সেই যে সেই ছোটবেলায় বিশ্বকর্মা পূজো মানেই ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসব। সারা আকাশ ঘুড়ির রঙে রঙে রাঙ্গিয়ে যেত। কত রকমের ঘুড়ি – সেই ‘পেটকাটি, চাঁদিয়াল, মোমবাতি, বগ্গা’ – মাসখানেক আগে থেকেই সবার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। ময়দা-তুঁত-কাচের গুঁড়ো… রাস্তা দিয়ে সাবধানে চলতে হত। একটু অন্যমনস্ক হয়েছ কি সুতোর পাকে মাঞ্জার জালে জড়িয়ে যাবে। সারা রাস্তা জুড়ে এক ল্যাম্পপোস্ট থেকে আরেক ল্যাম্পপোস্ট শুধু সুতো।
পুণেটা বিচ্ছিরি। না হয় বিশ্বকর্মা পুজো না আছে ঘুড়ি ওড়ানো! ওখানে হল দুর্গা নবমীতে পাণ্ডবমতে ‘আয়ুধ পূজা’ – সঙ্গে সব রকম যন্ত্রপাতি। উত্তর ভারতে যদিও বিশ্বকর্মা পুজো আছে, কিন্তু সঙ্গে ঘুড়ি নেই! তখন সেই কেলাস ফোর-ফাইভ। এ সময়টা বেশ ঘটনাবহুল বলতে হয়। বিল্লুটা তখন ছিল এক্কেবারে ‘টম্বয়’। আর আমি একটি মূর্তিমতী ভোঁদা! পিসির কাছে ছোটবেলার হাওড়ার গপ্পো শুনে বিল্লু তখন ঘুড়ি ওড়াতে শিখেছে। পিসিই শিখিয়েছিল। কাজেই সেবার বিশ্বকর্মা পুজোর দিন মহা মজা!
বিকেলবেলা ইস্কুল থেকে সোওওজা পিসির বাড়ি। বিল্লু ঘুড়ি ওড়াবে। আমার কাজ ওই লাটাই ধরা। সেবার অবশ্য সুতোয় বেশি মাঞ্জা দেওয়া হয় নি। হাত কেটে যাবার ভয়। বিশ্বকর্মা পুজো বছরের সেই ব্যতিক্রমী দিন যেদিন আমার ইস্কুল, কিন্তু বাবার অপিস ছুটি। মিশনারী স্কুলে দোল-দুর্গোৎসব বাদে ছুটি আশা করা যায় না – তায় আবার ঘুড়ি ওড়ানোটা ছেলেদের ডিপার্টমেন্ট। সকালবেলা স্বাভাবিক নিয়মেই স্কুলবাস আসত না। তাদের তো পুজো রে বাবা! আমাকে ইস্কুলে পৌঁছে দিয়ে মা মামারবাড়ি – ভাদ্রমাসের সংক্রান্তির লক্ষ্মীপুজো, আর বাবার সেদিন দুপুরে অপিসে নেমন্তন্ন – Testing Department এ মাংস-ভাত।
পরের বছর যখন বিল্লুর ঘুড়িতে বেশ হাত পাকলো ততদিনে বিকেলে ছাদে ঘুড়ি ওড়াবার মহা নেশা। সেবার আবার বাড়ীতে মাঞ্জা তৈরী করে সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া হল। ঘুড়ির কাগজ কিনে ঝাঁটার কাঠি বেঁকিয়ে বাড়িতে ঘুড়ি তৈরীও হল। আবার পুজোর দিন এল দোকানের কড়া মাঞ্জাওয়ালা সুতো রংবেরঙএর সব ঘুড়ি। সে সময় বিল্লু Septic Tonsil নিয়ে বেজায় নাজেহাল। প্রায় প্রায় জ্বর হয়। কাজেই ‘One day – Sick – Benu Bose’ অর্থাৎ ইস্কুল কামাই। তাই বিশ্বকর্মা পুজোর দিন ও যে মোট্টেই ইস্কুল যাবে না সে বলাই বাহুল্য!
আমি আর কি করি কাঁচুমাচু মুখটি করে ইস্কুল গেছি আর সকাল থেকে বসে আছি কখন ছুটিটা হবে! এদিকে মামার বাড়ির চারতলার ছাদে আর নিমগাছের মগডালে কদিনে যে কটা ঘুড়ি ভো কাট্টা হয়ে পড়েছে স-ব নদাদি জমা করে রেখেছে আমার জন্যে। তা আমি ঢ্যাঁড়শ তাই দিয়ে কি করব – সব নিয়ে গেছি বিল্লুর জন্যে।
যা হোক, ঘুড়ি-লাটাই-রঙ্গিন সুতো সব নিয়ে ছাত একেবারে জমজমাট। ওড়াবার লোক একজনই – বিল্লু। আর বাবা, পিসি, চিল্লুদিদি, আমি আর যারা যারা আছে সব ‘চিয়ার লিডার্স’। অবশ্য ততদিনে আমিও লাটাই ধরে সুতো গোটাতে শিখেছি! ঘুড়ি যখন অনেক ওপরে উঠে যেতো তখন আবার বিল্লু আমার হাতে লাটাইটা ছেড়ে দিত। ও-ই দূ-রে ঘুড়িটা ছোট্ট হয়ে উড়ছে, উড়ছে… । এই রে আরেকটা ঘুড়ি প্যাঁচ খেলতে আসছে, ওই রে ঘুড়ি লাট খাচ্ছে – ধর, ধর! টান, টান, টান – ভো কাট্টা! আহা সুতোয় প্যাঁচ মেরে কাটা ঘুড়িটা সুদ্ধু নামিয়ে আনতে হবে যে।
হাতে আবার একটা লম্বা লাঠি। পাশের বাড়ির দাদাগুলো ভারী দুষ্টু। মাঞ্জাহীন সুতোয় যখন প্র্যাক্টিসপর্ব চলছে তখন একটার পর একটা ঘুড়ি কেটে দিয়েছে! শরীরে একটু মায়াদয়া নেই গো! মাথা গরম, চোখে জল! দাঁড়া একবার নাগালে পাই! লাঠি দিয়ে টেনে ঘুড়িটা কেটে দেবো!
সে বছর আমার আরেকটা বাড়তি পাওনা ছিল প্রথম বিশ্বকর্মা পুজোয় নেমন্তন্ন যাওয়া। ইলেক্ট্রিক সাপ্লাইতে কাজ করার দৌলতে রোজই কেউ না কেউ আসে বাবার কাছে – আজ নতুন মিটার, কাল নতুন লাইন। টালার ছোড়দাদু (আমার আবার চার-পাঁচজন ছোড়দাদু) আবার খুব মিশুকে আর গপ্পে মানুষ। রোজই ওনার সঙ্গে কারুর না কারুর আলাপ পরিচয় হয়। সেবার ছোড়দাদুরই পাড়ার কোন লোক বাড়িতে নতুন সর্ষের তেলের কল করবে, তার জন্যে নতুন লাইন চাই। কারখানার লাইন বলে কথা – কৃতজ্ঞতা স্বরূপ বিশ্বকর্মা পুজোয় তেলকল উদ্বোধনে বাবার নেমন্তন্ন। আর আমি তো আছিই বাবার লেজুড়। অবশ্য আমার নেমন্তন্নর পেছনে ছোড়দাদুর একটু তদবির ছিল – আহা, বাচ্ছা মেয়ে!
বিশ্বকর্মা পুজোয় প্রসাদ আবার মাংস-ভাত! তা আমি তো বিশ্ব নিখাগী! সবেতেই ঝাল লাগে! কিন্তু ফ্যাক্টরী দেখতে যে আমার ভা-রি ভাল লাগে! যদিও সেদিন সব মেশিনপত্তর বন্ধ। কিন্তু বাড়ির মধ্যে তেল কল! কি অবাক কাণ্ড! তারপর খেয়ে দেয়ে যেমনি গাড়িতে উঠতে যাব টাটকা ঘানিতে পেষা এক টিন খাঁটি সর্ষের তেল গাড়িতে তুলে দিল! চিরকাল জানি নেমন্তন্ন যেতে হলে গিফ্ট নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু পুজোর নেমন্তন্নে ফলমূল ছেড়ে মাংস-ভাত তার ওপর আবার রিটার্ন গিফ্ট! আমার সে বিস্ময়ের আর অন্ত ছিল না!
কিন্তু তার পরের বছর বিশ্বকর্মা পুজো জীবনে একটা বিরাট বড় ধাক্কা নিয়ে এল। সেইদিন থেকে ওই বিশেষ দিনের লক্ষ্মীপুজো, ঘুড়ি ওড়ানো একেবারেই হারিয়ে গেল। তবে বাবাদের ছোটবেলার হাত ধরে একটা নতুন জিনিস এল আমাদের কাছে – কালীপুজোয় তুবড়ি।।
P.C.: Google Images