Posted in Uncategorized

চাঁদ তারার দেশে

IMG_1097

ছোটবেলায় সন্ধ্যেবেলা কোনদিন মামারবাড়ির ছাদে গেলে নদাদি দেখাতো – ওই দ্যাখ আকাশে, কালপুরুষ – হাতে ধনুক, কোমরে বেল্ট থেকে ঝুলছে তলোয়ার! আর ওই যে দেখা যাচ্ছে পায়ের কাছে কালপুরুষের শিকারী কুকুর – লুব্ধক। সেই আমার তারা চেনা। কিন্তু লোডশেডিং এর রাতে দাদির ঘরের জানলা দিয়ে অনেক দেখানোর পরও সন্ধ্যাতারাকে চিনে নিতে পারি নি। ভুগোল বইতে পড়া সপ্তর্ষিমন্ডল, লঘুসপ্তর্ষিমন্ডল, ক্যাসিওপিয়া তখন অধরাই থেকে গেছে। পরে বিধান নিবাসের ছাদে নিয়ে গিয়ে স্বপনকাকু চিনিয়েছিলেন কালপুরুষের কাঁধের ওপর লালচে তারা ‘আদ্রা’ – সন্ধ্যেবেলা সবার আগে আকাশের বুকে জেগে ওঠে যে, ধনুকের মাথায় উজ্জ্বল ‘রোহিনী’ – চন্দ্রদেবের সবচেয়ে প্রিয় রাণী।

এই রোহিনীকে বেশী ভালবাসার অপরাধে দক্ষরাজার বাকী ছাব্বিশজন মেয়ে্র ভা-রি রাগ হয়েছিল, তারা নালিশ করে চাঁদের নামে বাবার কাছে; আর দক্ষরাজাও রেগে গিয়ে অভিশাপ দেন, চাঁদের ক্ষয়রোগ হবে! তারপর রোহিনীর অনেক কাকুতি-মিনতির পর, বিশেষ করে চন্দ্রদেব যখন কথা দিলেন একেকদিন একেক রাণীকে সঙ্গে নিয়ে আকাশে দেখা দেবেন, তখন দক্ষরাজার মন নরম হল। কিন্তু অভিশাপ তো আর ফিরিয়ে নিতে পারেন না! তাই বললেন পনেরো দিন ধরে চাঁদের যেমন ক্ষয় হবে তেমনি পরের পনেরোদিন আবার চন্দ্রকলার বৃদ্ধি হবে। তারা চেনার সঙ্গে সঙ্গে এ গল্পও স্বপনকাকুর কাছেই শোনা।

কাকুই চিনিয়েছিলেন ওই দ্যাখ ক্যাসিওপিয়া। আরে সত্যিই তো ‘W’ দেখা যাচ্ছে! আর ওই হল প্রশ্নচিহ্ন – ‘সপ্তর্ষিমন্ডল’। আগেকার দিনে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হলে কিন্তু খালি চোখে বশিষ্টের পাশে আরুন্ধতিকে খুঁজে বার করতে হতো। নইলে সেনাবাহিনীতে Entry NOT!!

আরও অনেক তারামন্ডল, অনেক রাশিচক্র, তাদের ইংরিজি নাম শিখিয়েছিলেন। কিন্তু সেসব আমার মগজস্থ হয় নি। তবে বইমেলা থেকে একখানা Astro-calendar Card  কিনে এনেছিলুম। ক্যালেন্ডারের তারিখ মিলিয়ে কার্ড ঘুরিয়ে আকাশের গ্রহনক্ষত্রর অবস্থান দেখা যাবে বলে। এই শহরের আকাশের আলোর মালার মধ্যে বসে খালি চোখে কি আর তারা দেখা যায়! কাজেই শীলপাড়ায় রিয়া-রিম্পা ও তাদের কাকুকে যতই জোর করে ছাদে ধরে নিয়ে যাই না কেন, ওই কালপুরুষ, ক্যাসিওপিয়া আর সপ্তর্ষিমন্ডলেই তারাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের ইতি।

কিন্তু তাই বলে খালি চোখে চাঁদ-সূর্য তো দেখা না যাবার কিছু নেই! সেবার কোজাগরী পূর্ণিমার দিন হল পূর্ণ চন্দ্রগ্রহণ। কানাইজেঠুর বাড়ির লক্ষ্মীপূজোয় মাঠে বাজি পোড়ানো হতো –চর্‌কি, রংমশাল, তুবড়ি। কোন্‌ তুবড়ি কত উঁচুতে ওঠে, সেই বাজি পোড়ানো আর ঠাকুর দেখার মাঝে মন ভরে দেখে নিলুম কেমন করে সূর্যের ছায়া ধীরে ধীরে চাঁদকে ঘিরে ফেলছে। পূর্ণিমার জ্যোৎস্না কেমন অসময়ের অমাবশ্যায় ম্লান! আবার ধীরে ধীরে সেই রাহুর গ্রাস থেকে মুক্ত চাঁদ কেমন আকাশের বুকে ঝলমলিয়ে উঠল!

চন্দ্রগ্রহণ দেখার অভিজ্ঞতা আরও হয়েছে। তাই বলে ধূমকেতু! ১৯৮৬ সালে কলকাতার বুকে হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাব। এবার দেখা না হলে আবার সেই ৭৬ বছর পর! বিধান নিবাসে উৎসাহী মানুষজনের অভাব নেই। আর সবার ওপর আছেন দলনেতা কানাইজেঠু। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে দল বেঁধে সবাই রেডি। গোটা তিনেক আম্বাস্যাডার গাড়ি – কানাইজেঠুর, প্রভাতকাকুর আর সৌরেনজেঠুর। বাবার সঙ্গে আমি লেজুড় তো আছিই। বাবার একটা বাইনোকুলার ছিল, সেটাও সঙ্গে নেওয়া হল। খালি দুদিন পরে পরীক্ষা বলে মাইমা কিছুতেই মুনদিদিকে যেতে দিল না। একেই বলে Willpower!  গাড়ির কনভয় সবে চিড়িয়াখানার সামনে এসে পৌঁছেছে – ব্যাস্‌! একটি গাড়ি আক্সিল ভেঙে দেহ রাখলেন! এমনিতেই গাড়িগুলো ঠাসাঠাসি ভর্তি। কাজেই তিনটে গাড়ির লোক দুটো গাড়িতে ওঠার কোনো সম্ভবনাই নেই। ফলে একটা গাড়ি নিয়ে বাবা আবার বাড়ি ফিরে গেল আর তারপর একমুখ হাসি নিয়ে মুনদিদি বাবার সঙ্গে এসে হাজির!

এবার সোজা ডায়মন্ডহারবার। সেখানে মাঠের সামনে পৌঁছে দেখি থিকথিকে ভীড়। অন্ধকারে আর ভীড়ে হারিয়ে যাবার জোগাড়। তার মধ্যেই আশে পাশের লোকেরা যেদিকে চেয়ে আছে বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে আমরাও সেদিকে তাকাই। সবাই বলে ধূমকেতুর নাকি লেজ থাকে! কাজেই ওই লেজ দেখেই ঠিক চিনে নেওয়া যাবে হ্যালি সাহেবের আদরের দুলালটিকে। দুর্‌। কোথায় কি! অন্ধকার আকাশে চারিদিকে শুধুই কালো! একজন বলল ওই যে দূরে একটা গাছ দেখা যাচ্ছে, আগে ওটার ওপর ফোকাস কর। দেখতে পাচ্ছো কি? আচ্ছা, এবার তবে একটু একটু করে ওপরের দিকে দেখ দেখি!  হঠাৎ দেখি ভাসা ভাসা পেঁজা তুলোর মতো ছোট্ট কি যেন দেখা যাচ্ছে। ওই ওই, ওটাই ধুমকেতু! কই লেজ নেই তো! মনে পড়ে গেল সুকুমার রায়ের ‘হযবরল’। দেখি, দেখি আমাকেও একটু বাইনোকুলারটা দে।

ইতিমধ্যে খবর পাওয়া গেছে পাশেই কোনও এক Skywatcher club থেকে একদল একটা টেলিস্কোপ নিয়ে বসে রয়েছে। তাদেরই কিছু সাধ্যি সাধনা করে অবশেষে সেই টেলিস্কোপের মধ্যে দিয়ে আরেকটু ভাল করে জন্মের মতো দেখে নিলুম সেই লেজবিহিন পেঁজা তুলো – হ্যালির ধূমকেতু!

রাতের আকাশের গপ্পো তো অনেক হল। কিন্তু দিনের আকাশ! মাথার ওপরে যে সূয্যিদেব গন্‌গনে আগুনে দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছেন, তাঁকে কাবু করতে পারে একমাত্র রাহু। ১৯৮০ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারী পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা গেল কলকাতার আকাশে। তখন আমরা টালায় থাকি। তার আগেই ’৭৮ এ পেলের দৌলতে আমাদের বাড়ি টেলিভিশনের আমদানি হয়েছে। আর সেই সঙ্গে কোনও বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বাড়ি ভর্তি লোক। যেমন ভোটের পর তিনদিন ধরে টিভিতে টানা সিনেমা দেখানো হতো। তার মধ্যে মধ্যে ভোটের ফলাফল। কাজেই স্বাধীন ভারতের আকাশের প্রথম সূর্যগ্রহণ যে টিভিতে সরাসরি দেখানো হবে সে আর নতুন কথা কি!

আমার তখনও সূর্যগ্রহণ নিয়ে বিশেষ মাথাব্যাথা নেই। তবে বাড়িতে প্রচুর লোক, আর তার সবাই খুব উত্তেজিত – ঠাম্মার কথায় ‘গেরণ লেগেছে’! কারো হাতে সানগ্লাস, কারো হাতে ফিল্মের পুরোনো নেগেটিভ। বাবা অফিস থেকে একটা পিনহোল ক্যামেরা না কি নিয়ে এসেছে – বুঝি নে বাপু! টিভিতে থেকে থেকে কি সব সুর্যের ছবি দেখাচ্ছে আর সবাই সেই দেখে উত্তেজিত হয়ে বারান্দায় ছুটছে। আমায় কেউই বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না। কেবল ‘খবরদার, খালি চোখে সূর্যের দিকে তাকাবি না’ – এই হুকুম জারি করছে। আমিও কিন্তু দাদির একটা পুরোনো সানগ্লাস পরে বিলকুল রেডি! বাবা অবশ্য একবার ফিল্মের নেগেটিভের মধ্যে দিয়ে সুর্‍্যের দিকে দেখতে দিয়েছিল। তবে সেই সূর্যগ্রহণ আমার কাছে শুধুই সারা দুপুর ধরে সবার মনে উত্তেজনা আর ছোটাছুটি। আর কিছুই আমার মনে নেই।

বরং পুণায় থাকতে একবার সূর্যের আংশিক গ্রহণ দেখা যায়। কলেজের ‘অন্তরীক্ষ্‌’ ক্লাবের সদস্যরা আগে থেকেই ‘গ্রহণ-চশমা’ জোগাড় করে রেখেছে। শিক্ষকতার সুবাদে তার থেকে দু-একটা আমরাও কব্জা করে ফেলেছি। First Year এর ক্লাসরুমের বাইরে বারান্দায় দাঁড়ালেই সে চশমা চোখে দিব্যি গ্রহণ দেখা যাচ্ছে। একেবারে শুরু থেকে উত্তেজনার শেষ নেই। এই First contact, Second contact. প্রায় পূর্ণগ্রহণই বলা চলে, শুধু ‘Diamond Ring’ এর অভাব! শোনা গেলো মেকানিকাল ডিপার্টমেন্টের ছাদে নাকি টেলিস্কোপ বসানো হয়েছে। এসব ব্যাপারে আমি সবার আগে! টিফিনের সময় দল বেঁধে ছাদে গিয়ে টেলিস্কোপে চোখ রাখতেই হারিয়ে গেলাম ১৯৯৫ সালের ২৪শে অক্টোবরে।

তখন MSc পড়ি। ততদিনে পূর্ণগ্রহণ, মহাজাগতিক বস্তু, গ্রহ নক্ষত্র সম্বন্ধে আগ্রহ-উত্তেজনা-পরিকল্পনা সবই তুঙ্গে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় সব থেকে বেশি সময় পূর্ণগ্রহণ দেখা যাবে। ডায়মন্ডহারবার, ফলতা, বারুইপুর -। বেশ কিছুদিন যাবৎ জল্পনা-কল্পনা চলছে। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে ‘AstroPhysics Department’ থেকে ‘গ্রহণ চশমা’ জোগাড় হয়ে গেছে। কালিপুজোর পরের দিন। সবাই মিলে বারুইপুরে সোমার মাসির বাড়ি যাওয়া হবে। বেড়ানো, গল্প-আড্ডা, গ্রহণ দেখা কিছুই বাদ যাবে না! বিধি বাম। কালিপুজোর দিন দুপুর বেলা রাস্তায় বেরিয়ে হঠাৎ বাসের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে ওপরের ফ্ল্যাটের ঘোষালকাকু চলে গেলেন। এ অবস্থায় বারুইপুর যাওয়া অসম্ভব। ঘটনার আকস্মিকতায় মন একেবারেই বিপর্যস্ত।

কিন্তু পূর্ণগ্রহণও তো আর রোজ রোজ হয় না! আমার সব কাজের প্রশ্রয় বাবা। জেঠুকে ফোন করা হল। ডাকুদাদা তখন নতুন ক্যামেরা কিনে ছবিতোলার নেশায় বুঁদ। এরকম সুযোগ তো সে ছাড়তে পারে না! বৌদির পিসির বাগানবাড়ি ফলতায় গঙ্গার ধারে। সকাল ছটার মধ্যে জেঠুর বাড়ি পৌঁছতে পারলে দাদা-বৌদির সঙ্গে ফলতায় যাওয়া যায়। সেই হ্যালির ধুমকেতুর বেলা মাইমা যেমন প্রথমে মুনদিদিকে যেতে দেয় নি, এবারও কাকিমা ফোন করে পুতুকে বলে দিয়েছে, ‘খবরদার গ্রহণ দেখবি না। চোখের ওপর চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে থাকবি!’ বেচারি পুতু!

সেই ভোরবেলাই বাবা আমাকে আর রূপুকে পৌঁছে দিয়ে এল আলিপুরে। সেখান থেকে দাদা-বৌদি ও বৌদির দাদা-বৌদি সহ আমরা ছয়জনে চললুম ফলতার উদ্দেশ্যে। বৌদির বাবা-মা আগের রাত থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছেন। রাস্তায় যেতে যেতে গাড়ি থেকেই দেখা গেল গ্রহণ শুরু হয়ে গেছে। অমন রাসভারি সূয্যিদেবের গালে রাহু এক কামড় বসিয়ে দিয়েছে।

ফলতায় পৌঁছে সে বাগানবাড়ি দেখে তো চক্ষুস্থির! বাড়ির এক্কেবারে গা ঘেঁষে গঙ্গা। আবার বাড়ির মধ্যেই পুকুরে মাছ খেলা করছে, শালুক ফুল ফুটে আছে, আর গাছ-গাছালির অন্ত নেই! আকাশের সূর্য দেখি, না পাশের গঙ্গা! পুকুরের মাছ, না বাগানের গাছ! একটু একটু করে এদিকে চাঁদের ছায়া গ্রাস করে ফেলছে সূর্যের তেজ। ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে সে চূড়ান্ত মুহুর্ত। চারজোড়া মাথা ওপরের দিকে স্থির। আর সেই সঙ্গে স্ট্যান্ডে রাখা দাদার ক্যামেরা। চারপাশের প্রকৃতির বুকেও ধীরে ধীরে নেমে আসছে সন্ধ্যার নৈঃশব্দ্য। পুরো সূর্য ঢাকা পড়তে চলেছে অন্ধকারের গহ্বরে। হঠাৎ – ঝিলিক দিয়ে উঠল – হিরের দ্যুতি – Diamond Ring. গ্রহণ-চশমা খুলে ফেলে দিয়েছি চোখ থেকে। এ দৃশ্য না দেখলে জন্মই বৃথা! ‘কি দেখিলাম! জন্ম জন্মান্তর সার্থক!’ এরপর আকাশে সন্ধ্যের অন্ধকার। লক্ষ লক্ষ তারা ভেসে উঠেছে আকাশের গায়ে। মনে পড়ে গেল কবির কথা – ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’ -। পুকু্রের দিকে তাকিয়ে দেখি সব মাছ ঘুমিয়ে পড়েছে, শালুক ফুলের পাপড়িও সব বন্ধ। পুকুরের জল একেবারে নিথর-স্থির! সবে দিন শুরু করতে যাওয়া অবাক পাখীরা ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে আসছে ‘সাঁঝের কুলায়’। এইভাবেই তো মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ বোকা বানিয়েছিলেন রাজা জয়দ্রথকে!

মাত্র দু মিনিট দশ সেকেন্ডের নিশ্ছিদ্র নীরবতা। আবার ওপরের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা শেষবারের মতো দেখতে পাওয়া ‘হিরের আংটি’। ধীরে ধীরে গ্রহণ ছাড়তে শুরু করল, প্রকৃতিও তার অসময়ের ঘুম থেকে জেগে উঠল। আবার শালুক ফুল হেসে উঠল তাদের পাপড়ি মেলে, মাছের দল সাঁতার দিয়ে পুকুরের বুকে নতুন ঢেউ তুলতে লাগল, পাখীর দল নতুন উৎসাহে আবার করে বেরিয়ে পড়ল খাবারের সন্ধানে। আমরাও সারা জীবনের বিস্মিত ভাললাগার পুঁজি সংগ্রহ করে পা বাড়ালুম বাড়ির পথে।।

PC: Whatsapp images