Posted in Uncategorized

বাপী ডা-ব খাবি রে!

উত্তর ভারতের হাড়কাঁপানো শীতটা গেছে কি যায় নি, নতুন গরম ভাল করে পড়তে পেল না, শুরু হয়ে গেল হাত চুলকানো, পা চুলকানো। উফ্‌, আর পারা যায় না বাপু! কদিন আগে গরম মোজা পরেও পায়ের আঙ্গুল ফেটে রক্ত – Frostbite! এখন সুতির মোজাও পায়ে দেবার উপায় নেই – এলার্জি, আমবাত, পেটগরম! সেই হযবরল-র মত কে যেন কানের কাছে বলছে – “বাপী, ডাব খাবি রে!”

ছোটবেলায় ডাবের জল জিনিসটা মোটেই সুবিধের বোধ হত না। কচি ডাব – খা, খা। দূর্‌ বিচ্ছিরি, কেমন নোনতা নোনতা। কেন বাপু নারকেলের জল তো কেমন মিষ্টি! আরে শাঁসওয়ালা ডাব মিষ্টি হয়। শাঁস! সে তো আরোও বাজে – ল্যাতল্যাত করছে। মানুষে খায়! কিসস্যু খেতে শেখে নি রে মেয়েটা! শাঁসটাই তো ভাল রে। ভালো না কচু!

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর নতুন জামাইবাবু বললেন চল আমাদের সঙ্গে দুদিন দীঘা ঘুরে আসবে। বেশ কথা। জামাইবাবু বেজায় স্বাস্থ্যসচেতন। নো ভাজাভুজি, নো কোল্ডড্রিংস। সমুদ্রের ধারে এসেছ সারাদিন ঘোরো আর মনের সুখে (না কি দুখে!) ডাব খাও। এতদিন শুনতুম এই বিকেল হয়ে গেছে, সন্ধ্যে হয়ে গেছে আর ডাব খাওয়া যাবে না, ঠাণ্ডা লাগবে। দীঘায় গিয়ে জামাইবাবুর তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডাব – সকালে ডাব, সন্ধ্যায় ডাব, খাবার আগে ডাব, খাবার পরে ডাব। জল ফুরোলেই শাঁস আর শাঁস ফুরোলেই জল! সোনা মুখ করে খেয়ে যাচ্ছি – আরে ভাই ‘পেস্টিক’ কা সাওয়াল! কিছুক্ষণ পরে মনে হল কই শাঁসটা তো সেইরকম বিচ্ছিরি ল্যাতল্যাত করছে না! বেশ তো খেতে! নির্ঘাৎ কলকাতার ডাবওলারাই ইচ্ছে করে বাজে জিনিস দেয়! আর ডাবটা তো নারকোলের চেয়েও ভাল! অনেক জল – যেমন ঠাণ্ডা, তেমন মিষ্টি – ওই গরমে প্রাণটা সত্যিই জুড়িয়ে যায়! নাঃ, এই দীঘার ডাবগুলোই ভাল।

কিছুকাল পর ‘খাস কলকাত্তার মাইয়া’ ‘বিয়া কইর‍্যা’ চালান হলুম বড়িষা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি গাড়ি চলছে তো চলছে। পথ যেন ফুরোয় না! আমার বলে গড়িয়াহাটই সিলেবাসের বাইরে! বাজার করতে গেলে বড়জোর নিউ মার্কেট, আর ছোটোবেলায় বেড়াতে যেতে আলিপুর চিড়িয়াখানা – ব্যস্‌, কলকাতার ভূগোল ওখানেই ইতি। শ্বশুরবাড়ি যৌথ পরিবার, সবাই মিলে এক বাড়িতে থাকা। বাড়ির পেছনে বাগান – সেখানে অন্ততঃ ১২ / ১৪ টা নারকোল গাছ। সন্ধ্যেবেলা টিভি দেখতে বসেছি কিংবা রাত্তিরে শুয়ে আছি হঠাৎ আওয়াজ – দুম্‌। প্রথম প্রথম চমকে উঠে শুনি ও কিছু না গাছ থেকে নারকোল পড়ল। আর ঝপাং করে আওয়াজ মানে তাদের সলিল সমাধি! পেছনের খোলা নালায় পড়ে ভেসে ভেসে হুস্‌। বাগানে মাঝরাত্তিরে নারকোল পড়লে ভোর হতে হতে তারা সাফ্‌। দিনদুপুরে পড়লে কোন কোন সময় মা কি বাপী কুড়িয়ে এনে ডিভানের তলায় রেখে দিতেন।

লক্ষ্মীপুজোয় সেই নারকোলের নাড়ু করতেন মা। অন্যসময় সেখান থেকেই দিতেন নাতনিদের – নিয়ে যা মুড়ির সঙ্গে খাবি। নয়তো বলতেন মাকে বলবি রান্নায় দিতে। বাগান মেজোজেঠুর। কাজেই দ্বারভাঙ্গা থেকে ছোটুদা এলে ডাব-নারকোল, আম এসব পাড়াতেন। যদিও যত্নের অভাবে আমগাছে তখন পোকা লেগেছে। ঝড়ে পড়ে যাওয়া কাঁচা আমের চাটনি-আচার খেলেও নিজেদের বাড়ির বাগানের ভালো গাছের পাকা আম আমার খাওয়া হয় নি। পাকা আম সবই পোকা ভর্তি। কিন্তু ছুটির দিন বেলার দিকে ডাব-নারকোল পাড়াতে পাড়াতে বাগান থেকে ছোটভাইকে হাঁক দিতেন, “ডাব খাবি রে?”

হালকা শাঁসওয়ালা মিষ্টি জল প্রাণটা জুড়িয়ে যেত। জল খাওয়া হয়ে গেলেই বাপী কাটারি হাতে রেডি। ততদিনে সবার ধারণা হয়েই গেছে ‘বউমা ডাবের হালকা শাঁস খেতে ভালবাসে’। বাড়িতে নারকোল গাছ থাকায় বাড়ির ছেলেরা সবাই ডাব-নারকোল কাটায় এক্কেবারে expert. আর বাইরে থেকে দেখে কেমন বুঝতে পারেন কোনটা কচি, কোনটায় হালকা শাঁস, কোনটা জল বেশি!

ঠিক যেমন বাবা এমনিতে রান্নাঘর না মাড়ালেও ছুরি দিয়ে নিমেষের মধ্যে নারকোল টুকরো করে দিতে পারে! তখন বাবার ছোটবেলার গল্পে শোনা হাওড়ার বাড়ির নারকোলের ছাদ আর ডাবের জলে ফোটানো ছুঁচোবাজির মসলা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

পুণায় কলেজ যাবার পথে বিব্বেওয়াড়ির সিগনালে ঠেলা করে ডাব বিক্রি হত। আর তার দাম দেখে মনটা হু হু করে উঠতো বেহালার বাড়ির জন্যে। যদিও সেই নারকোল গাছের শেকড়ের ঠেলা সামলাতে আমাদেরই বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ঘরের মেঝে সারাতে গিয়ে দেখা গেল যত খোঁড়া হচ্ছে শুধুই নারকোলের শেকড়। মাটির ওপর একপেয়ে সরু লম্বা গাছ দেখে কে ভাবতে পারে মাটির নিচে লোকচক্ষুর আড়ালে ধীরে ধীরে সে কি বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসে আছে! তবে ভেবে দেখলে মনে হয় ঠিকই তো – সমুদ্রের পাড়ে নরম বালিতে দাঁড়ানো সারি সারি নারকোল গাছ কত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের উপকূলরেখা রক্ষা করে আসছে!

যা হোক, পুণায় পরীক্ষার পর কলেজে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি হয় কিন্তু আমাদের হয় না! ধাঁ ধাঁ গরমে রোজ নিয়ম করে কলেজে গিয়ে বসে থাকতে হয়। আজ ISO কাল NBA পরশু NAAC। আর বাইরের রোদের দিকে তাকালে আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা কারুর মনে হয় না। নিয়মিত আটঘণ্টা কখন দেখি দশঘণ্টা হয়ে গেছে! সেবার ওইরকমই ছুটি তবু ছূটি নেই এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল ক্যান্টিনে ‘নারল পানী’ পাওয়া যাচ্ছে। উফ্‌, আমাদের পায় কে! রোজই দুপুরবেলা ‘দাজি’কে পাঠানো হয় প্রায় আধ ডজন ডাব আসে। আহা, কি মিষ্টি ঠাণ্ডা জল! প্রাণ তো জুড়োলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাথার পোকাও তো নড়ল জল যখন এতও মিষ্টি নিশ্চয় ‘হালকা মালাই’ আছে। সেটা ফেলে দেওয়া মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু সেই শাঁস বার করতে গিয়ে নাভিশ্বাস ওঠার দাখিল! মালাই যতটা ‘হালকা’ বলে মনে করা হয়েছিল দেখা গেল ঠিক তার উলটো। বরং তাকে ‘মালাই’ না বলে ‘নারকোল’ বললেই মানায় বেশি।

ডাবের মুখ চামচ দিয়ে তো কোনোভাবেই বড় করা যাচ্ছে না! সবার জিনিসপত্র হাতড়ে হাতড়ে বেরোলো পেনসিল কাটার ছোট্ট ছুরি, Examএর দড়ি কাটার ভোঁতা ছুরি, তস্য ভোঁতা একটা কাঁচি। এই অস্ত্র নিয়ে কি যুদ্ধ জেতা যায়? তাই বলে ‘হাম তো ছোড়নেওয়ালে নেহি হ্যায়!’

সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মত ‘আক্রমণ!’ বলে তড়িঘড়ি সবার টেবিল থেকে বইখাতা কাগজ পেনসিল উধাও। যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত। সেখানে শুধুই জলশূন্য ডাব, ছুরি, কাঁচি আর চামচ! সবাই পাল্লা দিয়ে মালাই বার করার চেষ্টায় রত। এতটুকু মালাই বেরোলেই ‘ইউরেকা’! সবাই এতই মগ্ন যে কোন সময় পুরো Civil Engineering team inspect করতে এসেছে কারুর খেয়ালই নেই! ‘আরে ইধার তো ম্যাডাম লোগো কি নারল পার্টি চল রাহা হ্যায়’ – হঠাৎ সে কথায় চমক ভাঙ্গল সবার। হায় হায়, কি বেইজ্জত! ভাগ্যিস ওই টিমের সঙ্গে ডিরেক্টর স্যার কি HoD এসে পড়েন নি! স্টাফরুমে বসে গরমে ‘নারল পানী’ খাওয়ার সেই দিনই ইতি তো বটেই এমন কি শুনলুম রাতারাতি ক্যান্টিন থেকেও ‘নারল পানী’ উধাও!

এবাড়ির ছোট ছেলে্র তার মায়ের ছোটবেলার মতই ডাবের নরম শাঁস বিলকুল ‘না পসন্দ্‌’। সেও যখন ডাবের শাঁস দেখে বলে নারকোল দাও না আমার মনে হয় একেই কি বলে ‘runs in the blood!’ কিন্তু যখন সে ডাব কাটার জন্যে চামচ, ছুরি আর bottle opener নিয়ে ‘সরো, সরো’ করে তার বাবার সঙ্গে ঠেলাঠেলি করতে থাকে আমার মানস চক্ষে ভেসে ওঠে কাটারি হাতে আমাদের বাপী, বাপীর ছেলে আর বাপীর ছোট নাতির মুখ – সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলেছে!!

P.C. Google Images

Posted in Uncategorized

পুজোর কড়চা

শ্রীসঞ্জয় উবাচ

আমার পুজো শুরু হত বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাপীর সঙ্গে মেটাল বক্সে মাংস-ভাত খেয়ে ফেরার পথে রাদু থেকে নতুন জুতো কিনে। তারপর প্রতি রাতে খাটের তলা থেকে সেই জুতো বের করে মচ্‌মচ্‌ করে মার্চ পাস্ট – পুজোর সময় পায়ে ফোস্‌কা না পড়ে!

পঞ্চমীতে মামার বাড়ি যাবার প্রধান আকর্ষণ মাইমাদের কাছ থেকে পুজোর রসদ সংগ্রহ করে ষষ্ঠীতে ফেরা। যাতে পুজোর কটা দিন ফুটানিটা জমে ভাল। আধা রসদ ক্যাপ-বন্দুকেই শেষ। বাকিটা কোল্ড ড্রিংস আর বড়িষা কাফের পর্দা ঘেরা কেবিনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে তেল চপচপে রবারের মত মোগলাই নিয়ে যুদ্ধ। আর মাকে লুকিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা।

এরপর আসি পুজোর নাটকের মহড়ায়। ভরদুপুরে শেয়ালের মুখোশ পরে হযবরল-র শেয়াল পণ্ডিত সেজে ঘেমে নেয়ে একাক্কার। পরেরবার আবার হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালায় নেংটি ইঁদুর। মানুষ সেজে অভিনয় অধরাই রয়ে গেল।

পুজো প্যাণ্ডেলে আবার বিরাট দায়িত্ব – সকাল-বিকেল রেকর্ড প্লেয়ারে রেকর্ড পালটানো। পালা করে মান্না-কিশোর-হেমন্ত। আর দুপুরে বড়রা বাড়ি গেলেই তেড়ে হিন্দি গান চালানো আর ধরা পড়লে চরম বকুনি। সন্ধ্যেবেলা বেপাড়ায় ঠাকুর দেখা আর লুকিয়ে সিগারেটে সুখটান। কদিনের মত পড়াশোনা শিকেয় তোলা।

ঢাকীরা যখন দুপুরে প্যাণ্ডেলের পেছনে ঝিমোতো সেই ফাঁকে তাদের ঢাকে বেতালা চাঁটিতে তাদের কাঁচা ঘুমের দফা রফা। সেই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ঢাকীদের ওপর একটা অন্যরকম মায়া পড়ে যেত। দশমীর পরের দিন তারা যখন বাড়ি বাড়ি যেত টাকাপয়সা আর জামাকাপড় পাবার আশায় আমিও উৎসুক হয়ে তাদের অপেক্ষায় থাকতাম। একবার পুরোনো জামা হাতের কাছে না পেয়ে বাপীর সে বছরের পুজোর নতুন জামা তাদের দিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর কপালে বকুনিও জুটেছিল বলাই বাহুল্য। পরের বছর যখন শুনলুম বনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে সেই ঢাকী বাঘের পেটে গেছে আমার কি যে কষ্ট হয়েছিল বলার নয়। সে যেন স্বজন হারানোর দুঃখ। আজও সেই মুখটা চোখে ভাসে।

দশমীর দিন মোহিত হয়ে সেলুনের শান্তিদার ধুনুচি নাচ দেখে তার অন্ধভক্ত হয়ে যাওয়া। তার ওপর শান্তিদা ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার কাজেই আলাদা টান। তারপর সিদ্ধি খেয়ে পুকুর ঘাটে সটান শুয়ে থাকা আর উঠে বসতে গেলেই বেদম হাসি। তার ওপর কোন উপকারী বন্ধু গজা খাওয়ানোয় হাসির ছর্‌রা বেড়ে দশগুণ।

পাড়ার এক দাদার খুব রাগ ছিল এক কাকুর ওপর, কারণে অকারণে খ্যাচখ্যাচ করত বলে। সেবার মোক্ষম সুযোগ এসে গেল। ঠাকুর বিসর্জনের সময় অন্ধকারে মওকা বুঝে কার্তিক-গণেশের আগেই সেই কাকুকে পেছন থেকে এক ঠেলা। হেমন্তের কনকনে ঠাণ্ডায় এঁদো পুকুরের জলে পড়ে সে কাকুর যে কি নাজেহাল দশা!

আর্টিস্ট ভাগ্নে বলে মামাবাড়িতে ভারি খাতির। মেজমাইমার রঙ চটে যাওয়া চিনেমাটির মাদুর্গা রঙ করে রাখা ছিল বিজয়ার পর গিয়ে ফেরত দেব বলে। সেবার বিসর্জনের ঢাকের বাদ্যি মাথার পোকা দিল নাড়িয়ে। ঘোরের মধ্যে ঘরে গিয়ে সেই সপরিবারে মা দুর্গার মূর্তি নিয়ে এসে ‘বল দুগ্‌গা মাঈ কি জয়!’ বলে এক্কেবারে ঝপাং করে জলে।

P.C. Google Images

Posted in Uncategorized

ফিরে দেখা

এক শ্রাবণের সকালবেলা দুরুদুরু বক্ষে, ভীরু পায়ে মনে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে এসে দাঁড়ালুম বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে ‘তারকনাথ পালিত শিক্ষাপ্রাঙ্গণ’ বা সাধারণের ভাষায় বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক – সে বহু বহু কালের। পৃথিবীর আলো দেখার আগে থেকে এখানে আমার যাতায়াত। আমার চেতন-অবচেতনে এর অস্তিত্ব। এর আগে সজ্ঞান শিক্ষাজীবনের এগারো বছর কেটেছে মায়ের স্কুলে, হোলি চাইল্ড – আমার হোলি চাইল্ড। নাঃ, মায়ের কলেজে আমার পড়া হয় নি, মায়ের বিষয়ও না। তবে আবার এসে পৌঁছলুম মায়ের ইউনিভার্সিটি – বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ।

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল আট-ন’ তলা বাড়ি। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দূরদৃষ্টির সাক্ষর তার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অবস্থানেই প্রমাণ হয়। Anthropology, Zoology, Botany, Geography, Statistics, Bio-Chemistry সব পেরিয়ে সবার মাথার ওপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘Department of Pure Mathematics’ – ‘বিশুদ্ধ গণিত বিভাগ’। এমনিতেই সাধারণ লোকের ধারণায় অঙ্কের লোকেরা ‘আধপাগল’, ‘ছিটগ্রস্ত’  মানে তাদের মানসিক অবস্থান বাস্তব দুনিয়া থেকে অনেক দূরে। কাজেই অঙ্ক কষতে কষতে তাদের মাথা গরম হয়ে উঠলে সেই চিন্তাতরঙ্গ সোজা ছাদ ভেদ করে ছড়িয়ে যাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোণায় কোণায়। অন্যান্য বিষয়ের চিন্তাজাল সেই তরঙ্গস্রোতকে সহজে ছিন্ন করতে পারবে না।

প্রথমদিন কোলাপসিবিল গেট দিয়ে ঢুকে দুপাশে একের পর এক অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের নাম লেখা দরজা পেরিয়ে এসে পৌঁছলুম করিডোরের এক্কেবারে শেষপ্রান্তে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসরুমে। বিরাট ঘর – সামনে দেওয়াল জোড়া ব্ল্যাক – থুড়ি গ্রিন বোর্ড। তিনসারি বেঞ্চ সবই প্রায় ছেলেদের দখলে। এতদিনের প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ব্যাকবেঞ্চারের তুলনায় সামনের সিটের চাহিদাই বেশী। অঙ্ক কিনা, সবেতেই তাই ব্যাতিক্রমই নিয়ম! কলেজে অনার্স ক্লাসে পনেরোজনের মধ্যে আমরা বারোজনই ছিলাম মেয়ে। আমাদের দৌরাত্ম্যে হারাধনের ওই বাকি তিনটি ছেলের টিকির দেখা মিলত না। এখানে এসে দেখি প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্নজন ছেলের মাঝে টিমটিম করছে আট-দশজন মেয়ে।

ভালভাবে বোর্ড দেখতে গেলে মাঝের রো’য় বসাই ভাল। তা প্রথম বেঞ্চেই তো দেওয়াল হয়ে বসে আছে দু-তিনটে ছেলে! তারপর তিনটে বেঞ্চে জনা তিনেক করে মেয়ে – ব্যাস্‌, মহিলা মহল খতম! থার্ড বেঞ্চে একজন বেশ হাসিখুশি লম্বা মত মেয়ে তার মাথায় ইয়া মোটা বিনুনি, পাশের শান্ত-শিষ্ট ফর্সা ফর্সা বন্ধুর সঙ্গে গল্পে মত্ত। তার পাশেই গিয়ে বসলুম। আলাপ হল – বিনীতা সেনগুপ্ত, পাশে আশালতা। দুজনেই কৃষ্ণনগর গভরমেণ্ট কলেজ থেকে এসেছে। আর ফার্স্ট বেঞ্চের ওই কোঁকড়া চুলের ছেলেটি জয়ন্ত – ওদের কলেজের ফার্স্ট বয়, অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া! ভাবলুম এদের কেমন মজা – আগে থেকেই বেশ বন্ধু নিয়ে এসেছে!

এরপর আমাদের পাশে এসে বসল মৌসুমী – অত্যন্ত প্রাণচঞ্চল কিঞ্চিৎ ছিটগ্রস্ত। সামনের সারির ভীষণ সিরিয়াসে দলে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আসা সুচেতা, দিল্লির সোনালী আর বর্ণালী। পেছনে শান্তশিষ্ট মিতা, স্বপ্না আর রুমা। কিছুদিন পর এসে যোগ দিয়েছিল সীমা জৈন আর সাথী। সুচেতা খুব ভাল গান করত, বিশেষ করে নজরুলগীতি।

জয়ন্তর পাশের ছেলেটি সুদীপ্ত – সাউথ পয়েন্ট থেকে পাশ করে তারপর আশুতোষ কলেজে পড়েছে। চটপটে স্মার্ট বলিয়ে-কইয়ে গোছের লিডার টাইপ! বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই কলকাতার বাইরে থেকে হয় ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে নয়তো হস্টেলে থাকে। বিনীতা আর আশাও কিছুদিন পর লেডিস হস্টেলে চলে এল।

এরপর একে একে স্যার ও ম্যাডামদের সঙ্গে পরিচয়। তখন হেড ছিলেন বাদলবাবু, BC – পড়ান Propositonal Logic. বিষয়টা সহজ ও মজার আর স্যার পড়ানও খুব সহজ করে। Predicate Logic পড়ান MC – মানে মিহিরবাবু। উস্কোখুস্কো চুলে সুকুমার রায়ের হেড অপিসের বড়বাবু মার্কা গোঁফে স্যারকে দেখলেই আমার আইনস্টাইনের কথা মনে হত – typical absent-minded professor! সামনে দিয়ে আমরা চলে গেলেও ওনার চোখে পড়তুম কিনা সন্দেহ হত। তাই পরে যেদিন আবিষ্কার করেছিলুম যে উনি আসলে আমাকে ‘চেনেন’ সেদিন কি প্রচণ্ড যে অবাক হয়েছিলুম!

কুচকুচে কালো চুল, কালো মোটা গোঁফ আর মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে খদ্দরের পাঞ্জাবী আর ধুতি পরা রাশভারি শোভাকরবাবু যেন পরিবারের কর্তা – সামান্য খুঁটিনাটি বিষয়ও যাঁর কড়া নজর এড়ায় না! শোভাকরবাবুর কথা সীতাংশুকাকুর মুখে আগেই শুনেছিলুম – কাকুদের বন্ধু। তখন আমরা সবাইকে BC, SG, JD, DG – এভাবেই চিনি। শোভাকরবাবুর এতে ভারি আপত্তি। বলেন ‘শুনলেই নিজেকে কেমন কয়েদি, কয়েদি মনে হয়!’ আমারও সেই শুনে মনে পড়ে গেল ‘মা খু চিহল ও পঞ্জম হস্তম’। সীতাংশুকাকু যেমন আমরা স্যার বললেই বলতেন ‘কাকু বলতে পারিস না! কি ষাঁড়, ষাঁড় করছিস!’ শোভাকরবাবুর মধ্যে একটা ‘ক্যারিশ্মা’ ছিল। ক্লাসে ঢুকেই আমাদের সম্বোধন করলেন ‘My friends’! পড়াতে পড়াতেও বলতেন ‘now my friends …’। শুনতে বেশ মজা লাগত। চক ধরে যখন বোর্ডে লিখতেন মনে হত যেন তুলি ধরে ছবি আঁকছেন। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেন ‘মা জননী’ বলে, যেটা অর্ণবদাও অনুকরণ করত। তবে স্যার ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্রদের বেশী পছন্দ করতেন আর ওনার ওই পক্ষপাত বেশ বোঝা যেত। যেমন আমাদের তারক ছিল স্যারের খুব প্রিয়।

আর সেবার যখন সবাই মিলে পেছনের জানলা দিয়ে Miss Universe Sushmita Sen কে দেখার জন্যে হামলে পড়েছিল স্যার দেখতে পেয়ে যা বকুনি দিয়েছিলেন! সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা যে মানুষের সাফল্যের মাপকাঠি হতে পারে সে কথা স্যার কোনওমতেই মেনে নিতে পারেন নি। তবে তাতে করে আমাদের ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে সারা বছর উঁকি ঝুঁকি মেরে আরেকজন সৌন্দর্যের সম্রাজ্ঞী সুচিত্রা সেনকে দেখার চেষ্টা বন্ধ করতে পারেন নি।

শোভাকরবাবুর সঙ্গে সবসময় একসঙ্গে গল্প করতে বাড়ি যেতে যাঁকে দেখা যেত আকৃতি ও প্রকৃতিতে তিনি ছিলেন শোভাকরবাবুর বিপরীত। ফর্সা, লম্বা, মাথায় ধবদবে সাদা চুল, শ্মশ্রুগুল্‌ফহীন মুখ চোখে সরু ফ্রেমের চশমা সত্ত্বগুণের প্রতিমূর্তি মৃদুলবাবু – MKS এক্কেবারে স্নেহময় পিতা – সব সন্তানের প্রতি যাঁর অগাধ প্রশ্রয়।

প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্রং মিত্র বদাচরেৎ – এই শাস্ত্রবাক্য মেনে সকাল থেকেই MNM এর ঘরে টাটকা চা আর সিগারেটের গন্ধ ম’ ম’ করত। আসরের মধ্যমণি শোভাকরবাবু, মানববাবু ও সভ্যকূলে দুজনের যত রিসার্চ স্কলার। MNMএর নামটা যত বড় রোগাসোগা ছোটখাট মানুষটি ঠিক তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝড়ের গতিতে হাঁটেন, চলেন, কথা বলেন আর লেখেন!

ক্লাসে ঢুকে কোনও কথা না বলে বোর্ডের বাঁদিকের ওপরের কোণা থেকে ছোট ছোট অক্ষরে লিখতে শুরু করতেন যেন সবুজ ঘাসের ওপর সারি দিয়ে সাদা পিঁপড়ে চলে যাচ্ছে! আমরা যতক্ষণে বাঁদিকের অংশের নোট টুকে শেষ করতে ব্যস্ত স্যারের তিন কি চার সারি নোট লিখে প্রথম অংশ মুছে বোঝানো শুরু হয়ে যেত। প্রথম দিকে থৈ কূল পেতুম না, লেখা শেষ করব না পড়া বোঝানোয় মন দেব! একটু হাত থেমেছে কি বোর্ডের নোট মুছে গেছে! বিনীতা খুব speedএ নোট লিখত আর ওর হাতের লেখাও ছিল মুক্তোর মত। বেশিরভাগ সময় বিনীতার খাতাই ছিল আমার ভরসা। শুধু MNMএর ক্লাসেই নয় TDর ক্লাসেও।

আমি ফাঁকিবাজ Linear Algebraর ওই একই রকম একশোটা প্রুফ লিখতে একদম ভালবাসতুম না। কিন্তু বিনীতা কৃষ্ণনগর-কলকাতা ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করেও সব কাজ এক্কেবারে complete. TDও তাই প্রথম থেকেই বিনীতাকে খুব পছন্দ করতেন। ছাত্রছাত্রীদের সমস্ত গতিবিধি TDর সন্ধানী দৃষ্টির গোচরে। ছাড় নেই কারুরই।

ডিপার্টমেন্টের করিডোরে রামানুজান, Gauss, Laplace, Euler, Riemannএর ছবির সঙ্গে একটা ছবি ছিল তাঁর টাকমাথা মুখটা দেখলেই মনে হত PKS! PKSও TDর মত মুখরোচক খবরের সন্ধানে থাকলেও তুলনায় ওনার জনপ্রিয়তা ছিল একটু কম। তবে ক্লাসে এসে বাঁ হাতটা নিচু করে নোটের কাগজ ধরে আড় চোখে চেয়ে যখন বোর্ডে লিখতেন দেখতে খুব মজা লাগত – ঠিক যেন টুকলি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবেন!

ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেই বাঁহাতে যেমন MNMএর ঘর, ডান হাতে ছিল DKB-SKAর ঘর। SKA সবসময়ই নার্ভাস, ভীরু, আর DKB বড় দাদার মত ওনাকে সবসময় আগলে রেখেছেন। কিছুদিনের জন্যে এই ঘরে আমার যাতায়াত বেশ বেড়ে যায় তবে সে কথায় পরে আসছি।

স্যারেদের কথা বলতে যাঁর নাম হয়তো আমার সবচেয়ে আগে বলা উচিত ছিল তাঁর কথা বলি সবার শেষে। DG – ছাত্রছাত্রীদের কাছে কিছুটা ব্রাত্য কিছুটা হাসির মানুষ। দুপুর আড়াইটের আগে কোনদিন আসেননা আর থাকেন সন্ধ্যে সাতটা-সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। পরণে এক্কেবারে কোঁচকানো-দোমড়ানো হাফ শার্ট, ঝড়ের মতো আসেন-যান। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকেই বললেন “আমি ‘take home’ দিই, না করলেই পরীক্ষায় নাকের জলে চোখের জলে।“ তারপর বললেন “আমি শনি-রবিবার ম্যারাথন ক্লাস নিই সকাল থেকে টানা ছ’ ঘন্টা।“ কার্যক্ষেত্রে অবশ্য সারা দু বছরে একটাই মাত্র শনিবার দু’তিন ঘন্টার জন্যে ‘ম্যারাথন ক্লাস’ হয়েছে।

প্রথমদিন সবাইকে নিজের নাম আর কলেজের নাম বলতে হয়। স্যার বললেন তোমাদের নাম আমি মনে রাখতে পারব না। কলেজের নাম ধরে ডাকব। যে কলেজ থেকে একের বেশী স্টুডেন্ট এসেছে যেমন কৃষ্ণনগর বললে যে কোন একজনকে উত্তর দিতে হবে। তা আমার তো নাম নিয়ে চিরকালের সমস্যা। বিধান নগর কলেজ থেকে গেছি। এদিকে বিধান বলে একটি ছেলে আছে ক্লাসে। তা স্যার ‘বিধান’ বললে সে উত্তর দেবে না আমি বোঝা মুস্কিল! তবে স্যার আমায় ‘সল্টলেক’ বলে ডাকতেন প্রথম প্রথম। তারপর বাবা-মায়ের দেওয়া নামে চিনতে খুব বেশী সময় নেন নি। কিন্তু যেদিন সিঁড়ির ওপর থেকে ‘নাটক’ বলে হূঙ্কার দিয়েছিলেন আমি বেজায় চমকেছিলুম বলাই বাহুল্য!

স্যার হলেন অত্যন্ত সংশয়ী প্রকৃতির কারুর ওপর ভরসা করে ভরসা করতে পারেন না। তার ওপর আবার যোগ হয়েছে স্যারের স্যার প্রফেসর এন সি বোস মজুমদারের মন্ত্রগুপ্তির শিক্ষা। বলতেন নিজের রিসার্চের কাজ নিজের পার্টনারকেও বলবে না। বাসুদা ডিপার্টমেন্টের সব স্যারেদের নামে লাইব্রেরি থেকে বই নেয়, কেবল DG ভরসা করে ওনার নামে বই তুলতে দিতেন না। যদি ঠিক সময় ফেরৎ না দেয়। অথচ বাসুদা ছিল স্যারের প্রিয় ছাত্র। আমাদের নোট দিতেন ওনার ছাত্র জীবনের ছোট বঙ্গলিপি খাতা থেকে। সেই খাতার তখন খুবই করুণ দশা। সব পাতা আলাদা আলাদা হয়ে খুলে যাচ্ছে। একদিন অনেক বলে কয়ে পরেরদিনই খাতার পাতা জুড়ে মলাট দিয়ে নিয়ে আসব এই কড়ারে আমায় একটা খাতা দিলেন। সেই খাতার পাল্টানো ভোল দেখে তার পর থেকে এক কথায় আমায় খাতা বা বই দিতে রাজি হয়ে যেতেন। এমন কি ওনার নামে লাইব্রেরির বইও।    

ম্যাডামদের মধ্যে প্রথমেই আসে জ্যোতিদির কথা। ছোট্টখাট্ট মানুষটি সাদা তাঁতের শাড়ি প্লিট দিয়ে সুন্দর করে পরা, মাথায় কাঁটা দিয়ে টানটান করে বাঁধা খোঁপা এক্কেবারে টিপটপ। ঘড়ি ধরে ক্লাসে আসেন ঘড়ি ধরে ক্লাস শেষ করেন। ক্লাসে ঢুকে প্রথম কাজ ছিল বোর্ড মোছা। যত পরিষ্কার করে মোছা বোর্ড হোক দিদির মোছার গুণে এক্কেবারে ঝকঝকে হয়ে যেত যেন সদ্য রঙ করা হয়েছে। এসেই বোর্ডে লম্বা লম্বা করে দাগ টেনে চার ভাগ করে নিতেন। আর ধরে ধরে মুক্তোর মতো হাতের লেখায় বাঁদিক থেকে লিখতে শুরু করতেন। বোর্ডে কি করে সুন্দর করে লিখতে হয়, কত সহজে কত কম কথায় পুরো বিষয়টা কি করে প্রেজেন্ট করতে হয় বি এড পড়ার ঢের আগেই জ্যোতিদি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আর শিখিয়েছিলেন নিজে নিজে বই পড়ে কোনও বিষয় বোঝা আর নোট করা। বলতেন আমি তোমাদের ভবিষ্যতে রিসার্চ করার জন্য তৈরী করিয়ে দিচ্ছি। দিদির চেহারা, চালচলনে ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য যেন ফেটে পড়ত। ওনাকে দেখলে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যেত।

বন্দনাদি ছিলেন জ্যোতিদির দোসর। দুজনে যেন দুই বোন। তবে বন্দনাদি যেন জ্যোতিদির ছায়া। একজন নিজস্ব স্বকীয়তায় জাজ্বল্যমান সূর্য আর অন্যজনের মধ্যে ছিল চাঁদের স্নিগ্ধতা।

JS আসতেন নিজের ফিয়াট গাড়ি চালিয়ে। বাকিরা যখন হেঁটে, বাসে বা ট্রেনে করে যাতায়াত করতেন তখন ম্যাডাম ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেন হাতে নিজের গাড়ির চাবি ঝুলিয়ে। কিন্তু নিজে গাড়ি চালিয়ে আসা সেই ব্যক্তিত্বময়ী মহিলাকে ক্লাসের মধ্যে এক্কেবারেই মেলানো যেত না। সেখানে তিনি একেবারেই সাদামাটা, কিছুটা ম্লান। নির্দিষ্ট সময়ের ঢের আগেই ‘আজ থাক’ বলে ক্লাস শেষ করে দিতেন। সকালে আসতেন যেমন সবার আগে দুপুরে বাড়িও যেতেন সবার আগে। আমরা বলতুম JS আর  DGর ডিপার্টমেন্টের টাইমিং এর  intersection empty set.

MT বা MM বলতে মঞ্জুষাদি।ছাত্রছাত্রীদের এক্কেবারে my dear. Differential Geometry যদিও আমার বিশেষ ভাল লাগত না, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক মঞ্জুষাদির অসীম স্নেহ পেয়েছি – ডিপার্টমেন্টে এবং ডিপার্টমেন্টের বাইরে। আমি যেমন বাড়ি থেকে দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছি দিদির বাড়ি দুর্গাপুজো দেখতে, তেমনি দিদি একমাত্র যিনি আমার বিয়েতে এসেছিলেন। আর পরে আমাদের পুণার বাড়িতেও এসে ঘুরে গেছেন।

ক্লাস করতে করতে ধীরে ধীরে স্যার ম্যাডামদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, ওই বাড়িটা আপন হয়ে উঠেছে, এমন কি লিফটম্যান দাদাও চিনে গেছে – লিফটে উঠে বলতে হয় না আপনি ৭ নম্বরে লিফট থামিয়ে দেয়। সহপাঠী সহপাঠিনীরাও ‘বন্ধু’ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় পাওনা বিনীতা আর ওর সূত্রেই সুব্রত বিশ্বাস দা। দুজনেই মনের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছে। সীমা আমার যাতায়াতের সঙ্গী, এক বাসে একসঙ্গে বাড়ি ফিরি।

ছেলেদের মধ্যে অনির্বাণ, মৃণাল, অয়ন খুব সিরিয়াস। তারক তো অনার্সে ফার্স্টক্লাস পাওয়া – বিরাট fan following. দীপঙ্কর প্রচুর বাংলা গল্পের বই সাপ্লাই করত। সমীর, সুবিমল, শ্যামাপ্রসাদ, আনিসুর, উৎপল, অভিজিৎ, হাবিব, জার্জিস, অংশুমান – সবাইকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পাশে পেয়েছি। শ্যামাপ্রসাদ, অয়ন আর আমার একই স্পেশাল পেপার। জ্যোতিদির ক্লাসের নোট তৈরী থেকে Prof. N. C. Bose Majumder memorial essay competitionএ একসঙ্গে participate করা। অয়ন নিজের দুনিয়ায় থাকত তবে কোনও সাহায্য চাইলে কখনও না বলত না। শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে দেখেছি কি অসম্ভব ধৈর্য আর একাগ্রতা – tenacity and detailing. সে Monotonic Function এর essay লেখাই হোক, কি মধুবালার ছবি আঁকা।

ফার্স্ট বেঞ্চের সুদীপ্ত আর জয়ন্তর সঙ্গে সেই প্রথম দিন থেকেই ছিল খুনসুটির সম্পর্ক। আমাদের দেখে বোঝা যেত না আমরা ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে উঁচু ক্লাসে পড়ি না কি স্কুলের এক্কেবারে নিচু ক্লাসে। বোর্ড দেখতে পাচ্ছি না বলে সরে বসতে বললে দুজনে আরও পাশাপাশি ঘেঁষে বসত, আর আমার আর মৌসুমীর পেনের গুঁতো খেত। M.Sc.র শেষ দিনে আমার Slam Bookএ সুদীপ্ত লিখেছিল ‘আশাকরি আমাদের বন্ধুত্বটা চিরদিন অটুট থাকবে।‘ কিন্তু কালের নিয়মে জীবনের পথে চলতে চলতে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যায়। এতদিন পর নতুন করে বন্ধুদের ফিরে পাওয়ার মুহূর্তে খবর পেলুম সুদীপ্ত আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে – না ফেরার দেশের বাসিন্দা!

আমাকে ফাঁসাতে গিয়ে সেবার সুদীপ্ত আর জয়ন্ত যে রাম বুদ্ধু হয়েছিল সে কথা এবার বলতেই হয়। ফার্স্ট ইয়ারে এই মাস দেড়-দুয়েক ক্লাসের পর একদিন টিফিনের সময় DKB সুদীপ্তদের দেখা করতে বললেন। একটু পরেই দুই মক্কেল এসে আমায় বলল স্যার তোকে ডাকছেন। আমার তো তখন কেউ ডাকছেন শুনলেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। মনে হয় ওরে বাবা কি করলুম আবার! অবশ্য সিস্টার রোমানার কথায় ভয় পাওয়াটা আমার বিলাসিতা! যত বলি কেন ডাকছেন বল। দুজনেই বলে জানি না। ভয়ে ভয়ে স্যারের ঘরে যেতেই স্যার জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি নাকি অভিনয় করো!’ আমার তো মহা বিস্ময়! এ কথা তো স্যারের জানার কথা নয়! বলি ‘হ্যাঁ স্যার করি তো’। ‘কোথায় করেছ?’ ‘পাড়ায় পুজোর নাটকে’। ‘সামনে ডিপার্টমেন্টের রি-ইউনিয়ন। তোমাকে নাটকে অভিনয় করতে হবে।‘ বুঝলুম এ ওই ‘দাদার কীর্তি’ কেস। আমাকে অপ্রস্তুতে ফেলতে দুই মক্কেল স্যারের কাছে আমার নাম বলেছে। স্যারের ঘরে আমার পিছু পিছু দুজনে এসেছিল রগড় দেখতে। আমার কথা শুনে একদম ‘বোলতি বন্ধ্‌’। বাইরে আসতেই বলে ‘সত্যিই তুই অভিনয় করিস!’ আমিও তখন ডাঁটের মাথায় বলি ‘করি কিনা দেখবি!’

স্যার বললেন ছুটির পর এস। আমায় আর পায় কে! সুন্দরমের দীপকদা, মাঙ্গলিকের সমীর বিশ্বাস, রঙ্গনা থিয়েটারের দেবকুমার সবাই আমার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন সময়ে সময়ে। মনোজ মিত্র স্বয়ং আমাদের নাটক দেখে গেছেন। ‘আমি কি ডরাই সখী …’। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ফার্স্ট ইয়ার থেকে একমাত্র আমি নাটকে আছি। বাকি দু-একজন একদিন করে এসেই বিভিন্ন অছিলায় চলে গেছে – পরীক্ষার পড়ার ক্ষতি হবে, হ্যান-ত্যান।

এই নাটকের সূত্র ধরেই সিনিয়ার দাদা-দিদিদের সঙ্গে আমার খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল। এরপর থেকে ডিপার্টমেন্টে আমার প্রচুর গার্জেন। অর্ণবদা Differential Equationএ পুরো বাঁধানো নোট দিয়ে দিল। চন্দনাদি দিল Special এর 9th Paper. সুব্রতদা বাড়ি এসে পরীক্ষার আগে Differential Geometry পড়িয়ে গেল। দীপ্তেনদা-বাসুদা রিসার্চের শুরুর দিনগুলোয় শেখালো কি করে Journal review করতে হয়, কোথা থেকে research papers জোগাড় করতে হয়, স্যারের ঘরে সেমিনারে নতুন নতুন টপিক নিয়ে আলোচনা। রীতাদি ডেকে ডেকে গোখেল কলেজে কাজ দিল আর শমিকদার বাইকে চড়ে কুড়ি মিনিটে বাড়ি।

তবে সবার ওপরে ছিলেন DKB. খবর নিতেন পড়াশোনা ঠিকমত হচ্ছে তো? দেখো বাপু ওটা যেন ঠিক হয়। বলতেন বিয়ে করলে আমার তোমার বয়সী একটা মেয়ে থাকত। নাটকের সূত্রেই সবাই মিলে একদিন স্যারের বাড়ি পিকনিক করতে যাওয়া হল। প্রধান উদ্যোক্তা অদিতিদি। সেই অদিতিদি, অর্ণবদাও এখন তারাদের দেশে!

জানুয়ারী মাসের রি-ইউনিয়নের জন্য শনি-রবিবার নাটকের রিহার্সাল। ক্লাসের বাকি সবাই বাড়িতে পরীক্ষার পড়া তৈরীতে ব্যস্ত। বেশী পড়াশোনা করা যদিও আমার কোনওদিনই পোষায় না তবু বিবেক দংশন হয়। পার্থদা বলল, ‘শোন যারা পড়ার বাইরে এইসব রি-ইউনিয়ন, নাটক এসব করে দেখবি পরীক্ষায় তাদের রেজাল্ট বেশী ভাল হয়। এই আমায় আর উৎপলকে দ্যাখ। আমরা আমাদের সময় re-union, excursion সব কিছুর পাণ্ডা ছিলাম। আমরাই ফার্স্ট আর সেকেণ্ড হয়েছিলাম।‘ নাঃ, ফার্স্ট-সেকেণ্ডের আশা করতুম না, তবে পার্থদার কথায় ভারি ভরসা পেয়েছিলুম। আরও একটা কথা বলেছিল পার্থদা – এই ডিপার্টমেন্টে যে যাঁরই প্রিয় ছাত্র বা ছাত্রী হোক না কেন পরীক্ষার খাতায় কোনদিন কোনও partiality হয় না।

নাটকে পার্থদা, ঊৎপলদা, মাধবদা ছাড়াও প্রথমে অতসীদির একটা গান ছিল। কিন্তু চন্দনাদি, অদিতিদি আর আমি যখন রিহার্সালের ফাঁকে চুটিয়ে গল্প করতুম অতসীদি কিন্তু সেখানে থাকত না। কেষ্টদা পুরো রিহার্সাল করার পরও একদম ফাইনালের দিন পারিবারিক কারণে আসতে পারে নি। আর ত্রিপাঠী ধূমকেতুর মত মাঝে মধ্যে একেকবার এসে রিহার্সাল করে যেত।

নাটকের মেন পার্টে স্যার নিজে আর সুব্রতদা। দুজনের কারুর এক লাইনও পার্ট মুখস্থ নেই। প্রম্পটার বাসুদা প্রম্প তো করছে কিন্তু কার যে ডায়লগ দুজনের কেউ ধরতেই পারছে না। হল ভর্তি দর্শক তো হেসে খুন! তাতেও শুনলুম স্যার নাকি ‘আমার ভয়ে’ রাত জেগে জেগে পার্ট মুখস্থ করেছেন!

রি-ইউনিয়নের দিন নাটকের শেষে বাড়ি ফেরার তাড়া – শীতের রাত। সুব্রতদা বলল আগে একবার ডিপার্টমেন্টে চ’। গিয়ে দেখি সেকেণ্ড ইয়ারের ক্লাসরুমে থিকথিকে ভীড়। কি ব্যাপার! একটু পরে MNM তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গতিতে ঘরে ঢুকলেন – প্রবল হাততালি। শুরু হল স্যারের গান। নিচের মূল অনুষ্ঠানে স্যার কিন্তু গান করেন না। ওটা রি-ইউনিয়নের বিশেষ আকর্ষণ। একটার পর একটা গান। শেষ গানের রেশ কানে নিয়ে বাড়ি ফিরলুম – ‘আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো’।।

Posted in Uncategorized

প্রাণ ভোমরা

কর্তামশাইয়ের প্রাণভোমরার ডানা ফড়ফড়ানির চোটে আমাদের আত্মারাম এক্কেবারে খাঁচাছাড়া। মশাই আমার বেজায় কাজপাগল। কাজ ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারেন না। সেই প্রথম থেকে দেখে আসছি অফিসে যত কাজের চাপ, কাজের মান তত ভাল। ডেডলাইনের গুঁতো বাবুর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। বেশীরভাগ ডেডলাইনও তাই স্বকৃত। আর হাতে কাজ না থাকলেই মাথা গরম। নিজেও অস্থির আর বলা বাহুল্য চারপাশের লোকজনেরও ত্রাহি ত্রাহি দশা। সবসময়ই একটা কি করি, কি করি ভাব!

শুনেছি ছোটবেলায় পড়তে পড়তে মাথা গরম হয়ে গেলেই হাতে কাটারি নিয়ে হাজির সোজা পেছনের বাগানে। যেখানে যত কলাগাছ আছে সব ভবলীলা সাঙ্গ! অমন রাশভারি দাদু, যাঁর ভয়ে সারা বাড়ি থরহরি কম্প, এই নাতির বেলায় এক্কেবারে speakty not!

বিয়ের আগে রোজ নিয়ম করে ফোন আসত। সন্ধ্যের পর ফোন বাজলেই সবাই বলতো ‘ওই, এসে গেছে!’ হঠাৎ দেখি বেশ তিনচারদিন কোনও সাড়াশব্দ নেই। কি ব্যাপার! এমন সময় হবু শাশুড়ি মার ফোন। অফিসে অডিট চলছে। কারুর সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। ‘মেয়েটা হয়তো ভাবছে’ – উত্তর এসেছে ‘ওসব মেয়েটা-ফেয়েটা ছাড়ো!’ বুঝলুম খুব জাঁদরেল সতীনের সঙ্গে ঘর করতে চলেছি – বাবুর ‘কাজ’!

আবার যেই না সেই কাজ শেষ হল শুরু হল মাথার পোকা নড়া। কাজ নেই। কি করে সময় কাটবে! তবে তারও একটা দাওয়াই আছে। সোজা রান্নাঘর। সব্‌জিপাতি, মাছ-মাংস যা আছে খস্‌খস্‌ করে সব কাটা হয়ে গেল, রান্না করা হয়ে গেল। ‘ওরে, আজকের রান্না সব হয়ে গেছে। এতো খাবার কে খাবে এখন!’ তা সেটা তো আর রাঁধুনির সমস্যা নয়!

দেখলুম কাজ করার জন্যে নিজের কাছেই নিজের ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা। সবচেয়ে প্রিয় জিনিস বিসর্জন। ‘ফোন করবো না’, তারই একটা। এরকমই ‘CA না হয়ে মামার বাড়ি যাব না’, পড়া তৈরী না হলে ঠাকুরের মুখ দেখব না, তার জন্যে চুল-দাড়ি কামাব না, নতুন জামা পরব না।

সতীনের জ্বালা কি আমার কম! যেই কোথাও বেরোতে যাব বলবে একটা ছোট্ট কাজ আছে, এই পাঁচ মিনিট। কাজটা করেই বেরবো। তোমরা তৈরী হওনা! পাঁচ মিনিট ক্রমে ক্রমে দশ-বিশ-পঁচিশ …। কারুর সঙ্গে দেখা করার কথা থাকলে দেরী অবশ্যম্ভাবী। হোটেলে টেবিল বুক থাকলে ফোনের পর ফোন। ছেলেদের স্কুলে ফাংসন থাকলে সামনের সব ভাল জায়গা ভর্তি।

সবচেয়ে বেশী পুজোর সময়। আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তখন যেন অডিটের গুঁতো। সরকারী সময়সীমা তো আর দুর্গাপুজো অষ্টমী-নবমী দেখে হবে না! কলেজে ছুটি নিয়ে সকাল থেকে তৈরী হয়ে বসে আছি তো বসেই আছি। পাঁচ মিনিট যে ক্রমে ক্রমে কোথায় গিয়ে ঠেকছে! সকালের সাজ আর বেড়ানোর মেজাজ দিনের শেষে দুইই যখন এক্কেবারে ঘেঁটে ঘ’ ফোনের কবল থেকে মুক্তি মিলত। এবার নাকি হাসি হাসি মুখ করে বেড়াতে যেতে হবে আর ছবিও তুলতে হবে!

শনি-রবিবার বেরোনো মানেই রাস্তায় ফোন – গাড়িতে মাল লোড হয়ে আটকে আছে, এক্ষুনি ‘ক্রেডিট লক রিলিজ’ করতে হবে। বাইরে বেড়াতে গেলেও শান্তি নেই! ব্যাঙ্গালোরের লালবাগ তো পুরোটাই ‘ক্রেডিট লক’ এর গব্‌ভে।

কাজেই কোথাও গেলে আর কেউ সঙ্গে যাক না যাক বাবুর ‘লটপট’টি লটর পটর করতে করতে সবার আগে হাজির! হ্যাঁ মশাই ঠিকই ধরেছেন, ওটিই বাবুর প্রাণভোমরা।

তা এবার বাবু অনেকদিন পর অফিসের ট্যুরে গেছেন। আর কি বলব – বাড়ি থেকে বেরোতে না বেরোতেই যেন অভদ্রায় ধরেছে! কোথাও কিছু নেই হঠাৎ সোঁ-ও করে যেন একশ’ হাউই ছাড়া হয়েছে। আমি ভাগ্যিস অন্য ঘরে ছিলুম। শব্দভেদ করতে গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ! ঘরদোর ধোঁয়ায় ধোঁয়া। বাথরুমের গিজারের কি না হাউই সাজার ইচ্ছে হয়েছে! আমি তখন ন যযৌ ন তস্তৌ! কি যে করি, কাকে যে ডাকি! তার ওপর পৃথিবীতে কেউই আমার কোনও কথা পাত্তা দেয় না! ফোন করলেও কেউ আসে না। যা হোক, অসীম গুরুবল এ যাত্রায় হিটলারের গ্যাস চেম্বারের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি!

ওদিকে ট্যুরে গিয়েও অফিস-বাড়ি, ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের হাজারো চিন্তায় কর্তামশাইএর শরীর বেহাল, মন অস্থির। ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে সেদিন আর প্রাণভোমরার খোঁজ পড়ে নি। পরের দিন সকালে অফিস বেরোতে গিয়ে আচমকা আর্তনাদ ‘আমার ল্যাপটপ!’ এঘর, ওঘর, এ টেবিল, সে বিছানা সব ওলট-পালট করেও কোথায় কি! যত বলি আগে একটু স্থির হয়ে বসে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখ দেখি শেষ কখন ওটা দেখেছ? বাবু তত তুড়িলাফ খান! যার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘অস্থির বোস’ সে কি কখনও স্থির হয়ে বসতে পারে! তার ওপর একেবারে প্রাণভোমরাই উড়ে গেলে!

কিছুক্ষণ পরে বলেন ‘এয়ারপোর্টেই গেছে। সিকিউরিটি চেকের পর নেওয়া হয় নি’। সে আবার কি! তা সরকারী লাল ফিতের চেয়ে এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি চেকিংএর ঠেলা কিছু কম না! রোজই তার নিয়ম পালটায়। একদিন বলবে মোবাইল, চার্জার সব কিছু ব্যাগের মধ্যে পুরে সব সুদ্ধু চেকিন হবে। পরের দিনই বলবে শুধু মোবাইলই নয় তার একশ’ টাকার হেডফোনটাও ব্যাগ থেকে বার করে চেক করাতে হবে। এমন কি জুতো, ছাতা, ঘড়ি, বেল্ট কিছুই বাদ যাবে না।

বাবার মুখে শুনেছিলুম কিছুদিন আগেও ভারত থেকে যারা সরাসরি ইংল্যাণ্ডে যেত তাদের নাকি এক্কেবারে জন্মদিনের পোষাকে ইমিগ্রেসন চেক করাতে হত। ‘ব্ল্যাকি হিদেন’দের অপমান আর নাকাল করার চূড়ান্ত! এও ধীরে ধীরে সেই দিকেই যাচ্ছে মনে হয়! কোনোদিন বলবে একটা বড় ট্রেতে সবকিছু একসঙ্গে রাখতে হবে। কোনোদিন বলবে একটা ট্রেতে একটাই জিনিস – অর্থাৎ ল্যাপটপ আলাদা ট্রে, পার্সের আলাদা ট্রে, জুতো আলাদা, ফোন আলাদা; বেল্ট-ঘড়িও আলাদা! কোনোদিন হ্যাণ্ডব্যাগ এমনি যাবে, কোনোদিন তাকেও সিংহাসনে অর্থাৎ ট্রেতে চড়াতে হবে – আহা তার বুঝি ইচ্ছে হয় না!

তারওপর ব্যাগে খুচরো পয়সা থাকলে বার করে দেখাও। ওষুধ সেও দেখাও। এইসব সাতসতেরোয় দুবার করে ব্যাগ চেক করিয়ে নিজেকে আবার স্যুটেড-বুটেড করতে গিয়ে ‘গ্রে’ ল্যাপটপ ‘গ্রে’ট্রের মধ্যেই গ্যাঁট হয়ে বসে রইলেন!

হৈ হৈ হুলুস্থুলের মাঝে কোনওরকমে গুগলগুরুকে ধরে, একে ওকে ফোন করে এয়ারপোর্টের নম্বর তো পাওয়া গেল। এদিকে অফিস যাওয়া তো মাথায় উঠল। আরে, লটপটই যদি সঙ্গে না থাকে তো কোথায় গিয়েই বা কি লাভ!

ইন্টারনেটে দেখা গেল একটা ‘সিলভার’ ল্যাপটপের হারানো-প্রাপ্তির খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে বুঝি ওই! সবাই কি আর ল্যাপটপ ফেলে যায়! এবার তাহলে ফেরত পাবার ব্যবস্থা করতে হয়। ওই নম্বরে ফোন করতে তার বলল খবর নিয়ে জানাচ্ছি। কি ভাগ্যি, বড়বাবু দিওয়ালির ছুটিতে আজই বাড়ি আসছে। তার রাত্তিরে ওই এয়ারপোর্টেই পৌঁছনোর কথা। সে যদি উদ্ধার করতে পারে তার বাবার প্রাণভোমরা।

কিন্তু বড়বাবু! সে কি পারবে? সে তো সন্ধ্যেবেলা হাইওয়ে দিয়ে তারই মত আরেক গোবেচারা বন্ধুর সঙ্গে গাড়ি করে এয়ারপোর্ট অবধি আসবে ভেবেই আমার সাতরাত চোখে ঘুম নেই! ও বাবা, ভুলে গেলে বুঝি! সে তো নিজেই সব জিনিস হারিয়ে ফেলার ওস্তাদ! নতুন Casio ঘড়ি – আনার পর শুনলুম ‘এটা তোমার’। ওমাঃ, পরতে গেলেই শুনি ‘এটা পরলে কেন? এটা ছেলে বড় হয়ে পরবে’। তথাস্তু! তা ছেলে পরলো, বড় হবার আগেই। গুজরাট বেড়াতে গিয়ে। সে আবার কোনও কিছুই বেশীক্ষণ হাতে পরে থাকতে পারে না, সে ঘড়িই হোক, কি রাখী। তা মনের ভুলে ঘড়িটি হাত থেকে খুলে গাড়ির সিটে রেখে সে পরম নিশ্চিন্তে গাড়ি থেকে নেমে আসে। শুধুই কি ঘড়ি? ব্যাট, বল, টুপি মায় ইস্কুলের ব্যাগটি পর্যন্ত। একদিন ইস্কুল থেকে খালি হাতে ড্যাংডেঙিয়ে বাড়ি ফিরলেন। ব্যাগ গায়েব! বললেন ‘ইমলি পাড়ছিলুম, আঙ্কেল এসে ডাকলো, চলে এসেছি!’ তারপর সেই চশমা! বিকেলবেলা খেলতে গেলেন চোখে চশমা এঁটে। বাড়ি ফিরলেন চশমা হাওয়া। বলল ‘ওই তো ওখানে খুলে রেখে খেলছিলাম, এখন নেই’! নেই মানে! আমি যত রাগে ফেটে পড়ি ছেলে তত নির্বিকার! তখন তো সেই মুশকিল আসান দাদু এক হাতে একটা বড় টর্চ আর এক হাতে ছোট ভাইকে ধরে সার্চ পার্টি বের করলেন।

তো এই বড়বাবু এখন বাবার একমাত্র ভরসা ল্যাপটপ উদ্ধারের। অবশ্য ছেলে দেড় মাস পরে প্রথম হোস্টেল থেকে ফেরার পরই দেখি তার বাবা সেই বাংলা সিনেমার কমল মিত্রের মত তাকে বলছেন ‘তোমার মা তোমার জন্যে চিন্তা করে রাত্তিরে ঘুমোচ্ছেন না। তুমি মাকে একটু ভাল করে বোঝাও!’ বাবা ছেলের কথাবার্তা শুনে আমি হাসব না কাঁদব ভেবে পাই না!

যা হোক, এখান থেকে ‘মেল’-আ-মেলি করে চিঠি চাপাটি, আরও দরকারি কাগজপত্র তো দেওয়া হল, কিন্তু আসল কাগজটা! ল্যাপটপটা যে তেনারই তার জন্যে তো ট্যাগ নম্বরটা দিতে হয়! অফিসে ফোন করে আরও গড়বড়। দুজনের কাছ থেকে দুটো নম্বর এল যার প্রথম সংখ্যাদুটো আলাদা! এই রে কেলো করেছে! কোন নম্বরটা ঠিক বুঝবে কি করে! সব জায়গাতেই দেখি ‘উদো-বুধো’র ছড়াছড়ি। শেষে দুটো নম্বরই ছেলেকে দেওয়া হয়। আর সারাদিন ঠাকুর ঠাকুর করে কাটে।

অবশ্য এর মধ্যে এয়ারপোর্টের লোকেরা ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে -হ্যাঁ একটা ‘গ্রে’ ল্যাপটপ পাওয়া গেছে। এই মরেচে, ইন্টারনেটের লিস্টি যে বলছে ‘সিলভার’! আবার দ্বন্দ্ব সমাস! সকাল থেকে এতবার এয়ারপোর্টে ফোন করা হয়েছে যে তারা বোধহয় সবাই চিনে গেছে। দিদিমুণি বললেন ‘নেটে যা আছে সেটা International Passenger list. Domesticএর খবর ওখানে পাবেন না’! এই রে!

বাবু বললেন বাড়িতেই আরেকবার ভাল করে খুঁজে দেখ। সত্যি সত্যি বাড়িতেই নেই তো! আবার বলেন যদি এয়ারপোর্টে ফেলে না এসে থাকি! গাড়ির ড্রাইভার নিশ্চয় ডিকি খুলে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বার করে নেবে না! হায় রে, হ্যামলেট-রাজকুমার কিছুতেই পিছু ছাড়ে না! এয়ারপোর্ট অফিস যদি বন্ধ হয়ে যায়! ছেলের তো যেতে যেতে রাত সাড়ে ন’টা, দশটা। আবার ফোন – ‘আপনারা খোলা থাকবেন তো?’ ‘হ্যাঁ মশাই হ্যাঁ, আমাদের অহোরাত্র ডিউটি!’ পরের ফোন – ‘দেখুন দাদা এখানে লিখেছে ২৪ ঘণ্টা হয়ে গেলে জিনিস অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু আমার ছেলে –‘ ওদিক থেকে সোজা ধমক আসে ‘আপনি তো বললেন আপনার ছেলে আসবে!’ ‘হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার, থ্যাংকু, থ্যাংকু’।

তা ছেলের কলেজ কি পাশে! সে আসছে তো আসছে। রাস্তা আর ফুরোয় না। এদিকে বাড়িতে বসে দুরুদুরু বক্ষে দুজনে মোবাইলে তার ‘live location’ দেখে যাচ্ছি। কতদূর এল, আর কতক্ষণ বাকি। বার বার ফোনও করা যাচ্ছে না তাকে। বন্ধুর সামনে এতবার বাড়ি থেকে ফোন – তার একটা ‘পেস্টিক’ নেই! প্রায় কাছাকাছি এসে লোকেসান আর দেখায় না! এক জায়গায় স্থির! নামছে বোধহয়। ফোন ধরতে গেলে আবার নিজের জিনিস না গাড়িতে ফেলে আসে।

রাত দশটা। নাঃ, আর ধৈর্য রাখা যাচ্ছে না! দুগ্‌গা বলে করেই ফেলা হল ফোন। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ল্যাপটপ পেয়েছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ খুলে পাসওয়ার্ড দিয়ে দেখে নিয়েছি এটা তোমারই। এখন আমি sign করছি’। উঃ, কি শান্তি!

কি শান্তি – প্রাণভোমরা পাওয়া গেছে! কি শান্তি – ছেলে বড় হয়ে গেছে, দায়িত্ববান হয়ে গেছে!।।

Posted in Uncategorized

ড্যামকুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে – ৫

গুরগাঁও পর্বঃ

গুরগাঁও আসার ঠিক একমাসের মাথায় আমাদের মাথার ওপর থেকে সবচেয়ে বড় ছাতাটা সরে গেল। যে কোন পুজো হোক, যে কোন অনুষ্ঠান, বাড়িতে অতিথি – সবার আগে যিনি সেনাপতির মত সামনে দাঁড়াতেন সেই বাপী চলে গেলেন। কলকাতা হোক কি পুণা – মায়ের সব কাজের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন বাপী। আমরা যতক্ষণে তৈরী হয়ে পুজো মণ্ডপে যাব তার আগেই বাপীর মিষ্টি এনে কাগজে নাম-গোত্র লিখে সব কিছু রেডি। দশমীতে ঠাকুর বরণ, সিঁদুর খেলা – সেও সময় মত মিষ্টি পানপাতা সব হাজির। তাছাড়া অন্যান্য পুজো, ব্রত-উপবাস তো বটেই। আমরা মন্দিরে যাবার ঢের আগেই পুজো নিয়ে বাপী পৌঁছে যেতেন মন্দিরে। এমন কি পুণায় শেষবারের দুর্গাপুজোয় মায়ের শরীর বিশেষ ভাল নেই, এদিকে আমাদের বাইরে যাবার কথা, তখনও বাপীর মুখে সেই একই কথা – ‘আমি তো আছি, তোরা যা ঘুরে আয়’।

এখানে এসে সেই ‘আমি আছি’টাই এক্কেবারে ‘নেই’ হয়ে গেল। কিন্তু তখন মা যেন হয়ে উঠলেন একাধারে মা ও বাপী। আর বাপীর ছেড়ে যাওয়া ঊর্দিও উঠল বাপীর ছেলের গায়ে। নিজের মনখারাপ দূরে সরিয়ে রেখে ছেলেদের মন ভাল রাখতে নতুন জায়গায় এসে নতুন পুজো দেখার ছলে পুরোনোর অভাব ভুলিয়ে দেবার তার নিরন্তর চেষ্টা।

মায়ের তো সারা বছর পুজোপার্বণ, ব্রত-উপোস লেগেই থাকে। আর বেশী অনিয়মে বয়স্ক শরীরও মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে ওঠে। তখন মায়ের যত কিছু অভিমান অভিযোগ সব গিয়ে পড়ে ঠাকুর দেবতা, বিশেষ করে ওনার গুরুদেবের ওপর। এত পুজো উপোস করে যখন শরীরই খারাপ হল তখন ঠাকুরের মুখই দেখব না! কিন্তু পরের দিনই আবার নতুন ব্রত। আমরা কিছু বলতে গেলেই বলেন ‘ব্রত পালন করব না! কি বল?!’ তারপর এই লকডাউনের মধ্যে হঠাৎ তেড়ে উঠলেন ‘ঠাকুরের মুখ না দেখে আমার শরীর খারাপ; এবার আমি প্যাণ্ডেলে যাবই যাব!’

মহালয়ার দিন দিল্লিতে রামকৃষ্ণ সারদা মিশনে গান শুনতে যেতে মা খুব ভালবাসতেন। সেও আবার সবাই গান গাইছে দেখে মায়ের শখ হতো মায়ের বৌমাও গান করে। ওখানে সবার সামনেই আমায় খোঁচা লাগাতেন, সবাই গান করছে তুমি একটা গান করতে পারছ না! এদিকে আমার তো দরকারের সময় কিছুই মনে পড়ে না – সে কাজের কথাই হোক আর গান। আর তাছাড়া আমার ঝুলিতে একটা দুটোই গান আছে। ঠাকুর-মা-স্বামীজীর গান কি আগমনী গান হুট বলতেই কি আমি গাইতে পারি! শেষে একবার মাতাজীর কথায় একটা গান গাইতে মা যে কি খুশী হয়েছিলেন! মিশনের অনুষ্ঠানে বাংলা গান, বাংলা কথা, সবার ওপরে মাতাজীর অসীম ভালবাসার টান। যে কোন অনুষ্ঠান আছে জানতে পারলেই মা খুব উৎসাহের সঙ্গে মিশনে যেতেন।

মহালয়ার দিন বাড়িতে নামগানের আসর মা খুব মিস করতেন। কিন্তু  বাপী চলে যেতে মায়ের তো ডান হাতখানাই ভেঙ্গে গেল। বাপীহীন সংসারে নতুন শহরে আমাদের পক্ষে যে এতবড় অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব নয় সেটাও মা খুব ভাল জানতেন। নিজেরও তখন শরীর-মনে আগের মত সেই জোর নেই। এখানে সোসাইটির মধ্যেই কিন্তু কীর্তন মন্ডলী আছে। মাঝে মধ্যেই দুপুর থেকে তাদের কীর্তনের আসর বসে। বিশেষ করে শারদীয়া ও বাসন্তী নবরাত্রিতে পুরো ন’দিন ধরেই চলে দৈনিক কীর্তনের আসর। মাও এক একদিন গান-বাজনার আওয়াজ পেলে সেখানে যেতেন কীর্তন শুনতে। কিন্তু ভাষাগত সমস্যা বা যে কোন কারণেই হোক আমাদের বাড়ি সেই আসর বসানো সম্ভব হয়ে ওঠে নি।

পুণায় কলেজে কাজ করার সুবাদে সহকর্মী বন্ধুদের কাছে বহু মারাঠী প্রথা, রীতি-রেওয়াজ সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখানে এসে শামুকের খোলস ছেড়ে বেরোবার তাগিদটাই কোনদিন অনুভব করি নি। তাই ‘তীজ’ হোক কি ‘করোয়া চৌথ’, কীর্তন হোক কি দিওয়ালি মেলা – কোন কিছুতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি নি। সে সম্পূর্ণ ভাবেই আমার ব্যর্থতা। তবে দূর থেকে দেখে কিছু জিনিস জেনেছি। যেমন বছরের দুটো নবরাত্রিতেই নবমীর দিন ‘কঞ্জক’ বা কন্যা পূজা। সেদিন অনেকেই সামনের জুগ্‌গির বা বাঞ্জারাদের ছোট ছোট মেয়েদের বাড়িতে ডেকে ভাল খাবার খাওয়ায়, নতুন জামা দেয়। হোক না দু-একদিনের জন্যে তবু সেই দু-একদিনও তো তারা শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে পারে।

মা দুর্গা আমাদের ঘিরে রেখেছেন। এখানে আসতেই কুসু বলল আরে এই সামনের মাঠেই বঙ্গীয় পরিষদ গুরগাঁও এর বিরাট পুজো হয়। কদিন ধরে পুজো, খাওয়া-দাওয়া, আনন্দমেলা, দুপুরে ভোগ, সন্ধ্যেবেলা ফাংসন, কলকাতার আর্টিস্ট, মাঠজুড়ে কত রকম স্টল – দেখবি একটুও পুজোর আনন্দ বাদ পড়বে না। তাছাড়াও গুরগাঁওতে আরও বেশ কটা পুজো হয় দেখবি।

ওমা, সত্যি সত্যিই দোকান বাজারে যেতে আসতে দেখি রথের দিন খুঁটি পুজো হচ্ছে। তারপর বিরাট করে পুরো মাঠ ঘেরা হচ্ছে। দুদিকে দুটো গেট। গেট দিয়ে ঢুকেই পুজো কমিটির অপিস কাউন্টার। মাঝখানে পুজোর প্যাণ্ডেল। তার একেকবার একেকরকম থিম – কখনও গ্রাম বাংলা, কখনও কেদারনাথের মন্দির, কখনও চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার। পেছনের দিকে আলাদা করে স্টেজ আর মাথা ঢাকা বসার জায়গা। এপাশে ভোগ খাবার ব্যাবস্থা। স্টেজ আর খাবারের দিকে যেতে গেলে সেখানেও একটা গেট মত। বাইরের অবাঞ্ছিত লোক যাতে ঢুকতে না পারে। আবার প্রথম বছর এখানেও বাংলা বইএর স্টল – দেখেই মনটা খুশিতে ভরে গেল। তবে মাঠ জুড়ে বিরিয়ানি, কাবাব, চাইনিজ – খাবারেরই মেলা।

বঙ্গীয় পরিষদের পুজোর কর্মকর্তা ও কর্ত্রীরা সবাই অত্যন্ত ভাল মানুষ। এখানে গেলে কারোর মনেই হবে না যে সে নতুন এসেছে কি বাইরের লোক। অঞ্জলির লাইন হোক, কি সন্ধিপুজোয় প্রদীপ জ্বালানো অথবা দশমীর দিন সিঁদুরদান – নতুন-পুরোনো, কমিটি, বহিরাগত সবার সঙ্গে সমান ব্যবহার, সবার জন্যে এক নিয়ম। দুপুরে ভোগ খাবার ব্যবস্থাও খুব ভাল। সকালে গিয়ে বলতে হবে কটার ব্যাচের কজনের কুপন চাই। বসে খাবার মত ঠিক যত জনের ব্যবস্থা একেক ব্যাচের জন্য ঠিক ততগুলোই কুপন দেওয়া হয়। সেই সময়ের কুপন ফুরিয়ে গেলে অন্য কোন সুবিধেমত সময় নেওয়া যায়। আর কারুর যদি বেশী তাড়া বা দাঁড়িয়ে খেতে আপত্তি না থাকে তার জন্যে আছে আলাদা বুফের কুপন। পুজো নেবার ও প্রসাদ দেবারও একি রকম সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা।

একই রকম ভাবে আছে লক্ষ্মী পুজো, কালীপুজো, সরস্বতী পুজোতেও পুজো দেওয়া আর পুজোর পর খাবারের ব্যবস্থা। আমরা বাঙালীরা আবার কালীপুজোর সময় ঘোর তামসিক হয়ে উঠি। সেদিন পুজো শেষ হবার পর থাকে ঢালাও লুচি মাংসের ব্যবস্থা। খাওয়ানোর ব্যাপারে কোনও সময়ই কোনও কার্পণ্য নেই, কোনও আমি-তুমির ভেদ নেই। সবাই পেট ভরে মন ভরে তৃপ্তি করে খাবার খেতে পারে।

প্রথমবার দুর্গাপুজোয় যেতে গিয়ে দেখি ওমা, পেছনের দিকে সেক্টরের যে কম্যুনিটি হল সেখানেও একটা পুজো হচ্ছে। এরা বলে যেখানেই দশটা বাঙ্গালী সেখানেই একটা দুর্গা পুজো। আর পরের বছর সেই একটা পুজো ভেঙ্গে হয় দুটো পুজো। এটাই বাঙালী রীতি। এই পুজোতেও খাওয়াদাওয়া ফাংসন কলকাতার আর্টিস্ট সবই আছে, কেবল স্টল নেই। আমাদেরও পোয়া বারো। সুবিধে মত যে পুজো ইচ্ছে সেখানে যাই। তাছাড়াও আছে নির্বাণার পুজো, সুশান্ত লোকের পুজো, DLF এর পুজো। যদিও এসব পুজো সন্ধ্যেবেলাই দেখতে যাওয়া হত, কিন্তু এখানে একটা শান্তি ছেলেদের ইস্কুল অষ্টমী থেকে দশমী অবধি ছুটি।

এতদিনে একা একা মেট্রো চেপে দিল্লি যেতে আমি বেশ শিখে গেছি। তাই সপ্তমীর দিন বাকিরা যখন স্কুল আর অপিস নিয়ে ব্যস্ত আমি চলে যেতুম দিল্লি মিশনে। যদিও আমার নড়ে নড়ে তৈরী হয়ে এতদূর যেতে যেতে সকালের চন্ডীপাঠ ও হোম শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তারপর চলে গান আর অঞ্জলি। মাকে অনেক বলেও পুজোর মধ্যে বাড়ি থেকে বার করা যেত না। আমি তাই একাই যেতুম। মাতাজীদের কোনও ক্লান্তি নেই। সকাল দশটা থেকে প্রায় বারোটা পর্যন্ত যে যখন যাচ্ছে তখনি তাকে অঞ্জলি দেওয়ান। তারপর সপ্তমী আর নবমীতে এমনিতে হাতে হাতে প্রসাদ। অষ্টমীর দিন খিচুড়ি প্রসাদ। তবে আমি তো একবার মিশনে গেলে আর বাড়ি আসার নামটি করি না, তাই মাতাজীও ভলেন্টিয়ারদের সঙ্গে আমাকে দুপুরে ভাত-ডাল খাইয়ে তবে ছাড়েন।

পুণায় প্রথমদিকে একবার অষ্টমীর দিন রামকৃষ্ণ মঠে গিয়েছিলুম ছেলেদের নিয়ে। অমৃতাও ছিল আমাদের সঙ্গে। ওখানে তখন হোম হচ্ছে। ছোটবাবু তখন বছর তিনেকের। বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে উঠে দেখি সে আপন মনেই বলে চলেছে ‘ওম্‌ স্বাহা’। সেই শুনে অমৃতার পরে কি হাসি! শেষের দিকে দুবছর অষ্টমীতে পুণায় সারদা মঠে গেছি। ওখানেও হোম শেষ হলে আরতি আর তারপর ভজন হয়। তারপর খিচুড়ি প্রসাদ পেয়ে মনে অসীম তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফেরা। দিল্লি মিশনে গিয়েও সেই একই তৃপ্তি একই আনন্দ।

নবমীর দিন চারজনে মিলে দিল্লি চিত্তরঞ্জন পার্কে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। তবে এবার মেট্রোরেল নয় ক্যাব। দিল্লি তো কিছুই চিনি না। GK2 দিয়ে ঢুকে যেই না দেখেছি একটা মাঠে বিরাট করে প্যান্ডেল হয়েছে আর মাইকে মন্ত্র পড়ার আওয়াজ আসছে, গাড়ি থামান, গাড়ি থামান করে তো নেমে পড়েছি। ভেতরে গিয়ে ঠাকুর দেখা ছবি তোলা সব তো হল। আর কোনও পুজো হয় কি না আর হলেও কোথায় কত দূরে কিছুই জানি না। তবে সেই কলেজে পড়ার সময় রাজস্থান ট্যুরে যাবার পথে দিল্লি এসে দেখেছিলুম চিত্তরঞ্জন পার্কে একটা কালীবাড়ি আছে আর সেখানে দুর্গা পুজো হয়। দিল্লিতে যে কালীবাড়িও অনেকগুলো আছে আর সব জায়গাতেই দুর্গাপুজো হয় তাও তো তখন জানা নেই। আমার ধারণায় নিউ দিল্লি কালীবাড়ি মানেই এই চিত্তরঞ্জন পার্কের কালীবাড়ি। সেই কালীবাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করতে জানা গেল আরে এটা C. R. Parkই নয়। এটা ওই GK2র M-ব্লকের পুজো। বেরিয়ে এসে মাঠের পাশের দোকানদারদের জিজ্ঞেস করতে তারা তো বলে দিল এই রাস্তা দিয়ে এই দিকে গেলেই চিত্তরঞ্জন পার্ক।

হাঁটতে গিয়ে দেখি রাস্তা আর ফুরোয় না। প্রথমে খুব উৎসাহ নিয়ে তো শুরু করেছি। রাস্তার দুদিকে যে বাড়ির দিকেই তাকাই সব গেটেই বাঙালী পদবি লেখা – চ্যাটার্জী, মুখার্জী, বসু, সেনগুপ্তা এমনকি বক্সি। বক্সি দেখলেই আমার তো ব্যোমকেশের কথা মনে হয়। ছেলেরাও খুব উত্তেজিত। তারপরই রোদ্দুরে গরমে ঘামে জল তেষ্টায় সবার অবস্থা কাহিল। মাঝে মাঝে পথ চলতি লোকেদের জিজ্ঞেস করি ‘কতদূর, আর কতদূর’। রাস্তায় বাঁকের মুখে আরেকটা প্যান্ডেল। আরে দিল্লির ঠাকুর দেখতেই যখন বেরিয়েছি টুক করে ঠাকুরটা দেখে নিলে হয়! রাস্তার নাম দেখি বিপিন চন্দ্র পাল রোড। অবশেষে সেই রাস্তার বাঁক ঘুরে আবার একটা মাঠ। এখানে লেখা রয়েছে চিত্তরঞ্জন পার্ক কো-অপরেটিভ। হুররে, অবশেষে চিত্তরঞ্জন পার্ক পৌঁছনো গেছে।

দিল্লি-গুরগাঁওএ সব পুজোয় একই ছবি। পুণায় যেমন ঠাকুর আর ফাংসনের স্টেজ পাশাপাশি, এখানে ঠাকুরের আলাদা প্যাণ্ডেল। আর ফাংসনের স্টেজ তার থেকে একটু দূরে। (অবশ্য পুণার AFMC-র পুজোতেও তাই।) বহু জায়গায়ই ফাংসন শুধুমাত্র মেম্বারদের জন্যে। বাকিরা এসো, প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখো, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা স্টল থেকে বম্বে চাট, দই পুরি, পাপড়ি চাট অথবা আমিষ হলে বিরিয়ানি, ফিস ফ্রাই তারপর মিষ্টি, আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিংস খেতে খেতে বড় জোর দূর থেকে মাইকে ফাংসন শোনো। বেপাড়ার লোক হয়ে মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসে বসে ফাংসন দেখতে পাবে না বাপু! টাকা দিয়ে মেম্বার হও ফাংসন দেখো – ফেলো কড়ি মাখো তেল!

কো-অপরেটিভের পুজোয় দেখি বিজলিগ্রিলের স্টল। আহাঃ, আহাঃ – ফিস ফ্রাই, চিকেন কাটলেট না খেলে হয়! চিকেন ললিপপ, মোগলাই পরোটার চলটা এখানে বিশেষ নেই। রোল অবশ্য আছে – এগ, চিকেন, ভেজ; তবে আসল হল বিরিয়ানি। একেবারে ডিম, আলু দেওয়া শুকনো শুকনো কলকাতা বিরিয়ানি। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানিও আছে অবশ্য। পুণায় বাঙালীদের জন্যে খাবারের ভারি কষ্ট। বিশেষতঃ আমার মত যারা অতিরিক্ত মশলা মাখা দম বিরিয়ানি পছন্দ করে না। কলকাতার বিরিয়ানিই হয়ে উঠল আমাদের পুজোর প্রধান আকর্ষণ। তবে আমার জন্যে সোমবার, ষষ্ঠী, অষ্টমীতে বাদ। সেদিন শুধু মিষ্টি খেতে পার।

কো-অপরেটিভের পুজো দেখে এদিক ওদিক থেকে যা খবর পাওয়া গেল তাতে শুধু চিত্তরঞ্জন পার্কেই নাকি দশ-বারোটা দুর্গা পুজো হয়। প্রতি ব্লকের আলাদা পুজো। তাছাড়াও কিছু বাড়ির পুজোও আছে। ওদিকে আমাদের পা তো তখন জবাব দিয়েছে। মাঠ থেকে বেরোতেই শুনলুম এই তো সামনেই আরেকটা পুজো আছে। এই রাস্তা ধরে একটু এগোলেই। আর না। এবার টোটো। টোটো চালকরা সব বাঙালী। আমাদের নিয়ে গেল শিবমন্দির বা চিত্তরঞ্জন পার্ক কালীবাড়ি। এইতো সেই কালীবাড়ি যেটা আমি আগে দেখেছি! এক্কেবারে রাস্তা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে।

কালীমন্দিরের দুর্গাঠাকুর দেখে ভেতরে গিয়ে মা কালী, শিবঠাকুর আর রাধা-কৃষ্ণর সঙ্গেও দেখাটা সেরে নিলুম। ওদিকে নিচে তখন ভোগের বিশাল লাইন। মন্দিরের সামনে রামকৃষ্ণ মিশন আর আর্য সমাজ এদের বইএর স্টল। বাইরে মাঠের পাশে সারা রাস্তা জুড়ে রকম রকম দোকান। আচার-হজমি, ডাব, শোলার প্রতিমা, ইমিটেসন গয়না, ব্যাগ – কি আছে আর কি নেই! কিছুমিছু কেনাও হল।

এবার পরের ঠাকুর। B-ব্লকের ঠাকুর দেখার আগে রাস্তায় চোখে পড়ল চিত্তরঞ্জন ভবন। আর মাঠে ঢোকার মুখেই একটা বাড়ির গ্যারেজের মধ্যে থেকে তখন ঢাকের বাদ্যি শোনা যাচ্ছে। সেই বাড়ির ঠাকুরও দেখা হয়ে গেল আমাদের।

B-ব্লকের পুজোর বিরাট প্যাণ্ডেল। আর মাঠ জুড়ে খাবারের স্টল। দুর্গাঠাকুর দেখতে গিয়ে ফুচকা খাবো না তা কি হয়! যে ছেলেটি ফুচকা বিক্রি করছে পাশেই তার মা বসেছে ঝাল মুড়ি, মাংসের ঘুগনি, চুড়মুড় এই সব নিয়ে। মনের সাধ মিটিয়ে ছোটবেলার কলকাতার দুর্গাপুজো উপভোগ করছি মনে হল। আরে, ওই তো কোলা গোলাও আছে! আর বুড়ির মাথার পাকা চুল! মেলায় এসে ওটা না খেলে হয়! এটা দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক আর একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক, না কি সেই টালা পার্কের মেলা আর বিংশ শতাব্দীর আটের দশক। ঠিক যেন টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে গেছি সেই ছোটবেলায়। মেলার এক কোণে ওই তো ঘুর্ণী-নাগরদোলা আর ওই যে বেলুন ফাটানোর স্টল! বেলুন ফাটানোয় ছেলেদের উৎসাহ দেখে মনে হল সিলুয়েটে আমাদের ছোটবেলাটাই দেখা যাচ্ছে!

চিত্তরঞ্জন পার্কে গিয়ে বাঙালীর ‘মাছ-মিষ্টি-মোর’ না হলে চলে? তাই পুজো প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে আবার ঘুরে যাওয়া হল ১ নং মার্কেটে। মোটামুটি দশ-পনেরো মিনিটের হাঁটা পথে আরও দু একটা পুজো প্যাণ্ডেল আছে বলে সবাই বলছে। কিন্তু ততক্ষণে ছেলেরা ভেটো দিয়ে দিয়েছে, এবারের মত দিল্লির ঠাকুর দেখা ইতি। তাছাড়া যত সময় বাড়ছে রাস্তায় ভীড়ও বাড়ছে, বহু রাস্তা ‘NO ENTRY’ করে দিচ্ছে। দিল্লি থেকে ফেরার পথে গুরগাঁওএর গাড়ি পাওয়াই মুশকিল। মেট্রো করে যাওয়াই যায়, কিন্তু কাছাকাছি মেট্রো স্টেশন ঠিক চিনি না। আর ছেলেদের মেট্রো পালটে যেতে হবে শুনেই মাথা গরম। ওদিকে আবার রামলীলা ময়দানে রাবণ দহন পালা শুরু হবে একটু পরেই।

মাছের বাজারে ঘুরে মেছো গন্ধে ছেলেদের নাক সিঁটকানির ভয়ে বেরিয়ে এসে এবার বাঙালী মিষ্টি। আর ঠিক উল্টোদিকে পুজোর জন্যে নাড়ু-বাতাসা, খই, ঘরের তৈরী আচার, গোবিন্দভোগ চাল, মটর ডাল – কি আর কি নয়! বাজারের ভারে হাত যখন ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম এদিকে একের পর এক ক্যাব বুকিং ক্যান্সেল করছে তখন কোনওক্রমে একটা গাড়ি তো পাওয়া গেল।

এরপর পুজোর সময় একদিন চিত্তরঞ্জন পার্ক যাওয়া আর ঠিক এই এই ঠাকুর দেখা আর ফেরার পথে মার্কেট থেকে এই মিষ্টি-নোনতা, নাড়ু-বাতাসা, ধূপ, আচার, খই, লাল চালের মুড়ি কেনাটাও একটা নতুন রেওয়াজে পরিণত হল। ঠিক যেমন পুজোর মধ্যে একদিন ভাল হোটেলে খাওয়া। সে কলকাতায় তাজ বেঙ্গল, Main Land China হোক, কি পুণায় Oh! Calcutta, China Grill অথবা গুরগাঁওতে বিজলি গ্রিল কি দিল্লিতে আমিনিয়া।

বড়বাবু অনেক খুঁজে ভেলোরে দুর্গা পুজো দেখতে গিয়ে বলল ‘একটুও মনে হচ্ছে না ভেলোরে আছি’। কলকাতা, পুণা, গুরগাঁও, দিল্লি কি ভেলোরের পুজো দেখে আমাদের এটাই মনে হয়েছে যে দেশের যে শহরই হোক সব জায়গাতেই ঘরোয়া পুজোর মূল সুর সেই একই। দুর্গা পুজো মানেই চার-পাঁচটা দিন সব বাঙালী একজোট হয়ে মায়ের পুজো, একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, নাচ-গান হৈ হুল্লোড়, পরস্পরের সঙ্গে আলাপ পরিচয়, নতুন বন্ধু – নতুনের মোড়কে সেই এক টান, সেই এক তান।।

Posted in Uncategorized

ড্যামকুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে -৪

পুণা পর্বঃ

পুণায় প্রথম সকালে ঘুম ভাঙ্গলো ষষ্ঠীর ঢাকের আওয়াজে। বিধান নিবাসের পুজোর জমজমাট আয়োজন পেছনে ফেলে পঞ্চমীর দিন যখন দুই ছেলে আর শাশুড়ি মা কে নিয়ে দমদম এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিলুম তখন পিছু ফিরে আর তাকাই নি মা-বাবার মুখের দিকে। নিজের চোখের জল আর মনের বেদনাকে চাপা দিয়েছিলুম প্রিয়জনের কাছে যাবার আগ্রহ ও নতুন শহর নতুন মানুষ চেনার উত্তেজনা নিয়ে। তার আগে পাড়ার সবাই যখন বলেছেন ‘পুজোটা কাটিয়ে যাস’, তখন ওদিক থেকে অভয় এসেছে ‘তোমার কোনও চিন্তা নেই, এক্কেবারে বাড়ির পাশেই দুর্গা পুজো হচ্ছে’। মুম্বাই থেকে গাড়ি করে পুণা এসে পৌঁছলুম তখন অনেক রাত। ততক্ষণে বাপী ট্রেনে করে আমাদের আগেই পৌঁছে গেছেন পুণায়।

নতুনের উত্তেজনা চোখে নিয়ে তাকিয়ে দেখি সত্যিই মা দুর্গা আমাদের অভ্যর্থনা করবেন বলে সেজেগুজে বসে আছেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা পার হলেই সংকটহরণ মহাদেব মন্দির। সেই মন্দির চত্তোরেই হচ্ছে এক প্রবাসী বাঙ্গালী ভদ্রলোক শ্রী জয়ন্ত চক্রবর্তীর নিজস্ব দুর্গাপুজো – বিচক্ষণা দুর্গাপূজা।  

কলকাতার বাইরে এসে দেখলুম সনাতন ধর্ম মন্দির মানে একই চত্তোরের মধ্যে সব দেবতার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। গেট দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে রয়েছেন লাল টুকটুকে মহাবীর। বাঁদিকে শিবমন্দির তার সামনে বিরাট নাটমন্দির যা সবসময়ই সারমেয়কূলের দখলে। শিবলিঙ্গ স্পর্শ করতে হলে নিচু গর্তের মধ্যে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে আবার পিছু ফিরে হামাগুড়ি দিয়ে বেরোতে হবে। দেবতার কাছে নতমস্তক হয়ে থাকাই দস্তুর কিনা! ওদিকে কষ্টেশিষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে দেখা গেল শিবঠাকুরের ঠিক পাশেই ঠাণ্ডায় আরামে গুড়িসুড়ি দিয়ে সুখের নিদ্রায় মগ্ন ধর্মরাজের সঙ্গীরা! আমার মত অসীম সাহসী ভক্তের পুজোয় ওখানেই ছেদ পড়ে। পাশে রয়েছেন কালো পাথরের গণপতি সঙ্গে নবগ্রহ। তারও পাশে শ্বেতপাথরের বৃন্দাবনলাল রাধারমণবিহারীজী। পেছনের দিকে আছেন দেবী সিংহবাহিনী। আর আছে গোশালা আর সবের দায়িত্বে বিরাট জটা্জুটোধারী মোহন্তবাবা ও তাঁর শিষ্য।

প্রথম সকালেই বাপী ছুটলেন মন্দিরে ষষ্ঠীর পুজো পৌঁছে দিতে। একটু পরেই দাদা-বৌদি ছেলে মেয়ে নিয়ে হাজির। চল, চল পুণার ঠাকুর দেখবি। দাদার গাড়ি করেই যাওয়া হল পুণার কর্পোরেসন গ্রাউণ্ডের দুর্গা ঠাকুর দেখতে। পুরো মাঠ ত্রিপল দিয়ে ঘেরা। ষষ্ঠীর সকাল বলে ঢোকার খুব বেশী লাইন নেই। বিরাট বড় আলাদা আলাদা চালচিত্রের প্রতিমা। ঠাকুরের বেদির পাশেই স্টেজ। কদিনভোর রোজই সন্ধ্যেবেলা সেখানে ফাংসন হবে। মাঠ জুড়ে চেয়ার পাতা। পুজো কমিটির মেম্বারদের জন্য এই কদিন দুপুরেও ভোগের ব্যবস্থা। পুজোয় মেম্বার যে কেউই হতে পারেন। চাঁদা দিলেই হাতে পেয়ে যাবেন ভোগের কুপন। আর দুপুরের দিকেও থাকে কিছু না কিছু ঘরোয়া কম্পিটিসন – মহিলাদের শাঁখ বাজানো, বয়স্কদের কুইজ, ছোটদের বসে আঁকো, আবৃত্তি এইরকম আর কি।

মেম্বার না হলেও খাবারের অভাব নেই। মাঠের চারদিকে বিভিন্ন স্টল রয়েছে। সেখানে কলকাতার মিষ্টি, কচুরি তরকারি, মিষ্টি দই তার সঙ্গে আচার-কাসুন্দি, হজমিগুলি, পুজোর জন্যে আলতা-সিঁদুর, শাঁখা-পলা সবই পাওয়া যায়। তেমনি রয়েছে চিকনের শাড়ি, কুর্তির স্টল, বাংলার শাড়ি, মাটির বা জুটের গয়না, বাড়ি সাজানোর সামগ্রী, ছবির স্টলও। আর আছে খাবারের স্টল। সবচেয়ে ভীড় সেখানেই। মোগলাই পরোটা, ফিস ফ্রাই, চিকেন রোল, কাটলেট কি আছে আর কি নেই! পরে দেখলুম ওখানে মোটামুটি সব বড় পুজোয় এই একই ধারা।  মারাঠীদের অবশ্য বিপুল বিস্ময় পুজোর সময় তোমরা ‘ননভেজ’ খাচ্ছো! আরে কি করে বোঝাই পুজো আমাদের কাছে শুধুই রীতি মেনে পুজো করা নয়, দুর্গাপুজো বাঙ্গালীদের মিলন উৎসব।

নাঃ, মা দুর্গা কোনওভাবেই পুজোর সময় মন খারাপ করতে দেবেন না। কর্পোরেসনের পুজো ছাড়াও আমরা দেখলুম আনন্দম, AFMC, কোরেগাঁও পার্ক আর খাড়কি কালীবাড়ির পুজো। এর মধ্যে AFMC -র পুজোও বাড়ির বেশ কাছেই, আর আনন্দমের পুজো তো রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই। বৌদিরা তখন আনন্দম আর খাড়কি কালীবাড়ির পুজোয় ফাংসন করে। প্রথমবার অত ছোট ছেলেদের নিয়ে ফাংসন দেখতে যাওয়া হয় নি ঠিকই। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা তিন বছরের নীল আর সাড়ে সাতমাসের সোহমকে নিয়ে সবাই মিলে যাওয়া হল দুর্গাঠাকুর দেখতে।

তার আগে প্রবাস জীবনের আমার প্রথম পুজো-বাজার হল একটা প্যান্ট আর টপ। আর সেই নতুন কেনা পোশাক পরে সবাই মিলে গাড়ি করে গেলুম বাড়ির একদম পাশেই পাহাড় দেখতে। কলকাতার লোক আমরা, সমুদ্রের কাছাকাছি বাস। নিজেদের ঘরের জানলা থেকে পাহাড় দেখা আমাদের কাছে মস্ত বিস্ময়। নাই বা হল হিমালয়, পশ্চিমঘাট তো বটে!

জয়ন্তদা অত্যন্ত অমায়িক মানুষ। ওনার পুজোয় সবার অবারিত দ্বার। মন্দিরে গিয়ে বিচক্ষণা মা দুর্গার সামনে বসে থাকাটাও তখন মনে হয়েছিল বিরাট পাওয়া। আমাদের এগারো বছরের পুণা বাসে এমন কোনবার হয়নি যে বিচক্ষণায় পুজো দেখতে গেছি অথচ ভোগ প্রসাদ পাই নি। একবার তখন ছেলেরা আনন্দমে ফাংসন করেছে। ফাংসন শেষে দূরের এদিক ওদিক ঠাকুর দেখে বাড়ি ফেরার পথে রাত দেড়টার সময় বিচক্ষণায় এসেছি। মন্দির তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তখনও জয়ন্তদার মুখে সেই এক কথা – ‘একটু মায়ের প্রসাদ পেয়ে যান’। তখন কেবলমাত্র ডাল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। গেলাসে করে সেই ডালই দিয়েছেন প্রসাদ বলে।

সেবার নবমীর দিন আমাদের বাইরে যাবার কথা। বাড়িতে এসে তাড়াতাড়ি করে last minute packing সেরে বেরবো, বাপী ঢুকলেন হাতে বিচক্ষণার ভোগপ্রসাদের থালা। কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, ‘কি করব আমায় জোর করে প্রসাদ দিয়ে দিলে, বললে ‘মেসোমশাই বাড়ির জন্যে নিয়ে যান’।‘ সত্যি এই আন্তরিকতা এখন কোথায় মেলে!

পুণায় পুজোর সময় নতুন অভিজ্ঞতা স্কুল-কলেজ-অপিস সব খোলা। একমাত্র দশমীর দিন ছুটি। নাঃ, অভিযোগ জানানোর কিচ্ছু নেই। কারণ ঠিক মাসখানেক আগেই দশদিন ধরে হয়েছে গণপতি উৎসব। সেই সময়ও স্কুল-কলেজ-অপিস স-ব খোলা থাকে। কিন্তু তাতে উৎসবের আনন্দে এতটুকুও ভাটা পড়ে না। মহারাষ্ট্রে গণপতি উৎসব সত্যিই আমাদের দুর্গা পুজোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। মারাঠী অমারাঠী প্রায় প্রত্যেকে বাড়িতে ‘গণপতি বসায়’। তাছাড়া আছে ছোট বড় সব সোসাইটির পুজো। এমন কি স্কুল-কলেজ-অপিসের প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টেও আলাদা আলাদা পুজো। এর ওপর তো আছে বিভিন্ন ‘মণ্ডলের পুজো’।

সারাদিন বাড়ির পুজো, উপবা্‌স, রকম রকম ‘প্রসাদ’ তৈরী করে নিয়ম মাফিক ঠিক সময়ে সবাই যে যার কাজে যায়। সেখানেও নিয়মিত কাজের ফাঁকে এই দশদিন দৈনিক পুজো-আরতি-রঙ্গোলি-প্রসাদ। একেকদিন একেকজনের ভাগে পড়ে সেদিনের প্রসাদের দায়িত্ব। প্রত্যেকের কাছে চাঁদা নিয়ে মূর্তি আনা থেকে সাজানো গোছানো সব হয়। বড় ডিপার্টমেন্ট হলে একেকদিনে একাধিক সদস্য প্রসাদের ব্যবস্থা করেন। ঠিক একই ভাবে হয় সোসাইটির পুজো। সেখানে অতিরিক্ত আকর্ষণ রোজ কিছু না কিছু অনুষ্ঠান। আজ বাচ্ছাদের স্পোর্টস্‌, কাল বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, পরশু নাচ-গান বিচিত্রানুষ্ঠান, তারপরদিন রঙ্গোলি প্রতিযোগিতা, তারপর ‘Go as you like’ আর সবার ওপর Housie তো আছেই।

এই কদিন বাচ্ছাদের হোম ওয়ার্ক করার জন্যে আলাদা করে বলতে হয় না। বিকেলের মধ্যে সব সারা। তারপরই ‘আজ নিচে কি আছে মা?’ সেই প্রতিযোগিতায় বাচ্ছাদের উৎসাহর অন্ত নেই। মায়েদেরও। কে জিতল, কে ফার্স্ট হল? শেষদিন প্রাইজ দেওয়া হত। সেই নিয়েও কত জল্পনা কল্পনা। কি প্রাইজ দেওয়া হবে। বড়দেরও প্রাইজ আছে কি না। আর তারপর কম্যুনিটি ডিনার। বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে রান্না করানো হবে। সেদিন আবার কেরালার লোকেদের ‘ওনাম’, তাদের দ্বিগুণ আনন্দ। এই দশদিনের ভেতর একদিন আবার হবে সত্য নারায়ণ পুজো। এটা একটা অবশ্য পালনীয় রীতি। নিচের আরতি, অনুষ্ঠান শেষ হলে আবার প্রতিবেশীদের ঘরে যাওয়া হত আরতিতে। না গেলেই ডাকতে আসত। সন্ধ্যেবেলা একবার বাড়ি থেকে বেরোলে কাউকেই আর কিছু বলতে হত না। এবার এর ঘরে, এবার ওর ঘরে, বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যে কাবার। এই দশদিন ধরে সকাল বিকেল আরতি করতে করতে আমাদের অন্তত একটা মারাঠী ভজন শেখা হয়ে যেত। গণপতি উৎসব সত্যিই সবার মনে একটা একতার ভাব জাগায়। হিন্দু-মুসলিম-কৃশ্চান সবাই মিলে এসে যোগ দিত দশদিনের এই মহোৎসবে।

বাড়ি, অপিস-কাছারি, সোসাইটি সব সামলে এবার সবাই বের হত বড় বড় প্যান্ডেলের ঠাকুর দেখতে। কি তার সাজসজ্জা, কি তার আলোর রোশনাই! সারারাত ধরে চলত লোকের ঢল। কিন্তু পরের দিন সকাল থেকেই আবার সবাই যে যার রুটিন কাজে। সেখানে কোনও কামাই নেই, কোনও ফাঁকি নেই।

পুণা মারাঠী সংস্কৃতির মুলকেন্দ্র। আর গণপতি উৎসবকে নতুন করে জনপ্রিয় করার মুখ্য কারিগর লোকমান্য তিলকের বাসও ছিল এই পুণায়। তাছাড়া পুণা মারাঠীবীর শিবাজীর ছোটবেলার বাসভূমি। দাদাজী কোণ্ডদেবের ছত্রছায়ায় এই পুণার লালমহলেই জিজামাতার কাছে বড় হয়েছেন শিব্বারাও। কসবা পেঠের গণপতিকে স্বয়ং জিজামাতা পুজো করতেন। কাজেই মুম্বাই, নাসিককে ধরলেও গণপতি উৎসবে সম্মানের দিক থেকে পুণা এক কদম এগিয়ে।

গণপতি বিসর্জনও এখানে এক দেখবার মত ব্যাপার। দশদিন ধরে মহা সমারোহে পুজোর পর ধূমধাম করে ভাসান। পুণার পাঁচ জায়গার গণপতিকে বলা হয় ‘মানাচে গণপতি’ অর্থাৎ তাদের ‘মান’ সবার চেয়ে ওপরে। লোকমান্য তিলক নিজে ঠিক করে দেন এই মানের ক্রম। স্বাভাবিক কারণেই জিজামাতার পুজো করা ‘কসবা গণপতি’র স্থান এক নম্বরে। ইনি পুণার প্রধান বা ইষ্ট দেবতা। এরপর আছেন গ্রাম দেবতা ‘তাম্বে যোগেশ্বরী’। তাই এই যোগেশ্বরী মন্ডলের গণপতির স্থান দ্বিতীয়। এরপর ‘গুরুজী তালিম’ বা আখড়ার গণপতি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বজায় রাখার ব্যাপারে এই তালিমের বিরাট অবদান। পদমর্যাদায় চতুর্থ হলেও আকারে সবার বড় সারস বাগের গণপতি। আর পঞ্চমে আছেন তিলকের প্রতিষ্ঠিত ‘কেসরি ওয়াড়া’ বা ‘কেসরি’ ভবনের গণপতি। ১৮৮১ সালে লোকমান্য তিলক এই পত্রিকা প্রকাশ করেন তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে দেশবাসীকে স্বদেশমন্ত্রে উদবুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে।  

বিসর্জনের দিন সকাল থেকে সব পূজা মন্ডপ শুনসান। তখন অন্য জায়গায় অন্য এক কর্মযজ্ঞ চলছে। গণপতি বিসর্জনের শোভাযাত্রার জন্যে তখন তৈরী হচ্ছে রথ। সেও একেক মণ্ডলের একেকরকম রথ, একেকরকম আলোর সাজ। আর বেশ কিছুকাল আগে থেকেই সব তালিমের ছাত্রছাত্রীরা মহড়া দেয় শোভাযাত্রায় তাদের বিভিন্ন কসরৎ দেখানোর, ঢোলক বাজানোর জন্যে। পুণাবাসীর কাছে এ এক বিরাট সম্মানের ব্যাপার। সন্ধ্যে থেকে সারারাত চলে এই শোভাযাত্রা আর কসরৎ। রাস্তার দুধারে মানুষের ভীড় এই শোভাযাত্রা দেখার জন্যে। তারপর ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পরপর ক্রম অনুসারে ওই পাঁচ গণপতির নদীতে বিসর্জন হয়। এরপর অনুমতি পায় বাকি মন্ডল তাদের গণপতি বিসর্জন দেবার।

ছোটখাট সোসাইটির গণপতি বিসর্জনের অন্য ব্যবস্থা। তাদের অনন্ত চতুর্দশীর দিন সকাল থেকেই বিসর্জন হয় নির্দিষ্ট জায়গায়। আর বাড়ির গণপতি যে যার সাধ্য মত একদিন, তিনদিন, পাঁচদিন পরেও বিসর্জন দিয়ে দেন। এখন আবার বহু জায়গায় Eco-friendly মূর্তি। তারা বাড়িতেই জলের বালতিতে সেই গণপতি বিসর্জন দিয়ে সেই জল নিজেদের বাড়ির গাছের গোড়ায় দিয়ে দেন। আমাদেরও ছেলেরা একবার বাবার সঙ্গে আঁকার ক্লাস থেকে ফেরার পথে একটা প্রতিমা নিয়ে বাড়ি এল। তবে সেই প্রতিমা বিধি মেনে পুজো শুরু করা হয় নি। প্রতিদিন বাড়ির ঠাকুরকে পুজো করার সময় যেমন গণেশের পুজো হয় সেভাবেই পুজো করা হত, তাই সেই প্রতিমার বিসর্জনও হয় নি।

 বোস বাড়ির মহালয়ার নামগানের ধারা বড়মার পর মা আর মায়ের পর কাকিমা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু পুণায় এসেও মহালয়ার দিন ভজন-কীর্তন মা বন্ধ হতে দেন নি। তবে তখন আর নামগান শুধুমাত্র ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ ধ্বনিতে সীমাবদ্ধ নেই। ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ মন্ত্র মেনে তখন মহালয়ায় ঠাকুরের গান করা হত। তবে প্রথম বার ওই মন্দিরের রাধাকৃষ্ণের পুজারী মহারাজকে ধরে মা আর বাপী পুষ্পাদি নামে একজন ভক্ত মহিলার সন্ধান পান। তাঁর ‘কীর্তনের দল’ এসে মহালয়ার দিন ওই মন্দিরেই ‘হরে কৃষ্ণ’ নাম করে।

মন্দিরে নামগানের মধ্যেই দেখি কোথা থেকে সব শিবঠাকুরের বাহনেরা সেজে গুজে গায়ে, সিং এ আলপনা কেটে গলায় ঘণ্টা ঝুলিয়ে লাইন করে জটাবাবার সঙ্গীর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ল। আবার কিছুক্ষণ পরে ফিরেও এল। পরে শুনলুম ওইদিন ওখানে ‘বৈল পূজন’। ওদেশের এক নতুন রীতি জানা গেল। আরও জানা গেল ওখানে আমাদের মত শুধু মহালয়ার দিনই তর্পণ হয় না, পিতৃপক্ষের পুরো পনেরো দিন ধরেই তিথি অনুযায়ী হয় পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ। কারুর তিথি বাদ পড়ে গেলে বা বিশেষ কোনও কারণ থাকলে শেষে অমাবস্যায় তর্পণ করা হয়।

পরের বার আমাদের ফ্ল্যাটেই সোসাইটির সব মহিলারা এসে তাঁদের নিজের নিজের প্রদেশের প্রচলন অনুযায়ী কিছু কীর্তন গান করেন। তাতে ‘কিষণজী, গোপালা’র গান যেমন ছিল ‘মাতারাণী’র ভজনও ছিল। আর কুমার আন্টি আর তাঁর সাসুমা মিলে কিছু পাঞ্জাবী কীর্তনও শুনিয়ে দিলেন। এরপর আসেন ‘নারাণের বাবা’ – তিনি ইস্কনের একজন কর্মী প্রচারক। তাই তিনি এসে মায়ের মনমত ‘হরে কৃষ্ণ’ নাম শুনিয়ে যান। যদিও তারসঙ্গে বৌদি, বৌদির মা মাসিমা, গানের দিদি এঁরা এসে পরের দিকে বাংলা রবীন্দ্রসঙ্গীত বা অন্য কোনও ভক্তিগীতি গাইতেন। কিন্তু নিয়ম করে প্রতিবছর মহালয়ার অনুষ্ঠান ঠিকই হয়েছে। যদিও তখন গাইয়ের চেয়ে শ্রোতার সংখ্যাই অনেক বেশী।

গণপতি উৎসব আর দিওয়ালীর মধ্যে স্যান্ডুইচ হয়ে স্কুল কলেজে দুর্গা পুজোয় ছুটি তো দূরস্থ রীতিমত 1st Term আর Mid-semester exam চলত। আমি তবু পরের দিকে অষ্টমী বা নবমীর দিন সুবিধে মতো ছুটি নিয়ে নিতুম কিন্তু ছেলেদের অষ্টমী-নবমীতে প্রতি বছর অঙ্ক নয়তো সাইন্স নয়তো সোসাল স্টাডিস পরীক্ষা থাকত। কাজেই অষ্টমীর অঞ্জলি তো দূরের কথা পুজোর মধ্যে বসে বসে পরের দিনের পরীক্ষার পড়া তৈরী করতে হত। তবে ইস্কুল থেকে ফিরলেই চান করে নতুন জামা পরে দাদু-ঠাম্মার সঙ্গে তারা দুপুরে বিচক্ষণায় ভোগ খেতে যেত। আমি হয়তো তখনও কলেজ থেকে ফিরি নি।

সন্ধ্যেবেলা তাড়াতাড়ি করে পরের দিনের পরীক্ষার পড়া তৈরী করেই পুজোপ্যাণ্ডেলে ফাংসন দেখতে যাবার তাড়া। এখানেও সেই পঞ্চমী থেকেই ব্যস্ততা শুরু। সকালবেলা যেমন বিচক্ষণায় অঞ্জলি দেওয়া, ভোগ খাওয়া, সন্ধ্যেগুলো মোটামুটি আনন্দমের পুজোয়। পঞ্চমীর দিন আনন্দমে আনন্দমেলায় যাবার তাড়া। একটু দেরী হয়ে গেলেই স-ব খাবার শেষ। এদিকে স্কুল-কলেজে যেমন পরীক্ষার গুঁতো কর্তামশাইএর অপিসে তার চেয়েও বড় Audit এর গুঁতো। অপিসের Annual return সামলে সে যতক্ষণে এসে পৌঁছতো তার ঢের আগে মা-বাপী আর ছেলেদের নিয়ে আমি পৌঁছে যেতুম মাঠে। পরের দিকে কুপন কাউন্টারেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এদিকে খাবারের স্টল ফাঁকা। বাড়ি থেকে টিফিন বক্স নিয়ে গিয়ে খাবার কিনে রাখা হত। ছোটবাবুর প্রধান আকর্ষণ ছিল চিকেন ললিপপ। ওই কদিন রোজ তার চিকেন ললিপপ চাইই চাই। এদিকে ওই রঙ দেওয়া খাবার খেলেই তখন তার শরীর খারাপ হবেই।

অনেক দিন ফাংসন শেষ হবার পরেও আমরা চুপচাপ ফাঁকা মাঠে ঠাকুরের সামনে বসে থাকতুম। ছেলেরা তখন পুজো প্যাণ্ডেলে সদ্য পাতানো বন্ধুদের সঙ্গে স্টেজের ওপর উঠে নয়তো সারা মাঠে খেলা করতে প্রচন্ড ব্যাস্ত। পরের দিন যে ভোরবেলা উঠে স্কুলে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে সে কথা না তাদের মনে থাকে না আমাদের। নবমীর রাতে একটু নিশ্চিন্ত। কিন্তু সেদিন পুজো শেষের দুঃখে মনটা ভার।

পুণার পুজোর ফাংসনে কলকাতা থেকে কোন না কোন আর্টিস্ট আসতেন – রাঘব চ্যাটার্জী, জয়তি চক্রবর্তী, রূপঙ্কর, শ্রীকান্ত আচার্য। ওনাদের দিন ভাগ করা থাকত পর পর। আজ আনন্দম, কাল কর্পোরেসন, পরশু খাড়কি তার পরেরদিন কোরেগাঁও পার্ক। অনেক সময় মুম্বাইতে ফাংসন করে তারপর আসতেন পুণা বা পুণা থেকে মুম্বাই যেতেন। তাছাড়া নিজেদেরও নাচ-গান, নাটক থাকতো।

বৌদিরা প্রতি বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনও না কোনও নৃত্যনাট্য করত মধুমিতাদির পরিচালনায়। বৌদি থাকত গানে, ফুলনদেবী নাচে আর মাঠের পেছনে ঘাড়ে করে handycam নিয়ে ছবি আর ভিডিওর দায়িত্বে ডাকুদাদা। নবমীর প্রোগ্রাম শেষ হলে দাদারা আর আমরা দুটো গাড়ি নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোতুম। মোটামুটি কয়েকটা ঠাকুর দেখা হতই। এমন কি আগে নিজেরা দেখলেও আবার করে একসঙ্গে যাওয়া হত। সেই মজাটাই আলাদা। ওই কর্পোরেসন, AFMC, খাড়কি, কোরেগাঁও পার্ক আর পরে পরে যোগ হল হড়পসার। একেকসময় দূর থেকে আলো দেখে হয়তো গিয়ে দেখা যেত সেখানে নবরাত্রি পালন হচ্ছে – সেখানে মা সিংহবাহিনী নন, মা শেরাওয়ালী।

পুজো প্যাণ্ডেলে যাওয়ার ছেলেদের প্রধান আকর্ষণ যেমন চিকেন ললিপপ, চিকেন রোল, মোগলাই পরোটা, আমার জন্যে ঠিক সেই রকম খাড়কি কালীবাড়িতে কলকাতার পাবলিসার্স-বুক সেলার্স গিল্ডের বাংলা বইএর স্টল। পুজো মানেই একগাদা বাংলা বই কেনা। কলকাতা বইমেলায় না যেতে পারার দুঃখ ওই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। আবার কোরেগাঁও পার্কের স্টল থেকে কেনা হত সে বছরের পূজাবার্ষিকী আর বাংলা গানের সিডি। কিছু পোড়া মাটি আর জুটের গয়নাও কিনেছিলুম একবার কর্পোরেসনের পুজো দেখতে গিয়ে।

প্রথম যেবার ছোটবাবু বিচক্ষণায় ষষ্ঠীর দিনের উদ্‌বোধনী অনুষ্ঠানে গানের দলে ভিড়লেন তখনও উনি পড়তে শেখেন নি। কোরাসের দলে ওরা সব দুধভাত। কিন্তু বড়বাবু খুব সিরিয়াস মুখ করে গানের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করলেন। আমি সেবার স্টেজে এই সব আণ্ডাগাণ্ডা সামলানোর দায়িত্বে। তবে পরের সরস্বতী পুজোয় ছোটবাবু একটা সোলো গান করেছিলেন – ‘লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে’। আর সেবার দুর্গাপুজোয় আনন্দমে নাটকে পেল স্বামী বিবেকানন্দর ছোটবেলার গল্পে ‘বিলের বন্ধু’র পার্ট। পরের বছর ‘ভাড়াটে চাই’ নাটকে করল ভাইপোর পার্ট। এক্কেবারে মায়ের যোগ্য ছেলে! এক লাইন পড়া মুখস্থ হয় না, এদিকে নাটকের ডায়লগ সব ঝরঝরে মুখস্থ! ছেলের বাবাও মহা উৎসাহে ক্যামেরা, handycam সব নিয়ে রেডি। ‘ভাড়াটে চাই’ নাটকে আবার বাবা ছবি এঁকেছিল -নাটকের সেট।

আনন্দমে দুপুরবেলা যে সব প্রতিযোগিতা হত তার মধ্যে ছেলেরা বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় নাম দিত। বড়বাবু তো  প্রায় পুরো সময় ধরে পেন্সিল দিয়ে এঁকেই যাচ্ছে। সে উদ্যোক্তাদেরই টেনসন। সময় শেষ হতে চলল এবার তুমি রঙ করা শুরু করো। সে কে শোনে কার কথা! কিন্তু শেষ দশ মিনিটের মধ্যে রঙ করে আঁকা কমপ্লিট। সেও তার বাবার ছেলে। আঁকায় একটা প্রাইজ নিয়ে বাড়ি আসতো। সেবার প্রাইজ দিল Crossword এর কুপন। পুজো প্যাণ্ডেল থেকে বেরিয়ে বই কিনে তবে বাড়ি ফেরা। ছোটবাবুর তো সবই বড় বড় ব্যাপার! বাচ্ছাদের মত রঙ করতে তাঁর ভাল লাগে না। তিনি পেন্সিল সেড করেন! স্বাভাবিক ভাবেই ওই রঙচঙে ছবির ভীড়ে তাঁর পেন্সিল সেড মাঠে মারা যেত সে আঁকা যতই ভাল হোক!

ছেলেদের নাটক, গান, পরের বছর বিচক্ষণায় আমার গান – আবার সেই বিধান নিবাসের ছোটবেলার দিনগুলোর ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সেই রোজ তাড়াহুড়ো করে কলেজ থেকে ফিরেই রিহার্সালে যাওয়া, একসঙ্গে হৈ হৈ করে সময় কাটানো, রোজকার গতানুগতিক জীবনে একটু ব্যাতিক্রমের স্বাদ।

মারাঠীরাও প্রধানতঃ চৈত্র গৌরীর পুজো করে, মানে আমাদের বাসন্তী পুজো। তবে এই নবরাত্রিতেও বাড়িতে ঘটস্থাপন হয়। কিন্তু আমাদের মত অষ্টমীর উপোস নেই। মারাঠী উপবাস মানে রকম রকম ভাল ভাল খাবার – সাবুদানা খিচড়ি, সাবুদানা বড়া, আলুর বা রোতাড় (মানে রাঙাআলু)র নোনতা খাবার, থালপিঠ ( চিল্লা), ভোপড়া (কুমড়ো) দই দিয়ে smoothy। তবে উত্তর ভারতীয়রা নবরাত্রির উপোস করে। আর রাজস্থানী, গুজরাটি এরা মাতে ডাণ্ডিয়া নিয়ে। একবার আমাদের সোসাইটির সব মহিলারা বললেন নবরাত্রিতে ডাণ্ডিয়া করা হোক। তবে সবাই জানত আমরা বাঙালিরা ষষ্ঠী থেকে দশমী নিজেদের দুর্গা পুজো ছেড়ে আর কিচ্ছু করতে রাজি নই।

পুণায় এসে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বললুম সেকি তোমরা বিশ্বকর্মা পুজো করো না! যন্ত্রপাতি পুজো করবে না! বলল সে তো নবমীর দিন হবে আয়ূধ পূজন্‌। সে আবার কি? বলল ‘আরে সেই যে সেই বিরাটের যুদ্ধে অর্জুন আয়ূধ পুজো করে তারপর একাই পুরো কৌরব সেনাকে হারিয়েছিল জানো না!’ ‘হ্যাঁ সে তো জানি।‘ সেই, নবমীর দিন হল সেই তিথি। ওই দিন হবে সব যন্ত্রপাতি, কম্প্যুটারের পুজো – আধুনিক যুগের ‘আয়ূধ’। আর ওদের নাকি তুক আছে। নবমীর দিন সকাল থেকে সবাই খুব ভয়ে ভয়ে চুপচাপ থাকে। বলে ‘খন্ড নবমী’ কার ওপর দেবী চন্ডীর ভর হবে – তুলকালাম ঝগড়া হবে তার সঙ্গে। সকাল থেকে সব ওৎ পেতে থাকে। আর মাঝে মাঝেই খবর আসতে থাকে অমুক খেপেছে আজ। খুব চেঁচাচ্ছে। সেই শুনে বাকিদের কি শান্তি – এবারের মত ফাঁড়া কাটল!

তবে মারাঠী মেয়েদের সঙ্গে আমাদের কার্তিক ঠাকুরের মোট্টে সদ্ভাব নেই। সেই যে সেই গণেশ ঠাকুর পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার সময় চালাকি করে মা-বাবার চারদিকে টুক করে (তাও একবার নয় তিন তিনবার) ঘুরে কার্তিক ঠাকুরকে গো হারান হারিয়ে দিয়ে কার্তিক ঠাকুরের বিয়ে করাটাই পণ্ড করে দিলেন না! আর এই মারাঠী মেয়েগুলো সেই গণেশকে নিয়েই মাতামাতি করে, কার্তিকের কি সহ্য হয়! কার্তিকঠাকুরও সেই রাগে মারাঠী মেয়েদের মুখদর্শন করেন না। আমাদের দুর্গা পুজো দেখতে এসে ওদের সব কি বিস্ময়! সেকি, তোমরা কার্তিক ঠাকুরের মুখ দেখো? ও মা, কেন দেখব না! কার্তিক ঠাকুর বলে কি না আমাদের হিরো! সুন্দর দেখতে ছেলে হলেই আমরা বলি আহা যেন ‘লব কাত্তিক’! কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে পুত্র কামনায় কতজনের বাড়িতে জোড়া কার্তিক পুজো হয়! ওরা বললে, না বাপু আমাদের তো পুণায় মাত্র একটাই কার্তিকেয় মন্দির আছে, তাও সে সেই পর্বতীর ওপরে এক পাশে। সেদিকে মেয়েদের এমনি সময় যাওয়া বারণ। কেবল দিওয়ালীর পরের পুর্ণিমায় ‘দেবদিওয়ালির’ দিন সারা রাত ধরে আমাদের মেয়েরা পুরো পর্বতী প্রদীপ দিয়ে সাজায় আর সেই দিন শুধু মেয়েরা কার্তিকেয়র মন্দিরে গিয়ে জন্মদিনে কার্তিকের পুজো করতে পারে।

দশমীর দিন হয় ওদের সরস্বতী পুজো। রঙ্গোলি দিয়ে সব সরস্বতী যন্ত্র আঁকে। সেদিন সবাই বাড়ির দরজায় ঝেণ্ডু (গাঁদাফুল) আর দেবদারু পাতা দিয়ে তোরণ লাগায়। আর সবাই পরস্পরকে সোনা দিয়ে সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করে। আজকের এই মাগ্যি গন্ডার দিনে সোনা আর কি করে দেবে! তাই কাঞ্চন পাতা দিয়ে ‘কাঞ্চনদানের’ পুণ্য অর্জন করে।

পুণায় বিচক্ষণা দুর্গার সঙ্গে আমাদের যেন একটা অদৃশ্য বন্ধন আছে। আমাদের অনেক ভাল-মন্দের সাক্ষী ওই দুর্গামা। পুণার প্রথম সকালে ঘুম ভাঙ্গা যেমন ওই পুজোর ঢাকের আওয়াজে, তেমনি প্রথম ফাংসন করা, অষ্টমীতে অঞ্জলি, ভোগ খাওয়া, সন্ধিপুজোয় প্রদীপ জ্বালানো, দশমীতে মা কে সিঁদুরদান আবার ছেলে পুজোর সময় দেশের বাইরে গেছে বলে মায়ের অভিমানে চোখের জল ফেলা, কলকাতা থেকে সপ্তমীতে যখন খবর এল ঠাম্মা চলে গেছেন, তখন আমার মন খারাপ, কলকাতায় না যেতে পারার দুঃখ, অনেক নীরব চোখের জলের সাক্ষীও এই মা দুর্গা। আবার এই বিচক্ষণা দুর্গার সঙ্গেই ছেলেদের নিয়ে বিসর্জনে যাওয়া, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে নদীর ঘাটে ওদের ঢাক বাজানো, ঠাকুর ভাসান দেখার অভিজ্ঞতা আমাদেরও আবার সেই পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া।

কোজাগরী পূর্ণিমার দিন মারাঠীরা খোলা আকাশের নিচে দুধ ফুটিয়ে তারপর চাঁদের দিকে তাকিয়ে সেই দুধ খায়। পূর্ণিমার চাঁদের কিরণের সঙ্গে ওদের জীবনেও সুখ-সমৃদ্ধি পূর্ণ হয়ে ওঠে। পুণায় লক্ষ্মীপুজো মানেই অমৃতাদের বাড়ি যাওয়া। ওদের বাড়ির পুজো মানে যেন আমাদের নিজেদেরই বাড়ির পুজো। ওদের বাড়ি ছেলেদেরও অবাধ স্বাধীনতা। কলকাতা থেকে আত্মীয়স্বজন এলে নির্দ্বিধায় আমরা তাদেরও নিয়ে চলে যেতুম ওদের বাড়ির পুজোয়।

আর কালীপুজো – সেও আরেকরকম মজা। দিওয়ালী মহারাষ্ট্রে খুব বড় উৎসব। মূলতঃ পাঁচদিন ধরে পুজো – ধনলক্ষ্মী, ধান্যলক্ষ্মী, মহালক্ষ্মীর কাছে সবার জন্যে কায়িক, মানসিক এবং আত্মিক মঙ্গল কামনা। শুরু সেই ত্রয়োদশীতে – ধনতেরাস। না সোনা কেনাই সেদিনের মূল উদ্দেশ্য নয়, মূলতঃ ওই দিন ধন্বন্তরির পুজো – সকলের সুস্বাস্থ্যের কামনায়, কারণ স্বাস্থ্যই সম্পদ। নরকচতুর্দশীর দিন নরকাসুর বধ অর্থাৎ জীবাত্মাকে অজ্ঞানরূপী নরকের হাত থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা। অমাবস্যায় মহালক্ষ্মী পুজো। পরের দিন বলিপ্রতিপদ – ওই দিন দৈত্যরাজ মহাবলির একদিনের জন্যে মর্ত্যে পুনরাগমন তিথি। ভগবানের প্রতি ভক্তের সম্পূর্ণ শরণাগতির চূড়ান্ত নিদর্শন। আর সব শেষে ‘ভাউ বীজ’ অর্থাৎ আমাদের ভাইফোঁটা।

স্কুল-কলেজ-অপিস সব ছুটি। দাদারা আর আমরা মিলে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যেতুম। আমাদের বিজয়ার পর যেমন আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে মিলন উৎসব, মারাঠীদের দিওয়ালীতে সেই রকম রেওয়াজ। বাড়ি বাড়ি রকমারি নোনতা-মিষ্টি তৈরী করে পরস্পরের সঙ্গে আদানপ্রদান। মারাঠী বাচ্ছারা বাড়িতে সব মাটি দিয়ে ‘কিল্লা’ বানায়। তার গায়ে গায়ে ছোট ছোট পুতুল দিয়ে সিংহাসনে শিবাজী মহারাজ, চারপাশে তার সৈন্য সামন্ত, গাঁওয়ের লোকজন তাদের নানা পসরা নিয়ে, সঙ্গে গরু ঘোড়া – ওরা সবাই ফিরে যেত তাদের সেই বীরত্বের অতীতে।কালীপুজোয় বাজী পোড়ানোর পর রাতে আনন্দমের পুজোয়ও যাওয়া হত সবাই মিলে।

পরদিন হত আমাদের বাড়িতে ওই মা অন্নপূর্ণার অন্নকূট। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পুজোয় অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তবু দেবতা জানেন ভক্তের মনের কথা!

Posted in Uncategorized

ড্যামকুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে -৩

বড়িষা পর্বঃ

বাংলাদেশে প্রচলিত প্রবাদ দুর্গাপুজোর সময় মা দুর্গা ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেই কৈলাস থেকে পাঁচদিনের জন্যে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন। আর বাংলার ঘরের মেয়েরাও সেই উপলক্ষ্যে তাদের বাপের বাড়ি যাওয়ার ছুটি পায়। বিধান নিবাসের পুজোয় এত্তো মজা যে এখানে দিদিরা, পিসিরা সবাই পুজোর সময় সপরিবারে এসে পুজোয় সামিল হতেন। কিন্তু পুজোর ম্যাজিক কাটিয়ে বৌদিরা কিংবা মা-কাকিমারা কেউই বিশেষ বাপের বাড়ি যেতেন না। নিজেদের ‘বাড়ির পুজো’ ছেড়ে কি কেউ কোথাও যায়! বিধান নিবাস তো সবাই মিলেই বিরাট এক পরিবার।

কিন্তু বিয়ের পর দেখলুম আমি বাপের বাড়ি চলে গেলে শ্বশুরবাড়িতে সবার ফাঁকা মনে হয়। আর সবাই আমায় অভয় দিলেন দেখবে এখানে তপোবনের পুজো একদম নিজেদের বাড়ির পুজোর মতই। ওদিকে বিধান নিবাসে কাকু-কাকিমারা দেখা হলেই বলেন, ‘কি রে পুজোর কদিন এখানেই থাকছিস তো?’ এই দোটানায় ভাগাভাগি করে একবার উল্টোডাঙা একবার বড়িষা করেই পুজো কেটে যায়।

কোন কিছুই শুধুই ভাল বা শুধুই মন্দ হয় না। প্রথম বছর ঠিক পুজোর সময় মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু সেখান থেকেই রোজ বাপীকে বলে দিতেন বাড়িতে নতুন বৌ এসেছে, কি কি বাজার হবে, কি কি রান্না হবে। সেই মত সপ্তমীর দিন বাপীও দু-তিন রকম মাছ বাজার নিয়ে এসেছেন। এদিকে রান্না করার পদ্মদি ডুব! বাপীর তো মাথায় হাত। আমি তো রান্নায় দ্রৌপদী! শেষে মুশকিল আসান আমার হাজারি ঠাকুর। অবশ্য প্রথমেই বাপীর ওপর বেশ একচোট চেঁচামিচি করে একটু এনার্জি করে নিল। তারপর নিজেই সমস্ত মাছ ধুয়ে বেছে সবজিপাতি কেটে কুটে তরিবৎ করে সব রান্না করে ফেলল। পদ্মদিকে থোড়াই কেয়ার!

বোসবাড়িতে দেখতে গেলে পুজো শুরু হত সেই মহালয়া থেকে। সেদিন মা ঘরে ঠাকুরের ‘নামগান’ করাতেন। তার দুচারদিন আগে থেকে কানাইকে দিয়ে ঘরদোর ঝাড়াঝাড়ি। টেবিল, সোফা নাড়ানাড়ি। ঘর খালি করে জায়গা করতে হবে। কদিন আগে থেকে মা হারমোনিয়াম বের করে নানান সুরে নানান রাগে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ গাইতেন। আমার তো চিরকালের ধারণা ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ একটাই সুর, থুড়ি বেসুর! তার আবার যে এত রাগরাগিনী এত সুর জানা ছিল না। বাংলা হিন্দি বহু প্রচলিত গানের সুরেও এই নামগান গাওয়া হত।

মা বাপী রাত থাকতে উঠে কোনরকমে এক কাপ চা খেয়ে মহালয়া চালিয়ে দিয়ে শুরু করে দিতেন ঠাকুরের আসন সাজানো। যাতে বৃষ্টি না হয় তার জন্যে মহাবীরের জন্য স্পেশাল কলার ছড়া আর লাড্ডু দেওয়া হত। একটু বেলা হতেই তর্পণের কাজ সেরে ‘মাধবীদি’ এসে নাম শুরু করে দিয়ে যেতেন। নাম একবার শুরু হলে মাঝে বন্ধ দেওয়া যাবে না। একের পর এক মায়ের দলের মহিলারা এসে নাম ধরতেন। কতলোক যে আসতেন এই নামে। কারুর কারুর আবার নাম করতে করতে ‘ভর’ হত। সে এমন মাথা দোলতেন যে প্রথম প্রথম দেখে অবাক হয়ে যেতুম বই কি! মা আবার একবার বললেন অহোরাত্র নাম দেব। মানে সুর্যোদয়ের ২৪ মিনিট আগে থেকে সুর্যাস্তের ২৪ মিনিট পর অবধি।

নামগানের সঙ্গে থাকত মায়ের এলাহি খাওয়ানোর ব্যবস্থা। একবার ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে, একবার নাতি হাওয়ার জন্যে। সারাদিন একদিকে নাম হয়ে যাচ্ছে আর একদিকে ময়দা মাখা হচ্ছে তো হচ্ছেই, লুচি, আলুরদম, ছোলার ডাল, মিষ্টি। যাওয়ার সময় আবার সবার হাতে হাতে জলখাবারের প্যাকেট। বাপী, কাকিমা, কাকু তো বটেই বড় জেঠু যতদিন সুস্থ ছিলেন ব্যবস্থাপনার কাজে, লোকজন সামলানোর দায়িত্বে সমানে সারাদিন ব্যস্ত থেকেছেন। শুনেছি বাড়িতে এই নাম দেওয়া মূলতঃ বড়মার উদ্যোগেই শুরু।

শ্বশুরবাড়ি এসে আবার সেই টালার দিনগুলোতেই ফিরে গেলুম যেন। বাড়ি থেকে মা-কাকিমা, রিয়া-রিম্পা সবাই মিলে গিয়ে সকালে তপোবনে অঞ্জলি দেওয়া। একেকবছর রেশমীরাও আসত, ছোড়দারা থাকতেন। সবাই মিলে বাড়িতেই হৈ-হুল্লোড়, গল্প-আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া আর গান-বাজনা। ঘুরে ঘুরে পাড়ার ঠাকুর দেখা – প্রথমেই তো ওই কলকাতার জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো। প্রধান হল ‘আটচালা’। ওই আটচালাতে বসেই সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তিপত্র সই হয়ে সূতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতার মালিকানা হস্তান্তর হয় আর সেই সঙ্গে ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের বীজবপণ হয়। যাই হোক, কাল তার নিজের গতিতেই বয়ে চলে। ১৬১০ সালে এই আটচালায় প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয় আর আজ অবধি সেই একই কাঠামোয় প্রতিমা তৈরী করে পুজো করা হচ্ছে। সেদিনের সেই আটচালা আজ ভেঙ্গে গেলেও সেই পুরোনো থামগুলো এখনও সেই একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে সাক্ষী দিতে। শুনলুম নবমীর দিন ওখানে মোষ বলি হয়।

আটচালা ছাড়াও কাছাকাছির মধ্যেই আরও চার-পাঁচটা পুজো সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের – বড়বাড়ি, মেজোবাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকি বাড়ি। এছাড়া আরও কিছু পুরোনো সাবেকী পুজোও আছে। বাপীর সঙ্গে তো আমার প্রথম থেকেই ঠাট্টা-তামাসা, পেছনে লাগা চলে। ঠাকুর দেখে বাড়ি এসেই আমি পুজো মণ্ডপের নকলে ঘোষণা করতুম – ‘আমাদের এই বড়িষা গ্রামের শারদীয়া শ্রী শ্রী দুর্গা পুজায় আপনাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাই’। বাপীও রুখে উঠতেন – ‘গ্রাম! জানো এটা কলকাতা সাতলক্ষ আট!’ মা অবশ্য আমার দলে থাকতেন। বলতেন ‘কলকাতা না আরও কিছু! গ্রাম, গ্রাম!’

বড়িষার আরেক ‘high-voltage’ পুজো হল সৌরভ গাঙ্গুলিদের প্লেয়ার্স কর্ণারের পুজো। গাঙ্গুলি বাড়িতে মা চণ্ডীর ঘট স্থাপন করা বলে বাড়ির মধ্যে দুর্গা পুজো করা যায় না। তাই বাড়ির গেটের ঠিক বাইরের মাঠে এই দুর্গা পুজো। পুজো মণ্ডপে গেলেই সৌরভের ভাইবোন, কাকা-কাকিমাদের দেখা মিলত। সৌরভের কাকারা আমাদের ন’কাকা, ছোটকাকার সঙ্গে একই ক্লাবে ফুটবল খেলতেন। আর এখনও নিত্যদিন বাজারে দেখা হয়। আমাদের কাকারা বিশেষতঃ নকাকা ওনাদের আমলের ক্লাবের স্টার প্লেয়ার, সবাই চিনতেন। তবে পুজোপ্যাণ্ডেলে সৌরভকে দেখার সৌভাগ্য আমার কোনদিন হয় নি। লাল বাড়ির বিরাট গেট সব সময়ই বন্ধ। যদিও সেই গেটের ফাঁক দিয়ে ‘দাদা’র গুণগ্রাহীরা অনেক উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করতেন। পাশেই ডোনাদের হলুদ বাড়ি। ডোনা অবশ্য পরোক্ষভাবে আমার গোখেল কলেজের অঙ্ক অনার্সেরই ছাত্রী। ডোনার পার্ট টুর টেস্টের ইনভিজিলেসন করার অভিজ্ঞতা আমার আছে।

বড়িষা থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চৌরাস্তা, ব্লাইণ্ড স্কুল, ম্যান্টন পার হয়ে বেহালা ট্রাম ডিপো। ব্রাহ্ম সমাজ রোডে ঢুকে একটু এগিয়ে গেলেই কমরেড সোমনাথ চ্যাটার্জীদের বাড়ির সাবেকী পুজো। আমাদের যখন বিয়ে হল সেই বছর থেকেই শুরু হল তপোবনের ‘থিম পুজো’। সে বছর বহু জায়গাতেই গ্রাম বাংলা থিম। হবি ত হ’ তপোবন ক্লাবের পুজো সেবার Asian Paints শারদ সম্মান পেল। ব্যস্‌, হয়ে গেল পাড়ার পুজোয় গিয়ে একটু বসা, আরতি দেখা! সারা কলকাতা থেকে তখন লোকের ঢল – তপোবনের ঠাকুর দেখতে আসছে। আর রাস্তা জুড়ে অন্ধকার অন্ধকার চারটি হ্যারিকেন ঝুলিয়ে রেখেছে। গলির মুখ থেকে বাড়ি যেতে গেলেও বলে ‘NO ENTRY’ – ঘুরে যান! এমনিতেই নবমীর রাত মন খারাপ। তখন সেই বুবাকাকাদের বাড়ির সামনের পুজো প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে আরতি দেখা হল। আবার তো এক বছরের মত মায়ের কৈলাসে পাড়ি!

তারপর এল সুরঞ্জনদের বাড়ির পুজো। এর আগে তো ঘরোয়া পুজো, বাড়ির পুজো বলতে ওই বিধান নিবাসের পুজোই ছিল। তবে আমাদের M.Sc.র প্রফেসর মঞ্জুষাদির সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে দুর্গা পুজো হচ্ছে শুনে বিধান নিবাস থেকে পুরো দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছিলুম ‘ফ্ল্যাটের দুর্গাপুজো’ দেখতে। কিন্তু রঞ্জুদের বাড়ির পুজো তো প্রায় নিজেদেরই পুজো! বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে দুর্গাপুজোর মত এত বড় পুজোর সব আয়োজন, উপাচার, ভোগ, রান্না-খাওয়া – সে এক এলাহি ব্যাপার। যত দেখছি তত যেন বিস্ময়ে আমার বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে! ওদের বাড়ি সবার যেন অবারিত দ্বার। সক্কলের কি আন্তরিক, অমায়িক ব্যবহার। আর কাকু তো একাই একশো। যে যাচ্ছে তাকেই সামনে বসিয়ে এক্কেবারে কবজি ডুবিয়ে খাইয়ে তবে ছাড়ছেন।

ভীড় আমাদের মোট্টে পোষায় না। অথচ পুজোর কদিন আনন্দ তো ফাঁকি পড়তে পারে না। সকালবেলা হয়তো গাড়ি নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়তুম লং ড্রাইভে। অবশ্যই ভীড়ের উলটোপথে – ডায়মণ্ডহারবারে। হয়তো সঙ্গে ছোটমামু। ভাগ্নের গাড়ি করে কলকাতার ঠাকুর দেখতে যাবেন বলে এসেছেন। ফাঁকা রাস্তায় ডায়মণ্ডহারবার গিয়ে ঠাকুর দেখতে না পেয়ে রেগে আগুন!

তবে ঠাকুর দেখতেও যেতুম। রাত্তিরবেলা। রিয়া, রিম্পা, ছোটমামু আর আমরা দুজন। ভবানীপুর আর খিদিরপুরের ঠাকুর। আর ভবানীপুর যাওয়ার পথে নিউ আলিপুর চেতলার কিছু ঠাকুর। সেই দেখলুম ভবানীপুর ২৩ পল্লীর বিরাট অষ্টধাতুর মা দুর্গা।

ছোটমামু সঙ্গে থাকা মানে পুরো ভীড় ঠেলে রাস্তা করে এক্কেবারে আগলে আগলে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। খিদিরপুরের কত পুরোনো সব পুজো – কবিতীর্থ, ২৫ পল্লী, ৭৪ পল্লী। তার আশে পাশে ছোট বড় আরও কিছু ঠাকুর। ছোটমামু বাদ দিতেন না একটাও। সেই প্রথম দেখা দুর্দান্ত সব প্যাণ্ডেল। পোড়ো বাড়ি, ঠাকুর দালান, ভাঙ্গা দেওয়াল, দরজা, শ্যাওলা ধরা পাঁচিল – আসল নকল বোঝার উপায় নেই! সিনেমার সেট যে কত নিখুঁত হয় এ যেন তারই একটা ছোটখাট নমুনা।

বিয়ের পর থেকে নবমীর দিন দুপুরবেলা কোনও বড় হোটেলে – যেমন তাজ বেঙ্গল, Main Land China, খেতে যাওয়া এখন আমাদের একটা নিয়মের মত হয়ে গেছে। নাঃ, বিধান নিবাসে নবমীর মাংস-ভাত লাজুক জামাইএর কোনওদিন খাওয়া হয় নি। এখনও মোটামুটি পুজোয় একদিন বাইরে খাওয়া হয়ই।

সেবার হঠাৎ সিটি সেন্টারে ব্রিটানিয়ার লটারিতে পুজো পরিক্রমার সুযোগ এসে গেল। লটারিতে কখনই কোনও কিছু আমি পাই না। কাজেই কিছুই পাবো না ভেবেই কার্ড ভরেছিলুম। তাছাড়া সংসারে তখন আরেক নতুন সদস্যর আসার অপেক্ষা। কাজেই দু বছরের এক ছেলেকে ছেড়ে সারাদিনের মত পুজো পরিক্রমায় যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বাড়িতে বড়রা কেউ মানবেনই না!

কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল সবাই রাজী! সল্ট লেকে কার্ড ভরা হয়েছে তাই উল্টোডাঙ্গা থেকে আমাদের বাসে উঠতে হবে। আর আমাদের ভাগে সাউথ ক্যালকাটার ঠাকুর দেখা। ছোট্ট নীলকে তার দিয়া-দাদাইএর জিম্মায় রেখে সকাল সকাল আমরা দুজনে উল্টোডাঙ্গার মোড়ে গিয়ে হাজির। আরও লোকজনও সব জড়ো হয়েছেন। কিন্তু ঘণ্টা পেরিয়ে যায় বাসের দেখা নেই! যত সব জালিয়াতি-জোচ্চুরি! বহু উৎকণ্ঠার পর অবশেষে বাস এল। শুরু হল আক্ষরিক অর্থে আমার দক্ষিণ কলকাতার ঠাকুর দেখা।

একডালিয়া, ম্যাডাক স্কোয়ার, দেশপ্রিয় পার্ক, মুদিয়ালী, যোধপুর পার্ক – আরও কত ঠাকুর যে সারাদিন ধরে দেখা হল! বাসে করে ঘোরা, বেড়ানো, খাওয়া তারপর সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে নামার সময় সবার হাতে একটা করে ব্রিটানিয়ার assorted cookies এর বড় ডাব্বা। স্মরণীয় হয়ে রইল আমাদের সেই বছরের দুর্গা ঠাকুর দেখা।

দশমীর দিন সবারই মন খারাপ। পুজো শেষ, ছুটি শেষ, মজা শেষ, রোজকার গতানুগতিক জীবন থেকে মুক্তি শেষ। তাই শেষ পর্যন্ত যতটুকু আনন্দ নিংড়ে নেওয়া যায় তার জন্যে পারলেই গাড়ি নিয়ে বাবুঘাটে যেতুম বিসর্জন দেখতে। সেই হাইকোর্টের পাশে গাড়ি রেখে ছোট্‌ ছোট্‌ গঙ্গার ঘাটের দিকে! সেবার দশমীর দিন বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে মা বাপী এমন কি ছোট্ট নীল সহ আমরা গেলুম বাবুঘাটে ঠাকুর বিসর্জন দেখতে। সেখানে তখন সামনে দিয়ে হুস্‌ করে চলে গেল এক্কেবারে ফাঁকা চক্ররেল। মনে হচ্ছিল একবার চেপে পড়লেই হয়। টুক করে একচক্কর ঘুরে আসা যায়! আসলে ভীড়ভাড় পছন্দ না হলেও যে কোনও রকম হুজুগে আমি এক পায়ে খাড়া।

সেবারের দুর্গা পুজোয় যেমন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা চুটিয়ে আনন্দ করেছি, মনে হয় কলকাতায় আরও কিছু আনন্দ, কিছু অভিজ্ঞতা তখনও আমাদের বাকি থেকে গিয়েছিল। কালীপুজোয় রঙ্গোলি আর মোমবাতি দিয়ে সারা বাড়ি সাজানো বোসবাড়ির আরেক রেওয়াজের মধ্যে পড়ত। ব্যাঙ্গালোর থেকে রেশমী প্রতি বছর কালীপুজোর জন্যে বড় ‘দিয়া’ পাঠাত, সঙ্গে ভাইঝিদের জন্যে জোর হুকুম যেন খুব ভাল করে আলপনা, রঙ্গোলি দেওয়া হয়। বাড়ির কোনও অংশ যেন বাতি দিতে বাদ না পড়ে। আর তারপর সব ছবি তুলে পিসিকে পাঠাতে হবে। কালীপুজোর দিন বাড়িতে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো। অলক্ষ্মী বিদায়। একবার আমি বানালুম চালের গুঁড়ো আর রঙ দিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণ-কুবের। ছোট থেকে মামার বাড়ির পুজোয় শুধু দাদিকে আর মাইমাকেই ঠাকুর বানাতে দেখেছি, আমাদের তো হাত দেবার অনুমতিই ছিল না। কি যে আনন্দ হয়েছিল সেবার! কালীপুজোর দিন আমরা, কাকু-কাকিমা, বড়দারা, ছোড়দারা, দিদিরা সবাই মিলে বোসবাড়ি এক্কেবারে জমজমাট। আর বোসবাড়িতে জমায়েৎ মানেই তো গান-বাজনা। আর সবাই মিলে একসঙ্গে বাজী পোড়ানো।

ছোট্ট নীলকে নিয়ে দিওয়ালীতে বেনারস গিয়ে বাবা বিশ্বনাথ – মা অন্নপূর্ণার অন্নকূট উৎসব দেখে এসে কর্তামশাইএর ইচ্ছে হল আমরাও বাড়িতে অন্নপূর্ণা পুজো করব। পুজোপাঠ এ মায়ের তো কোনওদিনই কোন আপত্তি নেই। আর বাপীর তো সব ব্যাপারেই সমান আগ্রহ। সেই সেবার প্রথম আমাদের বাড়ি অন্নপূর্ণা পুজো। থার্মোকল দিয়ে মন্দির বানিয়ে আলপনা দিয়ে সেই মন্দিরের গায়ে লাড্ডু আর সোনপাপড়ি দিয়ে দেওয়াল বানিয়ে নানা রঙের রকমারী মিষ্টি-নোনতা মুড়ি-মোয়া-নাড়ু-বাতাসা সব দিয়ে আমরা আমাদের মত করে আমাদের সাধ্য অনুযায়ী অন্নকূট পালন করলুম। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। তবে পরের বছর থেকেই সব পুজো, সব অনুষ্ঠান পালন করা নতুন ভাবে, নতুন আঙ্গিকে, নতুন শহরে।

Posted in Uncategorized

ড্যামকুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে -২

বিধান নিবাস পর্বঃ

কৈশোরের শুরুতেই চলে এলাম বিধান নিবাসে। সেখানে সব নতুন রকমের অভিজ্ঞতা। পঁচিশে বৈশাখে প্রভাত ফেরী, দোল উৎসব – সে তো হল। শুনলুম সোসাইটির মধ্যেই নাকি দুর্গা পুজো হবে। কি কাণ্ড! আমরাই সবাই মিলে নাকি পুজো করব। আবার ফাংসনও হবে! নৃত্যনাট্য, নাটক এরকম সব কত কি! এসবই আমার কাছে এক্কেবারে নতুন অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে নাচ – ও আমার ‘আসে না!’ বুবুদি আর বুবাইদি খুব ভাল নাচ করে। ওরাই বাকিদের শেখাবে, আর গানের দায়িত্বে চন্দ্রাদি। শুনলুম রবি ঠাকুরের ‘শ্যামা’ হবে আর আমরা সব নাকি গ্রামবাসী।

সেবার বিশ্বকর্মা পুজোর দিন দাদি চলে গেল আমাদের ছেড়ে। শ্রাদ্ধশান্তির কাজ মিটতে না মিটতেই পরের দিনই আমাদের নাচ। আমার নাচ যে অত্যন্ত বাজে হয়েছিল বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই একটা নাচেই আমার নাভিশ্বাস ওঠার দাখিল। পরের বছর আবার পঞ্চমী ষষ্ঠী দুদিনে দুটো প্রোগ্রাম। পঞ্চমীর দিন বুদ্ধু-ভুতুম – তাতে ওই হিংসুটেদের ‘টিম লিডার’, মানে বড় রাজকুমার। আর পরের দিন দিদিদের চিত্রাঙ্গদায় ওই আবার গ্রামবাসী। এবারে আবার গ্রামবাসীদের একটার বেশী নাচ। তবে হিংসুটে রাজকুমারের নাচটা দিব্য উৎরে গিসল – কারণ ওতে নাচের চেয়ে অভিনয়টা ছিল বেশী। তার পরেরবার লক্ষ্মণের শক্তিশেলে জাম্বুবান হয়ে বুঝলুম অভিনয়, বিশেষ করে কাউকে নকল করা জিনিসটা আমার বেশ আসে।

এই পুজোর ফাংসনে দাদাদের আর কাকুদের নাটকের পাশাপাশি ছিল কাকিমাদের নাটক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষরক্ষা। সে নাটক দেখে আমাদের হাসতে হাসতে পেটে খিল। রত্না কাকিমা, গৌরীকাকিমা, স্বপ্না কাকিমা, মলি কাকিমা, সব্বাই যে কি ভাল অভিনয় করেছিলেন! পরের বছর কাকিমাদের চিরকুমার সভাও তাই। এক্কেবারে সুপার ডুপার হিট। পুজোর সময় ফাংসন দেখতে, বিশেষ করে আমাদের নৃত্যনাট্য, কত লোক যে আসতেন – পিসি আর বিল্লু, নদাদি, মামু-মাইমা, মুনদিদি বাবুদাদা তো বটেই মাইমার মাও আসতেন। সন্ধ্যেবেলা পুজো প্যাণ্ডেলের ভিড় ধাক্কাধাক্কি নেই, নিজেদের ঘরোয়া অনুষ্ঠান সকলেই খুব উপভোগ করতেন। বিশেষ করে পঞ্চমী ষষ্ঠীতে তখনও রাস্তায় বেরনো যেত।

নতুন জায়গায় আসার পর পর পু্রোনো জায়গা, পুরোনো অভ্যাসের জন্য মন কাঁদে। তাই বিধান নিবাসে আসার পরও প্রথম বছর টালাপার্ক, বেলগাছিয়ার ঠাকুর আর মেলা দেখতে যাওয়া হয়েছিল। তখন বাবার গাড়িতে আমি আর বিল্লু ছাড়াও সোমা, জয়াদি, পতু, রূপু সহ আরও অনেক কুচোকাচা – বিরাট টিম। বাবার ছোট প্রিমিয়ার পদ্মিনীতে গাদাগাদি করে ঠিকই ধরে যেত। তবে গাড়ি চড়ার রেকর্ড বোধহয় কালীপুজোর দিন পুজো শেষ হয়ে যাবার পর প্রভাত কাকুর আম্বাসেডর গাড়িতে গোপাকাকিমা, ইলাজেঠিমা, শিপ্রা জেঠিমা, মণিমালা কাকিমা, কল্পনা কাকিমা, বাবিদি, পিয়ালি, জয়াদি, সোমা, জয়িতা আর সবার শেষে ফাউ সবিতাকাকিমা…। ফাউ বাদ দিয়ে বাকি যাত্রীরা সকলেই বেশ গায়ে গতরে। বাবা যে কোথায় বসে গাড়িটা চালিয়েছিল আমার কল্পনার বাইরে। কারণ সে যাত্রায় আমি লেজুড়টিকে বাবা বাড়িতেই রেখে গিয়েছিল। আসলে তখন অত রাত জাগা আমার অভ্যাস ছিল না। তাই কালীপুজো শেষ পর্যন্ত না দেখেই আমি রণে ভঙ্গ দিয়েছিলুম।

যা হোক আমাদের ঠাকুর দেখার লিস্টিতে ওই বাগবাজার, কুমোরটুলি, আহিরীটোলা, ওদিকে কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলী পার্ক, দমকলের ঠাকুর সবই বহাল ছিল। বিবেকানন্দ রোডের পুজোগুলো, চালতাবাগান, হাতিবাগান, সেসবও ছিল। সঙ্গে যোগ হল কাঁকুড়গাছি, বেলেঘাটা, সল্ট লেকের ঠাকুর – লাবনী, করুণাময়ী, পূর্বাচল, বিডি ব্লক আরও কিছু কিছু। তখন সৌরেন জেঠুও আমাদের গাড়ি করে নিয়ে যেতেন। একবার ওদের সঙ্গে দুটো গাড়ি নিয়ে আমরা রাত্তিরে সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলুম। এখানে এসে আরেকটা বড় ব্যাপার হল বন্ধুরা মিলে ‘একা একা’ পাশের সোসাইটিগুলোয় ঠাকুর দেখতে যাওয়া – ঈশ্বরচন্দ্র নিবাস, এলিট, স্কাই লাইন, রাস্তা পেরিয়ে হাডকো, বি আর এস। ‘বড়’ হয়ে গেছি আমরা সবাই।

নিজেদের সোসাইটির পুজোয় মজাই আলাদা। রাত থাকতেই ঢাকিদের তুলে গোপা কাকিমা পুরো সোসাইটি ঘুরে ঢাক বাজাতে বলে দিতেন। পুজোর কত শত কাজ – সবাই পড়ে পড়ে ঘুমোলে চলবে! আমাদের কাজ ছিল গাছ থেকে দোপাটি আর মাঠ থেকে দুব্বো তোলার আর দুব্বো বাছার। সব্বাই অঞ্জলি দেবে অনেক ফুল লাগবে তো। সেই প্রথম বুঝলুম অঞ্জলি শুধুই অষ্টমীর দিন দেওয়া হয় না, রোজই দেওয়া হয়।

পুজোর কদিন তো আমরা এক্কেবারে ছাড়া গরু। কোনও শাসন বারণ নেই। ওই কদিন মায়েদেরও ছুটি বাড়ির কাজের হাত থেকে। সবাই সারাদিন নিচে পূজামণ্ডপে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে চান সেরে নতুন কাপড়জামা পরে সোজা নিচে। তারপর ওখানেই প্রথমে পুজোর জোগাড়ে আমাদের ফাই-ফরমাস খাটা, অঞ্জলি দেওয়া, ওখানেই প্রসাদ খাওয়া আর ভোগ-প্রসাদ বিতরণে সাহায্য করা। তারপর ওখানেই অপেক্ষা দুপুরের খাবারের জন্য। সঙ্গে চুটিয়ে গল্প আর আড্ডা।

ষষ্ঠীর রাত থেকে শুরু হত নিচে কম্যুনিটি খাওয়া। ষষ্ঠীর রাতে আর অষ্টমীর দুপুরে লুচি, সপ্তমীতে ইলিশ মাছ, নবমীতে পাঁঠার মাংস। দশমীতে দুপুরে contributory lunch. সপ্তমী থেকে নবমী বিকেলের পর থেকে পুজো মণ্ডপের পাশে ফুড স্টল।

প্রথম বছর অষ্টমীতে মহা গোলমাল। পুজো, অঞ্জলি সব সামলে দুপুরের খাবার তৈরীতে দেরী। বাচ্ছা-বুড়ো সবাই এদিকে খিদেয় পেট চুঁইচুঁই। কোনও রকমে মিউজিকাল চেয়ারের মত ঝাঁপিয়ে একটা সিট তো দখল করেছি, কিন্তু লুচি তো ভাজা হয় নি! বহুক্ষণ পর পর একটা করে লুচি আসে। এদিকে পেছনে তখন পরের ব্যাচের জন্যে সবাই চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে। কোনোরকমে দুটো লুচির পর ‘লুচি আনো, লুচি আনো’ গুঞ্জনের মাঝে হাতে একটা মাত্র লুচি নিয়ে বাবুদা ঝড়ের বেগে সামনে দিয়ে চলে গেল ‘লুচি নিবি না তো’ বলতে বলতে। নেবো, নেবো। কে শোনে কার কথা! ওই পুজোর খাওয়ার পরিবেশন করতে করতেই ছোটরা প্রথমে নুন-লেবু, তারপর জল, তারপর ধীরে ধীরে ভাত-ডাল-তরকারি পরিবেশন শিখে গেল। কাজের জন্য তৈরী হয়ে গেল পরের প্রজন্ম।

দুপুরে খাবার পরেও আমাদের বাড়ি যাবার কোনও নামটি নেই। মণ্ডপ খালি হয়ে গেলে সবাই মিলে  সোমাদের বাড়ি গিয়ে চড়াও হওয়া। সন্ধ্যেবেলা কোনওক্রমে একবার বাড়ি গিয়ে পোষাক পাল্টেই আবার নিচে ছুট। একদিকে সন্ধ্যারতি দেখা অন্যদিকে তাড়াতাড়ি মাঠে গিয়ে ভাল চেয়ার দখল করতে না পারলে দূর থেকে স্টেজের আর স্টেজের পেছনের সব খুঁটিনাটি রগড় ‘মিস’ হয়ে যাবে। ফাংসনের পর তার চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করে যখন অবশেষে বাড়ি ঢোকা হত ততক্ষণে ক্যালেণ্ডারের পাতায় তারিখ বদলে গেছে।

আস্তে আস্তে আমরাও বড় হচ্ছি, লায়েক হচ্ছি। ঠিক করলুম পুজোর সময় আমরা বন্ধুরা কজন মিলেই একটা নাটক করব – মনোজ মিত্রের ‘চোখে আঙুল দাদা’। ওনারই দলের দীপকদা বড়দের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নাটকেরও ডিরেকসন দেবেন। বেশ একটা গেরেমভারি ব্যাপার! একমাস আগে থেকে রোজ তার রিহার্সাল – পড়াশুনোর পাট সিকেয়। কিন্তু আমরা সবসময়ই দুধেভাতের দলে। আমাদের নাটক সেই পঞ্চমীতে কি বড়জোর ষষ্ঠীতে। সপ্তমীতে ছেলেদের নাটক, অষ্টমীতে বিচিত্রানুষ্ঠান – অষ্টমীর সন্ধ্যারতি, সন্ধিপুজো এসব থাকে কি না। নবমীতে ফিনিসিং টাচ – বড়দের নাটক। পঞ্চমী থেকেই আমাদের মন খারাপ হয়ে যেত – সোমা বলত ‘পুজো শেষ হয়ে গেল’। সত্যিই তাই – আর রোজ রোজ একসঙ্গে রিহার্সালের পর্ব নেই। পুজোর চারটে দিন তো শুরু হলেই শেষ।

সেই প্রথম দুবছর নাটক করার পর কাকিমাদের নাটক একরকম বন্ধ। মানে দু একজন বড়দের নাটকে থাকলেও কেবলমাত্র মহিলাশিল্পী নিয়ে নাটক আর হয় নি। হঠাৎ গায়ত্রীকাকিমা বললেন এবার মহিলারা করবে ‘শ্রীমতি ভয়ঙ্করী’। সবই হল, কিন্তু তার জন্যে ফচকে চাকরের পার্ট করার মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই আমার ডাক পড়ল। বড়দের সঙ্গে নাটক করব ভেবে সে যে কি আনন্দ! পতু আর সোমাও ছিল সেই নাটকে। বুবুনের একটা চকচকে সার্ট পরে হালকা গোঁফ লাগিয়ে পকেটে চিরুণি নিয়ে সেই ফচকে চাকরের পার্ট তারপর পুজোর বাকি কটা দিন সবার মুখে মুখে। অনেকেরই মতে ছেলের সাজে আমাকে এক্কেবারে বাবার মত দেখাচ্ছিল। নাটকের পরের দিন এক কাকু তো বলেই ফেললেন, ‘আরে, শুধু শুধু গোঁফটা উড়িয়ে দিলি কেন?!’

সেই শুরু বড়দের সঙ্গে নাটক করা। এবার তো পুরুষ মহিলা একসঙ্গে অভিনয়। সবচেয়ে বড় মজা হল নবমীর দিন নাটকের আগে অষ্টমীর সারারাত জেগে স্টেজে রিহার্সাল। বড়দের নাটকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কিন্তু প্রম্পটারের। সারাদিন নিজেদের চাকরি-ব্যবসা তারপর পুজোর হাজার দায়িত্ব সামলে কাকুদের কারুর পার্ট মুখস্থ করার সময় নেই। কেউ কেউ তো রিহার্সালে এসে এক্কেবারে নাক ডেকে ঘুমিয়েই পড়তেন।

একবার হল কি প্রম্পট শুনতে না পেয়ে এক কাকু ‘অ্যাঁ, অ্যাঁ’ করতে করতে প্রায় উইংসের বাইরেই বেরিয়ে গেলেন। আরেকবার তো প্রচণ্ড সিরিয়াস একটা সিনে প্রভাতকাকুর নকল গোঁফের অর্ধেকটা আঠা খুলে ঝুলছে, আর দর্শক হেসে কুটোপাটি। শেষকালে ‘ধ্যাত্তেরি’ বলে পুরো গোঁফটাই টেনে ফেলে দিতে সবাই একেবারে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।

ফাংসনের রিহার্সালে যে কত মজা, কত গল্প, কত ঠাট্টা-ইয়ার্কি। আমাদের তো রোজ রিহার্সাল দিতে দিতে পুরো নাটকটাই গড়গড়ে মুখস্থ হয়ে যেত। তখন কে বলবে যে ছোট থেকে আমাকে একলাইন পড়া মুখস্থ করাতে মায়ের নাভিশ্বাস উঠে যেত! কোনদিন কেউ রিহার্সালে না এলে আমি দিব্যি তার হয়ে প্রক্সি দিয়ে দিতুম। কোনও প্রম্পটারের দরকারই হত না। স্টেজ রিহার্সালের দিনও একই অবস্থা। সেদিনও পুরো টিম নেই, সেদিনও কারুর এক ফোঁটা পার্ট মনে নেই! ডিরেক্টরের টেনশান, বাকিদেরও উৎকণ্ঠা। ওমা, স্টেজে উঠে তিনিই যেন অন্য মানুষ! পুরো নাটকটা শেষ পর্যন্ত এতোই ভালো হত যে সবাই অবাক!

দশমীর দিন সকালবেলা দর্পণ বিসর্জন, দধিকর্মা। আয়নার মধ্যে দিয়ে ঠাকুরের পা দেখার কি ধুম আমাদের! তারপর ঠাকুর বরণ আর প্রণাম। গোপাকাকিমার উৎসাহের অন্ত নেই। ঠাকুরকে সিঁদুরদানের পর মায়েদের সিঁদুরখেলা দোলের রঙ খেলাকেও হারিয়ে দিত। দুর্গাপুজো মানে যে এত কিছু এত মজা জানা ছিল না তো! সবচেয়ে মজা ভাসানের সময়। এতদিন তো নিজেদের ঘরের জানলা থেকেই ভাসানের নাচ দেখেছি। এবার তো আমাদের পাশে পাশেই দাদাদের ধুনুচি নাচ। আমরাও চলেছি ঠাকুরের ম্যাটাডোরের সঙ্গে সঙ্গে পরিক্রমায়! সামনে এগিয়ে চল। যেখানে সবাই নাচছে তার কাছাকাছি। ঘুরতে ঘুরতে যেই অন্য সোসাইটির সামনে আসছে নাচের তোড় যেন কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে! বড়রা মানে মানসকাকু, কাশীকাকু, প্রভাতকাকু, সৌরেনজেঠু, দুই নন্দীকাকু, বাবা – এঁরা সবাই দাদাদের সামলাতে ব্যস্ত। ওদিকে বেশি দেরী হলে গঙ্গার ঘাটে অন্ধকার হয়ে যাবে।

দুচার বছর পরে শুনি ঠাকুরের ম্যাটাডোরের সঙ্গে বাবা যাচ্ছে গাড়ি নিয়ে। সে কি! বাবা যাচ্ছে আর আমি যাব না! আমরা বন্ধুরা মিলে বড়দের রাজি করিয়ে উঠে পড়লুম বাবার গাড়িতে। বাবুঘাটের কাছাকাছি গিয়ে দিল গাড়ি আটকে – NO ENTRY. কি দুঃখ, কি দুঃখ! এদিক ওদিক ঘুরে যতক্ষণে গঙ্গার ঘাটে এসে পৌঁছলুম ঠাকুর জলে পড়ে গেছেন!

সেবারে দাদারা বলল এবার ম্যাটাডোরে করে ভাসানে যাবি তো বল। কি উৎসাহ সবার। আমার তো সবচেয়ে বড় সাপোর্ট বাবার গাড়ি সঙ্গেই যাবে, কাজেই মায়েরও আপত্তির কোন কারণ নেই। তাছাড়া বাবা আমায় কোনসময়ই কোন কিছুতে বারণ করতো না। গাড়ি করে বাবুঘাটে বার দুয়েক গেছি। কিন্তু ম্যাটাডোরে করে ঠাকুরের সঙ্গে ভাসানে যাবার মজাটাই অন্যরকম। সারা রাস্তা সামলে সামলে চলা এই বুঝি গণেশ উলটে গেল, এই বুঝি কার্তিক ঠাকুর ম্যাটাডোর থেকে লাফিয়ে পড়ল! গঙ্গার ঘাটে গিয়ে অবশ্য আমাদের ম্যাটাডোর থেকে নামতে দেওয়া হল না। ‘না, মানে না! Strict NO!’ কিন্তু নিচে থেকেই সাপ্লাই আসতে থাকল আইসক্রিম, বেলুন এইসব।

ভাসানের পর মা দুর্গার অস্ত্রশস্ত্রের ভাগ বাঁটোয়ারা শুরু হল। আমার ভাগে পেয়েছিলুম একটা শাঁখ। সেটা আমার পড়ার বইএর তাকে রাখা থাকত। সরু লম্বা বেলুনগুলো ভারি মজার। সেগুলো ভাঁজ করে কেউ মাথায় পরছে, আবার কেউ মুড়ে হাত ওপরে করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চলন্ত ম্যাটাডোরের হাওয়ার ধাক্কায় তার থেকে মিষ্টি শব্দ আসছে কিরিকিরি কিরিকিরি। ফিরতি পথে পাশাপাশি সব ম্যাটাডোর থেকেই এই একই আওয়াজ। তবে মিষ্টি আওয়াজে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি তো কম খেলে না – বেড়ে যায়! যেই একজনের বেলুন কোনভাবে ফেটে যাচ্ছে অমনি সে একটা সেফটিপিন নিয়ে তাক করে কতক্ষণে বাকিদের বেলুন ফাটিয়ে দেওয়া যায়।

বিসর্জনের গাড়ি ফিরে এলে ঢাক বাজিয়ে আবার সবাইকে জানান দেওয়া হত। পল্টুদা গঙ্গায় চান করে মাথায় করে নিয়ে আসত শান্তির জলের ঘট। শূন্য কম্যুনিটি হলে সবাই জড়ো হলে শান্তির জল আর মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে তারপর শুরু হত বিজয়ার প্রণাম আর কোলাকুলি। আমরা প্রণাম করার জন্যে সেই যে একবার নিচু হতুম মাথা না তুলেই পরপর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেই যেতুম। এই করে করে একেকজনকে হয়তো তিন-চারবারও প্রণাম করেছি। সেই পায়ের মিছিলে হয়তো আমাদের চেয়ে ছোট কি সিকিউরিটি, জমাদার তারাও থাকত।

কেউ কেউ বলতেন এখানে প্রণাম নেবো না, বাড়ি আসতে হবে। আমাদের তো পোয়া বারো। সোসাইটির ১১৮টা ফ্ল্যাটে বিজয়া করতে করতে লক্ষ্মীপুজো এসেই যেত। মানে ততদিন সন্ধ্যে থেকে পড়াশোনার ইতি, আর রাত্তিরে বাড়ির রুটি তরকারি খাওয়া থেকেও মুক্তি। কাউকে কাউকে আগে থেকে বলে রাখা হত বিজয়ার স্পেশাল কিছু খাবার চাই। যেমন সোমাদের বাড়ি কাকিমার হাতের মাংসের ঘুগনি, আমার মায়ের মাংসের খিচুড়ি, কাশীকাকুর বাড়ি কাকিমার হাতের চিকেন রোল – দোকানকেও হার মানায় সে। আর মানসকাকুর বাড়ি বিভার হাতের মোগলাই পরোটা সঙ্গে মানসকাকুর স্পেশাল কৃষ্ণের মত বাঁশি বাজিয়ে নাচ আর কিশোর কুমারের নকল করা। কিন্তু নিচে ভাসানের পরিক্রমার সময় কোনদিন মানসকাকুকে নাচতে দেখি নি।

দুর্গাপুজোর পর দেখতে দেখতেই লক্ষ্মীপুজো। আমাদের তো সোমাদের বাড়ি সারা বছরই স্থায়ী ঠিকানা। তবে সবার নজর থাকতো কানাইজেঠুর বাড়ির সেবারের নিমন্ত্রণ পত্রের দিকে। কানাইজেঠুর বাড়ির পুজো প্রতি বছরই ওনার ‘মেয়ের বিয়ে’। বিরাট প্রমাণ সাইজের প্রতিমা বেনারসি শাড়ি আর সোনার গয়না দিয়ে  সাজানো। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও দেখার মত। আনন্দবাজারের কর্মী সহ কলকাতার শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী মহলের এমন কেউ বোধহয় ছিলেন না যিনি শ্রী কনাইলাল বসুর বাড়ির লক্ষ্মীপুজোয় না আসতেন। অনেকে শুধু নিমন্ত্রণ পত্রের জন্য নিমন্ত্রণ চেয়ে নিতেন। বাবারা বলত ‘কানাইদার ফ্যাক্টরি’। পুজোর কয়েক মাস আগে থেকে শ’য়ে শ’য়ে ছোট ছোট মিনিয়েচার কৌটো, হাঁড়ি, সরা, আয়না, মাটির ডাব, প্লাস্টিকের কলাগাছ সব জেঠু নিজে হাতে স্পেশাল আঠা দিয়ে বসে বসে জুড়ে কোনোবার করতেন দ্বারঘট, কোনোবার কনকাঞ্জলির কুলো, কি বরণডালা, কখনও দর্পণ বিসর্জন, লক্ষ্মীর ঝাঁপি। তার গায়ে সরু সাদা কাগজে লাল কালি দিয়ে লেখা থাকত ‘বাড়িতে লক্ষ্মী পুজো, সন্ধ্যায় আসবেন। ইতি – কানাইলাল বসু।‘ সঙ্গে বাংলায় সন তারিখ লেখা। পুজোর সময় ঢাক বাজানো হত। সানাইয়ের রোশনচৌকি বসত। আর তুবড়ি, রংমশাল এই সব বাজিও পোড়ানো হত।

সোসাইটির সব লোক একবার কানাই জেঠুর বাড়ি, একবার সোমাদের বাড়ি আর একবার নিচের পূজামণ্ডপে পালা করে ঘুরতেন। কানাইজেঠুর বাড়ির এই রাজকীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি সোমাদের বাড়ি কাকু-কাকিমার আন্তরিক আপ্যায়ন সবার মন ভরিয়ে দিত। তুলনায় প্যান্ডেলে ঠাকুরমশাই একা একাই পুজো করতেন। এমন কি এই দুই বাড়ির পুজো আর অনেকেই নিজেদের বাড়ির পুজো সামলে নিচে সোসাইটির পুজোয় গিয়ে সময়মত জোগাড় দিতে যেতে পারতেন না।

কানাইজেঠুর বাড়ির তুবড়ি দেখে অনেকেই বাবাকে একবার বললেন কালীপুজোয় তুবড়ি বানাতে। বাবা তুবড়ি বানালে আমি তো তার আসিস্ট্যান্ট আছিই। মশলা মাখা থেকে তুবড়ির খোল শুকিয়ে মশলা ভরা – পারি না পারি সবেতেই হাত লাগাই। ওপরে সুভাষকাকু আবার রংমশাল বানাতেন। কিন্তু সে এক্কেবারে চুপিচুপি। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে। পাছে বাজির মশলার কাছে গেলে কারুর কোনও অঘটণ ঘটে! কিন্তু বাজি যখন হল তখন আমাদের পায় কে! বাবা কাকাদের হাতে তৈরী ভেজালহীন বাজি।  বাবার তুবড়ি যত তিন-চার তলা অবধি ওঠে, কাকুর রংমশালও তেমনি কতক্ষণ ধরে জ্বলে!

কালীপুজোর আগের দিন আবার সৌরেনজেঠু আমাদের গাড়ি করে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেন। একদিকে কলেজ স্ট্রিটে ফাটাকেষ্টো-সোমেন মিত্রের ঠাকুর। অন্যদিকে বারাসাত। সঙ্গে রাস্তায় আরও একটা আধটা অন্য ঠাকুর। জেঠুদের ড্রাইভার উত্তমদার এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী উৎসাহ। কালীপুজোর রাত জেগে পূজো দেখা তারপর সবাই মিলে বসে ভোগ খাওয়া তারও একটা আলাদা মজা ছিল। পুজো প্যাণ্ডেলের আড্ডাখানায় একবার দাদারা নিয়ে এল একটা হুঁকো। আমরাও সবাই এক এক টান দিয়ে দেখলুম হুঁকো খাওয়া কেমন ব্যাপার। তেমনি কালীপুজোর পর এসে বলল হাঁ কর, হাঁ কর – তারপর সবার মুখে দিয়ে গেল এক এক ফোঁটা করে ‘মা কালীর প্রসাদ’। এই একসঙ্গে কাজ করা, ফাংসন করা, গল্প-আড্ডা-মজা এক প্রজন্মের সঙ্গে পরের প্রজন্মকে একটা অভিনব বন্ধনে বেঁধে দেয়। এই সোসাইটির মধ্যেই বেঁচে থাকে আগেকার একান্নবর্তী পরিবারের পারস্পরিক ভালবাসা, সৌহার্দ্য, স্নেহ-শ্রদ্ধার ঐতিহ্য। 

Posted in Uncategorized

ড্যামকুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে -১

টালা পর্বঃ

ছোটবেলায় পুজো মানেই অষ্টমীর দিন সকালবেলা বেদান্ত মঠে গিয়ে অঞ্জলি দেওয়া। সবাই মিলে একসঙ্গে যাওয়া হত – এবাড়ি থেকে দাদি, নদাদি আর ওবাড়ি থেকে ঠাম্মা, নঠাম্মা, পিসি আর অবশ্যই বিল্লু। তারপর বাবার সঙ্গে গাড়ি করে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। প্রত্যেক বছর কয়েকটা ঠাকুর দেখা এক্কেবারে বাঁধা – বিবেকানন্দ স্পোর্টিং, সিমলা স্পোর্টিং, সিমলা ব্যায়াম সমিতি, বিডন স্কোয়ার। তাছাড়া সাহিত্য পরিষদ, গোয়াবাগান পার্ক, হেঁদুয়া তো আছেই। বিডন স্কোয়ারের নাম কেন যেন আমাদের কাছে চিল্লুদিদির পুজো হয়ে গিয়েছিল, সে গল্পটা ঠিক মনে নেই।

P.C. Mahua Dutta

তবে আরেকটা গল্প মনে আছে। ছোটবেলায় বাবা একবার হাওড়ার পাড়ার সবার সঙ্গে কলকাতায় ঠাকুর দেখতে এসে এই মাঠে হারিয়ে গিয়েছিল। তখন পাড়ার এক দাদা, যাঁর পদবি ছিল চক্রবর্তী, অনুসন্ধান অপিসে গিয়ে বলেন আমার ভাই হারিয়ে গেছে। তারাও বলেছে ঠিক আছে কাগজে আপনার ভায়ের নাম আর আপনার নাম লিখে দিন।  তিনিও সেই মত লিখে দিয়েছেন। এবার হয়েছে কি নওল লিখতে গিয়ে বেখেয়ালে ‘ও’- এর মাথায় অতিরিক্ত মাত্রা পড়ে সে নাম হয়ে গেছে ‘নত্তল’। বাবা বলছে ‘শুনছি মাইকে খুব হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি চলছে ‘নত্তল চক্রবর্তী তুমি যেখানেই থাক এক্ষুনি আমাদের অনুসন্ধান অপিসের সামনে চলে এস। এখানে তোমার দাদা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।‘ বাবা ভাবছে এই নত্তল চক্রবর্তী ছেলেটা কে রে! তাকে এতক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি হচ্ছে! সে যে বাবা নিজেই সে তো আর বুঝতে পারে নি! একে তো সেই দাদা বাবার পদবি লেখেন নি, অভিনব এক নাম শুধু লিখেছেন, তার ওপর পুজো কমিটির লোকেরা আবার শুধুই সেই নামটা বলছে। দাদার নাম বলছে না। আমি বল্লুম ‘তারপর সেই দাদাকে খুঁজে পেলে কি করে?’ বাবা বলল  ‘ওই মাঠে ঘুরতে ঘুরতেই পেয়ে গেলুম।‘

একবার শুনলুম সেবার নাকি সব জায়গায় লোডশেডিং ঠাকুর হয়েছে। কলকাতায় তখন লোডশেডিং-এর প্রকোপ খুব বেড়েছে। তো সে ঠাকুর দেখতে গিয়ে দেখি বিভিন্ন রঙের আলো জ্বলছে-নিভছে। কিছুদিন পর দেখা গেল প্যাণ্ডেলে রীতিমত মা দুর্গার সঙ্গে অসুরের যুদ্ধ হচ্ছে। অন্ধকার প্যাণ্ডেলের এদিক থেকে সিংহ তেড়ে আসছে, ওদিক থেকে কার্তিক ঠাকুর তীর-ধনুক নিয়ে এগিয়ে আসছে, গণেশদাদাও বাদ যান না, অসুর বলে আমিই বা কম কিসে! সে ঠুসঠাস, দুমদাম কি আওয়াজ। তারপর মা দুর্গার হাতের ত্রিশূল যেই অসুরের বুকে এসে লাগল অমনি প্যাণ্ডেলের সব আলো জ্বলে উঠল আর দেখি লক্ষ্মী-সরস্বতীও হাসি হাসি মুখ করে পেছন থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

P.C. Jhumur Neogy

এরপর ঠাকুর দেখার লিস্টিতে যোগ হল যাতায়াতের পথে গৌরীবাড়ি, টালাপার্ক, বেলগাছিয়ার ঠাকুর। বেলগাছিয়ার পুজোয় মাঠে বেশ বড় মেলা বসত। আর সেই মেলা পুজো শেষ হয়ে যাবার পরেও কিছুদিন থাকত। তখন সকাল-বিকেল আমাদের দুজনের মেলায় যাবার কি ধুম! একবার দেখি বিল্লুর নতুন জামার পকেটে নতুন রুমালের সঙ্গে খুচরো টাকা! পিসি দিয়েছে ঠাকুর দেখতে গিয়ে মেলায় খরচ করবে বলে। সে আমি কি অবাক! তারপর মেলায় তো যাওয়া হল। ঠাকুর দেখার পর হজমিগুলি কেনা, ঘুর্ণী-নাগরদোলায় চড়া, বেলুন ফাটানো – সবই হল। কিন্তু বাড়ি আসার পর মনে হল যাঃ, টাকাটা তো খরচ করা হল না! মেলায় হজমিগুলি তো কিনতে না কিনতেই শিশি শেষ। তখন দুজনে মিলে কিইই পরামর্শ এবার তাহলে ছোটশিশি কেনা হবে না বড়শিশি। বিল্লুর তো তখন রোজ টনসিলে ব্যাথা। টক খেয়েই ব্যস্‌। তবে বুড়ির মাথার পাকা চুল এখনও আমার খেতে ভীষণ ভাল লাগে।

P.C. Pujarini Ghosh Saha

বিল্লুর তো খুব সাহস। তাই ঘুর্ণীতে ও চড়ত ঘোড়ার পিঠে। আমি তো ওই বন্ধ সিটে। কখনও সখনও সাহস করে বাঘসিংহর পিঠে চড়লেও সে কি ভয়, কি ভয়! দাদা আস্তে ঘোরাবেন কিন্তু! বেলুন ফাটাতেও খুব ভালবাসত বিল্লু। আমি তো চিরকালই লক্ষ্যভ্রষ্টের দলে। কাজেই ওই বন্দুক ছোঁড়া আমার কম্মো নয়!

আরেকবার সে খুব সাহস করে বাবার সঙ্গে তো নাগরদোলায় চড়েছি। শুনেছি আগের দিন বিল্লু নাগরদোলায় চড়েছে। কিন্তু যেই না নাগরদোলা ওপরে উঠেছে আমি ভয়ে কেঁদে কেটে চেঁচিয়ে মেচিয়ে মাঝপথে নেমে বাঁচি! তবে টয়ট্রেনে চড়ার মজাই ছিল আলাদা।

মেলা থেকে দুজনের দুটো ঘড়িও কেনা হত। সে সেই প্লাস্টিকের খেলনা ঘড়ি। পুজোর সময় সব বাচ্ছার হাতে হাতে সেই ঘড়ি আর বন্দুক। ফট্‌ফট্‌ করে সারাদিন সবাই ক্যাপ ফাটাচ্ছে। আমি ভীতুর ডিম বিল্লুর দেখে বন্দুক কিনতুম কিন্তু ক্যাপ ফাটাতে গেলেই আগুনের ফুলকি ছিটকে আসতো বলে ভয়ও পেতুম খুব।

একবার ঘড়ি কেনা হল তার ডায়ালের ওপর মেটালের ফয়েল লাগানো আর মোটা কাপড়ের ব্যাণ্ড – একজনের লাল আর একজনের কমলা। সে দুজনের কি ঘ্যাম! হঠাৎ দেখে সবাই ভাবছে সত্যিকারের ঘড়ি। কিন্তু যেই না কেউ সময় জানতে চাইছে – ব্যস্‌, আমাদের সব হাওয়া ফুস!

একবার বিল্লু বলল, ‘মামা এবার কুমোরটুলির ঠাকুর দেখাতে হবে’। সেই শুরু হল আহিরীটোলা, কুমোরটুলি, বাগবাজার সার্বজনীন; ওদিকে কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলী পার্ক এইসব ঠাকুর দেখা। তখন আবার কটা ঠাকুর দেখা হল গোণা হত রীতিমত। গাড়িতে যেতে যেতে ছোট বড় পাড়ার ঠাকুর, কোনও প্যাণ্ডেলের অর্ধেক, কোনওটার সিকি ভাগ – গুণতিতে বাদ যেত না কিছুই। যে সব প্যাণ্ডেলের সামনের দিক ঢাকা থাকত, গাড়ি থেকে না নামলে দেখা যেত না, সেই পুজোর উদ্যোক্তাদের ওপর ভারি রাগ হত। বাবাও আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওই দ্যাখ একটা ঠাকুর, এই একটা প্যাণ্ডেল ছেড়ে এলাম বলে হৈ হৈ করত।

আহিরীটোলায় সেবার ঠাকুরের মাটিরই শাড়ি-গয়না। সে যে কি অবাক হয়েছিলুম দেখে আর কি ভাল লেগেছিল ঠাকুর কি বলব! তারপর সেই মহম্মদ আলী পার্কের পাশে গলির মধ্যে দমকলের ঠাকুর অকাল বোধন। সে দেখে কি গবেষণার ধুম!

দশমীর দিন সকালেই যাওয়া হত হাওড়ায় বিজয়া করতে। কারণ তার পরের দিন থেকেই বাবার অপিস আর বিকেলে গঙ্গায় ঠাকুর ভাসানের ভিড় ঠেলে ওপারে হাওড়া পৌঁছনো এক্কেবারেই অসম্ভব। এখানেও বিল্লু আর পিসি আমাদের সঙ্গী। তাই পথে যেতে যেতে আরও কিছু ঠাকুর দেখে আমাদের লিস্টি বাড়ানো হত বলাই বাহুল্য। আর সেই সঙ্গে যোগ হত হাওড়ার ঠাকুরও। কালীবাবুর বাজারের ওপরেই একটা ঠাকুর। তারপর আমাদের বাড়ির গেটের পাশেই ছিল খুরুটের ঠাকুরের বিরাট প্যাণ্ডেল। ওদিকে শৈলীমার (বাবার ছোট পিসি) বাড়ি যেতে গেলেও ওদের মাঠের ঠাকুরের প্যাণ্ডেলের পাশ দিয়েই যেতে হত। কাজেই বলতে গেলে এই সব ঠাকুরও আমাদের বাঁধাধরা তালিকার মধ্যেই পড়ত।

ওদিকে আবার দশমীর দিন বিকেলবেলা সাউথে বিজয়া করতে গিয়ে দূর থেকেই দেখা হত পার্ক সার্কাস ময়দান বা দেশপ্রিয় পার্কের ঠাকুর। এইসব বড় মাপের ঠাকুর তো আর দশমীতেই ভাসান হত না। পার্ক সার্কাস ময়দানে কখনও সখনও ঠাকুর দেখতে যাওয়া হলেও দেশপ্রিয় পার্কের ভেতরে গিয়ে ঠাকুর দেখা হত না।

একবার হল কি – টালায় বাবলাকাকারা ঠিক করল সবাই মিলে তিনটে গাড়ি করে সারারাত ঠাকুর দেখতে যাওয়া হবে। মা বাবা যাওয়া মানে আমারও যাওয়া। কিন্তু সে যে আমার কি ভীষণ বোরিং লেগেছিল! সারা রাত ধরে ঘুরে ঘুরে একবার এই প্যাণ্ডেল একবার ওই প্যাণ্ডেল! ঘুমে তখন চোখ জুড়ে আসছে। একবার করে গাড়িতে উঠতে না উঠতেই আবার নামো নামো এই ম্যাডাক স্কোয়ার, এই একডালিয়া, এই দেশপ্রিয় পার্ক, এই পার্ক সার্কাস ময়দান। ধুত্তোরি! আবার ওই মাঝরাতে লছমিপিসি বলে ফুচকা খাব, আইসক্রিম খাব। তখন তো আমার কিছুই খেতে ভাল লাগত না। কাপ আইস্ক্রিম তো মোটেই না। কোণ আইস্ক্রিমের শুধু কোণটা পেলে হত, সে তো হবে না… বেশ কমলা কমলা কাঠি আইস্ক্রিম হয় তো ভাল হয়! সে বললেই বলবে শুধু বরফ গলা ব্যাথা হবে। চকোবার যে খাব এই ওপরের চকোলেটটা খেতে গেলে ভেতরের আইস্ক্রিম গলে জামায় পড়ে, আশান্তির একশেষ। ওই রাত্তিতে ওই ঠাণ্ডা আইসক্রিম আবার সব তাড়া লাগায় চটপট শেষ করো চল চল দেরী হয়ে যাচ্ছে – যন্ত্রণা!

তখন আমরা ক্লাস ফোরে পড়ি। সবাই বলল এবার দুটো পুজো। কি অদ্ভুত কাণ্ড বাবা! কার ছোটবেলায় কবে এরকম দুটো পুজো হয়েছিল সেই নিয়ে জোর আলোচনা। বাড়িতে কোন মত মানা হবে, কবে অঞ্জলি দেওয়া হবে এই নিয়েই হৈ হৈ! মঠের পুজো সব একমাস আগে। এদিকে তখন ইস্কুল অপিস সব খোলা। তাহলে পাড়ার পুজোতেই অঞ্জলি দিতে হয়। সেবার ইস্কুলে সিস্টার্স অফ চ্যারিটির ১২৫ বছর। সাধ্বী বার্থোলমেয়া ও সাধ্বী জেরোসার জীবনী নিয়ে নাটক হচ্ছে, বিল্লু করছে ছোট বার্থোলমেয়ার পার্ট। একদিন রিহার্সালে ছোট বার্থোলমেয়া আসে নি। কি ব্যাপার! সেদিন হল মঠের নিয়মে অষ্টমী আর সেদিন ওর জন্মদিন। সকালবেলা পিসির সঙ্গে বেলুড় মঠে গিয়ে সেদিন বিল্লু নাকি হারিয়ে গিসল। পুজো প্যাণ্ডেলে হারিয়ে যাওয়া  এদের মামা-ভাগ্নির একটা ট্র্যাডিশন মনে হচ্ছে!

সেবার পুজোয় প্রথম টালায় বারোয়ারি পুজো প্যাণ্ডেলে আমার অঞ্জলি দেওয়া। ম্যাডামের ইস্কুলের পাশে সেবার টালা পার্কের পুজোর প্যাণ্ডেল হয়েছিল। পরের বছর পুজোর সময় আমার জ্বর হওয়ায় সেবারও আর বেদান্ত মঠে যাওয়া হয় নি। ওই বারোয়ারি পুজোয়ই জ্বর গায়ে অঞ্জলি দেওয়া।

টালায় থাকতে যাকোনো পুজোর আগে কিছুদিন আমা্র ব্যস্ততা ভীষণ বেড়ে যেত। ঠিক রাস্তার মোড়ের বাড়ির একতলায় থাকার জন্যে যেমন ঘরে জানলায় বসে বসেই পাড়া বেপাড়ার সব ঠাকুর ভাসানের প্রশেসন, আলো, তাশা পার্টির বাজনা, বিসর্জনের নাচ দেখা যেত তেমনি যেখানে যত পুজো তার চাঁদা আদায়ের জন্য দলে দলে লোকজনের আসার বিরাম ছিল না। আমার তখন একটা খুব দরকারি কাজ ছিল দুর্গা পুজো, কালীপুজো এমনকি সরস্বতী পুজোরও স-ব চাঁদার রিসিট যত্ন করে রেখে দেওয়া। পরেরবার কেউ চাঁদা চাইতে এলেই তাকে প্রথমেই আমার প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হত। ‘কোন ক্লাব?’ ‘কই আগে তো আসেন নি?’ ‘আগের বারের রিসিট দেখান।‘  ‘আগেরবার তো এত টাকা নেন নি?’ ‘এই তো আমার কাছে রিসিট রয়েছে দশটাকা এবার কুড়ি চাইছেন কেন?’ – সে এক্কেবারে কড়া পুলিসি জেরা। তাও একটা দশ-এগারো বছরের মেয়ের! তবে মা এই চাঁদা শিকারীদের হাঙ্গামা পোহাতে হচ্ছে না বলে আমায় এ ব্যাপারে কিছুই বলতো না। উলটে দরজায় কড়া নাড়লে মজা করে বলতো ওই আরেক দল এসেছে দ্যাখ!

পুজো শেষ হয়ে গেলে বিজয়া পর্ব চলত কিছুদিন। তবে আমাদের বিজয়া করতে যাওয়া মুলতঃ ওই দশমীর দিনই। সকালে হাওড়ায় ওই দুবাড়ি। তারপর এক্কেবারে দুপুর থাকতেই বেরিয়ে পড়া হত সাউথে। সেখানে গোটা চার পাঁচ বাড়ি। ঠাকুর বিসর্জনের ভিড় শুরু হবার আগেই ফিরে আসার চেষ্টা। তারপর ফিরে এসে গোয়াবাগানে আমার মামারবাড়ি, বাবার মামারবাড়ি, আরও হইত দু একটা বাড়ি – সনৎমামুর বাড়ি, ময়না মাসির বাড়ি এইরকম। মোটামুটি এই ছিল অবশ্য কর্তব্যের তালিকায়। আর ছিল লিস্টি মিলিয়ে সব্বাইকে বিজয়ার চিঠি লেখা। কুলটিতে মেজঠাম্মা, দিল্লির ঠাম্মা, আমেরিকায় ছোট্‌ঠাম্মা, রঞ্জনকাকু, জেঠু। ঠাম্মার চিঠির নিচে আমার জন্যে একটু করে জায়গা ছেড়ে রাখা থাকত। অবশ্য ওই একটা চিঠির মধ্যেই মা বাবা সবাই আলাদা আলাদা করে দু এক লাইন করে লিখত।

তবে আমার তো তখন জীবনের সব চেয়ে বড় সমস্যা খাওয়া – সে যাই খাবার হোক। বিজয়ার মিষ্টির মধ্যে খুব প্রচলিত ছিল চন্দ্রপুলি – আমার এক্কেবারে না পসন্দ। তার সঙ্গে বড় নিমকি কি গজা হলে সেও এক্কেবারেই না। পান্তুয়া-লেডিকেনি সব ভাজা জিনিসই খেলেই গা গুলোয়। চানাচুরে ঝাল লাগে। তার ওপর টালার মিষ্টি জল ছাড়া টিউব ওয়েলের জলটাও এক্কেবারে খেতে পারি না। আমার খ্যাঁদা নাকে ঘ্রাণশক্তি কিন্তু খুব তীক্ষ্ণ! এদিকে ‘বিজয়ার পর শুধু মুখে যেতে নেই’! হাওড়ার বাড়িতে টিউব ওয়েলেরই জল। কিন্তু সেখানে চুপচাপ একটা সন্দেশ আর এক ঢোঁক জল তো খেতেই হয়। শৈলীমার বাড়ি কিন্তু খুব মজা। সেখানে এতো আদর আর প্রশ্রয় যে তাতেই পেট ভরে যেত। বাবাদের ছোটবেলার যত গল্পের ঝুলি খুলে বসা হত। ওদের বাড়ির পাশে যে পুকুর ছিল সবাই সাঁতার কাটতো। বাবা বলে আগে ওই পুকুরটাই আমাদের বাড়ি অবধি ছিল। ওই পুকুরেই বাবারাও বড় দাদাদের কাছে সাঁতার শিখেছে। একবার দেখা গেল ওদের বাড়ির সামনে  একটা আমগাছের চারা হয়েছে। বাবা অমনি সেটা তুলে নিল আম আঁটির ভেঁপু বানাবে বলে। সেই আঁটি অনেক পাথরে ঘষাঘষি করাও হল, কিন্তু ভেঁপুতে আওয়াজ আর বেরলো না! আরেকবার তো জল খাই আর না খাই আমি আর বিল্লু মিলে ওদের বাড়ির টিউবওয়েল টিপে টিপে সে কি জল ভরার ধুম! আমার রোগা হাড়ে তখন যেন অসুরের শক্তি! কলকাতায় বাড়িতে তো কলের জল। মামার বাড়ির পাশে রাস্তায় টিউব ওয়েল ছিল বটে আর পাশের বস্তির সবাই সেখানে জল ও নিত, কিন্তু আমাদের সেখানে পাম্প করার সুযোগ কোথায়!

একবার দেখালো বাবাদের ছোটবেলায় হাতে লেখা, হাতে আঁকা ম্যাগাজিন। বাদলজেঠু ছিলেন তার সম্পাদক। তাতে বাবা, জেঠু, বাদল জেঠু, ছোড়দাদু বড়দাদু সবার লেখা গল্প কবিতা তো বটেই সবচেয়ে মূল্যবান ছিল বাচ্চামার (বাবাদের ঠাকুমা) লেখা বেশ কিছু ছড়া। আমি একসময় সেই ম্যাগাজিনগুলো নিয়ে এসে সেই কবিতা আমার খাতায় টুকে রেখেছিলুম। আর ছিল বাদলজেঠুর তোলা বিভিন্ন ছবি – ক্যামেরার কারিকুরি। যেমন একটা বাদল জেঠু নিজেই নিজের দু-দুটো ছবি তুলেছেন একই ফ্রেমে। আর জয়দাদার আঁকা ছবি। কি যে ভাল ছবি আঁকতো জয়দাদা!

বিজয়ার আরেকটা মজার জিনিস ছিল ছেলেদের পরস্পরের সঙ্গে কোলাকুলি। অবশ্য সেই দেখে আমি আর বিল্লুও নিজেরা কোলাকুলি করতুম। ছেলে নই বলে কি আমরা কোলাকুলি করতে পারব না! বাবার পিসোমশাই ছিলেন বিরাট লম্বা মানুষ। বাদলজেঠু আর জয়দাদাও তাই।  বাবা পিসোমশায়ের সামনেই মজা করে বলতো ‘জানিস তো আমি পৃথিবীতে দুজন লোককে ভয় পাই – এক আমার পিসোমশাই আর এক আমার শ্বশুরমশাই।‘ আমার কিন্তু কথাটা মোটেই বিশ্বাস হত না! একটুও মনে হত না ওই দুজনের একজনকেও বাবা ভয় পায়। আর ভয় পাবেই বা কেন! দুজনের কেউই তো কোনওদিন বাবাকে বকে না! তা এই বিজয়ার পর দেখতুম বাবা এই দুজনের সঙ্গেও তো দিব্যি কোলাকুলি করছে! বাবা তো মোহনবাগানের অন্ধ ভক্ত। আর বাদলজেঠু-জয়দাদা ইস্ট বেঙ্গলের। সেই নিয়ে হয় বাদলজেঠু বাবার পেছনে লাগতেন নয় বাবা জয়দাদার। মোট কথা শৈলীমার বাড়ি মানেই একরাশ খুশি।

সাউথ ক্যালকাটায় যাওয়া মানে মামু বলতো চল চল আবার আঠারো বাড়ি যেতে হবে! মানে ওখানে দুই নদাদির বাড়ি – মায়ের ন’মাসি আর ন’কাকিমা। প্রথমে যাওয়া হত পার্ক সার্কাসে সেজঠাম্মা-সেজদাদুর বাড়ি। কিন্তু তখন ওদের বাড়ি দু দুটো কুকুর। বাড়িতে বেল বাজিয়ে বাবাকে আগে বলতে হত কুকুরদের বাঁধার কথা। তবে একটু পরে মা আর আমি ঢুকতুম। অনেক সময় আগে যাওয়া হত বণ্ডেল রোডে ছোড়দাদির (মায়ের ছোট পিসি) বাড়ি। মা বাবাকে বলতো সেজদাদুদের গিয়ে আগে বলতে পরে আমি আর মা হেঁটে চলে যেতুম বণ্ডেল রোড থেকে পার্ক সার্কাস।

ছোড়দাদির বাড়িতেও ছিল অগাধ ভালবাসা। ছোড়দাদি নিজের হাতে বিজয়ার জন্যে কিছু না কিছু বিশেষ খাবার বানিয়েই রাখতেন। ডালপুরি, খাস্তার কচুরি, লবঙ্গ লতিকা, পেরাকি – কিন্তু ওসব কিছুই আমার খেতে ভাল লাগত না। ছোড়দাদির কাছে সবাই যেত এই সব রকম রকম পোষাকি রান্না শিখতে। মা ও মালপো আর দই বড়া ছোড়দাদির কাছেই শিখেছিল। শেষের দুটোই অবশ্য আমার খুব খুব প্রিয়। তবে বিজয়ার পর আমার নজর থাকত ছোট্টুমামুর দেরাজের মাথায় রাখা কৌটো ভর্তি ভাজা মশলা আর টেবিলের ওপরে রাখা রকম রকম রংবেরঙের পেনের ওপর। ফাউন্টেন পেনে যদিও নিব খারাপ হয়ে যাবে বলে আমায় লিখতে দেওয়া হত না, কিন্তু অন্য ডটপেন বা লাল-সবুজ-বেগুনি কালির রঙ্গিন পেন দিয়ে মনের সুখে হিজিবিজি কাটা যেত। আর ছিল ফটকিরি দেওয়া জল। সে আবার আরেক অভিনব ব্যাপার! জল খেতে গেলে কেমন অন্যরকম মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ! তবে আমার কাছে খাওয়ার জন্য এও সুবিধের ছিল না।

জল আর জলখাবার দুয়েই আমার জন্যে সেরা নদাদির বাড়ি। নদাদির কথায় আমি ভালবাসি বলে আমার জন্যে নিজে হাতে বনিয়ে রাখতেন ঘুগনি, কুচো নিমকি আর নারকোল নাড়ু। সেবার দশমীর পরের দিন পড়েছে মহরম। তাই সেদিনও বাবার অপিস ছুটি। সেবার তাই দশমীর দিন না গিয়ে একাদশীর দিন যাওয়া হয়েছে সাউথে। যদিও অনেক হিসেব করে যাতে পার্ক সার্কাসের মহরমের তাজিয়ায় আটকে না পড়তে হয়। যেতেই সবারই একই কথা। তোমরা তো দশমীর দিনই আসো, আমরা ভাবছি কি হল এলে না! কাল ঘুগনি করেছিলাম তোমরা আসবে বলে। তবে ফ্রিজ খুঁজে আমার মত একটু ঘুগনি ঠিকই পাওয়া গিয়েছিল।

এইভাবেই ছোটবেলার একটা পর্বের রেশ ধরেই শুরু হয়ে গেল জীবনের আরেক পর্ব।

Posted in Uncategorized

শিবের গীত

পুজো আসছে। আসছে আবার কি! এসেই পড়েছে। দেখছ না কলকাতার সব নামী-দামী পুজোর উদ্‌বোধন শুরু হয়ে গেছে। হোক না পিতৃপক্ষ, সেই কবে দেবীপক্ষ শুরু হবে তার জন্যে কেউ বসে থাকে! আসলে উদ্‌বোধন জিনিসটা একটা শিল্প, বুঝলে শিল্প! এরপর উদ্‌বোধন শিল্পেরও কত মাস আগে থেকে মহড়া দিতে হবে। সেই যে বিশপ ইস্কুলে Prize Dayর কতদিন আগে থেকেই রোজ রিহার্সাল হতো – কিরকম স্টেজের পেছনে পর পর লাইন দিয়ে বসতে হবে। তারপর নাম ডাকার পর কি রকম করে Chief guest কে bow করে তাঁর হাত থেকে prize নিতে হবে, তারপর কতক্ষণ কোন দিকে তাকিয়ে ছবি তোলার জন্যে পোজ দিতে হবে, ঠিক কতটা হাসতে হবে আর সব শেষে স্টেজের কোন দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এখানেও হয়। আসলে এ তো আর ‘আমাদের সময়’ নয়! এখন বাচ্ছাদের এক্কেবারে সেই Play School থেকেই এসব Stage management, etiquette শেখানো হয়। বলা তো যায় না, হয়তো বড় হয়ে এটাই হবে তাদের অন্যতম রুজি রোজগারের পথ। ফিতে কাটার জন্যে কার দর কত!

কথায় বলে বারো মাসে তেরো পার্বণ। আরে সে তো ছিল সেই সেকালে! এখন তো একেক দিনেই তেরো পার্বণ। এখন কি আমরা নিছক বাঙালী! কবি থাকলে আজ কিছুতেই বলতে পারতেন না ‘রেখেছো বাঙালী করে’। এখন আমরা বিশ্ব-নাগরিক। বিশ্বায়ণ, বুঝলে বিশ্বায়ণ! তাই আমাদের পুজোও শুরু হয় সেই গণেশ পুজো, না না জন্মাষ্টমী থুড়ি রথযাত্রা থেকে! লোকমান্য তিলক আজ বেঁচে থাকলে নিশ্চয় দেখে খুশী হতেন যে তাঁর স্বপ্নের গণেশ উৎসবে বাংলা শুধু হৈ হৈ করে যোগই দিচ্ছে না, তাঁর সাধের মহারাষ্ট্র পুণাকে প্রায় টেক্কা দিতে চলেছে। আর দু-এক বছর! ‘লালবাগ চি রাজা’ ছেড়ে এরপর লোকে ‘লালদিঘির রাজা’কে দেখতে ছুটবে! তোমাদের তো ওই মজে যাওয়া মূলা-মূথা – পারবে আমাদের মা গঙ্গার সঙ্গে পাল্লা দিতে! যতই গণপতি বিসর্জনের বড়াই করো না কেন, আমাদের পুজোর ভাসান রীতিমত কার্নিভাল – শিল্প, ভাই শিল্প! এসব ব্যাপারে মতামতের জন্যে ওই পুতুল পুজোর ঘোর বিরোধী রবি ঠাকুরকে কেউ ডাকে!

যাক গে যাক, যাক গে যাক – ভাসানের কথা পরে হবে। এখন তো উদ্‌বোধন। এরপর কত নতুন নতুন খেতাব হবে- উদ্‌বোধনশ্রী, উদ্‌বোধনভূষণ, উদ্‌বোধনবিভূষণ, উদ্‌বোধনরত্ন! ফিতেটা ঠিক কত উঁচুতে কত শক্ত করে বাঁধা থাকবে। কাঁচিটা ঠিক কিভাবে ফিতের কোন অংশে কিভাবে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। তার সঙ্গে মুখে ঠিক কতটা হাসি, ঘাড়টা কতটা কাত, চোখটা ঠিক কতটা তোলা, ক্যামেরা থেকে কত দূরে, কিভাবে কতটা আলো ‘নিতে হবে’, চেহারা, মেক আপ, পোষাক?

পোষাক! এইটে হচ্ছে কথা! পুজো মানেই নতুন শাড়ি, নতুন জামা। ছোটবেলা থেকে যে সেই কত কথাই মনে পড়ছে! সেই যে সেই শিবদুর্গা, ডালিয়া! শিবদুর্গায় অবশ্য বেশিরভাগ শাড়ি কাচতে দেওয়া হত – কোরা ধুতি, শাড়ি আড়ন ধোলাই। ডালিয়ার শাড়ির তখন রমরমা বাজার! খানদানি-বনেদি-রইসী খরিদ্দারের ভিড়।

সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি, কাড়াকাড়ি – ছোট্ট সরু দোকান, বসার জায়গা মেলা ভার! কি যে বিরক্ত লাগতো! তার ওপর মায়ের সঙ্গে কোনওদিন কোনো ব্যাপারেই আমার পছন্দ মেলে না। সেই যে ‘তেরো পার্বণে’ গোরা গান গেয়েছিল না –

‘দাদা যদি ডানদিকে যায় বৌদি যাবে বাঁয়ে,

দাদা যদি চিনি কম খায় বেশী চিনি দেবে চায়ে’-

পুরো সেই কেস! কিন্তু কি আশ্চর্য! বাবা যেটা পছন্দ করতো সেটা কেমন আমার আর মায়ের দুজনেরই পছন্দ হয়ে যেতো! তো সেখানে পিসির শাড়ি, জেঠিমার শাড়ি, মাইমার শাড়ি, দাদির চওড়া লাল ঢালা পাড়, নদাদির কালো ইঞ্চিপাড়, ঠাম্মার নীল-সবুজ-খয়েরি ইঞ্চিপাড় – শাড়ির পর শাড়ির পর শাড়ি। ছোটখাট পাহাড়! আর তার সঙ্গে অলোকবাবুর বিরামহীন ধারাভাষ্য। কি আশ্চর্য! এতো বয়সী, এতো বৈচিত্র্যের এতো খরিদ্দার – সবার পছন্দ যেন ভদ্রলোকের নখদর্পণে!

কখনো সখনো পিসি আর বিল্লুও সঙ্গে যেত। সেবার আমার মহা আনন্দ! মনের সুখে দুজনে মিলে গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর। মা-বাবা নিজেদের জন্যে কখনই কিছু কিনতে চাইত না। অলোকবাবু বলতেন – বৌদিদের জন্যে তো নিলেন এবার নিজের একটা নিন! কোনো শাড়ি খুব পছন্দ হয়ে গেলে অনেক সময় বাবা জোর করেই মায়ের জন্যে সেটা কিনে দিত। তাছাড়া এই লেনদেন, exchange offerএ মায়ের এমনিই তিন-চারটে শাড়ি হত। বাবা ধুতি টুতি বিশেষ পরত না। তবে একবার একটা মুগার কাজ করা ধাক্কাপাড় ধুতি সবারই খুব পছন্দ হয়ে যাওয়ায় বাবার জন্যে কেনা হয়েছিল। তখনই সেটার দাম তখনকার হিসেবে অনেক! সামনে মুনদিদির বিয়ে – বৌভাতের দিন সেজেগুজে ‘মাঞ্জা’ দিয়ে সেটা পরার ইচ্ছে। সেটা কালিপুজোর রাতে ঠাকুর বসানোর সময় একবার শুধু কোনোরকম করে পরেই বাড়ি এসে তুলে রেখে দিয়েছিল। বিয়ের সব তত্ত্ব-নমস্কারি শাড়ি কিনতে তখন ওই দোকানে যাওয়াই হচ্ছে, তাই হাতে অনেক সময় নিয়েই সেই ধুতি কোঁচাতে দেওয়া হল। দুঃখের বিষয় সেই বাবার কেনা এবং একবার পরা ধুতিটি কোনো এক রইসী খরিদ্দারের চোখে পড়ে যায়। তা সেটি যেকোনো লোকেরই চোখে পড়ার মতো ছিল তো বটেই! কাজেই তারপর থেকে যতবারই সেই কোঁচানো ধুতি আনতে যাওয়া হয় সবসময়ই শোনা যায় কাল আসুন, পরশু আসুন…। এদিকে বিয়েবাড়িতে অনেক কাজ। দিন এগিয়ে আসে। গাড়ি ড্রাইভার বলতে তো তখন ওই বাবাই। তার মধ্যে অযথা দোকানের চক্কোর কাটার কার সময়! শেষে একদিন মা আর বাবা রাগে গরগর করতে করতে একটা অন্য ধুতি হাতে বাড়ি ফিরল। তাতে কোথায় মুগা! সাদা ফ্যাটফ্যাটে পাড়ে জরি ক্যাটক্যাট করছে। আবার এই নকল ধুতির জন্যে আরও কিছু আক্কেল সেলামী দিতেও হয়েছে! এমনিতে বাবা আমার সদাশিব, অজাতশত্রু। কারুর সঙ্গে ঝগড়া, বচসা, কথার কচকচির ধার দিয়েও যায় না। কিন্তু কোনও কারণে একবার মেজাজ বিগড়ে গেলে – ব্যাস্‌। কাজেই এরপর মা বা বাবা আর দ্বিতীয়বার ওই দোকানমুখো হবে না বলাই বাহুল্য।

বড়দের শাড়ি তো হল। আর ছোটদের! সে হবে সেই হগ সাহেবের ডেরা থেকে। সেও সব দাদির পছন্দের দোকান, দর্জি। তখন তো আর এখনকার মতো readymade এর যুগ নয়। প্রথমে কাপড় কেনা, তারপর বানানো। মোটামুটি দুপুর থেকে রাত। এ দোকান সে দোকান ঘুরে ঘুরে ছিট দেখেই যাচ্ছে, দেখেই যাচ্ছে। মুনদিদি, চিল্লুদিদি, বিল্লু, বুড়ি, পুতু, রূপু; তারপর দাদা, মামু, বাবুদাদা, ডাকুদাদা … দীর্ঘ লিস্টি। দোকানে না আছে বসার জায়গা না জল! কি বিরক্তি, কি বিরক্তি! খুব স্বাভাবিক একটু পর থেকেই আমার ঘ্যান্‌ঘ্যান আর মায়ের বকাবকি। তারপর সারা বছরে নববর্ষ, পুজো, জন্মদিন মিলে সবার দেওয়া রাজ্যের ছিটকাপড় বস্তা বোঝাই করে দর্জির দোকান।

গ্লোবের পেছনের রাস্তায় সেই ইংরেজ আমলের এক ভুতুড়ে বাড়ির ওপরতলায় সেই দর্জি। দাদির পছন্দের লোক বাবাঃ। মোটামুটি আমার ছ’টা জামা হতো। তাতে দুর্গা পুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো দিব্যি চলে যেত। মাঝে মাঝে ওই সঙ্গে জন্মদিনেরও একটা জামা। পুজোর পরেই annual পরীক্ষা। শেষ হতেই পরের দিন জন্মদিন, কাজেই!

রাঙ্গাদাদু আমায় ছোটবেলায় বলতেন গাবলু। ছোড়দাদু বললেন গাবলু এখন পেংলু হয়ে গেছে। সেই পেংলু প্যাঁকাঠির ছ’টা জামার ডিজাইন বাছতে অন্ততঃ বারোটা বই আর ঘণ্টা তিনেকের মামলা। তারপর সেই – মার যেটা পছন্দ আমার সেটা কিছুতেই পছন্দ হয় না। না আছে পকেট, না আছে বেল্ট। আর আমার পছন্দ? প্রশ্নই নেই। প্রথমে কিছুক্ষণ একটা আধটা রংচঙে বই উলটে পালটে আমার তখন নজর পুঁটলি পুঁটলি বাতিল হওয়া ছাঁট কাপড়, লাল-নীল-সাদা খড়ি, মাপের ফিতে আর – একসঙ্গে কত সাইজের কত কাঁচি! বারান্দার এক কোণে সেসব নিয়ে আমি বেজায় ব্যস্ত। তারপর মাপ দেওয়া, একদিন আবার Trial দেওয়া! অত্যন্ত বোরিং!

তো সেই দর্জি বুড়ো হয়ে গেল। নিজে আর সব জামা করতে পারে না, সময়মতো দিতেও পারে না। কাজেই কালের নিয়মে তার পর্ব মিটল। পিসি বলল হাতিবাগানে সুশ্রী টেলার্স বেশ ভাল। আমারও ‘বেশ ভাল’। বিল্লু আর আমি একসঙ্গে যাই জামা করাতে। বেশ একরকম জামা হবে কি মজা! ও মাঃ, জামা পরতে গিয়ে দেখি কোথায় একরকম! বিল্লুর জামায় কেমন সুন্দর বেশী বেশী পকেট। আবার সিস্টারদের মতো পাশে পকেট। তখন ফ্রকে পাশে পকেট নতুন নতুন উঠছে। আর আমার যদি বা কোনও জামায় সামনে এক আধটা পকেট আছে, সে এত্তো ছোট তাতে তো কিছুই রাখা যায় না! আর জামার হাতা? ওর কি সুন্দর লম্বা প্লেন হাতা A-line ফ্রক, আর আমার বেলায় সেই কোমরে একগুচ্ছের কুচি দেওয়া বোকা বোকা ঘটি হাতা জামা। অসহ্য! ঘটি হাতা কুঁচি দেওয়া জামা হলে নাকি একটু কম রোগা দেখাবে! আমাদের ছোটবেলায় কেন যে এরকম zero figure craze ছিল না! তাহলে আমার Miss Zero Figure খেতাব জেতা কে আটকাতো!

সুশ্রীর পর এল উদ্দিন। মানে তখন সুশ্রীতে এত ভীড় যখনই যাওয়া হয় বলে দেরী হয়ে গেছে আর অর্ডার নেওয়া হবে না! আর এত ভীড়ে Miss Zero Figure এর জামা যে ভুল্ভাল হবে বলাই বাহুল্য! তখন অল্টার করার সময় নেই। আর কোনওকিছুই একবার বিগড়োলে  তাকে সিধে করা নেহাতই দুরূহ – সে জামাকাপড়ই হোক কি সম্পর্ক, গানের সুর হোক কি কলকব্জা, অথবা ছেলেমেয়ে সন্তান সন্ততি!

উদ্দিন বাড়িতে এসে কাপড় আর মাপ নিয়ে যেত, তারপর আবার বানিয়ে দিয়েও যেত। কিন্তু তার ছিল দুটো মুস্কিল। ওর কাছে কোনো ডিজাইনের বই ছিল না। মন থেকে নয়তো ম্যাগাজিন দেখে বলতে হত। আর যতই বলা হোক একটু ঢিলেঢালা জামা বানাতে সে ততই tight fitting করতো। ফলে আমাকে দেখে মনে হত একটা সরু কাঠির গায়ে কাপড় পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে উদ্দিনের কাছে যেটা থাকতো সে হল রাজ্যের গল্প। ওর কাছেই প্রথম শোনা আজমীর শরিফের মাহাত্ম্য, কিংবা ইসলাম ধর্মের অনেক খুঁটিনাটি রীতি-রেওয়াজ।

আবার নিউ মার্কেট, এবার French. হরেক রকম ডিজাইনের ফ্রক, স্কার্ট, জ্যাকেট পরা হল কিছুকাল। তারপর সবাই বলল French বড্ড বেশী চার্জ নেয়। পাশেই সুষমা সস্তা অথচ ভাল। সেও গেল কিছুদিন। কিন্তু দিনে দিনে ভীড় বাড়তে লাগলো সব জায়গাতেই। আর ইস্কুল অফিসের ঝামেলা সামলে মানুষ কতদিন আগে থেকেই বা পুজোর বাজার করতে পারে! Baggy design এর ঢোলা জামা আর readymade dress এসে কিছুদিনের জন্যে মুক্তি পাওয়া গেল। কিন্তু ওই রোজই ফ্যাসন পালটায়!

পৃথিবীর কোনও পোষাকই আমার জন্যে মানানসই হয় না! নিজের আলমারি ঘেঁটে দেখি সবরকম মাপের জামা আর ব্লাউজে ভাঁড়ার বোঝাই! মানে আমি একাই সচ্ছন্দে একটা দোকান দিতে পারি। সব জামাই আমার মতে আমার দিব্যি হয়! তবে কথায় আছে কিনা ‘পররুচি পহননা’। আমাকে দেখে লোকের যখন সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায় তখন রকম রকম উপদেশাবলী আমার ওপর বর্ষণ হয়।  পুণায় একজন লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই বসলেন ‘tailor change কিজিয়ে’।

সালোয়ার কামিজ, কুর্তি নাহয় রেডিমেড দিয়ে কাজ চালানো গেল, কিন্তু ব্লাউজ? অনেক দোনামোনা করে একজনে কাছে গেলুম। এক্কেবারে পাশের ফ্ল্যাট। মা তাকে দিয়ে অনেক ব্লাউজ ইতিমধ্যে করিয়েছেন। অনেক মাপজোপ, অনেক আনুসঙ্গিক চাহিদা – ঝুল বড় চাই, গলা ছোট, গায়ে ঢোলা – মানে ব্লাউজ না হাফ শার্ট বোঝা দায়। এরকম দাবি মানতে লোকের বয়েই গেছে! কাজেই ব্লাউজ আসার পর দেখি সে আর অঙ্গেই উঠছে না। সেই ইস্কুলে ব্লাউজ তৈরী শিখেছিলুম না, যার কোনও মাপ জোপের বালাই নেই! দেখে শুনে ভাবি বললেন ‘আপকা চেহরা থোড়া আচ্ছা হো গয়া’! বোঝো কাণ্ড! বাংলা করলে দাঁড়ায় ওই মাপ দেওয়া থেকে ব্লাউজ পাওয়ার মধ্যের সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই আমি একাই লোরেল-হার্ডির গল্প হয়ে গেছি! ফলম্‌ – ভাবি মহা নিষ্ক্রমণম্‌।

গাড়ি হাঁকিয়ে রোজ কলেজ যাই। হাঁকিয়ে না কচু – বিশুদ্ধ কাঁপতে কাঁপতে ইষ্টনাম জপতে জপতে! তা কলেজ পাড়াতেই কে কে মার্কেট, সেখানে অনেক টেলার। খুঁজে খুঁজে একজনের কাছে গেলুম – পতঙ্গ। তখন বাড়িতে এদিক ওদিক করে বেশ কিছু dress material জমেছে। তা প্রথম খেপে পতঙ্গ সময়ের আগেই সব জামা করে দিল। আর সবই বেশ ভদ্রস্থ। মনটা বেশ খুশী খুশী। অতি উৎসাহে ওখান থেকেই আরও দু-একটা কাপড় কিনে ফেলা গেল। পাশেই তো সারি সারি দোকান। ব্যস্‌, সব খেল খতম! এরপর বেশ কদিন আমার দৈনিক কাজ হল কলেজ ফেরতা পতঙ্গকে জামার জন্য তাগাদা দেওয়া। আজ দিচ্ছি আর কাল দেব! অতি কষ্টে সে যাত্রায় পতঙ্গর কামড় থেকে মুক্তি মিলল। না কি পতঙ্গের আমার হাত থেকে মুক্তি!

রূপালী বললে ‘শান্তিনী’ ভাল। ওম্‌ শান্তি! কুছ পরোয়া নেহি। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইন্দিরানগরের মোড় থেকে বাঁ দিকে গেলে কে কে মার্কেট আর ডান দিকে বেঁকলেই শান্তিনী। শান্তিনীও প্রথম প্রথম নির্দিষ্ট  দিনের আগেই জামা দিয়ে দিত। তবে একবার করে পাশের দিকের একটা করে সেলাই খোলাতে হত। আমার কেমন মনে হত ওরা ইচ্ছে করে একটা করে সেলাই বেশী দেয় আবার করে খুলবে বলে! কিন্তু জীবনে শান্তি কি বেশীদিন থাকে। আবার নতুন শহর আবার ‘রাম সে গিণা’।

এখানে এসে ওব্বাবা সোসাইটির মধ্যেই tailoring shop! সবাই দেখি জামা কাপড় করাচ্ছে, সব সময়ই ভীড়। একদিন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলুম ‘ফলস্‌ পিকো করতে কত নেন?’ কি ঘ্যাম রে বাবা! তিন তিনবার জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর নেই! শেষকালে বললে ‘সময় হবে না’! দুত্তোর, নিকুচি করেছে এমন টেলারের! ‘আমি কি ডরাই সখি!’ গজগজ করতে করতে বাড়ি ফিরে নিজেই বসিয়ে ফেললুম ফলস্‌ পিকো, একটা কুর্তির হাতা। ভারি তো সেলাই! এইসব বাজে কাজের জন্য অযথা তেল মারতে পারব না বাপু! মা বলল তবে সেলাই শিখেছিসই বা কেন? আরে সেলাই তো শিখেছিলুম কাঁচি দিয়ে কুচকুচ করে কাপড় কাটব বলে। বাবা বলত না আমায় ‘কাঁচি পাগলা’! ঠিক আছে দেখিয়ে দিচ্ছি কেন সেলাই শিখেছি আর কেমন সেলাই শিখেছি!

রে রে করে একটা সালোয়ার কামিজ তৈরী হয়ে গেল। বাড়িতে সবাই বলতে লাগলেন একদিনে অত কোরো না ঘাড়ে ব্যথা হবে। কে শোনে কার কথা! কিন্তু এ তো নেহাত সুতির কাপড়। আলমারিতে যে সিল্ক আর সিন্থেটিক কাপড় পড়ে রয়েছে তার কি হবে! তাছাড়া বেশিক্ষণ কোনও কাজ করা আমার পোষায় না বাপু!

গুরগাঁও এসে সবচেয়ে লাভজনক আবিষ্কার ব্যাপার কেন্দ্রে বুড়োর দোকান। বড়বাবু বলে ‘chinless দাদু’। সেই প্রথম দিন থেকেই কি খাতির! বলে আরে আপনি কি আমার দোকানের আজকের কাস্টমার! সেই কবে থেকে আসছেন! তাই বটে! নির্ঘাৎ পূর্ব জন্মের হিসেব। কারণ এ জন্মে তো এই সবে এ শহরে এলুম।

দাদুর দোকানে সবচেয়ে বড় সুবিধে আমায় কিছু বলতে হয় না। দাদুর ছেলে এক্কেবারে ঠিক ঠিক মাপ মত আর পছন্দসই জামা বের করে দেয়।

কর্তামশাই বললেন চল দাদুর দোকানে গিয়েই বলবে একটা  ভাল দর্জির সন্ধান দিতে। এখানে সব দোকানের সামনেই একজন করে সেলাই মেসিন নিয়ে বসে থাকে, টুকটাক ঝুল ছোট করা হাতা লাগানো এসব করার জন্য। দাদু বললে একেই দাও না। কোনও অসুবিধে নেই। তোমার যেমন চাই, যবে চাই করে দেবে। আমি ‘গ্রান্টি’ দিচ্ছি। দাদুর কথায় ঝোলা ভর্তি কাপড় তাকেই দিয়ে ভারমুক্ত হলুম। সমস্যা সেই কোনও বই নেই ডিজাইন বাছার। কাজেই ভুল্ভাল দর্জি, ভুল্ভাল ডিজাইন, ভুল্ভাল মাপ। মানে – ‘ভুল, সবই ভুল’! দর্জিদের একটা বিরাট গুণ যেদিন জামা দেবে বলে লিখে দেয়, সেদিন কিছুতেই দেয় না। এদিকে দাদুর তো পুরো প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন! শেষে কর্তামশাই আর ‘chinless দাদু’র যৌথ চাপে বেচারা স্যান্ডউইচ দর্জি কাঁচুমাচু মুখটি করে কথা দিল পরের দিনই বাড়ি এসে সব জামা দিয়ে যাবে। নাঃ, সে যাত্রা কথা রেখেছিল। বরং আমার ট্র্যাক রেকর্ড ভেঙে বেশ ভালই সেলাই করেছিল!

পরেরবার তো আমার সাহস গেল বেড়ে। আগেরবারের ভরসায় যেখানে যত ভালভাল সিল্কের কাপড় – কামিজ-কুর্তি, ব্লাউজ – সব একসঙ্গে নিয়ে হাজির! ওমা, কোথায় কে! সব ভোঁ ভা। দাদু বললে – ও সে ভারি ‘বদমাস’, তাকে দিয়েছি দূর করে। দেখি তার জায়গায় বসে কিশোর কুমারের ‘হাফ টিকিট’ সিনেমায় ‘চিল চিল চিল্লাকে’ গানে ট্রেনে বসে বকের মত মুণ্ডু নাড়া এক লোক! স্বভাবতঃই হ্যাঁ, হ্যাঁ করে দাদু সেই বকদর্জির অনেক গুণ গাইলেন আর আমিও ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি ভেবে ঝোলা সুদ্ধু তার জিম্মা করে দিলুম।

ডিজাইন? সব ‘এক সে বড়কর এক’। প্রথমেই বাপীর ভাষায় ‘তারার সঙ্গে ভেড়া’ মানে sea green raw silk এর ঘাড়ে কড়া রাণী কালারের সুতির ব্লাউস পিসের জোড় দিয়ে একটা হযবরল। তারপর একটা কটসুলের কাপড় – সামনে শীত আসবে বলে পুরো গলাবন্ধ, পুরোহাতা পাঠানী কাবুলিওয়ালা মার্কা কুর্তি – কর্তামশাই এর ভাষায় ছেলেদের না মেয়েদের বোঝার উপায় নেই! তারপর ওই মরালগ্রীবা টেলারসাহেবের হাতে পড়ে সে ওই একমাত্র বক অথবা জিরাফ ছাড়া কারুর গলায় ফিট হবে না! ব্লাউজ তো এত বছরের এত পরীক্ষা নিরীক্ষার পর পুরোপুরি ‘ভজা’ – মানে ভগবান জানেন! তার যে আবার ডিজাইন, কাট ইত্যাদি, প্রভৃতি বলার দরকার ছিল সে তো আমার অতি ঊর্বর মাথাতেই আসে নি! ওদিকে বাইরে যখন এই সব তুলকালাম চলছে তখন দোকানের ভেতর থেকে কর্তামশাই হাঁকডাক করেই চলেছেন, ‘ওসব ছেড়ে এক্ষুনি এদিকে এসে বল কোন জামা পছন্দ’। পরের দিন জামা আনতে গিয়ে তো মাথায় হাত! সবই পাতে দেবার অযোগ্য! ওই কুর্তিগুলোর কথা নাহয় বাদই দিলুম। কিন্তু আমার এত শখ করে কেনা মেখলার ব্লাউজ! চোখ ফেটে জল আর তার সঙ্গে কর্তামশায়ের বকুনি। ভাল করে দেখে দেবে না! ঘুরতে ঘুরতে সেই আগেরবারের ‘বদমাস’ দর্জিরও দেখা মিলল। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আর কোনই লাভ নেই। যা বুঝলুম এসব alter করা বকবাবাজীর কর্ম নয়! তবু কিছু করানোর ব্যর্থ চেষ্টা যে হয় নি তা নয়। তারপর নিজের কিছু কারিকুরি আর অসংখ্য সেপ্টিপিনের ভরসায় ব্লাউজ তো পরা হল; কিন্তু ওই ‘তারার সঙ্গে ভেড়া’!

কাজ করা ব্লাউজপিসটা বন্ধুর ভালবেসে দেওয়া আর সিল্কের পিসটা কর্তার। সেই থেকে মতলব ভাঁজছি কি করা যায়! ভয়ে নতুন শাড়ি কেনাই ছেড়ে দিয়েছি! এদিকে রোজ বাড়িতে ঢুকতে বেরোতে, বারান্দায় দাঁড়াতে নিচের দর্জিকে দেখা যায়। সবসময়ই একটা কর্মচঞ্চলতা। একা নয়, সঙ্গে আ্ররও তিন-চারজন কারিগর। রোজই পাঁয়তাড়া কষি একবার যাব কি যাব না! প্রায় একমাসের প্রচেষ্টায় অবশেষে দুগ্‌গা বলে গিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললুম – একটা ব্লাউজ বানিয়ে দেবে? কিম্‌ আশ্চর্যম্‌ অতঃপরম্‌! খুব ভাল করেই শাড়ি থেকে মাপ করে ব্লাউজপিস কেটে ব্লাউজ করে দেবে বলল! বোধহয় এতদিন ধরে দেখে দেখে পুরো ছিটগ্রস্ত বদ্ধপাগল ভেবে আমার ওপর তার দয়া হয়েছে! কারণ এক কথায় সেই ‘তারা-ভেড়া’র ঝামেলাও মেটাবার চেষ্টা করবে বলে কথা দিল!

এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে। তক্ষুনি আবার হাজির হই ‘তারা-ভেড়া’ আর বাকি টুকরো কাপড় নিয়ে। কিন্তু নিজেরই মতের ঠিক না থাকলে যা হয়! আজ গিয়ে বলি এই ডিজাইন করে দাও। কালই আবার বলি না, না পালটে এরকম কর। সুবিধেও খুব – একবার নিচে নামলেই হল। প্রথমে বলেছিল কাপড় আর যা লাগবে কিনে এনে দেবেন। আমিও বলি – না বাপু, ওসব তুমিই এনো। তারপর বাড়ি এসে বাক্স হাতড়ে খানিকটা অস্তরের কাপড় হাতে হাজির হই – চলবে! সেই না দেখে সে তো অজ্ঞান হয়ে যায় আর কি! আমার ওপর যেটুকু ভরসা ছিল সেও গেল। বলেছিল কাপড়ের স্যাম্পেল দেখে যাবেন। আমার স্যাম্পেল দেখে পরে বলল আমিই আপনাকে খবর দেব। আমিও বসে আছি – এই খবর দেয়। কোথায় কি! এই করে করে জামার delivery date এসে গেল। তাও দিন দুই পার করেই গেলুম। তবু মনে স্থির বিশ্বাস ও জামা কিছুতেই হয় নি। ওমা, বলে কি সব রেডি! আর সেই কালো জামা? সেও রেডি! স্যাম্পেল না দেখিয়েই! নাঃ, সে প্রয়োজন আর বোধ করে নি।

এত সহজে সব মিটবে! বাড়ি এসে জামা পরতে গিয়ে দেখি সেই এক কেস! এক সপ্তাহের মধ্যেই ‘চেহরা আচ্ছা হো গয়া’। চিরকালের অভ্যাসমত একেও পৈ পৈ করে বলে এসেছিলুম ভেতরে কাপড় রাখবে আর বেশ ঢোলা ঢোলা করে করবে। হায় রে, এই তার নমুনা! মোবাইলে ছবি তুলে নিয়ে আবার যাই বড় করাতে। আর – কি সাহস! সঙ্গে করে নিয়ে যাই আরও একটা ভালো শাড়ির ব্লাউজপিস। আর? একটা রেডিমেড ঢলঢলে ব্লাউজ। বলি এরকম কাটের করে দিতে পারবে না বুঝি! বলে কেন পারব না? আমি তো জিজ্ঞেস করেছিলাম। ঠিকঠিক মাপমত ব্লাউজ দিলে খুব ভালই হয়। আমি বলি – তা মেপে দেখ দিকি এটার কি অবস্থা? মাপতে গিয়ে তো তার চোখ কপালে। বলে এতো দেখি তিন ইঞ্চি বড়! আচ্ছা ঠিক আছে মাপে এক ইঞ্চি করে বাড়িয়ে দিচ্ছি। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তাকে এইরকম বিচিত্র মাপ, বিচিত্র নমুনা আর বিভিন্ন বিচিত্র নির্দেশ দিয়ে ফিরতে ফিরতে ভাবি – আরেকবার যাব না কি? কিছুই তো লিখে নিল না! আদৌ কোনও কথা শুনবে তো! এবার যতক্ষণ না সব জামাগুলো আবার ফেরত পাচ্ছি বিভিন্ন দুর্ভাবনা আর দুঃস্বপ্নে এখন আমার বিনিদ্র রজনীযাপনের পালা।

কালই ঘটেছে বাপু এতো কাণ্ড, তাই আজ ধান ভানতে এই শিবের গীত।।

P.C. : Google images.