Posted in Uncategorized

আমি মানব … বিস্ময়ে

cartoon curious woman looking upwards

আমার আবার একটু অবাক হবার স্বভাব আছে। মানে ধরো চারপাশে কত কি যে ঘটে যায় – আমি মাঝে মাঝেই স্থান-কাল-পাত্র ভুলে হাঁ করে সেদিকে তাকিয়ে থাকি। যেমন রাস্তায় কেউ হয়তো এক কানে একটা তালা আর অন্য কানে একটা চাবি ঝুলিয়ে চলেছে – আরে কানের দুল রে বাবা, ওই রকমই ফ্যাশন! কিম্বা ধর কুর্তির সামনে দিকটা ছোট অথচ পিছন দিকটা তার থেকে চার ইঞ্চি লম্বা, কিম্বা ডানদিকের ঝুলটা বাঁ দিক থেকে ছোট। আমিও জগৎ সংসার ভুলে অবাক বিস্ময়ে সেদিকেই চেয়ে থাকি! কলকাতায় থাকতে কাঁকনদির কাছে কতবার তাড়া খেয়েছি! “অ্যায়! ওরকম করে দেখো না। কি ভাবছে!” আহা, আমি ইচ্ছে করে দেখছি না! শিখছি, নতুন রকম কিনা!

আমাদের কিশোরীবেলায় অবশ্য একটি ছেলে ও একটি মেয়ে রাস্তায় হাত ধরাধরি করে চললেও তা দেখার বস্তু হতো!

পুণায় গিয়ে কলেজে ঢুকে দেখি বহু ছাত্রের কানে দুল! না বাপু, বাঙালী ছেলেদের এ রোগ অন্ততঃ আগে ছিল না। আবার একজন দেখি দুই ভুরুর মাঝখানে দুটো আলপিন ফুটিয়েছে! ক্লাসে ঢুকে অঙ্ক করবো কি; আমি তো ওই ‘হাঁ’ -। আহা রে না জানি বাছার কত কষ্ট হচ্ছে! কান বিঁধনোর মতো এও কোনও পারিবারিক রেওয়াজ কি না কে জানে! বিশ্বাস করো ছেলেটার গোবেচারা মুখখানা দেখে একটুও মনে করতে পারি নি যে সে নিজে থেকে এমন উৎকট বেদনাদায়ক সৌন্দর্যবৃদ্ধি (?!!!)র পরিকল্পনা করতে পারে!

তারপর ধর সেই আরেকজন – সেও বেশ ভোলাভালা। সামনে থেকে দেখতে আহা কি ভদ্র সভ্য ভালমানুষ। চুল-দাড়ি কামানো মূর্তি। ওমা, যেই না পেছনে ফিরেছে – দেখি ব্রুস লির সিনেমার মতো মাথার পেছনে শিরদাঁড়া বরাবর ওই শিরদাঁড়ার সমানই সরু বিনুনি! আমি আবার এমনিই ‘কাঁচি-পাগলা’। (মানে ছোটবেলায় একবার আনন্দমেলায় ছবি বেরিয়ে পনেরো টাকা পেয়েছিলুম। তা সেই টাকা দিয়ে কি কি কেনা যেতে পারে তার দীর্ঘ লিস্টি বানিয়ে শেষ পর্যন্ত কিনেছিলুম দুটো কাঁচি – একটা ন’টাকা আর একটা ছ’টাকা। আমার সেই টাকা নয়-ছয় দেখে বাবা আমার নাম দিয়েছিল ‘কাঁচি-পাগলা’)। কি যে হাত নিশপিস করতো কাঁচি দিয়ে বিনুনিটা কুচুৎ করে কেটে দেবার জন্যে!

ওদিকে আফ্রিকান ছাত্রীদের কথা না বলাই ভাল! আহা তাদের যে কুচি কুচি কোঁকড়ানো চুল হয় সে জানি – তা বলে মাথা ভর্তি বিনুনি! সারা মাথায় নাহোক হাজার খানেক বিনুনি। আচ্ছা, এরা চান করে কি করে! আর এই এত বিনুনি বাঁধতে সময় কত লাগে! শীতল এসে বললে – ‘না গো, জিগ্যেস করেছি। ওরা নিজেরা বাঁধে না। পার্লারে গিয়ে পাক্কা এক বেলা ধরে এগুলো করায়। আর যতদিন না আবার চুল বড় হয়, এগুলো খোলেও না, চানও করে না!’ আরে রামোঃ, কাছে যাস নি বাপু! এই গরমে এক মাস ধরে চান করে না! ওই জটার মধ্যে নির্ঘাৎ উকুনের বাসা।

কিন্তু সবচেয়ে বেশী ব্যোম্‌কে দিয়েছিল সাহিল দেও। লম্বা-চওড়া দশাসই চেহারা। নিজের সম্বন্ধে বিরাট উচ্চ ধারনা। বিশেষতঃ কলেজে সদ্য নতুন আমাকে তো ধর্তব্যের মধ্যেই ধরে না। এক মুখ দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে মুখের যেটুকু বাকি তাও তার বাবরি চুলের অন্তরালে। আমারও সেরকম – দেখলেই মনে হয় দিই কেটে। নেহাত মারাঠা বর্গির ভয়ে চুপচাপ থাকি! তা সে সাহিল দেও পাস করে বেরিয়ে গেলো আর আমিও ততদিনে বর্গি-হামলা সামাল দিতে শিখে নিয়েছি। হঠাৎ একদিন শুনি – “হ্যালো ম্যাম”। মুখ তুলে দেখি cleaned shaved, corporate hair-style এক ভদ্রলোক। কি জানি, মাঝে মাঝে আসে বটে গলায় টাই আঁটা একদল ছেলে্মেয়ে – প্রচুর প্রচুর সস্তায় encyclopedia, dictionary, CD – এসব নিয়ে। তেমনি কেউ হবে হয়তো! খুব গম্ভীর হয়ে ফিরে তাকাই – বলব ভাবি, মোটেই কিছু লাগবে না। “চিনতে পারছেন না?!” হাঁ করে চেয়ে দেখি, আরে এ যে সেই সাহিল দেও। তখন সে ছাত্রর তকমা ছেড়ে অপিসবাবু হয়েছে। মনে মনে বলি ‘পথে এস বাপু’।

শীতলের স্কুটি চেপেই পুণার বিশ্বজয়ের শুরু। আমার মতো সহযাত্রীকে নিয়ে তারও বিড়ম্বনার শেষ নেই। তাই হামেশাই বকুনি খেতুম, “এইসে মৎ দেখো ম্যাডাম!” ছেলের ইস্কুলের আধুনিকা মায়েরা আমায় একটু কৃপার চোখেই দেখে। হদ্দ গাঁইয়া বলে বিশেষ কথাটথা বলে না। সেদিন ছেলের অঙ্ক দিদিমণি খুব দয়াপরবশ হয়ে আমাকে বোঝাতে বসলেন কি করে ছেলেকে অঙ্ক করাতে হয়। বললেন, “যদি আপনি একটু অঙ্ক জানেন, তাহলে” –। ঠিক বটে ঠাক্‌রুণ! জানিনা। স্বয়ং নিউটন সাহেবই বলেছেন ‘জ্ঞান সমুদ্রের তীরে নুড়ি কুড়োচ্ছেন’!

তারপর ধর সেবার। ব্যাংকে গেছি। স্বীকার করতে বাধা নেই, ব্যাংকে যেতে আমার ভারি ভয়। ওই ডেবিট-ক্রেডিটের চক্কর কিছুতেই মগজে ঢোকে না। আজকাল আবার ফোনে মেসেজ আসে – ‘Amount debited, amount credited’. কেন রে বাপু পাতি ‘Deposited, withdrawn’ বললে কি জাত যাবে! ঠিক যেই খুশী হয়ে ভাবব কিছু টাকা পেলুম বুঝি; শুনব না, না, টাকা কেটে নিল! অসহ্য! তা যা হোক, একা যাইনি মোটেও। কত্তামশাই আমার হয়ে ফর্ম ভরছেন আর আমি revolving chair এ দুলে দুলে ঘুরে ঘুরে সব বিজ্ঞাপনের বাহার দেখছি। ও মাঃ, ডেবিট কার্ডের ওপর কত রংবাহারি রকমারি ছবি! বাঘ, সিংহ, জঙ্গল, প্রজাপতি, আবার ফরেনের স্কাইস্ক্যাপার – দুর্‌, গ্লোসাইনের বাঁদিকের ওপরের লাইটটা খারাপ হয়ে গেছে! এরা দেখে না নাকি! সারাতে পারে না! অমন সুন্দর ছবিগুলোর বারোটা! আচ্ছা, আমি হলে কোন ছবিটা পছন্দ করতুম! রয়াল বেঙ্গল টাইগার – না কি পশুরাজ সিংহ! হাতির পালটাও বেশ। আহা একঝাঁক প্রজাপতিই বা কি দোষ করলে! বরফে ঢাকা পাহাড়টাও মন্দ না। আহাঃ, সমুদ্রে সূর্যোদয়! “এখানে সই করো”। ভাবনায় ছেদ পড়ল। থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করছি “কোথায়?” ব্যাঙ্কের কর্মীটি ভারি ভদ্র। বললেন, “ম্যাডাম বাড়ি থেকে একদম বেরোন না, নাহ্‌”। কত্তামশাইএর প্রেস্টিজ পাংচার। “মানেঃ! ম্যাডাম অমুক কলেজে অঙ্ক পড়ান”। নেহাৎ পুণায় সবাই সে কলেজ একডাকে চেনে। কাজেই মহিলা এক্কেবারে চুপ মেরে যান।

তবে কলেজের দৌলতে কর্পোরেশনের অপিসে মহা খাতির পাওয়া গেছে। শুধুমাত্র এই কলেজে পড়ানোর খাতিরে ফ্ল্যাটের ভুল ট্যাক্সের হিসেব নির্ঝঞ্ঝাটে ঠিক করানো গেছে।

আপাততঃ আমার দৃষ্টিবিভ্রাটের নবীনতম গপ্পোটি বলা যাক। সেদিন মেট্রোস্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়েই দেখি ফুটপাতটা কেমন বেগুনী বেগুনী লাগছে! নাহ্‌, এখন তো দোল নয়, আর অন্য কোনও উৎসবও নেই। রোদে গরমে চোখ ধাঁধিয়ে গেল নাকি! আরে ভাল করে দেখার কি উপায় আছে ছাই! গেটের মুখেই সারি দিয়ে ছেলেধরার দল মানে অটোওয়ালারা দাঁড়িয়ে। কে আগে খপ্‌ করে সওয়ারি ধরতে পারে। ফুটপাতের রঙ মরীচিকা না বাস্তব, ঠাওর করার আগেই আমি এক অটোচালকের জিম্মায়। কিন্তু চোখ সেই ফুটপাতে আঁটা। এতোক্ষণে বোঝা গেছে কালোজাম! না, জাম একটাও নেই। আরে বাবা তাহলে তো আগেই বুঝতে পারতুম। আহা, আমি কি অতটাই ভূত নাকি! গাছ থেকে পাকা ফল পড়ে পুরো ফুটপাত যেন বেগুনী রঙে চুবিয়ে দিয়েছে।

ও মাঃ, এই বুঝি জামগাছ! আমি আবার উদ্ভিদ্‌বিশারদ্‌ – এক আম আর নিম ছাড়া কোনও গাছ চিনি না। তাও মামারবাড়িতে নিমগাছ ছিল কিনা। নিমগাছের মগডালে ঘুড়ি এসে আটকে থাকলে আমার পাওনা হত। ছোটবেলায় নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত মাজা একটা মজার খেলা ছিল। আর নদাদি কচি কচি নিমপাতা আঁকশি দিয়ে পেড়ে দিত গরম গরম ভাতের সঙ্গে নিম-বেগুন ভাজা খাওয়া হবে, আর কাঠি দিয়ে হবে পুতুলের ঝাঁটা।

আর আমগাছ! অনেক দুঃখে তাকে মনে রেখেছি। শোবার ঘরের লাগোয়া বারান্দা – আর তার গায়েই আমগাছ। গাছ বোঝাই ইয়া বড় বড় পুরুষ্টু আম। কিন্তু বিশেষ করে ওই গাছের আম একটা যদি কোনদিন খেয়েছো, শুধু এ জম্মে নয় আগামী জম্মেও নাম ভুলে যাবে এত টক। আর তার সঙ্গে ফাউ ছিল লাল লাল কাঠপিঁপড়ে। মা বলতেন ওই পিঁপড়ের বিষ মানে কেউটে সাপের বিষ। পিঁপড়ে কামড়াবার দরকার নেই, জানলার পাল্লায় যেখানে ওই পিঁপড়ে চলে গেছে শুধু সেখানে হাত লাগলেই হাত ফুলে ঢোল, যত ব্যাথা-যন্ত্রণা তত চুলকানি। ব্যাস্‌, সাতদিনের জন্য নিশ্চিন্ত। বাগানে আরোও গাছ ছিল, চুটিয়ে সেই আমের আচার আর চাটনি খাওয়া হয়েছে বলাই বাহুল্য।

আচ্ছা, এই তাহলে জামগাছ। দেখি তো কেমন হয়! কই জামপাতা তো মোটেই আমপাতার মতো নয়! সেই যে সেই ক্লাস টেনে জীবনবিজ্ঞানে রকমারি পাতা সংগ্রহ করতে হয়েছিল; রাখবাবু ট্রেনে করে অশোকনগর যেতে আসতে আমাদের হয়ে কত পাতা জোগাড় করে দিয়েছেন – পদ্ম, কাঁঠাল, শিমুল। পুকুরপাড়ে কাদায় নেমে শুশনি, কচুপাতা পর্যন্ত এনে দিয়েছেন। সেসব পাতার চাপে ওই অত্তো মোটা সংসদের ইংরিজি-বাংলা অভিধানের পাতাগুলো পর্যন্ত লালচে ছোপ ধরে গেল! উঁহু, জাম পাতা তো ছিল না!

এইসব ভাবতে ভাবতে অটোর মধ্যে বসে পড়েও অবাক চোখে মুখ বাড়িয়ে ওপর দিকে চেয়ে আছি। মন দিয়ে জাম খুঁজছি। গাছসুদ্ধু ফল এক্কেবারে খালি! ওইতো মাত্র দু-চারটে জাম দেখা যাচ্ছে পাতার ফাঁকে! এদিকে অটোওয়ালা গাড়ি ছাড়বে কিনা বুঝতে পারছে না। ফিরে এসে পরের যাত্রী ধরার তাড়া আছে তার। শেষে আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল, “কি হয়েছে! এটা জামুনের গাছ। সবাই এখান থেকে জামুন নিয়ে যায়। খুব মিষ্টি” । অর্থাৎ তাহলে এবার যাওয়া যাক।।

PC: Google