Posted in Reflections

তব কথামৃতম্‌

তব কথামৃতং তপ্তজীবনং, কবিভিরীড়িতং কল্মষাপহম্‌।

শ্রবণমঙ্গলং শ্রীমদাততং, ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ।।

[গোপীগীতা, রাসপঞ্চাধ্যায়]

শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের একত্রিংশতি অধ্যায়ের নবম শ্লোক – বৈষ্ণবভক্তদের মধ্যে তো বটেই কিন্তু আজ সমধিক প্রচলিত ও প্রসারিত শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমণ্ডলীর কাছে। রামকৃষ্ণ ভাবাশ্রয়ীদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই ‘শ্রীম’, তাঁর রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রথমেই এই শ্লোকটির উল্লেখ করেছেন। রচনার মঙ্গলাচরণ করেছেন এই শ্লোক দিয়েই। আর আমরাও তোতাপাখীর বাঁধা বুলির মত কথামৃত পড়ার আগে এইটি আউড়ে যাই। কিন্তু সত্যিই কি ভেবে দেখেছি এই কথাগুলোর কি তাৎপর্য!

কথা মানে শুধুই কি ‘বাণী’? কথার তো আরেকটা মানে হয় গল্প বা আখ্যান। আসুন না ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের বাণীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনের আখ্যানের নিরিখে একটু আলোচনা করা যাক এই শ্লোকের মর্মার্থ।

কথামৃতকার মাস্টারমশাই ঠাকুরের ‘কথা’ কে শুধু ‘কথা’ বলেই ক্ষান্ত হন নি – বলেছেন ‘কথামৃত’। এই অমৃত জীবনদায়ী। কিন্তু কার কাছে? উত্তর!

১) তপ্তজীবনম্‌ –

সংসারের তাপে দগ্ধ ক্লান্ত মানুষ যখন দুঃখে কষ্টে মুহ্যমান – মনে করে আর কেন! শেষ করে দিই জীবনটা তখন ঠাকুরের কথা, ঠাকুরের জীবন নতুন করে তাদের বাঁচার রসদ জোগায়। বিশ্বাস না হলে স্বয়ং কথামৃতকারের জীবনের দিকেই একবার ফিরে তাকান না! জীবনের প্রতি হতশ্রদ্ধ মাস্টারমশাই তখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন কলকাতার কাছাকাছি এ বাগান, সে বাগান – জীবনটা মনের মত চলছে না, কিন্তু জীবনের ইতি টানার জায়গাটা তো মনের মত খোঁজা যায়! ঘুরতে ঘুরতেই এসে পড়লেন ‘রাসমণির বাগানে’। প্রথম দর্শনেই ঠাকুরকে দেখে তাঁর মনে হল ‘সাক্ষাৎ শুকদেব ভাগবৎ-কথা কহিতেছেন, আর সর্বতীর্থের সমাগম হইয়াছে। অথবা যেন শ্রীচৈতন্য পুরীক্ষেত্রে রামানন্দ স্বরূপাদি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন ও ভগবানের নামগুণকীর্তন করিতেছেন’। সেই পরিচয় ঠাকুরের সঙ্গে। সম্পূর্ণ বদল হয়ে গেল একটা জীবন। ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের কথাকার হয়ে গেলেন অমর।

ঠাকুরের অন্তরঙ্গ দলের শেষ সদস্য – ঈশ্বরকোটি তিনি – পূর্ণ তাঁর নাম। সংসারের জ্বালায় জর্জরিত। ঠিক করলেন এবার শেষ করে দিতে হবে এই জীবনটাকে। প্রস্তুত হয়ে ভাবলেন শেষবারের মত একটু ঠাকুরের কথা পড়ে নি। সেই চিন্তা করতে করতে পাড়ি দেওয়া যাবে পরপারে। কথামৃত হাতে নিয়ে অমনিই উল্টোলেন পাতা। দেখেন লেখা রয়েছে, ‘পূর্ণের বয়স পনর হইবে। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন’। ব্যস্‌, মনের মধ্যে ওঠে নতুন তরঙ্গ – ‘ঠাকুর সবসময় আমার মঙ্গল চিন্তা করেন! আর সেই আমি নিজের জীবন শেষ করার কথা ভাবছি!’ মৃত্যুচিন্তা মুছে গেল মন থেকে।

আদরের কন্যাটিকে হারিয়ে ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত জীবনের মানে খুঁজে পান না। যে মেয়ে এই ছিল এক লহমায় সে নেই হয়ে গেল! অস্থির মনে একদিন গিয়ে পড়েন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে। দুপুর থেকে সন্ধ্যে গড়িয়ে যায় কথায় কথায়। বাড়ি ফেরেন রাম দত্ত – যেন এক নতুন মানুষ।

শোকাতুরা বিধবা ব্রাহ্মণী হারিয়েছেন তাঁর একমাত্র মেয়েটিকেও। ঠাকুরের ঘরের বাইরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনেন ঘরের ভেতরের কথা। সেই কথাই শেষ পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয় তাঁর সে শোক। খুঁজে পান বেঁচে থাকার নতুন দিশা।

ঠাকুর আমাদের বালক স্বভাব। যেখানে যা নতুন কিছু শোনেন তাই দেখতে ছোটেন। নইলে কেউ কোনদিন শুনেছে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী থিয়েটার দেখতে যান! ‘নিমাই সন্ন্যাস’ পালা। দেখে বললেন ‘আসল নকল এক বোধ হল’। পালটে গেলো বিনোদিনী সহ আরও সব নটীদের জীবন। অমৃতের সন্ধান পেলেন তাঁরা। শুদ্ধতার মূর্তরূপ ঠাকুর যিনি এতটুকু অশুদ্ধ সহ্য করতে পারতেন না, সাহেবরূপী ছদ্মবেশী তারাসুন্দরীকে কৃপা করলেন – কোথায়? সেও সেই কাশীপুরে, শেষ অসুখের সময়। বারাঙ্গনা নটীদের তাপিত চিত শীতল হল সেই অমৃতের পরশে।

২) কবিভিরীড়িতম্‌ –

কবি অর্থাৎ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি, জ্ঞানী যাঁরা, তাঁরা প্রশংসা করেন যাঁর, হয়ে যান সেই অমৃতের ভাগী। সে তো সেই শুরুর কাল থেকেই। ভৈরবী ব্রাহ্মণীর উৎসাহে মথুরবাবুর ব্যবস্থাপনায় বৈষ্ণবচরণ সহ বড় বড় পণ্ডিতেরা আসেন তর্কসভায় ঠাকুরের অবতারত্ব প্রমাণ করতে। ইঁদেশের গৌরী পণ্ডিত সেদিন ছিলেন না। পরে এসে তিনি ঠাকুরকে বলেন, ‘বৈষ্ণবচরণ আপনাকে অবতার বলে? তবে তো ছোট কথা বলে। আমার ধারণা, যাঁহার অংশ হইতে যুগে যুগে অবতারেরা লোক-কল্যাণসাধনে জগতে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাঁহার শক্তিতে তাঁহারা ঐ কার্য সাধন করেন, আপনি তিনিই!’  বালক স্বভাব ঠাকুর বলেন, ‘কে জানে বাবু, আমি তো কিছু জানি না’।

পশ্চিমদেশ থেকে আসা দার্শনিক পণ্ডিত নারায়ণ শাস্ত্রী – তিনি ঠাকুরের মধ্যে ‘শাস্ত্রের সূক্ষ্ম বিষয় সমূহ উপলব্ধ’ লক্ষ্য করেছিলেন। তাই নবদ্বীপ থেকে নব্যন্যায়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করে ফেরার পথে আবার আসেন দক্ষিণেশ্বরে। জেদ ধরে শেষ পর্যন্ত ঠাকুরের কাছে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ঠিক চিনেছিলেন ঠাকুরকে।

সে সময়ের বিদগ্ধ বক্তা শ্রী কেশব চন্দ্র সেন। স্বয়ং ইংল্যাণ্ডের রাণী যাঁর বক্তৃতা শুনতে আগ্রহী, তিনি সময় পেলেই ছুটে আসেন ঠাকুরের কথা শুনতে। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনিই প্রথম প্রচার করলেন ঠাকুরের কথা। সেই লেখা পড়েই সে সময়ের কলকাতার বড় বড় বিদ্বান-বুদ্ধিজীবী থেকে কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা একে একে আসতে শুরু করল ঠাকুরের কাছে।

রামচন্দ্র দত্ত ঠাকুরের বাণী প্রচার করতে লাগলেন পুস্তিকার আকারে, বক্তৃতার মাধ্যমে। নাট্যাচার্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর বিভিন্ন নাটকে ঠাকুরেরই ভাব, তাঁরই কথা প্রচার করলেন। তিনি বলতেন ‘নাটক লিখতে তিনিই শিখিয়েছেন’।

স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলার পর বলেন ‘আজ একটি নতুন কথা শিখলাম ‘।

৩) কল্মষাপহম্‌ –

ঠাকুরের কথামৃত মানুষের দেহ-মন থেকে কালিমা-কলুষ দূর করে দেয়।

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ নিজের সম্বন্ধে বলতেন তিনি নাকি এত পাপ করেছেন যে তিনি যেখানে দাঁড়ান সেখানে মাটি সাত হাত নিচে নেমে যায়। ঠাকুরের পবিত্র পরশে সেই গিরিশ চন্দ্র হয়ে উঠলেন ‘ভক্ত ভৈরব’। ঠাকুরের কৃপা স্পর্শে তিনি মনে করতেন তিনি গঙ্গাস্নান করলে মা গঙ্গা তাঁর পাবনী শক্তি ফিরে পাবেন।

সেই রকমই অপরিচিত জনৈক ভক্ত একদিন দক্ষিণেশ্বরে এসে ঠাকুরের ঘরের দরজার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। নিজেকে মনে করেন ক্ষমাহীন পাপী। বাইরে থেকেই ঠাকুরের কথা শোনেন আর চোখের জল ফেলেন। পরম কারুণিক ঠাকুর নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসেন তাকে। বলেন, ‘বল, আমি মাদুর্গার ছেলে। আমার কোনও পাপ নেই! আর আজ থেকে আর কোনও পাপ কর্ম কোরো না’। ব্যস্‌, তুমি শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত – এত সহজ!

কালীপদ ঘোষ, সুরেশ মিত্র আকণ্ঠ মদ্যপানে মাতাল। ঠাকুর একবারও বললেন না তাঁদের মদ খাওয়া ছাড়তে। শুধু বললেন মা কালীকে নিবেদন করে খেতে। মায়ের ছেলে মাকে কি খারাপ জিনিস দিতে পারেন! ধীরে ধীরে দুজনেরই মনের পরিবর্তন হতে দেখা যায়। একসময় সুরেশ মিত্র হয়ে ওঠেন ঠাকুরের অন্যতম রসদদার। তিনি না থাকলে আমরা আজ এই রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ পেতুম কি!

ঠাকুর ও মা মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। একটি ভক্ত মেয়ে হঠাৎ বেশ কিছুদিন মায়ের কাছে আসে না। করুণাময়ী জননী খবর নিতে পাঠান। শোনেন সে এগজিমা রোগে আক্রান্ত তাই মায়ের কাছে আসতে পারে না। ডেকে পাঠালেন তাকে। ঠাকুরের চরণামৃত দিয়ে রোজ দু ফোঁটা করে খেতে বলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই সেই মেয়েটি রোগমুক্ত হয়ে ওঠে।

মদ্যপ পদ্মলোচন – গভীর রাতে তার মাতলামিতে অতিষ্ঠ সবাই। সে কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়েই গান শুরু করে মায়ের ঘরের বন্ধ জানলার দিকে চেয়ে। ‘ওঠ গো করুণাময়ী, খোলো গো কুঠির দ্বার’। ভক্তের সে ডাকে জননী কি সাড়া না দিয়ে পারেন! খুলে যায় মায়ের ঘরের জানলা। দূর থেকেই মা কে দেখে চলে যায় সে। রাস্তার মাঝেই পড়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কিন্তু করুণাময়ী যার সহায় তার আর চিন্তা কিসের! মা বলেন পদ্মলোচনকে ঠাকুর এসে নিয়ে গেছেন।

পরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দ ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছেছেন রাজস্থানের খেতড়িতে। রাজ অতিথির মনোরঞ্জনের জন্যে রাজা গানের আসর বসান। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, একজন বাঈজীর গান শুনবেন!আসর ছেড়ে উঠে যান স্বামীজী। ঘর থেকে শুনতে পান ভেসে আসছে যমুনা বাঈএর সেই বুকফাটা আর্তি – ‘প্রভু মেরে অবগুণ চিৎ না ধরো। সমদর্শী হ্যায় নাম তোহারো চাহে পার করো’। ঘোর ভাঙ্গে স্বামীজীর। কি একজন মানুষকে ঘৃণা করছেন তিনি! তিনি না সন্ন্যাসী! সেই মহান সন্ন্যাসীর দর্শনেই পালটে গেল যমুনা বাঈএর জীবনও। এরপর বাকি জীবন তিনি এক ছোট্ট কুটিয়ায় থাকতেন আর গান শোনাতেন শুধুমাত্র তাঁর কৃষ্ণ ভগবানকে।

৪) শ্রবণমঙ্গলম্‌ –

শ্রীম বলতেন ঠাকুরের সব কথাই মন্ত্র। যা ত্রাণ করে তাই তো মন্ত্র। সেই মন্ত্র সব সময়ই মঙ্গলপ্রদ। তবু তারও মধ্যে থেকে যদি বিশেষ কোনো আখ্যান বলতে হয় তবে সেই মাস্টার মশাইকে দিয়েই শুরু করতে হয়। সেই সে শুরুর দিনের কথা। তখনকার দিনের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ পাস মাস্টারমশাই এক গরীব নিরক্ষর পূজারি ব্রাহ্মণের কাছে সেই প্রথম দিনেই শুনলেন ‘এককে জানার নাম জ্ঞান আর বহুকে জানার নাম অজ্ঞান’। জানলেন ‘নিরাকারও সত্য আবার সাকারও সত্য’। শুনলেন, জানলেন ‘মানব জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ’।

ঘর ভর্তি লোক; বৈষ্ণবদের সম্বন্ধে বলতে বলতে ঠাকুর ভাবস্থ। বললেন, ‘জীবকে দয়া করার তুই কে? দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীব সেবা’। সেদিনের সেই এক ঘর ভক্তের মাঝে এক কলেজে পড়ুয়া ছেলে নরেন্দ্রনাথের প্রাণে বাজলো সে কথা। বললেন ‘যদি কোনওদিন সুযোগ হয় আজ যা শুনলুম তা কাজে করে দেখাবো’। উত্তরকালে সেই আদর্শই জন্ম দিল ‘রামকৃষ্ণ মিশন’।

নিরাকারবাদী কেশব সেন, ব্রাহ্মনেতা। ঠাকুরের প্রভাবে ধীরে ধীরে মানতে আরম্ভ করলেন ব্রহ্মের শক্তি – মা কালী। পরিবর্তন হল তাঁর মত প্রভাবশালী মানুষের জীবন দর্শন।

যুবক ভক্ত যোগীন্দ্র। প্রশ্ন করে বসে ঠাকুরকে ‘কাম যায় কি করে?’ ঠাকুরের সহজ দাওয়াই – ‘হাততালি দিয়ে হরিনাম করলেই কাম যাবে’। এত সহজ! বিশ্বাস হয় না যোগীন্দ্রের। তারপর ভাবে ঠাকুর যখন বলছেন একবার করেই দেখা যাক। কি আশ্চর্য! কিছুদিনের মধ্যে সত্যি সত্যিই মিলে গেল ঠাকুরের কথা, ফল পেলেন হাতে নাতে।

পরম আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ কৃষ্ণকিশোর। দেওঘরে গিয়ে জলতেষ্টায় কাতর। জল তুলছিল সে এক মুচি। ব্রাহ্মণ বললেন ‘বল শিব। তুই শুদ্ধ’। নির্দ্বিধায় খেলেন সেই ‘মুচির হাতের জল’। ঠাকুরের মুখে শোনা এ ঘটনারই পরবর্তী ধাপ মায়ের কথা – ভক্তের কোনো জাত হয় না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই তো সেই সমন্বয়ের বাণী!

বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক গরীব বিধবা বধূ শ্রীশ্রীমা। তীর্থে গেছেন দক্ষিণ ভারত। মায়ের অমোঘ আকর্ষণে ব্যাঙ্গালোরে আশ্রমে উপচে পড়া ভক্তের ভিড়। সবাই মায়ের কথা শুনতে চায়। কিন্তু কেউ তো কারুর ভাষা জানেন না। কুছ পরোয়া নেই। নীরবতাই যেখানে অন্তরের ভাষা সেখানে শব্দও কম পড়ে যায়। সেদিন সব ভক্ত বাড়ি ফিরেছিলেন মনের মধ্যে পরম পরিতৃপ্তি নিয়ে।

৫) শ্রীমদ্‌ আততম্‌ –

শ্রীমৎ – অর্থাৎ, ভগবানের কথা শ্রী বা সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ। আর তা আততম্‌ – মানে, সুদূরপ্রসারী এবং সহজপ্রাপ্ত।

ঠাকুরের কথা যে সুদুরপ্রসারী তা তো ঠাকুরের জীবনী থেকেই দেখা যায়। সাধনকালে সারা দেশের কোথা কোথা থেকে একে একে এসেছেন ভৈরবী ব্রাহ্মণী, তোতাপুরী, রামাইত সাধু। আবার কোথা থেকেই বা এসেছেন নারায়ণ শাস্ত্রী, বৈষ্ণবচরণ, গৌরী পণ্ডিত! আবার কেশব সেনের সঙ্গে এসেছেন ক্যাপ্তেন কুক। এসেছেন নেপালের রাজকর্মী ক্যাপ্তেন উপাধ্যায়, এসেছেন সিন্ধুপ্রদেশের হীরানন্দ। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, শশধর পণ্ডিত তাঁরাও এসেছেন ঠাকুরের কথা শুনতে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অধর সেন তো ঠাকুরের পরম প্রিয় ভক্তদের একজন। আর যিনিই এসেছেন তিনিই সমৃদ্ধ হয়েছেন তাঁর জীবনে।

চিকিৎসা করতে শ্যামপুকুরে থাকার সময় হঠাৎই একদিন এসেছিলেন এক খ্রীষ্টান ভক্ত; যিনি ঠাকুরের মধ্যেই দেখেছিলেন তাঁর প্রভু যীশুকে।

সেরকম মায়ের আকর্ষণও কিছু কম নয়। সিনেমা জগতের বিধর্মী পার্সী সোরাব মোদি কিসের টানে এসেছিলেন মায়ের কাছে? দুজনে তো দুজনের ভাষা জানতেন না! তবু পুর্ণ হয়েছে সবার হৃদয়, ধন্য তাঁদের জীবন।

৬) ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ –

যাঁরা বহু সুকৃতি সঞ্চয় করেছেন, উদার চিত্ত যাঁরা, সংসারের ভোগবাসনা যাঁদের চলে গিয়েছে, একমাত্র ব্রহ্মানন্দ ভোগ করতে চান যাঁরা, তাঁরাই এই অমৃত পানে পরম আনন্দ ভোগ করেন এবং অন্যকেও এই অমৃতের আস্বাদন করান।

ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানেরা অহোরাত্র কেবল ঠাকুরের ভাবেই বুঁদ হয়ে থাকতেন। যতিশ্রেষ্ঠ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন পশ্চিমে তিনি কেবল ঠাকুরের কথাই বলেছেন। কথামৃতকার শ্রীম বলতেন ঠাকুরের কথা ছাড়া আর কি জানি! তাই শুধু কথামৃত রচনা নয়, তাঁর কাছে যখনই কেউ আসতেন পরিচিত কি অপরিচিত তিনি সবার কাছে শুধুই ঠাকুরের কথাই বলতেন। সেই অমৃতবারি সিঞ্চন করতেন সবার ওপর।

আমাদের অনেকেরই হয়তো কখনও কখনও মনে হয়েছে, আমরা কেন এত পরে জন্মালুম। ঠাকুরের পার্ষদ, ঠাকুরের সন্তান, ঠাকুরের ভক্ত – যাঁরা এই চর্মচক্ষে দেখেছেন ঠাকুর-মা-স্বামীজীকে, শুনেছেন তাঁদের মধুর অমৃতময়ী বাণী, ধন্য হয়েছে তাঁদের জীবন সে অমৃত ধারায় – তার থেকে আমরা কি চির বঞ্চিতই থেকে গেলুম! কিন্তু না, অহৈতুকী কৃপাসিন্ধু ঠাকুর হঠাৎ করেই নিজে থেকে ধরা দিয়েছেন কোনোও কোনোও ভক্তের কাছে, আজও এই সময়ও।

এক মহারাজ কথায় কথায় বলেন ‘কাঁচাখেকো ঠাকুর’ – কখন কি ভাবে যে কার মনের মধ্যে ঢুকে পড়েন কেউ টেরটিও পায় না। তাই তো শুধু কথামৃতকার বা বালক ভক্ত পূর্ণই নন আজও শোনা যায় কোনো মহিলা আত্মহননের জন্য অনুকূল মুহূর্তের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে আনমনা ভাবেই খুলে পড়েন পাশে রাখা একটা বই আর সেই বই আমূল পরিবর্তন করে তার সম্পুর্ণ জীবনবোধ, কোথায় চলে যায় নিজেকে শেষ করে দেবার সেই পরিকল্পনা। বলাই বাহুল্য সে বই আজকের যুগের বেদ – শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত।

সাহিত্যিক জরাসন্ধ তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতিগ্রন্থ লৌহকপাটেও জানিয়েছেন এমন এক দুর্ধর্ষ মহিলা  কয়েদীর কথা। যে নাকি জেলখানার সমস্ত কর্মী এবং বাকি কয়েদীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল তার ব্যবহারে। আর কোনো উপায় না দেখে জেলার সাহেব তাকে জেলের লাইব্রেরী থেকে একটা বই পড়তে দেন। তারপর লাইব্রেরী থেকে সেই মেয়েটির নামে নালিশ জানানো হয়। সে কিছুতেই সেই বই ফেরৎ দেয় না, উলটে গালিগালাজ মারধর করে সেই লোকেদের তাড়িয়ে দেয়। মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করে জেলার সাহেব জানতে পারেন সেই বইএর মধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছে জীবনের মানে। তাই কোনোওভাবেই সে সেই বইটি আর কাছছাড়া করতে রাজি নয়। এই তো সেই মধু যা সবাইকে সত্যের পথে, আলোর পথে, অমৃতের পথের সন্ধান দেয়।

তথ্য সূচীঃ

  1. শ্রীম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত
  2. শ্রীমৎ স্বামী সারদানন্দজী বিরোচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ
  3. শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দজী রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-প্রসঙ্গ
  4. শ্রীমৎ স্বামী চেতনানন্দজী লিখিত ধ্যানলোকে শ্রীরামকৃষ্ণ
  5. শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত – প্রতিদিনের প্রয়োজন, বক্তাঃ- শ্রীমৎ স্বামী বিমোক্ষানন্দজী, SARAS অনলাইন সৎসঙ্গ ১০ই এপ্রিল ২০২৪
  6. কথামৃতের জাদু, বক্তাঃ- শ্রীমৎ স্বামী নিখিলেশ্বরানন্দজী, কথামৃত ভবন ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৯

Author:

I do whatever I like and whenever I like :) ;P

2 thoughts on “তব কথামৃতম্‌

  1. I had a cursory and very preliminary look at the writings . I am flabbergasted. It’s professionally scripted . I am amazed by the author’s concentration power to listen and write and too so much in details . It’s too good. But I need to read again. The above is written after went through few pages and glanced through the rest . All the very best .
    Jai Thakur 🙏🙏🙏

    Liked by 1 person

Leave a comment