর আবেগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ উপাধি ঝুলিতে এসেছে। কিন্তু ভগবান তো অত সহজে ছেড়ে দেবার লোক নন!

যে ইঞ্জিনিয়ারিং কোনদিন পড়তে চাইও নি, পাইও নি – দশ দশটা বছর তার মাঝেই নির্বাসন! স্নাতক, স্নাতকোত্তর মায় পিএইচডি – প্রযুক্তিবিদ্যার উপযোগী অঙ্কও যেমন নতুন করে শিখে নিতে হয়েছে, তেমনি জানা হয়ে গেছে বর্তমান যুগের প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের নাড়ি নক্ষত্র। কিন্তু এই দশ বছর শুধুই মনে হয়েছে ‘কেন? কেন?’ কি শিখেছি, কি ভালবেসেছি আর কি পড়াচ্ছি! ‘হেথা নয়, হেথা নয় অন্য কোথাও অন্য কোনখানে!’

হ্যাঁ আবার সুযোগ এসেছে। M.Tech., M.Sc. Tech. এরপর নির্ভেজাল M.Sc.  – না, বিশুদ্ধ নয় ফলিত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। M.Sc. dissertation, PhD student guide  – নাই বা হল official portfolio, নাই বা পেলুম remuneration! কিন্তু মাঝে যে দশ দশটা বছর পেরিয়ে গেছে! আমি যে দলছুট হয়ে পড়েছি! তাতে কি। কোমর বেঁধে লেগে পড়। ধুলো ঝেড়ে বেরোলো বই খাতা, ফাইল পত্র, পেপার, থিসিস। ও বাবা! এসব কি লেখা! এ কি আমারই কাজ! নিজেকেই অচেনা লাগে। তবু বহু ভালবাসায় আবার শুরু নতুন উদ্যমে। আবার একটা একটা করে নতুন রেজাল্ট, নতুন পেপার। ‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না!’ গুণীমহলে কি গ্রাহ্য হবে এই কাজ!

আবার স্বীকৃতি এসেছে একটু একটু করে। CMS এর পরিচিত গণ্ডি ছেড়ে IMS Conference. IIT Hostel – প্রথমবার বাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে থাকার অভিজ্ঞতা। হোক না মাত্র তিনরাত। ছাত্রীজীবনে যে যোগ্যতা অর্জন করতে পারি নি সেই অঙ্কের হাত ধরেই সেই অধিকার প্রাপ্তি। International Journal এর পাতায় জ্বলজ্বল করছে নিজের নাম! একটা প্রোজেক্ট সফলভাবে শেষ করা। অবশ্যই স্যারেদের উৎসাহ আর সহকর্মীর সাহায্য ছাড়া হতো না, তবু নিজের ভালবাসার জোর।

এর মধ্যেও আবার ভিন্ন স্বাদের গল্প। দশবছর প্রযুক্তিবিদ্যার পর এবার পরিসংখ্যায়ন। স্নাতকোত্তরে পড়ানোর অভিজ্ঞতা। প্রথাগত পদ্ধতিতে শুরু করে অতিমারীর অচলাবস্থায় বিকল্প পদ্ধতি।

জানি না কর্মজীবনের শেষপাদে এসে এই নতুন অঙ্ক আমার কোন কাজে লাগবে! কিন্তু কবি তো বলেছেন ‘জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা’! হয়তো এ আমার পরজন্মের পাথেয় সংগ্রহ। হ্যাঁ পরজন্মেও অঙ্ককেই ভালবাসতে চাই – আরোও নিবিড় ভাবে।

কিন্তু আজকে কেন মনের কোণে বেজে উঠছে বিদায়ের সুর! ‘হেথা হোতে যাও পুরাতন, হেথায় নূতনের খেলা আরম্ভ হয়েছে’-

তবু ‘আমি ভালবাসি যারে সেকি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে!’

তাই চিৎকার করে বলব –

‘নূতন আলোয় নূতন অন্ধকারে

লও যদিবা নূতন সিন্ধুপারে,

তবু তুমি সেইতো আমার তুমি

আবার তোমায় চিনব নূতন করে’।।  

P. C. Google Images

Posted in Uncategorized

ভোট দিন, ভোট দিন!!

চারদিকে ভোটের হাওয়া। সবার মনেই কি হয়, কি হয়! আমরা সবাই সচেতন নাগরিক। গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার জন্য সদাই তৈরি – বিশেষ করে সেটা যদি কাজে না হয়ে কথায় হয়। এতদিন শুনতুম ‘ভোট পুজো’ এখন শুনছি ‘খেলা হবে’! সে যা হোক – পরিবর্তন তো মানতেই হবে – ক্ষমতারই হোক কি স্লোগানের!

ছোটবেলায় স্লোগান ছিল –

‘ভোট দেবেন কিসে – কাস্তে ধানের শীষে’,

‘ভোট পাবে কারা – কাস্তে হাতুড়ি তারা’

‘সাম্রাজ্যবাদের একটি ধাপ – গাই বাছুরে মারুন ছাপ’…

আর ছিল – ‘দলে দলে ভোট দিন, হাত চিহ্নে ছাপ দিন’।

ঘাসফুল, পদ্মফুল কিছুই তখন ছিল না, তাই ‘চুপচাপ ফুলে ছাপ’ও শোনা যেত না।

যাই হোক – ফিরি সেই ছোটবেলায় – মানে সেই টালার জমানায়। সকাল থেকে বাবা আর ঠাম্মা ভোট দিতে যাবে, মা বেচারির লিস্টিতে নাম নেই-  সবার আগে আমি তৈরি। সেখানে গিয়ে ঠিক কি হল মনে নেই, তবে সবাই অনেকক্ষণ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে তারপর একবার এঘর একবার ওঘর – আবার এক কোণে একটা ছেঁড়া ছেঁড়া কাপড় না চটের বস্তা – তার আড়ালে একজন একজন করে যাচ্ছে। তার আগে একবার কি সব সইসাবুদ করছে, পরে আবার আঙ্গুলে কালি লাগাচ্ছে – বাবার সঙ্গে গিয়ে দেখলুম ওই কাপড়ের আড়ালে একটা উঁচু টুলের ওপর কি সব কাগজে ছাপছোপ মারা হচ্ছে আবার বেরিয়ে আরেকটা বাক্সে কাগজটা মুড়ে ফেলে দিচ্ছে। কি জানি বাপু কি তোমাদের ভোট দেওয়া। কত করে বললুম বাবার মতো আমার আঙ্গুলেও একটু রঙ লাগিয়ে দাও, কিছুতেই দিলে না! পরের বার – মানে ভোট তো বছর বছর লেগেই আছে, আজ লোকসভা, কাল বিধানসভা, পরশু কর্পোরেশন – লিস্ট মেলাতে এসে বুলিদিদির বাবা বললেন ‘সে কি লিস্টে বৌদির নাম নেই! লিখে নাও’। মায়ের নামও লিস্টিতে উঠে গেল। কেবল আমিই বাদ! তা সেবার ওই বুলিদিদির বাবাই ভোট দিতে গিয়ে আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন না। বললেন ও আমার কাছে বসুক। আমি বলে কি না পাড়ার একটা মাতব্বর, আমায় ঢুকতে দিলে না!!! এমনি অপমান! বুলিদিদির বাবা মোট্টে ভাল না, এমনিই সবসময় আমার পেছনে লাগে!

যাই হোক সময় তো আর থেমে থাকে না। বুলিদিদির বাবা আমায় কতদিন ভোট দেওয়া থেকে আটকাবেন! যেই না আঠারো বছর বয়স হল ভোটার লিস্টএ নাম উঠলো। আর এমনি কপাল সামনেই ভোট। আর আমায় পায় কে! এবার ওই চটের আড়ালেও যেতে পাব আর আঙ্গুলেও কালি লাগাতে পারব। সক্কাল সক্কাল দুপ্পুর দুপ্পুর মা বাবা ঠাম্মা সবাই মিলে ভোট দিতে গেলুম। লাইনে দাঁড়িয়েই আছি – বেশ বোরিং। শুধু প্রথমবার ভোট দেবার উত্তেজনায় চুপ করে আছি! কিন্তু ওই গরমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠাম্মার মাথা ঘুরে গেল। তাড়াতাড়ি সবাই ঠাম্মাকে বসার একটা টুল দিল আর আমায় বলল ‘ওনাকে আর ভোট দিতে হবে না। তুমিই ওনার হয়ে ভোটটা দিয়ে দিয়ো। কি মাসিমা ঠিক আছে তো! কাকে ছাপ মারবে ওকে বলে দেবেন’। ঠাম্মার হাত থেকে তাস বের করা যেমন শক্ত কোন চিহ্নে ছাপ মারতে হবে সেটা জানা তেমনি সোজা। ভোটের দিন চিরকাল বাবার পেছনে ঘ্যান ঘ্যান করেছি বল না কাকে ভোট দিলে? কিছুতেই বলতো না। ঝাঁটা সাইকেল এইরকম যা তা বলে এড়িয়ে যেতো। ঠাম্মার ভোট ছিল open secret. কিন্তু তখন আমি নতুন অধিকার পেয়েছি। একবার ভাবলুম দিই নিজের ইচ্ছেমতো যাকে মনে হচ্ছে! তারপর মনে হল বিশ্বাসের অমর্যাদা মহাপাপ!

তা বাপু আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চিহ্নে ছাপ মেরেছি। হালের NOTAও বাদ যায় নি। কখনও প্রার্থী দেখে, কখনও বন্ধুবান্ধব সহকর্মীদের আলোচনার ফলে। কখনও নিজের মনের কোনও ধারণা থেকে। কিন্তু আমার বাপু খুব সাফ track record.  আজ অবধি এমন কখনও হয় নি যাকে ভোট দিয়েছি সে জিতেছে! এমন কি যিনি সেই আসনের এক্কেবারে গেঁড়ে বসা প্রার্থী – ভেবেছি সেই তো জিতবে, কি লাভ একটা ভোট নষ্ট করে। দেখা গেলো ফলের কোনও অন্যথা হয় নি। আমার record unbroken!

ওদিকে আবার বিভিন্ন লোকের কাছে শুনে শুনে মাথায় বদবুদ্ধিও কম হয় নি। কালির দাগ তোলার জন্যে আঙ্গুলে নেলপালিশ লাগিয়ে গেছি। বাড়ি এসে খুঁটে খুঁটে দাগ তুলেছি। নাহ্‌, ছাপ্পা ভোট দেওয়াটা এখনও হয় নি। আর হয়নি ভোটের ডিউটি করার অভিজ্ঞতা। ভুল বল্লুম কি? কেন সেই কৃষ্ণনগর গভর্মেন্ট কলেজে স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ইলেকশন! সবাই বলল এ হল মিনি – কলেজ যার এরিয়া তার। রীতিমত বোমা-পিস্তল-পেটো নিয়ে ভোটাভুটি হয়। আর সেই ইলেকশনের ডিউটি করতে করতেই বড়দের মুখে শুনেছি কেমন করে তাঁদের লোকসভা-বিধানসভার ভোটের ডিউটি করতে হয়েছে। এমন কি কলেজ ইলেকশনে ঘেরাও হতে হয়েছে, ছাত্রদের দু পকেট থেকে দুটো বন্দুকের নলের খোঁচা খেতে হয়েছে। আমি অবশ্য নতুন গিয়েই কলেজে চত্তরে নাম করে ফেলেছি – ‘লেডি হিটলার’। শুনেছি ইউনিয়নের বাঘা বাঘা ছেলেরা আমায় কি জানি কেন সমঝে চলে আর পরীক্ষার গার্ড টার্ডও যাতে আমি একটু ইয়ে করে দিই আর কি সিনিয়ারদের কাছে আবেদন করে – ‘ম্যাডামকে একটু বলুন না!’ আমি চুপচাপ শুনি আর মনে মনে মুচকি হাসি। ভাগ্যিস্‌, বড় ইলেকশনের ডিউটি পড়লেই হয়েছিল আর কি!

আর সেই সেবার – কলেজে রোজই গরম গরম আলোচনা। কোন কেন্দ্রে কে প্রার্থী। কে ভাল কাজ করে, ক্ষমতায় কার আসা ভাল, জনগণের জন্যে কে ভাবে! পরিবর্তনের হিড়িকে ঠিক করেছি অমুক দলকেই ভোট দেবো। যত বলি ওগো শুনছো, অমুক প্রার্থী ভাল বলছে সবাই! বললেই বলে আমার কি দরকার বাপু। কাউকেই চিনি না। চিহ্ন দেখে বোতাম টিপে দেবোখন। একে তো লিস্টিতে নাম খুঁজে পাওয়া যায় না। তারপর শুনি সোসাইটিতে একেজনের একেক জায়গায় সেন্টার – খুঁজে পাওয়াই দায়। এদিকে আমার উৎসাহের শেষ নেই। সেই অনেক খুঁজে খুঁজে দেখি নানিকাকিমাদের বাড়ি যাবার পথেই একটা ছোট গলি, যেটায় ঢুকিয়ে রোজ গাড়ি ঘোরাই আর ভাবি বুঝি blind lane, তার মধ্যে দিয়ে গিয়ে  পেছনে চওড়া রাস্তা, বিরাট ইস্কুল! সেখানে আছে আমাদের নাম। গিয়ে বলি ভোটার কার্ড নেই বাপু। তোমাদের আপিসেই জমা আছে। এই ড্রাইভিং লাইসেন্স দিচ্ছি ছবি মিলিয়ে দেখে নাও। কর্তা লাইনের আগে, আমি পেছনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করি দরজার গায়ে লাগা লিস্টি পড়ছি – অন্ততঃ দেখি তো যাকে ভোট দেবো তার নামটা কি! ওমা! দলের তো নামও নেই, চিহ্নও নেই! এমন কি একটা চিহ্নও চেনা নয়! কি ব্যাপার। আরে যে লোকসভা কেন্দ্র ভেবে শিখে পড়ে এসেছি আমাদের সেই কেন্দ্রই নয়! এদিকে কর্তামশাই তো দেবনাগরী দেখলেই ‘তারে জমিন্‌ পর’ – পড়ে দিতে দোভাষী লাগে। অতঃ কিম্‌ ভাবব বলে ভাবার আগেই ভেতর থেকে চিৎকার – কি গো এতো চিহ্নই দেখতে পাচ্ছি না! আরে ঢুকে যখন পড়েছ যা হোক একটা বোতাম টিপে দাও না বাপু!

 আরে ওই ভোটার লিস্টে নাম ওঠার গপ্পোটা তো বলাই হল না! মারাঠীরা ভীষন সচেতন নাগরিক। কলেজে সবসময় current affairs নিয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা চলছে। তার সঙ্গে ‘আপ কে উধার…’ শুনে শুনে কানে তালা ধরার উপক্রম। বাড়ি এসে মাঝে মাঝে বলি দেখ না ভোটার লিস্টে নাম ওঠে কিনা। কর্তামশাই বলেন ছাড়ো তো কাউকে চিনি না, কোথায় ফর্ম, কোথায় জমা – অফিসের কাজ সামলাবো, না ওই করব! তুমি পারো তো ব্যবস্থা করো। জো হুকুম। ধাড়িয়াল আন্টি বাড়িতেই ফর্ম এনে দিলেন। ওই সামনে ভোট, লিস্ট update চলছে। সোসাইটিতে তখন আমরা অনেকে নতুন এসেছি। ফর্ম কোথায় জমা দিতে হবে তাও বলে দিয়েছেন। ওইতো ছেলেদের আঁকার ইস্কুলের পাশেই। এবার তো ফর্ম জমা করো। ছবি ওয়ালা নতুন ভোটার কার্ড করাতেই হবে সরকার বলে দিয়েছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে তিনি তো ফর্ম ভরলেন, জমাও দিলেন। ওমা ভোট এসে গেল সবার বাড়ি বাড়ি স্লিপ চলে এল আমাদের তো এল না! ছেলের জন্মদিনে নেমন্তন্ন এসে অমৃতা বলল ‘এই নিন দাদা আপনার স্লিপ। নাম দেখে আমাদের বাড়ি দিয়ে গেছে। বাবার নামে মেসোমশায়ের নাম দেখে বুঝলুম এটা আসলে আপনার’। আসলে দুই বাড়ির কর্তার নামই এক। এদিকে ভোটের দিন এসে গেল আমার স্লিপের দেখা নেই। একে তো আমারই উৎসাহ বেশি। আর তাছাড়া কলেজে গিয়ে দেখাতে হবে আমিও অধিকার প্রয়োগ করেছি! সকাল থেকে মুখ শুকিয়ে বসে আছি। কর্তামশাই বললেন আচ্ছা চল দেখি। ভোটের বুথের সামনে বিশাল ভিড়। সবেধন স্লিপটা দেখিয়ে বলছি একটু দেখুন না আমার নামটা উঠেছে কিনা! এই দেখুন এই স্লিপের আগে পরেই হবে নিশ্চয়। দেখি একজন চেঁচাচ্ছে আমায় দেখে – ‘বাসি’ ‘বাসি’। কি বলে রে বাবা! বাসি পচা হোতে যাব কেন! লিস্ট দেখায় এই তো তোমার নাম – ‘চন্দ্রানী নওলকিশোর বাসি’ তো! ছবিটা তো আমারই বটে! ও হরি, এইবার বুঝেছি! ওই যে তিনি তাড়াহুড়ো করে ফর্ম ভরেছিলেন – ‘Basu’ ‘Basi’  হয়ে গেছেন। আর মারাঠিরা মুখে যতই বড় বড় বুলি আওড়াক, আদপে তারা মোটেই বড় হয় নি, একলা চলতেও শেখে নি। আমরা বাঙ্গালিরা যে জন্মেই স্বাধীন সে ওদের বোধের বাইরে। তাই নিজেদের ইচ্ছেমতো নামের পাশে বাবার নাম জুড়ে দিয়েছে! হায় রে জিজামাতার অবোধ সন্তানের দল, বাবার নামটাও পুরো লিখলিনা আর শ্বশুরবাড়ির গোত্রটাও দিলি পাল্টে! যাহোক ওই ‘বাসি’ হয়েই টাটকা ভোট দিয়ে রঙ লাগা আঙ্গুল তুলে বিজয়িনীর মতো বাড়ি ফিরলাম।

P.C. Google images