Posted in Reflections

জিজ্ঞাসুর এক বছর

দেখতে দেখতে হৈ হৈ করে একটা বছর পার হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এই তো সেই দিন। নিজের দুশ্চিন্তার পাহাড়ে পুরোপুরি বিধ্বস্ত; রাতের ঘুম চোখ থেকে উধাও। দিনের বেলাও ‘দিন কাটে না’। সারাদিন শুয়ে শুয়ে বোকাবাক্সে একই সিরিয়ালের একই পর্ব দেখে চলেছি। রোজই সেই একই জিনিস। আসলে নিজের মুখোমুখি হতেই ভয়। এই বুঝি আবার গ্রাস করলো দুশ্চিন্তা। মূঢ়তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ যাকে বলে। এদিকে আবার বিবেক দংশনও হয়। কি করছি!

বই পড়তে যাই – দু চার লাইনের বেশি এগোয় না। অত যে প্রিয় শরদিন্দু সেও না। আচ্ছা শরদিন্দু না হয় সাধুভাষা, কিন্তু অন্য বই! লীলা মজুমদার, নবনীতা দেবসেন! নাহ্‌, তাও ভাল লাগে না। চেষ্টা যে করছি না তা নয়। তার সঙ্গে ইস্কুলের দাওয়াই – প্রার্থনা। হচ্ছে না!

কিসের দুশ্চিন্তা এত! বোঝাতে পারি না কাউকেই। নিজেকেই কি বোঝাতে পারি! আমাদের মস্ত বড় ভরসার জায়গা এই ‘পবিত্র শিশুপাল’ – অক্সিজেন সিলিণ্ডার না, যেন পুরো একটা অক্সিজেনের প্ল্যাণ্ট। কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই। দেখি সব বন্ধুই কম বেশি সেই আমার মতই ‘মন খারাপ’এর শিকার। কেউ বলল ‘Mid-life crisis’, ‘Separation anxiety’, ‘Hormonal change’, দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধি। বেশির ভাগেরই ছেলে মেয়ে বাইরে পড়তে চলে গেছে। তা পাখীর ছানা বড় হলে ডানা মেলে তো উড়বেই।  তার ওপর এই করোনার ছোবল। অনেকেই অনেক কাছের মানুষকে হারিয়ে দিশাহারা। কাজেই অক্সিজেন প্ল্যাণ্টও যথেষ্ট অক্সিজেন দিতে পারছে না। দেবে কি করে – কাঁচামালেই যে টান! কে কাকে উৎসাহ জোগায়! উলটে চারিদিকের এত ডিপ্রেসন যে কারুর সঙ্গে কথা বলতেই ভয় হয়। মন ভাল হবার বদলে আরও খারাপ হয়ে যায়।

নাহ্‌, এভাবে চলতে পারে না। কেন ভগবদ্গীতার ৬.৫ ভুলে গেলে!

উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ।

আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ॥

নিজেই নিজেকে উদ্ধার করতে হবে। তা নিজে করলেও সঙ্গীসাথী সঙ্গে থাকলে তো মন্দ হয় না। ওই বন্ধুদেরই শরণাপন্ন হলুম। সারাদিন ওই এক গাছ-ফুল, পোষাক-আশাক, রান্না রেসিপি, ঘোরা-বেড়ানো, পরচর্চা আর না হলেই সেই পরীক্ষার রেসাল্ট, এ ফার্স্ট ও লাস্ট। আরে বাবা কেউ না কেউ তো ফার্স্ট হবেই! চেনা নেই শোনা নেই তার রেসাল্ট জেনে আমি নিজের টেনশন বাড়াই কেন!

দুচারজনকে পাকড়াই। চল না অন্ততঃ একটা দিন একটা ঘন্টা একসঙ্গে কোনোও একটা বই পড়া শুরু করি? তা কিছু সঙ্গী জুটে যায়– সকব’র ভাষায় মুর্গী। কিন্তু কি বই পড়া যাবে? আরে আজ না রামনবমী? তা আদিকাব্য রামায়ণ দিয়েই শুরু করা যাক না! যতই সেই ছোটবেলা থেকে রামায়ণ শুনে বড় হই না কেন, রামায়ণের অনেক কিছু না জানা, না বোঝা, ভুল বোঝা রয়ে গেছে। আর অনেক প্রশ্নও। কেউ কেউ বলে তাই বলে রামজীর নিন্দা কিন্তু শুনতে পারব না! নিন্দা কেন হবে! দেখা যাক না যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে, হয়তো তাতে রামচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েও যেতে পারে। অন্ধ বিশ্বাস নয় – যুক্তিগ্রাহ্য শ্রদ্ধা। ভগবান রাম নন, মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম – শ্রেষ্ঠ মানুষ যিনি। যাঁকে দেখে নিজেদের জীবনটাকেও একটু tune করে নেওয়া যায়। শ্রদ্ধেয়া মুক্তিপ্রাণা মাতাজীর ‘রামায়ণ প্রসঙ্গ’ বইটা বাড়িতেই ছিল। এরকম কত বই যে কেনা আছে, কবে পড়া হবে জানা নেই! ছোট বই। শুরুটা ছোটই ভাল। আগে দেখা তো যাক পরীক্ষা কতটা সফল হয়!

দিদিমণি, বড়দিমণি, স্বরূদি, Master Chef, আর সঙ্গে সোমা – ছোট থেকে আমার মাথার সব উদ্ভট খেয়াল যে বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছে। আর এসেছে সেই আরেকজন! সেই সকব’র কথায় অসুস্থ বলে যাকে দেখতে তার বাড়ি গিয়েই কাল হয়েছে। বইএর আলমারীতে রাখা ভগবৎগীতার বই দেখেই পাগলীর মাথার পোকা নড়ে উঠেছে আর ‘খপাৎ খপাৎ’ করে ছেলেধরার মত মুর্গী ধরে ছোটু তার পাঠশালা ভর্তি করছে।  

জিজ্ঞাসুর প্রথম দিন সকব’র প্রতিক্রিয়া

তা জয়া ছাড়া কি বিজয়া থাকতে পারে!জয়াদিদিমণিও এসেছে। নবাংকুরের বাকিরা ইস্কুল অফিস নিয়ে ব্যস্ত, কাজেই তাদের ছাড় দিতেই হয়। এসেছে পরম পূজনীয় মহারাজের বড় আদরের ‘দিদি’। এসেছে সাড়ে বারো আর পিটিম্যামও। মুখপুস্তিকায় জীবনজিজ্ঞাসা ভরা পোস্ট দেখে লায়লাকেও ডেকে নিলুম দলে। বাকি পবিত্র শিশুপালেরা কেউ কেউ ‘এ রসে বঞ্চিত’ আর কেউ কেউ ‘কাজের মানুষ’। তাই ইচ্ছে থাকলেও তাদের উপায় নেই। প্রথম দিনে বই পড়া জমলো ভালই। আর উৎসাহরও শেষ নেই সবার মনে। তক্ষুণি হোয়াটস্‌আপে গ্রুপ তৈরী হয়ে গেল। তার বেশ গালভরা নাম – জিজ্ঞাসু।

সেই তো শুরু হল যাত্রা। এই যাত্রার শুরুতেই পেয়েছি পুজনীয় বিমোক্ষানন্দজী মহারাজের আশীর্বাদ। আমাদের উৎসাহ দেখে মহারাজ নিজে থেকেই এই বইটা কিনে একদিন আমাদের সঙ্গে রামায়ণের ওপর আলোচনা করতেও রাজী হয়ে যান। ওনার এই অযাচিত কৃপায় আমরা আপ্লুত। তবে কেউ কেউ একটু যেন আড়ষ্ট। কখনও এমন সামনাসামনি কোনো সাধুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার অভিজ্ঞতা নেই তো! কিন্তু মহারাজের এই আসার জন্যে আমাদের অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। একাধিকবার সব ঠিকঠাক হয়েও শেষ মুহুর্তে মিটিং বানচাল হয়ে গেছে। তখন মনে হয়েছে শ্রীরামচন্দ্র বুঝি আমাদের এইসব অর্বাচীনের মত প্রশ্নে কুপিত হয়েছেন।

ইতিমধ্যে আমাদের সাপ্তাহিক একদিনের ক্লাস বেড়ে দুদিন তারপর চারদিন, সোম থেকে বৃহস্পতি হয়েছে। আবার কখনও কখনও তাতেও হয় না। শুক্রবারেও হাত পড়ে। তারপর শুরু হয়েছে একাদশী উপলক্ষ্যে ‘রামনাম সংকীর্তন’। যত আমি রামচন্দ্রকে ‘মোট্টে পছন্দ করতুম না’ তত যেন রামচন্দ্র জড়িয়ে ধরেন আমায়! আর সেই দেখে নির্ঘাৎ সেই দাড়িওয়ালা ‘পেরবীন’ মানুষটিও মুখ টিপে টিপে হাসেন। ভাবেন ‘কেমন জব্দ’!

অবশ্য তাঁর সঙ্গে আরেকজনও হাসেন – উদ্দাত্ত কণ্ঠে ‘হা হা’ করে, যিনি ওই দাড়িওয়ালা পেরবীনকে বলেন ‘দোস্ত’! সেই ‘দোস্ত’কে জানতে গেলে তো তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্যকে পড়তে, জানতে, বুঝতে হবেই! ‘ভাষ্য’ না পড়লে কি ‘সূত্র’ বোঝা যায়! আর শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত তো নবযুগের ‘বেদ’। সেই বেদ জানতে গেলে স্বামীজীর লেখা তো পড়তেই হয়। আর সবাই মিলে একসঙ্গে ঝাঁপ দিলে ঠিক সাঁতরে পার হওয়া যাবে। একেই অন্যকে টেনে নিয়ে যাবে। নইলে বন্ধু কিসে!

আমাদের এমন অবস্থা, যে বই পড়তে যাই, হয় কিছুই বুঝি না, নয় অনেক প্রশ্ন। কাউকে তো চাই যাঁর কাছে এইসবের উত্তর পাওয়া যাবে। ভাষ্য বোঝার জন্যেও যেমন চাই টিকা, আমাদেরও তেমনি মহারাজদের ব্যাখ্যা বোঝার জন্যে আরও কোনো ব্যাখ্যাকার চাই। আমাদের স্তরে নেমে এসে যিনি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। একা SwV মাসের ওই একটা ক্লাসে আর কত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন! তাছাড়া অনেক সময় ওনার অন্য অসুবিধেও থাকে, ক্লাস নিতে পারেন না। এদিকে আমাদের প্রশ্নের পাহাড় তো ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে।

বিল্লু তো চিরকালই আমার মুশকিল আসান। বলল SwS কে জিজ্ঞেস করব? সে হলে তো খুব ভালই হয়। রাজিও হয়ে যান মহারাজ। ঠিক হয় মাসে দুদিন করে ক্লাস নেবেন মহারাজ। তা স্বামীজী কে দিয়েই শুরু করা যাক। কারণ স্বামীজীর লেখা পড়তে গিয়ে আমাদের শুধুই হোঁচট খেতে হচ্ছে। দুজন মহারাজ এক্কেবারে দুই মেরুর  – SwV যত ধীর স্থির, আসতে আসতে এগোন। যেকোনো জিনিসের একেবারে মূল থেকে শুরু করেন আর যতক্ষণ না সবার বোঝা হচ্ছে পরের বিষয়ে যান না, SwS-এর যেন তত তাড়া। থেকে থেকেই করুণ স্বরে বলতে হয় মহারাজ একটু সবুর করুন। ছোট মহারাজ প্রথমেই ডিক্রি জারি করে দিলেন systematically না পড়লে কিস্যু হবে নি। আর ঠাকুর-মা-স্বামীজীকে ঠিকমতো বুঝতে হলে একটু শাস্ত্র অন্ততঃ প্রকরণ গ্রন্থ পড়তেই হবে। আর সে সব উনি ইতিমধ্যেই অন্য জায়গায় পড়িয়ে ফেলেছেন। কাজেই সেসব বক্তৃতা শুনেই নিজেদের শিখে নিতে হবে।

সেই শুরু হল আরেক পর্ব। নিজেরা নিজেরা YouTube video দেখে বোঝার চেষ্টা। তবে ‘তত্ত্ববোধ’ জিজ্ঞাসুর বোধশক্তি বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে। আজকাল নিজেরা বই পড়তে গেলে মনে হয় শব্দগুলো যেন চেনা চেনা। আর না চেনা হলেও কুছ পরোয়া নেহি! মহারাজ তো আছেন পড়া বুঝিয়ে দেবার জন্যে। আর এমন মজার কাণ্ড – আমরা যখন যে পড়াটা পড়ি দেখি সব বইএর বিষয়গুলো কেমন এক! এ বাপু ওই ‘দাড়িওয়ালা’র কারসাজি ছাড়া কি!

এদিকে এত শক্ত শক্ত পড়ার ভয়ে পাঠশালা থেকে রোজই ছাত্রী পালায়। ছোটুর খপাৎ খপাৎ আর কোনওই কাজে আসে না। ফ্যাল ফ্যাল করে দেখে ছোটু – দুরুদুরু বুকে। শেষকালে এমন সাধের পাঠশালা উঠে যাবে না তো! ছোটু তাহলে বাঁচবে কি নিয়ে? এই যে রোজ সকাল থেকে ছোটুর ব্যস্ততা, আর এই যে নিয়মিত পড়ার বাইরে প্রায়শঃই বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান! কত নতুন নতুন গল্প, গান, স্তোত্র শোনা, পাঠশালা ছুটি হয়ে যাবার পরও আরও কতক্ষণ আড্ডা – এগুলোই তো ছোটুর আসল অক্সিজেন। আর একা ছোটুই বা বলি কেন, আফিঙ্গের মৌতাতে তো আরও অনেক ময়ূরই মজেছে।

ভরসা একটাই ওপর থেকে যিনি সব কলকাঠি নাড়ছেন, মহারাজদের মধ্যে দিয়ে যাঁর কৃপা জিজ্ঞাসুর ওপর ঝরে পড়ছে, প্রথম জন্মদিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের সব বিশেষ বন্দোবস্তও আসলে যিনি করছেন তিনিই টেনে নিয়ে যাবেন এই জিজ্ঞাসু – এটাই আশা, এটাই ভরসা আর এটাই প্রার্থনা।

Posted in Reflections

তব কথামৃতম্‌

তব কথামৃতং তপ্তজীবনং, কবিভিরীড়িতং কল্মষাপহম্‌।

শ্রবণমঙ্গলং শ্রীমদাততং, ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ।।

[গোপীগীতা, রাসপঞ্চাধ্যায়]

শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের একত্রিংশতি অধ্যায়ের নবম শ্লোক – বৈষ্ণবভক্তদের মধ্যে তো বটেই কিন্তু আজ সমধিক প্রচলিত ও প্রসারিত শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমণ্ডলীর কাছে। রামকৃষ্ণ ভাবাশ্রয়ীদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই ‘শ্রীম’, তাঁর রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রথমেই এই শ্লোকটির উল্লেখ করেছেন। রচনার মঙ্গলাচরণ করেছেন এই শ্লোক দিয়েই। আর আমরাও তোতাপাখীর বাঁধা বুলির মত কথামৃত পড়ার আগে এইটি আউড়ে যাই। কিন্তু সত্যিই কি ভেবে দেখেছি এই কথাগুলোর কি তাৎপর্য!

কথা মানে শুধুই কি ‘বাণী’? কথার তো আরেকটা মানে হয় গল্প বা আখ্যান। আসুন না ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের বাণীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনের আখ্যানের নিরিখে একটু আলোচনা করা যাক এই শ্লোকের মর্মার্থ।

কথামৃতকার মাস্টারমশাই ঠাকুরের ‘কথা’ কে শুধু ‘কথা’ বলেই ক্ষান্ত হন নি – বলেছেন ‘কথামৃত’। এই অমৃত জীবনদায়ী। কিন্তু কার কাছে? উত্তর!

১) তপ্তজীবনম্‌ –

সংসারের তাপে দগ্ধ ক্লান্ত মানুষ যখন দুঃখে কষ্টে মুহ্যমান – মনে করে আর কেন! শেষ করে দিই জীবনটা তখন ঠাকুরের কথা, ঠাকুরের জীবন নতুন করে তাদের বাঁচার রসদ জোগায়। বিশ্বাস না হলে স্বয়ং কথামৃতকারের জীবনের দিকেই একবার ফিরে তাকান না! জীবনের প্রতি হতশ্রদ্ধ মাস্টারমশাই তখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন কলকাতার কাছাকাছি এ বাগান, সে বাগান – জীবনটা মনের মত চলছে না, কিন্তু জীবনের ইতি টানার জায়গাটা তো মনের মত খোঁজা যায়! ঘুরতে ঘুরতেই এসে পড়লেন ‘রাসমণির বাগানে’। প্রথম দর্শনেই ঠাকুরকে দেখে তাঁর মনে হল ‘সাক্ষাৎ শুকদেব ভাগবৎ-কথা কহিতেছেন, আর সর্বতীর্থের সমাগম হইয়াছে। অথবা যেন শ্রীচৈতন্য পুরীক্ষেত্রে রামানন্দ স্বরূপাদি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন ও ভগবানের নামগুণকীর্তন করিতেছেন’। সেই পরিচয় ঠাকুরের সঙ্গে। সম্পূর্ণ বদল হয়ে গেল একটা জীবন। ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের কথাকার হয়ে গেলেন অমর।

ঠাকুরের অন্তরঙ্গ দলের শেষ সদস্য – ঈশ্বরকোটি তিনি – পূর্ণ তাঁর নাম। সংসারের জ্বালায় জর্জরিত। ঠিক করলেন এবার শেষ করে দিতে হবে এই জীবনটাকে। প্রস্তুত হয়ে ভাবলেন শেষবারের মত একটু ঠাকুরের কথা পড়ে নি। সেই চিন্তা করতে করতে পাড়ি দেওয়া যাবে পরপারে। কথামৃত হাতে নিয়ে অমনিই উল্টোলেন পাতা। দেখেন লেখা রয়েছে, ‘পূর্ণের বয়স পনর হইবে। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন’। ব্যস্‌, মনের মধ্যে ওঠে নতুন তরঙ্গ – ‘ঠাকুর সবসময় আমার মঙ্গল চিন্তা করেন! আর সেই আমি নিজের জীবন শেষ করার কথা ভাবছি!’ মৃত্যুচিন্তা মুছে গেল মন থেকে।

আদরের কন্যাটিকে হারিয়ে ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত জীবনের মানে খুঁজে পান না। যে মেয়ে এই ছিল এক লহমায় সে নেই হয়ে গেল! অস্থির মনে একদিন গিয়ে পড়েন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে। দুপুর থেকে সন্ধ্যে গড়িয়ে যায় কথায় কথায়। বাড়ি ফেরেন রাম দত্ত – যেন এক নতুন মানুষ।

শোকাতুরা বিধবা ব্রাহ্মণী হারিয়েছেন তাঁর একমাত্র মেয়েটিকেও। ঠাকুরের ঘরের বাইরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনেন ঘরের ভেতরের কথা। সেই কথাই শেষ পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয় তাঁর সে শোক। খুঁজে পান বেঁচে থাকার নতুন দিশা।

ঠাকুর আমাদের বালক স্বভাব। যেখানে যা নতুন কিছু শোনেন তাই দেখতে ছোটেন। নইলে কেউ কোনদিন শুনেছে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী থিয়েটার দেখতে যান! ‘নিমাই সন্ন্যাস’ পালা। দেখে বললেন ‘আসল নকল এক বোধ হল’। পালটে গেলো বিনোদিনী সহ আরও সব নটীদের জীবন। অমৃতের সন্ধান পেলেন তাঁরা। শুদ্ধতার মূর্তরূপ ঠাকুর যিনি এতটুকু অশুদ্ধ সহ্য করতে পারতেন না, সাহেবরূপী ছদ্মবেশী তারাসুন্দরীকে কৃপা করলেন – কোথায়? সেও সেই কাশীপুরে, শেষ অসুখের সময়। বারাঙ্গনা নটীদের তাপিত চিত শীতল হল সেই অমৃতের পরশে।

২) কবিভিরীড়িতম্‌ –

কবি অর্থাৎ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি, জ্ঞানী যাঁরা, তাঁরা প্রশংসা করেন যাঁর, হয়ে যান সেই অমৃতের ভাগী। সে তো সেই শুরুর কাল থেকেই। ভৈরবী ব্রাহ্মণীর উৎসাহে মথুরবাবুর ব্যবস্থাপনায় বৈষ্ণবচরণ সহ বড় বড় পণ্ডিতেরা আসেন তর্কসভায় ঠাকুরের অবতারত্ব প্রমাণ করতে। ইঁদেশের গৌরী পণ্ডিত সেদিন ছিলেন না। পরে এসে তিনি ঠাকুরকে বলেন, ‘বৈষ্ণবচরণ আপনাকে অবতার বলে? তবে তো ছোট কথা বলে। আমার ধারণা, যাঁহার অংশ হইতে যুগে যুগে অবতারেরা লোক-কল্যাণসাধনে জগতে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাঁহার শক্তিতে তাঁহারা ঐ কার্য সাধন করেন, আপনি তিনিই!’  বালক স্বভাব ঠাকুর বলেন, ‘কে জানে বাবু, আমি তো কিছু জানি না’।

পশ্চিমদেশ থেকে আসা দার্শনিক পণ্ডিত নারায়ণ শাস্ত্রী – তিনি ঠাকুরের মধ্যে ‘শাস্ত্রের সূক্ষ্ম বিষয় সমূহ উপলব্ধ’ লক্ষ্য করেছিলেন। তাই নবদ্বীপ থেকে নব্যন্যায়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করে ফেরার পথে আবার আসেন দক্ষিণেশ্বরে। জেদ ধরে শেষ পর্যন্ত ঠাকুরের কাছে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ঠিক চিনেছিলেন ঠাকুরকে।

সে সময়ের বিদগ্ধ বক্তা শ্রী কেশব চন্দ্র সেন। স্বয়ং ইংল্যাণ্ডের রাণী যাঁর বক্তৃতা শুনতে আগ্রহী, তিনি সময় পেলেই ছুটে আসেন ঠাকুরের কথা শুনতে। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনিই প্রথম প্রচার করলেন ঠাকুরের কথা। সেই লেখা পড়েই সে সময়ের কলকাতার বড় বড় বিদ্বান-বুদ্ধিজীবী থেকে কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা একে একে আসতে শুরু করল ঠাকুরের কাছে।

রামচন্দ্র দত্ত ঠাকুরের বাণী প্রচার করতে লাগলেন পুস্তিকার আকারে, বক্তৃতার মাধ্যমে। নাট্যাচার্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর বিভিন্ন নাটকে ঠাকুরেরই ভাব, তাঁরই কথা প্রচার করলেন। তিনি বলতেন ‘নাটক লিখতে তিনিই শিখিয়েছেন’।

স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলার পর বলেন ‘আজ একটি নতুন কথা শিখলাম ‘।

৩) কল্মষাপহম্‌ –

ঠাকুরের কথামৃত মানুষের দেহ-মন থেকে কালিমা-কলুষ দূর করে দেয়।

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ নিজের সম্বন্ধে বলতেন তিনি নাকি এত পাপ করেছেন যে তিনি যেখানে দাঁড়ান সেখানে মাটি সাত হাত নিচে নেমে যায়। ঠাকুরের পবিত্র পরশে সেই গিরিশ চন্দ্র হয়ে উঠলেন ‘ভক্ত ভৈরব’। ঠাকুরের কৃপা স্পর্শে তিনি মনে করতেন তিনি গঙ্গাস্নান করলে মা গঙ্গা তাঁর পাবনী শক্তি ফিরে পাবেন।

সেই রকমই অপরিচিত জনৈক ভক্ত একদিন দক্ষিণেশ্বরে এসে ঠাকুরের ঘরের দরজার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। নিজেকে মনে করেন ক্ষমাহীন পাপী। বাইরে থেকেই ঠাকুরের কথা শোনেন আর চোখের জল ফেলেন। পরম কারুণিক ঠাকুর নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসেন তাকে। বলেন, ‘বল, আমি মাদুর্গার ছেলে। আমার কোনও পাপ নেই! আর আজ থেকে আর কোনও পাপ কর্ম কোরো না’। ব্যস্‌, তুমি শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত – এত সহজ!

কালীপদ ঘোষ, সুরেশ মিত্র আকণ্ঠ মদ্যপানে মাতাল। ঠাকুর একবারও বললেন না তাঁদের মদ খাওয়া ছাড়তে। শুধু বললেন মা কালীকে নিবেদন করে খেতে। মায়ের ছেলে মাকে কি খারাপ জিনিস দিতে পারেন! ধীরে ধীরে দুজনেরই মনের পরিবর্তন হতে দেখা যায়। একসময় সুরেশ মিত্র হয়ে ওঠেন ঠাকুরের অন্যতম রসদদার। তিনি না থাকলে আমরা আজ এই রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ পেতুম কি!

ঠাকুর ও মা মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। একটি ভক্ত মেয়ে হঠাৎ বেশ কিছুদিন মায়ের কাছে আসে না। করুণাময়ী জননী খবর নিতে পাঠান। শোনেন সে এগজিমা রোগে আক্রান্ত তাই মায়ের কাছে আসতে পারে না। ডেকে পাঠালেন তাকে। ঠাকুরের চরণামৃত দিয়ে রোজ দু ফোঁটা করে খেতে বলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই সেই মেয়েটি রোগমুক্ত হয়ে ওঠে।

মদ্যপ পদ্মলোচন – গভীর রাতে তার মাতলামিতে অতিষ্ঠ সবাই। সে কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়েই গান শুরু করে মায়ের ঘরের বন্ধ জানলার দিকে চেয়ে। ‘ওঠ গো করুণাময়ী, খোলো গো কুঠির দ্বার’। ভক্তের সে ডাকে জননী কি সাড়া না দিয়ে পারেন! খুলে যায় মায়ের ঘরের জানলা। দূর থেকেই মা কে দেখে চলে যায় সে। রাস্তার মাঝেই পড়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কিন্তু করুণাময়ী যার সহায় তার আর চিন্তা কিসের! মা বলেন পদ্মলোচনকে ঠাকুর এসে নিয়ে গেছেন।

পরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দ ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছেছেন রাজস্থানের খেতড়িতে। রাজ অতিথির মনোরঞ্জনের জন্যে রাজা গানের আসর বসান। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, একজন বাঈজীর গান শুনবেন!আসর ছেড়ে উঠে যান স্বামীজী। ঘর থেকে শুনতে পান ভেসে আসছে যমুনা বাঈএর সেই বুকফাটা আর্তি – ‘প্রভু মেরে অবগুণ চিৎ না ধরো। সমদর্শী হ্যায় নাম তোহারো চাহে পার করো’। ঘোর ভাঙ্গে স্বামীজীর। কি একজন মানুষকে ঘৃণা করছেন তিনি! তিনি না সন্ন্যাসী! সেই মহান সন্ন্যাসীর দর্শনেই পালটে গেল যমুনা বাঈএর জীবনও। এরপর বাকি জীবন তিনি এক ছোট্ট কুটিয়ায় থাকতেন আর গান শোনাতেন শুধুমাত্র তাঁর কৃষ্ণ ভগবানকে।

৪) শ্রবণমঙ্গলম্‌ –

শ্রীম বলতেন ঠাকুরের সব কথাই মন্ত্র। যা ত্রাণ করে তাই তো মন্ত্র। সেই মন্ত্র সব সময়ই মঙ্গলপ্রদ। তবু তারও মধ্যে থেকে যদি বিশেষ কোনো আখ্যান বলতে হয় তবে সেই মাস্টার মশাইকে দিয়েই শুরু করতে হয়। সেই সে শুরুর দিনের কথা। তখনকার দিনের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ পাস মাস্টারমশাই এক গরীব নিরক্ষর পূজারি ব্রাহ্মণের কাছে সেই প্রথম দিনেই শুনলেন ‘এককে জানার নাম জ্ঞান আর বহুকে জানার নাম অজ্ঞান’। জানলেন ‘নিরাকারও সত্য আবার সাকারও সত্য’। শুনলেন, জানলেন ‘মানব জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ’।

ঘর ভর্তি লোক; বৈষ্ণবদের সম্বন্ধে বলতে বলতে ঠাকুর ভাবস্থ। বললেন, ‘জীবকে দয়া করার তুই কে? দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীব সেবা’। সেদিনের সেই এক ঘর ভক্তের মাঝে এক কলেজে পড়ুয়া ছেলে নরেন্দ্রনাথের প্রাণে বাজলো সে কথা। বললেন ‘যদি কোনওদিন সুযোগ হয় আজ যা শুনলুম তা কাজে করে দেখাবো’। উত্তরকালে সেই আদর্শই জন্ম দিল ‘রামকৃষ্ণ মিশন’।

নিরাকারবাদী কেশব সেন, ব্রাহ্মনেতা। ঠাকুরের প্রভাবে ধীরে ধীরে মানতে আরম্ভ করলেন ব্রহ্মের শক্তি – মা কালী। পরিবর্তন হল তাঁর মত প্রভাবশালী মানুষের জীবন দর্শন।

যুবক ভক্ত যোগীন্দ্র। প্রশ্ন করে বসে ঠাকুরকে ‘কাম যায় কি করে?’ ঠাকুরের সহজ দাওয়াই – ‘হাততালি দিয়ে হরিনাম করলেই কাম যাবে’। এত সহজ! বিশ্বাস হয় না যোগীন্দ্রের। তারপর ভাবে ঠাকুর যখন বলছেন একবার করেই দেখা যাক। কি আশ্চর্য! কিছুদিনের মধ্যে সত্যি সত্যিই মিলে গেল ঠাকুরের কথা, ফল পেলেন হাতে নাতে।

পরম আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ কৃষ্ণকিশোর। দেওঘরে গিয়ে জলতেষ্টায় কাতর। জল তুলছিল সে এক মুচি। ব্রাহ্মণ বললেন ‘বল শিব। তুই শুদ্ধ’। নির্দ্বিধায় খেলেন সেই ‘মুচির হাতের জল’। ঠাকুরের মুখে শোনা এ ঘটনারই পরবর্তী ধাপ মায়ের কথা – ভক্তের কোনো জাত হয় না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই তো সেই সমন্বয়ের বাণী!

বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক গরীব বিধবা বধূ শ্রীশ্রীমা। তীর্থে গেছেন দক্ষিণ ভারত। মায়ের অমোঘ আকর্ষণে ব্যাঙ্গালোরে আশ্রমে উপচে পড়া ভক্তের ভিড়। সবাই মায়ের কথা শুনতে চায়। কিন্তু কেউ তো কারুর ভাষা জানেন না। কুছ পরোয়া নেই। নীরবতাই যেখানে অন্তরের ভাষা সেখানে শব্দও কম পড়ে যায়। সেদিন সব ভক্ত বাড়ি ফিরেছিলেন মনের মধ্যে পরম পরিতৃপ্তি নিয়ে।

৫) শ্রীমদ্‌ আততম্‌ –

শ্রীমৎ – অর্থাৎ, ভগবানের কথা শ্রী বা সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ। আর তা আততম্‌ – মানে, সুদূরপ্রসারী এবং সহজপ্রাপ্ত।

ঠাকুরের কথা যে সুদুরপ্রসারী তা তো ঠাকুরের জীবনী থেকেই দেখা যায়। সাধনকালে সারা দেশের কোথা কোথা থেকে একে একে এসেছেন ভৈরবী ব্রাহ্মণী, তোতাপুরী, রামাইত সাধু। আবার কোথা থেকেই বা এসেছেন নারায়ণ শাস্ত্রী, বৈষ্ণবচরণ, গৌরী পণ্ডিত! আবার কেশব সেনের সঙ্গে এসেছেন ক্যাপ্তেন কুক। এসেছেন নেপালের রাজকর্মী ক্যাপ্তেন উপাধ্যায়, এসেছেন সিন্ধুপ্রদেশের হীরানন্দ। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, শশধর পণ্ডিত তাঁরাও এসেছেন ঠাকুরের কথা শুনতে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অধর সেন তো ঠাকুরের পরম প্রিয় ভক্তদের একজন। আর যিনিই এসেছেন তিনিই সমৃদ্ধ হয়েছেন তাঁর জীবনে।

চিকিৎসা করতে শ্যামপুকুরে থাকার সময় হঠাৎই একদিন এসেছিলেন এক খ্রীষ্টান ভক্ত; যিনি ঠাকুরের মধ্যেই দেখেছিলেন তাঁর প্রভু যীশুকে।

সেরকম মায়ের আকর্ষণও কিছু কম নয়। সিনেমা জগতের বিধর্মী পার্সী সোরাব মোদি কিসের টানে এসেছিলেন মায়ের কাছে? দুজনে তো দুজনের ভাষা জানতেন না! তবু পুর্ণ হয়েছে সবার হৃদয়, ধন্য তাঁদের জীবন।

৬) ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ –

যাঁরা বহু সুকৃতি সঞ্চয় করেছেন, উদার চিত্ত যাঁরা, সংসারের ভোগবাসনা যাঁদের চলে গিয়েছে, একমাত্র ব্রহ্মানন্দ ভোগ করতে চান যাঁরা, তাঁরাই এই অমৃত পানে পরম আনন্দ ভোগ করেন এবং অন্যকেও এই অমৃতের আস্বাদন করান।

ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানেরা অহোরাত্র কেবল ঠাকুরের ভাবেই বুঁদ হয়ে থাকতেন। যতিশ্রেষ্ঠ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন পশ্চিমে তিনি কেবল ঠাকুরের কথাই বলেছেন। কথামৃতকার শ্রীম বলতেন ঠাকুরের কথা ছাড়া আর কি জানি! তাই শুধু কথামৃত রচনা নয়, তাঁর কাছে যখনই কেউ আসতেন পরিচিত কি অপরিচিত তিনি সবার কাছে শুধুই ঠাকুরের কথাই বলতেন। সেই অমৃতবারি সিঞ্চন করতেন সবার ওপর।

আমাদের অনেকেরই হয়তো কখনও কখনও মনে হয়েছে, আমরা কেন এত পরে জন্মালুম। ঠাকুরের পার্ষদ, ঠাকুরের সন্তান, ঠাকুরের ভক্ত – যাঁরা এই চর্মচক্ষে দেখেছেন ঠাকুর-মা-স্বামীজীকে, শুনেছেন তাঁদের মধুর অমৃতময়ী বাণী, ধন্য হয়েছে তাঁদের জীবন সে অমৃত ধারায় – তার থেকে আমরা কি চির বঞ্চিতই থেকে গেলুম! কিন্তু না, অহৈতুকী কৃপাসিন্ধু ঠাকুর হঠাৎ করেই নিজে থেকে ধরা দিয়েছেন কোনোও কোনোও ভক্তের কাছে, আজও এই সময়ও।

এক মহারাজ কথায় কথায় বলেন ‘কাঁচাখেকো ঠাকুর’ – কখন কি ভাবে যে কার মনের মধ্যে ঢুকে পড়েন কেউ টেরটিও পায় না। তাই তো শুধু কথামৃতকার বা বালক ভক্ত পূর্ণই নন আজও শোনা যায় কোনো মহিলা আত্মহননের জন্য অনুকূল মুহূর্তের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে আনমনা ভাবেই খুলে পড়েন পাশে রাখা একটা বই আর সেই বই আমূল পরিবর্তন করে তার সম্পুর্ণ জীবনবোধ, কোথায় চলে যায় নিজেকে শেষ করে দেবার সেই পরিকল্পনা। বলাই বাহুল্য সে বই আজকের যুগের বেদ – শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত।

সাহিত্যিক জরাসন্ধ তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতিগ্রন্থ লৌহকপাটেও জানিয়েছেন এমন এক দুর্ধর্ষ মহিলা  কয়েদীর কথা। যে নাকি জেলখানার সমস্ত কর্মী এবং বাকি কয়েদীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল তার ব্যবহারে। আর কোনো উপায় না দেখে জেলার সাহেব তাকে জেলের লাইব্রেরী থেকে একটা বই পড়তে দেন। তারপর লাইব্রেরী থেকে সেই মেয়েটির নামে নালিশ জানানো হয়। সে কিছুতেই সেই বই ফেরৎ দেয় না, উলটে গালিগালাজ মারধর করে সেই লোকেদের তাড়িয়ে দেয়। মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করে জেলার সাহেব জানতে পারেন সেই বইএর মধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছে জীবনের মানে। তাই কোনোওভাবেই সে সেই বইটি আর কাছছাড়া করতে রাজি নয়। এই তো সেই মধু যা সবাইকে সত্যের পথে, আলোর পথে, অমৃতের পথের সন্ধান দেয়।

তথ্য সূচীঃ

  1. শ্রীম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত
  2. শ্রীমৎ স্বামী সারদানন্দজী বিরোচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ
  3. শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দজী রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-প্রসঙ্গ
  4. শ্রীমৎ স্বামী চেতনানন্দজী লিখিত ধ্যানলোকে শ্রীরামকৃষ্ণ
  5. শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত – প্রতিদিনের প্রয়োজন, বক্তাঃ- শ্রীমৎ স্বামী বিমোক্ষানন্দজী, SARAS অনলাইন সৎসঙ্গ ১০ই এপ্রিল ২০২৪
  6. কথামৃতের জাদু, বক্তাঃ- শ্রীমৎ স্বামী নিখিলেশ্বরানন্দজী, কথামৃত ভবন ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৯
Posted in Uncategorized

বাপী ডা-ব খাবি রে!

উত্তর ভারতের হাড়কাঁপানো শীতটা গেছে কি যায় নি, নতুন গরম ভাল করে পড়তে পেল না, শুরু হয়ে গেল হাত চুলকানো, পা চুলকানো। উফ্‌, আর পারা যায় না বাপু! কদিন আগে গরম মোজা পরেও পায়ের আঙ্গুল ফেটে রক্ত – Frostbite! এখন সুতির মোজাও পায়ে দেবার উপায় নেই – এলার্জি, আমবাত, পেটগরম! সেই হযবরল-র মত কে যেন কানের কাছে বলছে – “বাপী, ডাব খাবি রে!”

ছোটবেলায় ডাবের জল জিনিসটা মোটেই সুবিধের বোধ হত না। কচি ডাব – খা, খা। দূর্‌ বিচ্ছিরি, কেমন নোনতা নোনতা। কেন বাপু নারকেলের জল তো কেমন মিষ্টি! আরে শাঁসওয়ালা ডাব মিষ্টি হয়। শাঁস! সে তো আরোও বাজে – ল্যাতল্যাত করছে। মানুষে খায়! কিসস্যু খেতে শেখে নি রে মেয়েটা! শাঁসটাই তো ভাল রে। ভালো না কচু!

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর নতুন জামাইবাবু বললেন চল আমাদের সঙ্গে দুদিন দীঘা ঘুরে আসবে। বেশ কথা। জামাইবাবু বেজায় স্বাস্থ্যসচেতন। নো ভাজাভুজি, নো কোল্ডড্রিংস। সমুদ্রের ধারে এসেছ সারাদিন ঘোরো আর মনের সুখে (না কি দুখে!) ডাব খাও। এতদিন শুনতুম এই বিকেল হয়ে গেছে, সন্ধ্যে হয়ে গেছে আর ডাব খাওয়া যাবে না, ঠাণ্ডা লাগবে। দীঘায় গিয়ে জামাইবাবুর তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডাব – সকালে ডাব, সন্ধ্যায় ডাব, খাবার আগে ডাব, খাবার পরে ডাব। জল ফুরোলেই শাঁস আর শাঁস ফুরোলেই জল! সোনা মুখ করে খেয়ে যাচ্ছি – আরে ভাই ‘পেস্টিক’ কা সাওয়াল! কিছুক্ষণ পরে মনে হল কই শাঁসটা তো সেইরকম বিচ্ছিরি ল্যাতল্যাত করছে না! বেশ তো খেতে! নির্ঘাৎ কলকাতার ডাবওলারাই ইচ্ছে করে বাজে জিনিস দেয়! আর ডাবটা তো নারকোলের চেয়েও ভাল! অনেক জল – যেমন ঠাণ্ডা, তেমন মিষ্টি – ওই গরমে প্রাণটা সত্যিই জুড়িয়ে যায়! নাঃ, এই দীঘার ডাবগুলোই ভাল।

কিছুকাল পর ‘খাস কলকাত্তার মাইয়া’ ‘বিয়া কইর‍্যা’ চালান হলুম বড়িষা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি গাড়ি চলছে তো চলছে। পথ যেন ফুরোয় না! আমার বলে গড়িয়াহাটই সিলেবাসের বাইরে! বাজার করতে গেলে বড়জোর নিউ মার্কেট, আর ছোটোবেলায় বেড়াতে যেতে আলিপুর চিড়িয়াখানা – ব্যস্‌, কলকাতার ভূগোল ওখানেই ইতি। শ্বশুরবাড়ি যৌথ পরিবার, সবাই মিলে এক বাড়িতে থাকা। বাড়ির পেছনে বাগান – সেখানে অন্ততঃ ১২ / ১৪ টা নারকোল গাছ। সন্ধ্যেবেলা টিভি দেখতে বসেছি কিংবা রাত্তিরে শুয়ে আছি হঠাৎ আওয়াজ – দুম্‌। প্রথম প্রথম চমকে উঠে শুনি ও কিছু না গাছ থেকে নারকোল পড়ল। আর ঝপাং করে আওয়াজ মানে তাদের সলিল সমাধি! পেছনের খোলা নালায় পড়ে ভেসে ভেসে হুস্‌। বাগানে মাঝরাত্তিরে নারকোল পড়লে ভোর হতে হতে তারা সাফ্‌। দিনদুপুরে পড়লে কোন কোন সময় মা কি বাপী কুড়িয়ে এনে ডিভানের তলায় রেখে দিতেন।

লক্ষ্মীপুজোয় সেই নারকোলের নাড়ু করতেন মা। অন্যসময় সেখান থেকেই দিতেন নাতনিদের – নিয়ে যা মুড়ির সঙ্গে খাবি। নয়তো বলতেন মাকে বলবি রান্নায় দিতে। বাগান মেজোজেঠুর। কাজেই দ্বারভাঙ্গা থেকে ছোটুদা এলে ডাব-নারকোল, আম এসব পাড়াতেন। যদিও যত্নের অভাবে আমগাছে তখন পোকা লেগেছে। ঝড়ে পড়ে যাওয়া কাঁচা আমের চাটনি-আচার খেলেও নিজেদের বাড়ির বাগানের ভালো গাছের পাকা আম আমার খাওয়া হয় নি। পাকা আম সবই পোকা ভর্তি। কিন্তু ছুটির দিন বেলার দিকে ডাব-নারকোল পাড়াতে পাড়াতে বাগান থেকে ছোটভাইকে হাঁক দিতেন, “ডাব খাবি রে?”

হালকা শাঁসওয়ালা মিষ্টি জল প্রাণটা জুড়িয়ে যেত। জল খাওয়া হয়ে গেলেই বাপী কাটারি হাতে রেডি। ততদিনে সবার ধারণা হয়েই গেছে ‘বউমা ডাবের হালকা শাঁস খেতে ভালবাসে’। বাড়িতে নারকোল গাছ থাকায় বাড়ির ছেলেরা সবাই ডাব-নারকোল কাটায় এক্কেবারে expert. আর বাইরে থেকে দেখে কেমন বুঝতে পারেন কোনটা কচি, কোনটায় হালকা শাঁস, কোনটা জল বেশি!

ঠিক যেমন বাবা এমনিতে রান্নাঘর না মাড়ালেও ছুরি দিয়ে নিমেষের মধ্যে নারকোল টুকরো করে দিতে পারে! তখন বাবার ছোটবেলার গল্পে শোনা হাওড়ার বাড়ির নারকোলের ছাদ আর ডাবের জলে ফোটানো ছুঁচোবাজির মসলা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

পুণায় কলেজ যাবার পথে বিব্বেওয়াড়ির সিগনালে ঠেলা করে ডাব বিক্রি হত। আর তার দাম দেখে মনটা হু হু করে উঠতো বেহালার বাড়ির জন্যে। যদিও সেই নারকোল গাছের শেকড়ের ঠেলা সামলাতে আমাদেরই বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ঘরের মেঝে সারাতে গিয়ে দেখা গেল যত খোঁড়া হচ্ছে শুধুই নারকোলের শেকড়। মাটির ওপর একপেয়ে সরু লম্বা গাছ দেখে কে ভাবতে পারে মাটির নিচে লোকচক্ষুর আড়ালে ধীরে ধীরে সে কি বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসে আছে! তবে ভেবে দেখলে মনে হয় ঠিকই তো – সমুদ্রের পাড়ে নরম বালিতে দাঁড়ানো সারি সারি নারকোল গাছ কত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের উপকূলরেখা রক্ষা করে আসছে!

যা হোক, পুণায় পরীক্ষার পর কলেজে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি হয় কিন্তু আমাদের হয় না! ধাঁ ধাঁ গরমে রোজ নিয়ম করে কলেজে গিয়ে বসে থাকতে হয়। আজ ISO কাল NBA পরশু NAAC। আর বাইরের রোদের দিকে তাকালে আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা কারুর মনে হয় না। নিয়মিত আটঘণ্টা কখন দেখি দশঘণ্টা হয়ে গেছে! সেবার ওইরকমই ছুটি তবু ছূটি নেই এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল ক্যান্টিনে ‘নারল পানী’ পাওয়া যাচ্ছে। উফ্‌, আমাদের পায় কে! রোজই দুপুরবেলা ‘দাজি’কে পাঠানো হয় প্রায় আধ ডজন ডাব আসে। আহা, কি মিষ্টি ঠাণ্ডা জল! প্রাণ তো জুড়োলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাথার পোকাও তো নড়ল জল যখন এতও মিষ্টি নিশ্চয় ‘হালকা মালাই’ আছে। সেটা ফেলে দেওয়া মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু সেই শাঁস বার করতে গিয়ে নাভিশ্বাস ওঠার দাখিল! মালাই যতটা ‘হালকা’ বলে মনে করা হয়েছিল দেখা গেল ঠিক তার উলটো। বরং তাকে ‘মালাই’ না বলে ‘নারকোল’ বললেই মানায় বেশি।

ডাবের মুখ চামচ দিয়ে তো কোনোভাবেই বড় করা যাচ্ছে না! সবার জিনিসপত্র হাতড়ে হাতড়ে বেরোলো পেনসিল কাটার ছোট্ট ছুরি, Examএর দড়ি কাটার ভোঁতা ছুরি, তস্য ভোঁতা একটা কাঁচি। এই অস্ত্র নিয়ে কি যুদ্ধ জেতা যায়? তাই বলে ‘হাম তো ছোড়নেওয়ালে নেহি হ্যায়!’

সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মত ‘আক্রমণ!’ বলে তড়িঘড়ি সবার টেবিল থেকে বইখাতা কাগজ পেনসিল উধাও। যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত। সেখানে শুধুই জলশূন্য ডাব, ছুরি, কাঁচি আর চামচ! সবাই পাল্লা দিয়ে মালাই বার করার চেষ্টায় রত। এতটুকু মালাই বেরোলেই ‘ইউরেকা’! সবাই এতই মগ্ন যে কোন সময় পুরো Civil Engineering team inspect করতে এসেছে কারুর খেয়ালই নেই! ‘আরে ইধার তো ম্যাডাম লোগো কি নারল পার্টি চল রাহা হ্যায়’ – হঠাৎ সে কথায় চমক ভাঙ্গল সবার। হায় হায়, কি বেইজ্জত! ভাগ্যিস ওই টিমের সঙ্গে ডিরেক্টর স্যার কি HoD এসে পড়েন নি! স্টাফরুমে বসে গরমে ‘নারল পানী’ খাওয়ার সেই দিনই ইতি তো বটেই এমন কি শুনলুম রাতারাতি ক্যান্টিন থেকেও ‘নারল পানী’ উধাও!

এবাড়ির ছোট ছেলে্র তার মায়ের ছোটবেলার মতই ডাবের নরম শাঁস বিলকুল ‘না পসন্দ্‌’। সেও যখন ডাবের শাঁস দেখে বলে নারকোল দাও না আমার মনে হয় একেই কি বলে ‘runs in the blood!’ কিন্তু যখন সে ডাব কাটার জন্যে চামচ, ছুরি আর bottle opener নিয়ে ‘সরো, সরো’ করে তার বাবার সঙ্গে ঠেলাঠেলি করতে থাকে আমার মানস চক্ষে ভেসে ওঠে কাটারি হাতে আমাদের বাপী, বাপীর ছেলে আর বাপীর ছোট নাতির মুখ – সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলেছে!!

P.C. Google Images

Posted in Uncategorized

পুজোর কড়চা

শ্রীসঞ্জয় উবাচ

আমার পুজো শুরু হত বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাপীর সঙ্গে মেটাল বক্সে মাংস-ভাত খেয়ে ফেরার পথে রাদু থেকে নতুন জুতো কিনে। তারপর প্রতি রাতে খাটের তলা থেকে সেই জুতো বের করে মচ্‌মচ্‌ করে মার্চ পাস্ট – পুজোর সময় পায়ে ফোস্‌কা না পড়ে!

পঞ্চমীতে মামার বাড়ি যাবার প্রধান আকর্ষণ মাইমাদের কাছ থেকে পুজোর রসদ সংগ্রহ করে ষষ্ঠীতে ফেরা। যাতে পুজোর কটা দিন ফুটানিটা জমে ভাল। আধা রসদ ক্যাপ-বন্দুকেই শেষ। বাকিটা কোল্ড ড্রিংস আর বড়িষা কাফের পর্দা ঘেরা কেবিনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে তেল চপচপে রবারের মত মোগলাই নিয়ে যুদ্ধ। আর মাকে লুকিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা।

এরপর আসি পুজোর নাটকের মহড়ায়। ভরদুপুরে শেয়ালের মুখোশ পরে হযবরল-র শেয়াল পণ্ডিত সেজে ঘেমে নেয়ে একাক্কার। পরেরবার আবার হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালায় নেংটি ইঁদুর। মানুষ সেজে অভিনয় অধরাই রয়ে গেল।

পুজো প্যাণ্ডেলে আবার বিরাট দায়িত্ব – সকাল-বিকেল রেকর্ড প্লেয়ারে রেকর্ড পালটানো। পালা করে মান্না-কিশোর-হেমন্ত। আর দুপুরে বড়রা বাড়ি গেলেই তেড়ে হিন্দি গান চালানো আর ধরা পড়লে চরম বকুনি। সন্ধ্যেবেলা বেপাড়ায় ঠাকুর দেখা আর লুকিয়ে সিগারেটে সুখটান। কদিনের মত পড়াশোনা শিকেয় তোলা।

ঢাকীরা যখন দুপুরে প্যাণ্ডেলের পেছনে ঝিমোতো সেই ফাঁকে তাদের ঢাকে বেতালা চাঁটিতে তাদের কাঁচা ঘুমের দফা রফা। সেই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ঢাকীদের ওপর একটা অন্যরকম মায়া পড়ে যেত। দশমীর পরের দিন তারা যখন বাড়ি বাড়ি যেত টাকাপয়সা আর জামাকাপড় পাবার আশায় আমিও উৎসুক হয়ে তাদের অপেক্ষায় থাকতাম। একবার পুরোনো জামা হাতের কাছে না পেয়ে বাপীর সে বছরের পুজোর নতুন জামা তাদের দিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর কপালে বকুনিও জুটেছিল বলাই বাহুল্য। পরের বছর যখন শুনলুম বনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে সেই ঢাকী বাঘের পেটে গেছে আমার কি যে কষ্ট হয়েছিল বলার নয়। সে যেন স্বজন হারানোর দুঃখ। আজও সেই মুখটা চোখে ভাসে।

দশমীর দিন মোহিত হয়ে সেলুনের শান্তিদার ধুনুচি নাচ দেখে তার অন্ধভক্ত হয়ে যাওয়া। তার ওপর শান্তিদা ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার কাজেই আলাদা টান। তারপর সিদ্ধি খেয়ে পুকুর ঘাটে সটান শুয়ে থাকা আর উঠে বসতে গেলেই বেদম হাসি। তার ওপর কোন উপকারী বন্ধু গজা খাওয়ানোয় হাসির ছর্‌রা বেড়ে দশগুণ।

পাড়ার এক দাদার খুব রাগ ছিল এক কাকুর ওপর, কারণে অকারণে খ্যাচখ্যাচ করত বলে। সেবার মোক্ষম সুযোগ এসে গেল। ঠাকুর বিসর্জনের সময় অন্ধকারে মওকা বুঝে কার্তিক-গণেশের আগেই সেই কাকুকে পেছন থেকে এক ঠেলা। হেমন্তের কনকনে ঠাণ্ডায় এঁদো পুকুরের জলে পড়ে সে কাকুর যে কি নাজেহাল দশা!

আর্টিস্ট ভাগ্নে বলে মামাবাড়িতে ভারি খাতির। মেজমাইমার রঙ চটে যাওয়া চিনেমাটির মাদুর্গা রঙ করে রাখা ছিল বিজয়ার পর গিয়ে ফেরত দেব বলে। সেবার বিসর্জনের ঢাকের বাদ্যি মাথার পোকা দিল নাড়িয়ে। ঘোরের মধ্যে ঘরে গিয়ে সেই সপরিবারে মা দুর্গার মূর্তি নিয়ে এসে ‘বল দুগ্‌গা মাঈ কি জয়!’ বলে এক্কেবারে ঝপাং করে জলে।

P.C. Google Images

Posted in Reflections

শ্রীরামকৃষ্ণ-স্তোত্র দশকম্‌

শ্রীরামকৃষ্ণ-স্তোত্র দশকম্‌

-স্বামী বিরজানন্দ

ব্রহ্ম-রূপমাদি-মধ্য-শেষ-সর্ব-ভাসকম্,
ভাব-ষটক-হীন-রূপ-নিত্য-সত্যমদ্বয়ম্।
বাঙমনোঽতি-গোচরঞ্চ নেহি-নেতি-ভাবিতম্,
ত্বং নমামি দেব-দেব-রামকৃষ্ণমীশ্বরম্।।১

আদিতেয়ভীহরং সুরারি-দৈত্য-নাসকম্
সাধু-শিষ্ট-কামদং মহী-সুভার-হারকম্।
স্বাত্মরূপ-তত্ত্বকং যুগে যুগে চ দর্শিতম্,
ত্বং নমামি… ।।২

সর্বভূত-সর্গ-কর্ম-সূত্র-বন্ধ-কারণম্
জ্ঞান-কর্ম-পাপ-পুণ্য-তারতম্যসাধনম্।
বুদ্ধি-বাস-সাক্ষী-রূপ-সর্ব-কর্ম-ভাসনম্,
ত্বং নমামি… ।।৩

সর্ব-জীব-পাপ-নাশ করাণং ভবেশ্বরম্,
স্বীকৃতঞ্চ গর্ভবাস দেহধানমীদৃশম্।
যাপিতং স্ব-লীলয়া চ যেন দিব্যজীবনম্,
ত্বং নমামি… ।।৪

তুল্য-লোষ্ট্র-কাঞ্চনঞ্চ হেয়-নেয়-ধীগতম্,
স্ত্রীষু নিত্য-মাতৃভাব-শক্তিরূপ ভাবুকম্।
জ্ঞান-ভক্তি-ভুক্তি-মুক্তি-শুদ্ধ-বুদ্ধি-দায়কম্,
ত্বং নমামি… ।।৫

সর্ব-ধর্ম-গম্য-মূল-সত্য-তত্ত্ব-দেশকম্,
সিদ্ধ-সর্ব-সম্প্রদায়-সম্প্রদায়-বর্জিতম্।
সর্ব-শাস্ত্র-মর্ম-দর্শি-সর্ববিন্নিরক্ষরম্,
ত্বং নমামি… ।।৬

চারুদর্শ-কালিকা-সুগীত-চারু-গায়কম,
কীর্ত্তনেষু মত্তবচ্চ নিত্য-ভাবহিহ্বলম্।
সূপদেশ-দায়কং হি শোক-তাপ-বারকম্,
ত্বং নমামি… ।।৭

পাদপদ্ম-তত্ত্ব-বোধ-শান্তি-সৌখ্য-দায়কম্
সক্ত-চিত্ত ভক্ত-সূনু নিত্য-বিত্ত-বর্ধকম্।
দম্ভি-দর্প-দারণন্তু নির্ভয়ং জগদগুরুম্,
ত্বং নমামি… ।।৮

পঞ্চবর্ষ-বাল-ভাব-যুক্ত-হংস-রূপিণম্,
সর্ব লোকরঞ্জনং ভবাব্ধি-সঙ্গ ভঞ্জনম্।

শান্তি-সৌখ্যসদ্ম-জীব-জন্মভীতি-নাশনম্,
ত্বং নমামি… ।।৯
ধর্ম-হান-হারকং ত্বধর্ম-কর্ম-বারকম্,
লোক-ধর্ম-চারণঞ্চ সর্ব-ধর্ম-কোবিদম্।

ত্যাগি-গেহি-সেব্য-নিত্য-পানাঙ্ঘি-পঙ্কজম্,
ত্বং নমামি… ।।১০
স্তোত্রশূন্য-সোমকং সদীশ-ভাব-ব্যঞ্জকম্,
নিত্য-পাঠকস্য বৈ বিপত্তি-পুঞ্জ-নাশকম্।

স্যাৎ তদাপি জাপ-যাগ-যোগ-ভোগ-সৌলভম্,
দুর্লভন্তু রামকৃষ্ণ-রাগ-ভক্তি-ভাবনম্।।১১

ইতি শ্রীবিরজানন্দ-রচিতং ভক্তি-সাধকম।
স্তব-সারং সমাপ্তং বৈ শ্রীরামকৃষ্ণ-তূণকম্।।১২

১। পরব্রহ্মরূপঃ

শ্রীরামকৃষ্ণ সেই নির্গুণ নিরাকার পরব্রহ্ম যাঁর আলোয় সৃষ্টির আদি-মধ্য-অন্ত আমাদের কাছে প্রতিভাত হচ্ছে। তিনি জন্মাদি ষড়বিকাররহিত কারণ তিনি স্বরূপতঃ ব্রহ্ম। তিনি নিত্য-সত্য স্বরূপ, তিনি অদ্বয় – তাঁর কোনোও দ্বিতীয় নেই। তিনি বাক্য ও মনের অগোচর – পঞ্চইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নাম-রূপাদি কোনো বস্তুদ্বারাই তাঁকে ব্যাখ্যা করা যায় না।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

২। সগুণ-সাকার অবতাররূপঃ

পাপের ভারে পৃথিবী যখন ভারাক্রান্ত তখন যুগে যুগে তিনি অবতাররূপ পরিগ্রহ করে দেবতাদের শত্রু দৈত্যদের নাশ করে আদিত্যাদি দেবতার ভয় দূর করেন এবং সাধু মহাত্মাদের কাম্যবস্তু দান করেন। তিনি নিজের আত্মরূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও অবতার রূপে জন্ম নিয়ে তিনি সাধারণের মতই ব্যবহার করেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৩। কর্মফলদাতা সাক্ষীরূপঃ

তিনি সৃষ্টি ও জীবের কর্মফলের নিয়ন্ত্রা। পঞ্চভূতের সংমিশ্রণে সৃষ্টির রহস্য, পরা-অপরাবিদ্যা সব তাঁর অধিগত এবং জীবের জ্ঞান ও কর্ম অনুসারে তিনি তাদের ফলদান করেন। তিনি বিবেক-বুদ্ধিরূপে জীবের অন্তরে বাস করেন এবং সাক্ষীরূপে তাদের সকল কর্ম অবলোকন করেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৪। অবতারত্ব ও নরলীলাঃ

তিনি জগতের ঈশ্বররূপে শরণাগত জীবের সর্ব পাপ নাশ করে তাদের কর্মফল থেকে মুক্তি দিতে পারেন। তিনি কর্মবন্ধনরহিত হয়েও স্বেচ্ছায় মানবজন্ম স্বীকার করে ধরায় অবতীর্ণ হন এবং জীবকল্যাণে এক অনবদ্য দিব্যজীবনের চিত্র আমাদের সামনে রেখে গেছেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৫। ব্রহ্মজ্ঞানী লক্ষণ – স্থিতপ্রজ্ঞরূপঃ

তিনি দ্বৈতবুদ্ধিরহিত। তাঁর কাছে লোহা ও সোনা সমান এবং কোনও কিছুই ত্যাজ্য বা গ্রাহ্য নয়। তিনি সর্বাবস্থায় সকল স্ত্রীলোককে মাতৃরূপে, জগজ্জননীর প্রকাশরূপে দর্শন করেন। তিনি পরা-অপরা বিদ্যা, বিবেক বুদ্ধি, জ্ঞান-ভক্তি দান করতে পারেন। আবার তিনি জীবকে তাদের কামনা অনুযায়ী একাধারে জাগতিক সম্পদ ও জন্ম-মৃত্যুচক্র থেকে মুক্তিও দান করতে পারেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৬। শাস্ত্ররূপী শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তিনি সর্বধর্মের মূলে যে প্রকৃত সত্য – সেই তত্ত্বের জ্ঞাতা। কারণ তিনি সব পথ দিয়েই সেই সত্যকে নিজে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি কোনও সম্প্রদায়কেই অশ্রদ্ধা করেন না কিন্তু নিজে সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধে। তিনি আপাত দৃষ্টিতে নিরক্ষর হলেও সর্ব শাস্ত্রের প্রকৃত মর্মদর্শী ও সর্বশাস্ত্রের রক্ষক।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৭। সিদ্ধসাধক শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তিনি তাঁর ভক্তিপূর্ণ সঙ্গীতে মা কালীকে প্রসন্ন করে মায়ের দর্শন লাভ করেছিলেন। তিনি অহোরাত্র ঈশ্বরের ভাবে বিহ্বল হয়ে থাকতেন এবং ভাবের ঘোরে কীর্তনানন্দে মত্ত হয়ে যেতেন। তিনি তাঁর শিষ্যগণকে সম্যক উপদেশ দিতেন যাতে তাঁরা সংসারের শোকতাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৮। অভয় ও করুণামূর্তি, ভক্তবৎসল শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তাঁর মহিমা জেনে যাঁরা তাঁর পাদপদ্মে শরণ নিয়েছেন তিনি তাঁদের সুখ ও শান্তি প্রদান করেন। আবার জাগতিক বিষয়ে আসক্ত ভক্তকে তিনি নিত্য জাগতিক সম্পদ দান করেন। তিনি জগৎগুরুরূপে নির্ভীক হস্তে জীবের দম্ভ ও দর্প হরণ করে তাদের সঠিক মার্গ দর্শন করান।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৯। ঈশ্বররূপী শ্রীরামকৃষ্ণ – বাল্যলীলাঃ

পাঁচবছর বয়সে আকাশে কালো মেঘের গায়ে সাদা বকের সারি দেখে তাঁর প্রথম ভাব হয়েছিল। তিনি সেই বালক বয়সেই তাঁর রঙ্গপ্রিয়তা ও সরস বাক্যালাপের মাধ্যমেই তাঁর গ্রামের মানুষের সংসারাসক্তি ও মোহবন্ধন মোচন করেন। শান্তি ও সুখের মূর্তপ্রতীক তিনি লোকের মন থেকে জন্ম-মৃত্যুর ভয় দূর করেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

১০। ধর্মসংস্থাপক শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তিনি ধর্মের হানি, ধর্মের গ্লানি নাশ করেন এবং অধর্ম কর্ম দূরীভূত করেন। তিনি সর্বধর্মের মূল সত্য জেনেও প্রচলিত লোকাচার সমূহ মেনে চলেন। ত্যাগী ও গৃহী, ভক্ত-অভক্ত সকল মানুষেরই সংসারের সকল কলুষ ও সংসারাগ্নি থেকে মুক্তিলাভের জন্য তাঁর পবিত্র, পাবনী চরণকমলই একমাত্র আশ্রয়।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

১১। ফলশ্রুতিঃ

নিত্য স্তোত্রপাঠে লোকের সকল বিপত্তি নাশ হবে ও তাদের মনে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি দুর্লভ অনুরাগ ও ভক্তিভাব জাগ্রত হবে এবং তাদের জপ-যোগের সকল ফললাভ হবে ও সুকৃতির ফল বহুগুণে বর্ধিত হবে।।

Kind acknowledgement :

Swami Shantivratanandaji, Minister-in-Charge, EIRE Vedanta Society, Ireland.