Posted in Uncategorized

বাপী ডা-ব খাবি রে!

উত্তর ভারতের হাড়কাঁপানো শীতটা গেছে কি যায় নি, নতুন গরম ভাল করে পড়তে পেল না, শুরু হয়ে গেল হাত চুলকানো, পা চুলকানো। উফ্‌, আর পারা যায় না বাপু! কদিন আগে গরম মোজা পরেও পায়ের আঙ্গুল ফেটে রক্ত – Frostbite! এখন সুতির মোজাও পায়ে দেবার উপায় নেই – এলার্জি, আমবাত, পেটগরম! সেই হযবরল-র মত কে যেন কানের কাছে বলছে – “বাপী, ডাব খাবি রে!”

ছোটবেলায় ডাবের জল জিনিসটা মোটেই সুবিধের বোধ হত না। কচি ডাব – খা, খা। দূর্‌ বিচ্ছিরি, কেমন নোনতা নোনতা। কেন বাপু নারকেলের জল তো কেমন মিষ্টি! আরে শাঁসওয়ালা ডাব মিষ্টি হয়। শাঁস! সে তো আরোও বাজে – ল্যাতল্যাত করছে। মানুষে খায়! কিসস্যু খেতে শেখে নি রে মেয়েটা! শাঁসটাই তো ভাল রে। ভালো না কচু!

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর নতুন জামাইবাবু বললেন চল আমাদের সঙ্গে দুদিন দীঘা ঘুরে আসবে। বেশ কথা। জামাইবাবু বেজায় স্বাস্থ্যসচেতন। নো ভাজাভুজি, নো কোল্ডড্রিংস। সমুদ্রের ধারে এসেছ সারাদিন ঘোরো আর মনের সুখে (না কি দুখে!) ডাব খাও। এতদিন শুনতুম এই বিকেল হয়ে গেছে, সন্ধ্যে হয়ে গেছে আর ডাব খাওয়া যাবে না, ঠাণ্ডা লাগবে। দীঘায় গিয়ে জামাইবাবুর তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডাব – সকালে ডাব, সন্ধ্যায় ডাব, খাবার আগে ডাব, খাবার পরে ডাব। জল ফুরোলেই শাঁস আর শাঁস ফুরোলেই জল! সোনা মুখ করে খেয়ে যাচ্ছি – আরে ভাই ‘পেস্টিক’ কা সাওয়াল! কিছুক্ষণ পরে মনে হল কই শাঁসটা তো সেইরকম বিচ্ছিরি ল্যাতল্যাত করছে না! বেশ তো খেতে! নির্ঘাৎ কলকাতার ডাবওলারাই ইচ্ছে করে বাজে জিনিস দেয়! আর ডাবটা তো নারকোলের চেয়েও ভাল! অনেক জল – যেমন ঠাণ্ডা, তেমন মিষ্টি – ওই গরমে প্রাণটা সত্যিই জুড়িয়ে যায়! নাঃ, এই দীঘার ডাবগুলোই ভাল।

কিছুকাল পর ‘খাস কলকাত্তার মাইয়া’ ‘বিয়া কইর‍্যা’ চালান হলুম বড়িষা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি গাড়ি চলছে তো চলছে। পথ যেন ফুরোয় না! আমার বলে গড়িয়াহাটই সিলেবাসের বাইরে! বাজার করতে গেলে বড়জোর নিউ মার্কেট, আর ছোটোবেলায় বেড়াতে যেতে আলিপুর চিড়িয়াখানা – ব্যস্‌, কলকাতার ভূগোল ওখানেই ইতি। শ্বশুরবাড়ি যৌথ পরিবার, সবাই মিলে এক বাড়িতে থাকা। বাড়ির পেছনে বাগান – সেখানে অন্ততঃ ১২ / ১৪ টা নারকোল গাছ। সন্ধ্যেবেলা টিভি দেখতে বসেছি কিংবা রাত্তিরে শুয়ে আছি হঠাৎ আওয়াজ – দুম্‌। প্রথম প্রথম চমকে উঠে শুনি ও কিছু না গাছ থেকে নারকোল পড়ল। আর ঝপাং করে আওয়াজ মানে তাদের সলিল সমাধি! পেছনের খোলা নালায় পড়ে ভেসে ভেসে হুস্‌। বাগানে মাঝরাত্তিরে নারকোল পড়লে ভোর হতে হতে তারা সাফ্‌। দিনদুপুরে পড়লে কোন কোন সময় মা কি বাপী কুড়িয়ে এনে ডিভানের তলায় রেখে দিতেন।

লক্ষ্মীপুজোয় সেই নারকোলের নাড়ু করতেন মা। অন্যসময় সেখান থেকেই দিতেন নাতনিদের – নিয়ে যা মুড়ির সঙ্গে খাবি। নয়তো বলতেন মাকে বলবি রান্নায় দিতে। বাগান মেজোজেঠুর। কাজেই দ্বারভাঙ্গা থেকে ছোটুদা এলে ডাব-নারকোল, আম এসব পাড়াতেন। যদিও যত্নের অভাবে আমগাছে তখন পোকা লেগেছে। ঝড়ে পড়ে যাওয়া কাঁচা আমের চাটনি-আচার খেলেও নিজেদের বাড়ির বাগানের ভালো গাছের পাকা আম আমার খাওয়া হয় নি। পাকা আম সবই পোকা ভর্তি। কিন্তু ছুটির দিন বেলার দিকে ডাব-নারকোল পাড়াতে পাড়াতে বাগান থেকে ছোটভাইকে হাঁক দিতেন, “ডাব খাবি রে?”

হালকা শাঁসওয়ালা মিষ্টি জল প্রাণটা জুড়িয়ে যেত। জল খাওয়া হয়ে গেলেই বাপী কাটারি হাতে রেডি। ততদিনে সবার ধারণা হয়েই গেছে ‘বউমা ডাবের হালকা শাঁস খেতে ভালবাসে’। বাড়িতে নারকোল গাছ থাকায় বাড়ির ছেলেরা সবাই ডাব-নারকোল কাটায় এক্কেবারে expert. আর বাইরে থেকে দেখে কেমন বুঝতে পারেন কোনটা কচি, কোনটায় হালকা শাঁস, কোনটা জল বেশি!

ঠিক যেমন বাবা এমনিতে রান্নাঘর না মাড়ালেও ছুরি দিয়ে নিমেষের মধ্যে নারকোল টুকরো করে দিতে পারে! তখন বাবার ছোটবেলার গল্পে শোনা হাওড়ার বাড়ির নারকোলের ছাদ আর ডাবের জলে ফোটানো ছুঁচোবাজির মসলা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

পুণায় কলেজ যাবার পথে বিব্বেওয়াড়ির সিগনালে ঠেলা করে ডাব বিক্রি হত। আর তার দাম দেখে মনটা হু হু করে উঠতো বেহালার বাড়ির জন্যে। যদিও সেই নারকোল গাছের শেকড়ের ঠেলা সামলাতে আমাদেরই বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ঘরের মেঝে সারাতে গিয়ে দেখা গেল যত খোঁড়া হচ্ছে শুধুই নারকোলের শেকড়। মাটির ওপর একপেয়ে সরু লম্বা গাছ দেখে কে ভাবতে পারে মাটির নিচে লোকচক্ষুর আড়ালে ধীরে ধীরে সে কি বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসে আছে! তবে ভেবে দেখলে মনে হয় ঠিকই তো – সমুদ্রের পাড়ে নরম বালিতে দাঁড়ানো সারি সারি নারকোল গাছ কত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের উপকূলরেখা রক্ষা করে আসছে!

যা হোক, পুণায় পরীক্ষার পর কলেজে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি হয় কিন্তু আমাদের হয় না! ধাঁ ধাঁ গরমে রোজ নিয়ম করে কলেজে গিয়ে বসে থাকতে হয়। আজ ISO কাল NBA পরশু NAAC। আর বাইরের রোদের দিকে তাকালে আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা কারুর মনে হয় না। নিয়মিত আটঘণ্টা কখন দেখি দশঘণ্টা হয়ে গেছে! সেবার ওইরকমই ছুটি তবু ছূটি নেই এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল ক্যান্টিনে ‘নারল পানী’ পাওয়া যাচ্ছে। উফ্‌, আমাদের পায় কে! রোজই দুপুরবেলা ‘দাজি’কে পাঠানো হয় প্রায় আধ ডজন ডাব আসে। আহা, কি মিষ্টি ঠাণ্ডা জল! প্রাণ তো জুড়োলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাথার পোকাও তো নড়ল জল যখন এতও মিষ্টি নিশ্চয় ‘হালকা মালাই’ আছে। সেটা ফেলে দেওয়া মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু সেই শাঁস বার করতে গিয়ে নাভিশ্বাস ওঠার দাখিল! মালাই যতটা ‘হালকা’ বলে মনে করা হয়েছিল দেখা গেল ঠিক তার উলটো। বরং তাকে ‘মালাই’ না বলে ‘নারকোল’ বললেই মানায় বেশি।

ডাবের মুখ চামচ দিয়ে তো কোনোভাবেই বড় করা যাচ্ছে না! সবার জিনিসপত্র হাতড়ে হাতড়ে বেরোলো পেনসিল কাটার ছোট্ট ছুরি, Examএর দড়ি কাটার ভোঁতা ছুরি, তস্য ভোঁতা একটা কাঁচি। এই অস্ত্র নিয়ে কি যুদ্ধ জেতা যায়? তাই বলে ‘হাম তো ছোড়নেওয়ালে নেহি হ্যায়!’

সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মত ‘আক্রমণ!’ বলে তড়িঘড়ি সবার টেবিল থেকে বইখাতা কাগজ পেনসিল উধাও। যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত। সেখানে শুধুই জলশূন্য ডাব, ছুরি, কাঁচি আর চামচ! সবাই পাল্লা দিয়ে মালাই বার করার চেষ্টায় রত। এতটুকু মালাই বেরোলেই ‘ইউরেকা’! সবাই এতই মগ্ন যে কোন সময় পুরো Civil Engineering team inspect করতে এসেছে কারুর খেয়ালই নেই! ‘আরে ইধার তো ম্যাডাম লোগো কি নারল পার্টি চল রাহা হ্যায়’ – হঠাৎ সে কথায় চমক ভাঙ্গল সবার। হায় হায়, কি বেইজ্জত! ভাগ্যিস ওই টিমের সঙ্গে ডিরেক্টর স্যার কি HoD এসে পড়েন নি! স্টাফরুমে বসে গরমে ‘নারল পানী’ খাওয়ার সেই দিনই ইতি তো বটেই এমন কি শুনলুম রাতারাতি ক্যান্টিন থেকেও ‘নারল পানী’ উধাও!

এবাড়ির ছোট ছেলে্র তার মায়ের ছোটবেলার মতই ডাবের নরম শাঁস বিলকুল ‘না পসন্দ্‌’। সেও যখন ডাবের শাঁস দেখে বলে নারকোল দাও না আমার মনে হয় একেই কি বলে ‘runs in the blood!’ কিন্তু যখন সে ডাব কাটার জন্যে চামচ, ছুরি আর bottle opener নিয়ে ‘সরো, সরো’ করে তার বাবার সঙ্গে ঠেলাঠেলি করতে থাকে আমার মানস চক্ষে ভেসে ওঠে কাটারি হাতে আমাদের বাপী, বাপীর ছেলে আর বাপীর ছোট নাতির মুখ – সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলেছে!!

P.C. Google Images

Author:

I do whatever I like and whenever I like :) ;P

Leave a comment