Posted in Uncategorized

ফিরে দেখা

এক শ্রাবণের সকালবেলা দুরুদুরু বক্ষে, ভীরু পায়ে মনে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে এসে দাঁড়ালুম বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে ‘তারকনাথ পালিত শিক্ষাপ্রাঙ্গণ’ বা সাধারণের ভাষায় বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক – সে বহু বহু কালের। পৃথিবীর আলো দেখার আগে থেকে এখানে আমার যাতায়াত। আমার চেতন-অবচেতনে এর অস্তিত্ব। এর আগে সজ্ঞান শিক্ষাজীবনের এগারো বছর কেটেছে মায়ের স্কুলে, হোলি চাইল্ড – আমার হোলি চাইল্ড। নাঃ, মায়ের কলেজে আমার পড়া হয় নি, মায়ের বিষয়ও না। তবে আবার এসে পৌঁছলুম মায়ের ইউনিভার্সিটি – বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ।

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল আট-ন’ তলা বাড়ি। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দূরদৃষ্টির সাক্ষর তার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অবস্থানেই প্রমাণ হয়। Anthropology, Zoology, Botany, Geography, Statistics, Bio-Chemistry সব পেরিয়ে সবার মাথার ওপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘Department of Pure Mathematics’ – ‘বিশুদ্ধ গণিত বিভাগ’। এমনিতেই সাধারণ লোকের ধারণায় অঙ্কের লোকেরা ‘আধপাগল’, ‘ছিটগ্রস্ত’  মানে তাদের মানসিক অবস্থান বাস্তব দুনিয়া থেকে অনেক দূরে। কাজেই অঙ্ক কষতে কষতে তাদের মাথা গরম হয়ে উঠলে সেই চিন্তাতরঙ্গ সোজা ছাদ ভেদ করে ছড়িয়ে যাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোণায় কোণায়। অন্যান্য বিষয়ের চিন্তাজাল সেই তরঙ্গস্রোতকে সহজে ছিন্ন করতে পারবে না।

প্রথমদিন কোলাপসিবিল গেট দিয়ে ঢুকে দুপাশে একের পর এক অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের নাম লেখা দরজা পেরিয়ে এসে পৌঁছলুম করিডোরের এক্কেবারে শেষপ্রান্তে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসরুমে। বিরাট ঘর – সামনে দেওয়াল জোড়া ব্ল্যাক – থুড়ি গ্রিন বোর্ড। তিনসারি বেঞ্চ সবই প্রায় ছেলেদের দখলে। এতদিনের প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ব্যাকবেঞ্চারের তুলনায় সামনের সিটের চাহিদাই বেশী। অঙ্ক কিনা, সবেতেই তাই ব্যাতিক্রমই নিয়ম! কলেজে অনার্স ক্লাসে পনেরোজনের মধ্যে আমরা বারোজনই ছিলাম মেয়ে। আমাদের দৌরাত্ম্যে হারাধনের ওই বাকি তিনটি ছেলের টিকির দেখা মিলত না। এখানে এসে দেখি প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্নজন ছেলের মাঝে টিমটিম করছে আট-দশজন মেয়ে।

ভালভাবে বোর্ড দেখতে গেলে মাঝের রো’য় বসাই ভাল। তা প্রথম বেঞ্চেই তো দেওয়াল হয়ে বসে আছে দু-তিনটে ছেলে! তারপর তিনটে বেঞ্চে জনা তিনেক করে মেয়ে – ব্যাস্‌, মহিলা মহল খতম! থার্ড বেঞ্চে একজন বেশ হাসিখুশি লম্বা মত মেয়ে তার মাথায় ইয়া মোটা বিনুনি, পাশের শান্ত-শিষ্ট ফর্সা ফর্সা বন্ধুর সঙ্গে গল্পে মত্ত। তার পাশেই গিয়ে বসলুম। আলাপ হল – বিনীতা সেনগুপ্ত, পাশে আশালতা। দুজনেই কৃষ্ণনগর গভরমেণ্ট কলেজ থেকে এসেছে। আর ফার্স্ট বেঞ্চের ওই কোঁকড়া চুলের ছেলেটি জয়ন্ত – ওদের কলেজের ফার্স্ট বয়, অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া! ভাবলুম এদের কেমন মজা – আগে থেকেই বেশ বন্ধু নিয়ে এসেছে!

এরপর আমাদের পাশে এসে বসল মৌসুমী – অত্যন্ত প্রাণচঞ্চল কিঞ্চিৎ ছিটগ্রস্ত। সামনের সারির ভীষণ সিরিয়াসে দলে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আসা সুচেতা, দিল্লির সোনালী আর বর্ণালী। পেছনে শান্তশিষ্ট মিতা, স্বপ্না আর রুমা। কিছুদিন পর এসে যোগ দিয়েছিল সীমা জৈন আর সাথী। সুচেতা খুব ভাল গান করত, বিশেষ করে নজরুলগীতি।

জয়ন্তর পাশের ছেলেটি সুদীপ্ত – সাউথ পয়েন্ট থেকে পাশ করে তারপর আশুতোষ কলেজে পড়েছে। চটপটে স্মার্ট বলিয়ে-কইয়ে গোছের লিডার টাইপ! বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই কলকাতার বাইরে থেকে হয় ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে নয়তো হস্টেলে থাকে। বিনীতা আর আশাও কিছুদিন পর লেডিস হস্টেলে চলে এল।

এরপর একে একে স্যার ও ম্যাডামদের সঙ্গে পরিচয়। তখন হেড ছিলেন বাদলবাবু, BC – পড়ান Propositonal Logic. বিষয়টা সহজ ও মজার আর স্যার পড়ানও খুব সহজ করে। Predicate Logic পড়ান MC – মানে মিহিরবাবু। উস্কোখুস্কো চুলে সুকুমার রায়ের হেড অপিসের বড়বাবু মার্কা গোঁফে স্যারকে দেখলেই আমার আইনস্টাইনের কথা মনে হত – typical absent-minded professor! সামনে দিয়ে আমরা চলে গেলেও ওনার চোখে পড়তুম কিনা সন্দেহ হত। তাই পরে যেদিন আবিষ্কার করেছিলুম যে উনি আসলে আমাকে ‘চেনেন’ সেদিন কি প্রচণ্ড যে অবাক হয়েছিলুম!

কুচকুচে কালো চুল, কালো মোটা গোঁফ আর মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে খদ্দরের পাঞ্জাবী আর ধুতি পরা রাশভারি শোভাকরবাবু যেন পরিবারের কর্তা – সামান্য খুঁটিনাটি বিষয়ও যাঁর কড়া নজর এড়ায় না! শোভাকরবাবুর কথা সীতাংশুকাকুর মুখে আগেই শুনেছিলুম – কাকুদের বন্ধু। তখন আমরা সবাইকে BC, SG, JD, DG – এভাবেই চিনি। শোভাকরবাবুর এতে ভারি আপত্তি। বলেন ‘শুনলেই নিজেকে কেমন কয়েদি, কয়েদি মনে হয়!’ আমারও সেই শুনে মনে পড়ে গেল ‘মা খু চিহল ও পঞ্জম হস্তম’। সীতাংশুকাকু যেমন আমরা স্যার বললেই বলতেন ‘কাকু বলতে পারিস না! কি ষাঁড়, ষাঁড় করছিস!’ শোভাকরবাবুর মধ্যে একটা ‘ক্যারিশ্মা’ ছিল। ক্লাসে ঢুকেই আমাদের সম্বোধন করলেন ‘My friends’! পড়াতে পড়াতেও বলতেন ‘now my friends …’। শুনতে বেশ মজা লাগত। চক ধরে যখন বোর্ডে লিখতেন মনে হত যেন তুলি ধরে ছবি আঁকছেন। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেন ‘মা জননী’ বলে, যেটা অর্ণবদাও অনুকরণ করত। তবে স্যার ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্রদের বেশী পছন্দ করতেন আর ওনার ওই পক্ষপাত বেশ বোঝা যেত। যেমন আমাদের তারক ছিল স্যারের খুব প্রিয়।

আর সেবার যখন সবাই মিলে পেছনের জানলা দিয়ে Miss Universe Sushmita Sen কে দেখার জন্যে হামলে পড়েছিল স্যার দেখতে পেয়ে যা বকুনি দিয়েছিলেন! সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা যে মানুষের সাফল্যের মাপকাঠি হতে পারে সে কথা স্যার কোনওমতেই মেনে নিতে পারেন নি। তবে তাতে করে আমাদের ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে সারা বছর উঁকি ঝুঁকি মেরে আরেকজন সৌন্দর্যের সম্রাজ্ঞী সুচিত্রা সেনকে দেখার চেষ্টা বন্ধ করতে পারেন নি।

শোভাকরবাবুর সঙ্গে সবসময় একসঙ্গে গল্প করতে বাড়ি যেতে যাঁকে দেখা যেত আকৃতি ও প্রকৃতিতে তিনি ছিলেন শোভাকরবাবুর বিপরীত। ফর্সা, লম্বা, মাথায় ধবদবে সাদা চুল, শ্মশ্রুগুল্‌ফহীন মুখ চোখে সরু ফ্রেমের চশমা সত্ত্বগুণের প্রতিমূর্তি মৃদুলবাবু – MKS এক্কেবারে স্নেহময় পিতা – সব সন্তানের প্রতি যাঁর অগাধ প্রশ্রয়।

প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্রং মিত্র বদাচরেৎ – এই শাস্ত্রবাক্য মেনে সকাল থেকেই MNM এর ঘরে টাটকা চা আর সিগারেটের গন্ধ ম’ ম’ করত। আসরের মধ্যমণি শোভাকরবাবু, মানববাবু ও সভ্যকূলে দুজনের যত রিসার্চ স্কলার। MNMএর নামটা যত বড় রোগাসোগা ছোটখাট মানুষটি ঠিক তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝড়ের গতিতে হাঁটেন, চলেন, কথা বলেন আর লেখেন!

ক্লাসে ঢুকে কোনও কথা না বলে বোর্ডের বাঁদিকের ওপরের কোণা থেকে ছোট ছোট অক্ষরে লিখতে শুরু করতেন যেন সবুজ ঘাসের ওপর সারি দিয়ে সাদা পিঁপড়ে চলে যাচ্ছে! আমরা যতক্ষণে বাঁদিকের অংশের নোট টুকে শেষ করতে ব্যস্ত স্যারের তিন কি চার সারি নোট লিখে প্রথম অংশ মুছে বোঝানো শুরু হয়ে যেত। প্রথম দিকে থৈ কূল পেতুম না, লেখা শেষ করব না পড়া বোঝানোয় মন দেব! একটু হাত থেমেছে কি বোর্ডের নোট মুছে গেছে! বিনীতা খুব speedএ নোট লিখত আর ওর হাতের লেখাও ছিল মুক্তোর মত। বেশিরভাগ সময় বিনীতার খাতাই ছিল আমার ভরসা। শুধু MNMএর ক্লাসেই নয় TDর ক্লাসেও।

আমি ফাঁকিবাজ Linear Algebraর ওই একই রকম একশোটা প্রুফ লিখতে একদম ভালবাসতুম না। কিন্তু বিনীতা কৃষ্ণনগর-কলকাতা ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করেও সব কাজ এক্কেবারে complete. TDও তাই প্রথম থেকেই বিনীতাকে খুব পছন্দ করতেন। ছাত্রছাত্রীদের সমস্ত গতিবিধি TDর সন্ধানী দৃষ্টির গোচরে। ছাড় নেই কারুরই।

ডিপার্টমেন্টের করিডোরে রামানুজান, Gauss, Laplace, Euler, Riemannএর ছবির সঙ্গে একটা ছবি ছিল তাঁর টাকমাথা মুখটা দেখলেই মনে হত PKS! PKSও TDর মত মুখরোচক খবরের সন্ধানে থাকলেও তুলনায় ওনার জনপ্রিয়তা ছিল একটু কম। তবে ক্লাসে এসে বাঁ হাতটা নিচু করে নোটের কাগজ ধরে আড় চোখে চেয়ে যখন বোর্ডে লিখতেন দেখতে খুব মজা লাগত – ঠিক যেন টুকলি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবেন!

ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেই বাঁহাতে যেমন MNMএর ঘর, ডান হাতে ছিল DKB-SKAর ঘর। SKA সবসময়ই নার্ভাস, ভীরু, আর DKB বড় দাদার মত ওনাকে সবসময় আগলে রেখেছেন। কিছুদিনের জন্যে এই ঘরে আমার যাতায়াত বেশ বেড়ে যায় তবে সে কথায় পরে আসছি।

স্যারেদের কথা বলতে যাঁর নাম হয়তো আমার সবচেয়ে আগে বলা উচিত ছিল তাঁর কথা বলি সবার শেষে। DG – ছাত্রছাত্রীদের কাছে কিছুটা ব্রাত্য কিছুটা হাসির মানুষ। দুপুর আড়াইটের আগে কোনদিন আসেননা আর থাকেন সন্ধ্যে সাতটা-সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। পরণে এক্কেবারে কোঁচকানো-দোমড়ানো হাফ শার্ট, ঝড়ের মতো আসেন-যান। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকেই বললেন “আমি ‘take home’ দিই, না করলেই পরীক্ষায় নাকের জলে চোখের জলে।“ তারপর বললেন “আমি শনি-রবিবার ম্যারাথন ক্লাস নিই সকাল থেকে টানা ছ’ ঘন্টা।“ কার্যক্ষেত্রে অবশ্য সারা দু বছরে একটাই মাত্র শনিবার দু’তিন ঘন্টার জন্যে ‘ম্যারাথন ক্লাস’ হয়েছে।

প্রথমদিন সবাইকে নিজের নাম আর কলেজের নাম বলতে হয়। স্যার বললেন তোমাদের নাম আমি মনে রাখতে পারব না। কলেজের নাম ধরে ডাকব। যে কলেজ থেকে একের বেশী স্টুডেন্ট এসেছে যেমন কৃষ্ণনগর বললে যে কোন একজনকে উত্তর দিতে হবে। তা আমার তো নাম নিয়ে চিরকালের সমস্যা। বিধান নগর কলেজ থেকে গেছি। এদিকে বিধান বলে একটি ছেলে আছে ক্লাসে। তা স্যার ‘বিধান’ বললে সে উত্তর দেবে না আমি বোঝা মুস্কিল! তবে স্যার আমায় ‘সল্টলেক’ বলে ডাকতেন প্রথম প্রথম। তারপর বাবা-মায়ের দেওয়া নামে চিনতে খুব বেশী সময় নেন নি। কিন্তু যেদিন সিঁড়ির ওপর থেকে ‘নাটক’ বলে হূঙ্কার দিয়েছিলেন আমি বেজায় চমকেছিলুম বলাই বাহুল্য!

স্যার হলেন অত্যন্ত সংশয়ী প্রকৃতির কারুর ওপর ভরসা করে ভরসা করতে পারেন না। তার ওপর আবার যোগ হয়েছে স্যারের স্যার প্রফেসর এন সি বোস মজুমদারের মন্ত্রগুপ্তির শিক্ষা। বলতেন নিজের রিসার্চের কাজ নিজের পার্টনারকেও বলবে না। বাসুদা ডিপার্টমেন্টের সব স্যারেদের নামে লাইব্রেরি থেকে বই নেয়, কেবল DG ভরসা করে ওনার নামে বই তুলতে দিতেন না। যদি ঠিক সময় ফেরৎ না দেয়। অথচ বাসুদা ছিল স্যারের প্রিয় ছাত্র। আমাদের নোট দিতেন ওনার ছাত্র জীবনের ছোট বঙ্গলিপি খাতা থেকে। সেই খাতার তখন খুবই করুণ দশা। সব পাতা আলাদা আলাদা হয়ে খুলে যাচ্ছে। একদিন অনেক বলে কয়ে পরেরদিনই খাতার পাতা জুড়ে মলাট দিয়ে নিয়ে আসব এই কড়ারে আমায় একটা খাতা দিলেন। সেই খাতার পাল্টানো ভোল দেখে তার পর থেকে এক কথায় আমায় খাতা বা বই দিতে রাজি হয়ে যেতেন। এমন কি ওনার নামে লাইব্রেরির বইও।    

ম্যাডামদের মধ্যে প্রথমেই আসে জ্যোতিদির কথা। ছোট্টখাট্ট মানুষটি সাদা তাঁতের শাড়ি প্লিট দিয়ে সুন্দর করে পরা, মাথায় কাঁটা দিয়ে টানটান করে বাঁধা খোঁপা এক্কেবারে টিপটপ। ঘড়ি ধরে ক্লাসে আসেন ঘড়ি ধরে ক্লাস শেষ করেন। ক্লাসে ঢুকে প্রথম কাজ ছিল বোর্ড মোছা। যত পরিষ্কার করে মোছা বোর্ড হোক দিদির মোছার গুণে এক্কেবারে ঝকঝকে হয়ে যেত যেন সদ্য রঙ করা হয়েছে। এসেই বোর্ডে লম্বা লম্বা করে দাগ টেনে চার ভাগ করে নিতেন। আর ধরে ধরে মুক্তোর মতো হাতের লেখায় বাঁদিক থেকে লিখতে শুরু করতেন। বোর্ডে কি করে সুন্দর করে লিখতে হয়, কত সহজে কত কম কথায় পুরো বিষয়টা কি করে প্রেজেন্ট করতে হয় বি এড পড়ার ঢের আগেই জ্যোতিদি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আর শিখিয়েছিলেন নিজে নিজে বই পড়ে কোনও বিষয় বোঝা আর নোট করা। বলতেন আমি তোমাদের ভবিষ্যতে রিসার্চ করার জন্য তৈরী করিয়ে দিচ্ছি। দিদির চেহারা, চালচলনে ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য যেন ফেটে পড়ত। ওনাকে দেখলে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যেত।

বন্দনাদি ছিলেন জ্যোতিদির দোসর। দুজনে যেন দুই বোন। তবে বন্দনাদি যেন জ্যোতিদির ছায়া। একজন নিজস্ব স্বকীয়তায় জাজ্বল্যমান সূর্য আর অন্যজনের মধ্যে ছিল চাঁদের স্নিগ্ধতা।

JS আসতেন নিজের ফিয়াট গাড়ি চালিয়ে। বাকিরা যখন হেঁটে, বাসে বা ট্রেনে করে যাতায়াত করতেন তখন ম্যাডাম ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেন হাতে নিজের গাড়ির চাবি ঝুলিয়ে। কিন্তু নিজে গাড়ি চালিয়ে আসা সেই ব্যক্তিত্বময়ী মহিলাকে ক্লাসের মধ্যে এক্কেবারেই মেলানো যেত না। সেখানে তিনি একেবারেই সাদামাটা, কিছুটা ম্লান। নির্দিষ্ট সময়ের ঢের আগেই ‘আজ থাক’ বলে ক্লাস শেষ করে দিতেন। সকালে আসতেন যেমন সবার আগে দুপুরে বাড়িও যেতেন সবার আগে। আমরা বলতুম JS আর  DGর ডিপার্টমেন্টের টাইমিং এর  intersection empty set.

MT বা MM বলতে মঞ্জুষাদি।ছাত্রছাত্রীদের এক্কেবারে my dear. Differential Geometry যদিও আমার বিশেষ ভাল লাগত না, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক মঞ্জুষাদির অসীম স্নেহ পেয়েছি – ডিপার্টমেন্টে এবং ডিপার্টমেন্টের বাইরে। আমি যেমন বাড়ি থেকে দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছি দিদির বাড়ি দুর্গাপুজো দেখতে, তেমনি দিদি একমাত্র যিনি আমার বিয়েতে এসেছিলেন। আর পরে আমাদের পুণার বাড়িতেও এসে ঘুরে গেছেন।

ক্লাস করতে করতে ধীরে ধীরে স্যার ম্যাডামদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, ওই বাড়িটা আপন হয়ে উঠেছে, এমন কি লিফটম্যান দাদাও চিনে গেছে – লিফটে উঠে বলতে হয় না আপনি ৭ নম্বরে লিফট থামিয়ে দেয়। সহপাঠী সহপাঠিনীরাও ‘বন্ধু’ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় পাওনা বিনীতা আর ওর সূত্রেই সুব্রত বিশ্বাস দা। দুজনেই মনের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছে। সীমা আমার যাতায়াতের সঙ্গী, এক বাসে একসঙ্গে বাড়ি ফিরি।

ছেলেদের মধ্যে অনির্বাণ, মৃণাল, অয়ন খুব সিরিয়াস। তারক তো অনার্সে ফার্স্টক্লাস পাওয়া – বিরাট fan following. দীপঙ্কর প্রচুর বাংলা গল্পের বই সাপ্লাই করত। সমীর, সুবিমল, শ্যামাপ্রসাদ, আনিসুর, উৎপল, অভিজিৎ, হাবিব, জার্জিস, অংশুমান – সবাইকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পাশে পেয়েছি। শ্যামাপ্রসাদ, অয়ন আর আমার একই স্পেশাল পেপার। জ্যোতিদির ক্লাসের নোট তৈরী থেকে Prof. N. C. Bose Majumder memorial essay competitionএ একসঙ্গে participate করা। অয়ন নিজের দুনিয়ায় থাকত তবে কোনও সাহায্য চাইলে কখনও না বলত না। শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে দেখেছি কি অসম্ভব ধৈর্য আর একাগ্রতা – tenacity and detailing. সে Monotonic Function এর essay লেখাই হোক, কি মধুবালার ছবি আঁকা।

ফার্স্ট বেঞ্চের সুদীপ্ত আর জয়ন্তর সঙ্গে সেই প্রথম দিন থেকেই ছিল খুনসুটির সম্পর্ক। আমাদের দেখে বোঝা যেত না আমরা ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে উঁচু ক্লাসে পড়ি না কি স্কুলের এক্কেবারে নিচু ক্লাসে। বোর্ড দেখতে পাচ্ছি না বলে সরে বসতে বললে দুজনে আরও পাশাপাশি ঘেঁষে বসত, আর আমার আর মৌসুমীর পেনের গুঁতো খেত। M.Sc.র শেষ দিনে আমার Slam Bookএ সুদীপ্ত লিখেছিল ‘আশাকরি আমাদের বন্ধুত্বটা চিরদিন অটুট থাকবে।‘ কিন্তু কালের নিয়মে জীবনের পথে চলতে চলতে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যায়। এতদিন পর নতুন করে বন্ধুদের ফিরে পাওয়ার মুহূর্তে খবর পেলুম সুদীপ্ত আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে – না ফেরার দেশের বাসিন্দা!

আমাকে ফাঁসাতে গিয়ে সেবার সুদীপ্ত আর জয়ন্ত যে রাম বুদ্ধু হয়েছিল সে কথা এবার বলতেই হয়। ফার্স্ট ইয়ারে এই মাস দেড়-দুয়েক ক্লাসের পর একদিন টিফিনের সময় DKB সুদীপ্তদের দেখা করতে বললেন। একটু পরেই দুই মক্কেল এসে আমায় বলল স্যার তোকে ডাকছেন। আমার তো তখন কেউ ডাকছেন শুনলেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। মনে হয় ওরে বাবা কি করলুম আবার! অবশ্য সিস্টার রোমানার কথায় ভয় পাওয়াটা আমার বিলাসিতা! যত বলি কেন ডাকছেন বল। দুজনেই বলে জানি না। ভয়ে ভয়ে স্যারের ঘরে যেতেই স্যার জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি নাকি অভিনয় করো!’ আমার তো মহা বিস্ময়! এ কথা তো স্যারের জানার কথা নয়! বলি ‘হ্যাঁ স্যার করি তো’। ‘কোথায় করেছ?’ ‘পাড়ায় পুজোর নাটকে’। ‘সামনে ডিপার্টমেন্টের রি-ইউনিয়ন। তোমাকে নাটকে অভিনয় করতে হবে।‘ বুঝলুম এ ওই ‘দাদার কীর্তি’ কেস। আমাকে অপ্রস্তুতে ফেলতে দুই মক্কেল স্যারের কাছে আমার নাম বলেছে। স্যারের ঘরে আমার পিছু পিছু দুজনে এসেছিল রগড় দেখতে। আমার কথা শুনে একদম ‘বোলতি বন্ধ্‌’। বাইরে আসতেই বলে ‘সত্যিই তুই অভিনয় করিস!’ আমিও তখন ডাঁটের মাথায় বলি ‘করি কিনা দেখবি!’

স্যার বললেন ছুটির পর এস। আমায় আর পায় কে! সুন্দরমের দীপকদা, মাঙ্গলিকের সমীর বিশ্বাস, রঙ্গনা থিয়েটারের দেবকুমার সবাই আমার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন সময়ে সময়ে। মনোজ মিত্র স্বয়ং আমাদের নাটক দেখে গেছেন। ‘আমি কি ডরাই সখী …’। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ফার্স্ট ইয়ার থেকে একমাত্র আমি নাটকে আছি। বাকি দু-একজন একদিন করে এসেই বিভিন্ন অছিলায় চলে গেছে – পরীক্ষার পড়ার ক্ষতি হবে, হ্যান-ত্যান।

এই নাটকের সূত্র ধরেই সিনিয়ার দাদা-দিদিদের সঙ্গে আমার খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল। এরপর থেকে ডিপার্টমেন্টে আমার প্রচুর গার্জেন। অর্ণবদা Differential Equationএ পুরো বাঁধানো নোট দিয়ে দিল। চন্দনাদি দিল Special এর 9th Paper. সুব্রতদা বাড়ি এসে পরীক্ষার আগে Differential Geometry পড়িয়ে গেল। দীপ্তেনদা-বাসুদা রিসার্চের শুরুর দিনগুলোয় শেখালো কি করে Journal review করতে হয়, কোথা থেকে research papers জোগাড় করতে হয়, স্যারের ঘরে সেমিনারে নতুন নতুন টপিক নিয়ে আলোচনা। রীতাদি ডেকে ডেকে গোখেল কলেজে কাজ দিল আর শমিকদার বাইকে চড়ে কুড়ি মিনিটে বাড়ি।

তবে সবার ওপরে ছিলেন DKB. খবর নিতেন পড়াশোনা ঠিকমত হচ্ছে তো? দেখো বাপু ওটা যেন ঠিক হয়। বলতেন বিয়ে করলে আমার তোমার বয়সী একটা মেয়ে থাকত। নাটকের সূত্রেই সবাই মিলে একদিন স্যারের বাড়ি পিকনিক করতে যাওয়া হল। প্রধান উদ্যোক্তা অদিতিদি। সেই অদিতিদি, অর্ণবদাও এখন তারাদের দেশে!

জানুয়ারী মাসের রি-ইউনিয়নের জন্য শনি-রবিবার নাটকের রিহার্সাল। ক্লাসের বাকি সবাই বাড়িতে পরীক্ষার পড়া তৈরীতে ব্যস্ত। বেশী পড়াশোনা করা যদিও আমার কোনওদিনই পোষায় না তবু বিবেক দংশন হয়। পার্থদা বলল, ‘শোন যারা পড়ার বাইরে এইসব রি-ইউনিয়ন, নাটক এসব করে দেখবি পরীক্ষায় তাদের রেজাল্ট বেশী ভাল হয়। এই আমায় আর উৎপলকে দ্যাখ। আমরা আমাদের সময় re-union, excursion সব কিছুর পাণ্ডা ছিলাম। আমরাই ফার্স্ট আর সেকেণ্ড হয়েছিলাম।‘ নাঃ, ফার্স্ট-সেকেণ্ডের আশা করতুম না, তবে পার্থদার কথায় ভারি ভরসা পেয়েছিলুম। আরও একটা কথা বলেছিল পার্থদা – এই ডিপার্টমেন্টে যে যাঁরই প্রিয় ছাত্র বা ছাত্রী হোক না কেন পরীক্ষার খাতায় কোনদিন কোনও partiality হয় না।

নাটকে পার্থদা, ঊৎপলদা, মাধবদা ছাড়াও প্রথমে অতসীদির একটা গান ছিল। কিন্তু চন্দনাদি, অদিতিদি আর আমি যখন রিহার্সালের ফাঁকে চুটিয়ে গল্প করতুম অতসীদি কিন্তু সেখানে থাকত না। কেষ্টদা পুরো রিহার্সাল করার পরও একদম ফাইনালের দিন পারিবারিক কারণে আসতে পারে নি। আর ত্রিপাঠী ধূমকেতুর মত মাঝে মধ্যে একেকবার এসে রিহার্সাল করে যেত।

নাটকের মেন পার্টে স্যার নিজে আর সুব্রতদা। দুজনের কারুর এক লাইনও পার্ট মুখস্থ নেই। প্রম্পটার বাসুদা প্রম্প তো করছে কিন্তু কার যে ডায়লগ দুজনের কেউ ধরতেই পারছে না। হল ভর্তি দর্শক তো হেসে খুন! তাতেও শুনলুম স্যার নাকি ‘আমার ভয়ে’ রাত জেগে জেগে পার্ট মুখস্থ করেছেন!

রি-ইউনিয়নের দিন নাটকের শেষে বাড়ি ফেরার তাড়া – শীতের রাত। সুব্রতদা বলল আগে একবার ডিপার্টমেন্টে চ’। গিয়ে দেখি সেকেণ্ড ইয়ারের ক্লাসরুমে থিকথিকে ভীড়। কি ব্যাপার! একটু পরে MNM তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গতিতে ঘরে ঢুকলেন – প্রবল হাততালি। শুরু হল স্যারের গান। নিচের মূল অনুষ্ঠানে স্যার কিন্তু গান করেন না। ওটা রি-ইউনিয়নের বিশেষ আকর্ষণ। একটার পর একটা গান। শেষ গানের রেশ কানে নিয়ে বাড়ি ফিরলুম – ‘আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো’।।