বিধান নিবাস পর্বঃ
কৈশোরের শুরুতেই চলে এলাম বিধান নিবাসে। সেখানে সব নতুন রকমের অভিজ্ঞতা। পঁচিশে বৈশাখে প্রভাত ফেরী, দোল উৎসব – সে তো হল। শুনলুম সোসাইটির মধ্যেই নাকি দুর্গা পুজো হবে। কি কাণ্ড! আমরাই সবাই মিলে নাকি পুজো করব। আবার ফাংসনও হবে! নৃত্যনাট্য, নাটক এরকম সব কত কি! এসবই আমার কাছে এক্কেবারে নতুন অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে নাচ – ও আমার ‘আসে না!’ বুবুদি আর বুবাইদি খুব ভাল নাচ করে। ওরাই বাকিদের শেখাবে, আর গানের দায়িত্বে চন্দ্রাদি। শুনলুম রবি ঠাকুরের ‘শ্যামা’ হবে আর আমরা সব নাকি গ্রামবাসী।
সেবার বিশ্বকর্মা পুজোর দিন দাদি চলে গেল আমাদের ছেড়ে। শ্রাদ্ধশান্তির কাজ মিটতে না মিটতেই পরের দিনই আমাদের নাচ। আমার নাচ যে অত্যন্ত বাজে হয়েছিল বলার অপেক্ষা রাখে না। ওই একটা নাচেই আমার নাভিশ্বাস ওঠার দাখিল। পরের বছর আবার পঞ্চমী ষষ্ঠী দুদিনে দুটো প্রোগ্রাম। পঞ্চমীর দিন বুদ্ধু-ভুতুম – তাতে ওই হিংসুটেদের ‘টিম লিডার’, মানে বড় রাজকুমার। আর পরের দিন দিদিদের চিত্রাঙ্গদায় ওই আবার গ্রামবাসী। এবারে আবার গ্রামবাসীদের একটার বেশী নাচ। তবে হিংসুটে রাজকুমারের নাচটা দিব্য উৎরে গিসল – কারণ ওতে নাচের চেয়ে অভিনয়টা ছিল বেশী। তার পরেরবার লক্ষ্মণের শক্তিশেলে জাম্বুবান হয়ে বুঝলুম অভিনয়, বিশেষ করে কাউকে নকল করা জিনিসটা আমার বেশ আসে।
এই পুজোর ফাংসনে দাদাদের আর কাকুদের নাটকের পাশাপাশি ছিল কাকিমাদের নাটক – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষরক্ষা। সে নাটক দেখে আমাদের হাসতে হাসতে পেটে খিল। রত্না কাকিমা, গৌরীকাকিমা, স্বপ্না কাকিমা, মলি কাকিমা, সব্বাই যে কি ভাল অভিনয় করেছিলেন! পরের বছর কাকিমাদের চিরকুমার সভাও তাই। এক্কেবারে সুপার ডুপার হিট। পুজোর সময় ফাংসন দেখতে, বিশেষ করে আমাদের নৃত্যনাট্য, কত লোক যে আসতেন – পিসি আর বিল্লু, নদাদি, মামু-মাইমা, মুনদিদি বাবুদাদা তো বটেই মাইমার মাও আসতেন। সন্ধ্যেবেলা পুজো প্যাণ্ডেলের ভিড় ধাক্কাধাক্কি নেই, নিজেদের ঘরোয়া অনুষ্ঠান সকলেই খুব উপভোগ করতেন। বিশেষ করে পঞ্চমী ষষ্ঠীতে তখনও রাস্তায় বেরনো যেত।
নতুন জায়গায় আসার পর পর পু্রোনো জায়গা, পুরোনো অভ্যাসের জন্য মন কাঁদে। তাই বিধান নিবাসে আসার পরও প্রথম বছর টালাপার্ক, বেলগাছিয়ার ঠাকুর আর মেলা দেখতে যাওয়া হয়েছিল। তখন বাবার গাড়িতে আমি আর বিল্লু ছাড়াও সোমা, জয়াদি, পতু, রূপু সহ আরও অনেক কুচোকাচা – বিরাট টিম। বাবার ছোট প্রিমিয়ার পদ্মিনীতে গাদাগাদি করে ঠিকই ধরে যেত। তবে গাড়ি চড়ার রেকর্ড বোধহয় কালীপুজোর দিন পুজো শেষ হয়ে যাবার পর প্রভাত কাকুর আম্বাসেডর গাড়িতে গোপাকাকিমা, ইলাজেঠিমা, শিপ্রা জেঠিমা, মণিমালা কাকিমা, কল্পনা কাকিমা, বাবিদি, পিয়ালি, জয়াদি, সোমা, জয়িতা আর সবার শেষে ফাউ সবিতাকাকিমা…। ফাউ বাদ দিয়ে বাকি যাত্রীরা সকলেই বেশ গায়ে গতরে। বাবা যে কোথায় বসে গাড়িটা চালিয়েছিল আমার কল্পনার বাইরে। কারণ সে যাত্রায় আমি লেজুড়টিকে বাবা বাড়িতেই রেখে গিয়েছিল। আসলে তখন অত রাত জাগা আমার অভ্যাস ছিল না। তাই কালীপুজো শেষ পর্যন্ত না দেখেই আমি রণে ভঙ্গ দিয়েছিলুম।
যা হোক আমাদের ঠাকুর দেখার লিস্টিতে ওই বাগবাজার, কুমোরটুলি, আহিরীটোলা, ওদিকে কলেজ স্কোয়ার, মহম্মদ আলী পার্ক, দমকলের ঠাকুর সবই বহাল ছিল। বিবেকানন্দ রোডের পুজোগুলো, চালতাবাগান, হাতিবাগান, সেসবও ছিল। সঙ্গে যোগ হল কাঁকুড়গাছি, বেলেঘাটা, সল্ট লেকের ঠাকুর – লাবনী, করুণাময়ী, পূর্বাচল, বিডি ব্লক আরও কিছু কিছু। তখন সৌরেন জেঠুও আমাদের গাড়ি করে নিয়ে যেতেন। একবার ওদের সঙ্গে দুটো গাড়ি নিয়ে আমরা রাত্তিরে সবাই মিলে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলুম। এখানে এসে আরেকটা বড় ব্যাপার হল বন্ধুরা মিলে ‘একা একা’ পাশের সোসাইটিগুলোয় ঠাকুর দেখতে যাওয়া – ঈশ্বরচন্দ্র নিবাস, এলিট, স্কাই লাইন, রাস্তা পেরিয়ে হাডকো, বি আর এস। ‘বড়’ হয়ে গেছি আমরা সবাই।
নিজেদের সোসাইটির পুজোয় মজাই আলাদা। রাত থাকতেই ঢাকিদের তুলে গোপা কাকিমা পুরো সোসাইটি ঘুরে ঢাক বাজাতে বলে দিতেন। পুজোর কত শত কাজ – সবাই পড়ে পড়ে ঘুমোলে চলবে! আমাদের কাজ ছিল গাছ থেকে দোপাটি আর মাঠ থেকে দুব্বো তোলার আর দুব্বো বাছার। সব্বাই অঞ্জলি দেবে অনেক ফুল লাগবে তো। সেই প্রথম বুঝলুম অঞ্জলি শুধুই অষ্টমীর দিন দেওয়া হয় না, রোজই দেওয়া হয়।
পুজোর কদিন তো আমরা এক্কেবারে ছাড়া গরু। কোনও শাসন বারণ নেই। ওই কদিন মায়েদেরও ছুটি বাড়ির কাজের হাত থেকে। সবাই সারাদিন নিচে পূজামণ্ডপে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে চান সেরে নতুন কাপড়জামা পরে সোজা নিচে। তারপর ওখানেই প্রথমে পুজোর জোগাড়ে আমাদের ফাই-ফরমাস খাটা, অঞ্জলি দেওয়া, ওখানেই প্রসাদ খাওয়া আর ভোগ-প্রসাদ বিতরণে সাহায্য করা। তারপর ওখানেই অপেক্ষা দুপুরের খাবারের জন্য। সঙ্গে চুটিয়ে গল্প আর আড্ডা।
ষষ্ঠীর রাত থেকে শুরু হত নিচে কম্যুনিটি খাওয়া। ষষ্ঠীর রাতে আর অষ্টমীর দুপুরে লুচি, সপ্তমীতে ইলিশ মাছ, নবমীতে পাঁঠার মাংস। দশমীতে দুপুরে contributory lunch. সপ্তমী থেকে নবমী বিকেলের পর থেকে পুজো মণ্ডপের পাশে ফুড স্টল।
প্রথম বছর অষ্টমীতে মহা গোলমাল। পুজো, অঞ্জলি সব সামলে দুপুরের খাবার তৈরীতে দেরী। বাচ্ছা-বুড়ো সবাই এদিকে খিদেয় পেট চুঁইচুঁই। কোনও রকমে মিউজিকাল চেয়ারের মত ঝাঁপিয়ে একটা সিট তো দখল করেছি, কিন্তু লুচি তো ভাজা হয় নি! বহুক্ষণ পর পর একটা করে লুচি আসে। এদিকে পেছনে তখন পরের ব্যাচের জন্যে সবাই চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে। কোনোরকমে দুটো লুচির পর ‘লুচি আনো, লুচি আনো’ গুঞ্জনের মাঝে হাতে একটা মাত্র লুচি নিয়ে বাবুদা ঝড়ের বেগে সামনে দিয়ে চলে গেল ‘লুচি নিবি না তো’ বলতে বলতে। নেবো, নেবো। কে শোনে কার কথা! ওই পুজোর খাওয়ার পরিবেশন করতে করতেই ছোটরা প্রথমে নুন-লেবু, তারপর জল, তারপর ধীরে ধীরে ভাত-ডাল-তরকারি পরিবেশন শিখে গেল। কাজের জন্য তৈরী হয়ে গেল পরের প্রজন্ম।
দুপুরে খাবার পরেও আমাদের বাড়ি যাবার কোনও নামটি নেই। মণ্ডপ খালি হয়ে গেলে সবাই মিলে সোমাদের বাড়ি গিয়ে চড়াও হওয়া। সন্ধ্যেবেলা কোনওক্রমে একবার বাড়ি গিয়ে পোষাক পাল্টেই আবার নিচে ছুট। একদিকে সন্ধ্যারতি দেখা অন্যদিকে তাড়াতাড়ি মাঠে গিয়ে ভাল চেয়ার দখল করতে না পারলে দূর থেকে স্টেজের আর স্টেজের পেছনের সব খুঁটিনাটি রগড় ‘মিস’ হয়ে যাবে। ফাংসনের পর তার চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ করে যখন অবশেষে বাড়ি ঢোকা হত ততক্ষণে ক্যালেণ্ডারের পাতায় তারিখ বদলে গেছে।
আস্তে আস্তে আমরাও বড় হচ্ছি, লায়েক হচ্ছি। ঠিক করলুম পুজোর সময় আমরা বন্ধুরা কজন মিলেই একটা নাটক করব – মনোজ মিত্রের ‘চোখে আঙুল দাদা’। ওনারই দলের দীপকদা বড়দের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নাটকেরও ডিরেকসন দেবেন। বেশ একটা গেরেমভারি ব্যাপার! একমাস আগে থেকে রোজ তার রিহার্সাল – পড়াশুনোর পাট সিকেয়। কিন্তু আমরা সবসময়ই দুধেভাতের দলে। আমাদের নাটক সেই পঞ্চমীতে কি বড়জোর ষষ্ঠীতে। সপ্তমীতে ছেলেদের নাটক, অষ্টমীতে বিচিত্রানুষ্ঠান – অষ্টমীর সন্ধ্যারতি, সন্ধিপুজো এসব থাকে কি না। নবমীতে ফিনিসিং টাচ – বড়দের নাটক। পঞ্চমী থেকেই আমাদের মন খারাপ হয়ে যেত – সোমা বলত ‘পুজো শেষ হয়ে গেল’। সত্যিই তাই – আর রোজ রোজ একসঙ্গে রিহার্সালের পর্ব নেই। পুজোর চারটে দিন তো শুরু হলেই শেষ।
সেই প্রথম দুবছর নাটক করার পর কাকিমাদের নাটক একরকম বন্ধ। মানে দু একজন বড়দের নাটকে থাকলেও কেবলমাত্র মহিলাশিল্পী নিয়ে নাটক আর হয় নি। হঠাৎ গায়ত্রীকাকিমা বললেন এবার মহিলারা করবে ‘শ্রীমতি ভয়ঙ্করী’। সবই হল, কিন্তু তার জন্যে ফচকে চাকরের পার্ট করার মেয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। সেই আমার ডাক পড়ল। বড়দের সঙ্গে নাটক করব ভেবে সে যে কি আনন্দ! পতু আর সোমাও ছিল সেই নাটকে। বুবুনের একটা চকচকে সার্ট পরে হালকা গোঁফ লাগিয়ে পকেটে চিরুণি নিয়ে সেই ফচকে চাকরের পার্ট তারপর পুজোর বাকি কটা দিন সবার মুখে মুখে। অনেকেরই মতে ছেলের সাজে আমাকে এক্কেবারে বাবার মত দেখাচ্ছিল। নাটকের পরের দিন এক কাকু তো বলেই ফেললেন, ‘আরে, শুধু শুধু গোঁফটা উড়িয়ে দিলি কেন?!’
সেই শুরু বড়দের সঙ্গে নাটক করা। এবার তো পুরুষ মহিলা একসঙ্গে অভিনয়। সবচেয়ে বড় মজা হল নবমীর দিন নাটকের আগে অষ্টমীর সারারাত জেগে স্টেজে রিহার্সাল। বড়দের নাটকে সবচেয়ে বড় ভূমিকা কিন্তু প্রম্পটারের। সারাদিন নিজেদের চাকরি-ব্যবসা তারপর পুজোর হাজার দায়িত্ব সামলে কাকুদের কারুর পার্ট মুখস্থ করার সময় নেই। কেউ কেউ তো রিহার্সালে এসে এক্কেবারে নাক ডেকে ঘুমিয়েই পড়তেন।
একবার হল কি প্রম্পট শুনতে না পেয়ে এক কাকু ‘অ্যাঁ, অ্যাঁ’ করতে করতে প্রায় উইংসের বাইরেই বেরিয়ে গেলেন। আরেকবার তো প্রচণ্ড সিরিয়াস একটা সিনে প্রভাতকাকুর নকল গোঁফের অর্ধেকটা আঠা খুলে ঝুলছে, আর দর্শক হেসে কুটোপাটি। শেষকালে ‘ধ্যাত্তেরি’ বলে পুরো গোঁফটাই টেনে ফেলে দিতে সবাই একেবারে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
ফাংসনের রিহার্সালে যে কত মজা, কত গল্প, কত ঠাট্টা-ইয়ার্কি। আমাদের তো রোজ রিহার্সাল দিতে দিতে পুরো নাটকটাই গড়গড়ে মুখস্থ হয়ে যেত। তখন কে বলবে যে ছোট থেকে আমাকে একলাইন পড়া মুখস্থ করাতে মায়ের নাভিশ্বাস উঠে যেত! কোনদিন কেউ রিহার্সালে না এলে আমি দিব্যি তার হয়ে প্রক্সি দিয়ে দিতুম। কোনও প্রম্পটারের দরকারই হত না। স্টেজ রিহার্সালের দিনও একই অবস্থা। সেদিনও পুরো টিম নেই, সেদিনও কারুর এক ফোঁটা পার্ট মনে নেই! ডিরেক্টরের টেনশান, বাকিদেরও উৎকণ্ঠা। ওমা, স্টেজে উঠে তিনিই যেন অন্য মানুষ! পুরো নাটকটা শেষ পর্যন্ত এতোই ভালো হত যে সবাই অবাক!
দশমীর দিন সকালবেলা দর্পণ বিসর্জন, দধিকর্মা। আয়নার মধ্যে দিয়ে ঠাকুরের পা দেখার কি ধুম আমাদের! তারপর ঠাকুর বরণ আর প্রণাম। গোপাকাকিমার উৎসাহের অন্ত নেই। ঠাকুরকে সিঁদুরদানের পর মায়েদের সিঁদুরখেলা দোলের রঙ খেলাকেও হারিয়ে দিত। দুর্গাপুজো মানে যে এত কিছু এত মজা জানা ছিল না তো! সবচেয়ে মজা ভাসানের সময়। এতদিন তো নিজেদের ঘরের জানলা থেকেই ভাসানের নাচ দেখেছি। এবার তো আমাদের পাশে পাশেই দাদাদের ধুনুচি নাচ। আমরাও চলেছি ঠাকুরের ম্যাটাডোরের সঙ্গে সঙ্গে পরিক্রমায়! সামনে এগিয়ে চল। যেখানে সবাই নাচছে তার কাছাকাছি। ঘুরতে ঘুরতে যেই অন্য সোসাইটির সামনে আসছে নাচের তোড় যেন কয়েক গুণ বেড়ে যাচ্ছে! বড়রা মানে মানসকাকু, কাশীকাকু, প্রভাতকাকু, সৌরেনজেঠু, দুই নন্দীকাকু, বাবা – এঁরা সবাই দাদাদের সামলাতে ব্যস্ত। ওদিকে বেশি দেরী হলে গঙ্গার ঘাটে অন্ধকার হয়ে যাবে।
দুচার বছর পরে শুনি ঠাকুরের ম্যাটাডোরের সঙ্গে বাবা যাচ্ছে গাড়ি নিয়ে। সে কি! বাবা যাচ্ছে আর আমি যাব না! আমরা বন্ধুরা মিলে বড়দের রাজি করিয়ে উঠে পড়লুম বাবার গাড়িতে। বাবুঘাটের কাছাকাছি গিয়ে দিল গাড়ি আটকে – NO ENTRY. কি দুঃখ, কি দুঃখ! এদিক ওদিক ঘুরে যতক্ষণে গঙ্গার ঘাটে এসে পৌঁছলুম ঠাকুর জলে পড়ে গেছেন!
সেবারে দাদারা বলল এবার ম্যাটাডোরে করে ভাসানে যাবি তো বল। কি উৎসাহ সবার। আমার তো সবচেয়ে বড় সাপোর্ট বাবার গাড়ি সঙ্গেই যাবে, কাজেই মায়েরও আপত্তির কোন কারণ নেই। তাছাড়া বাবা আমায় কোনসময়ই কোন কিছুতে বারণ করতো না। গাড়ি করে বাবুঘাটে বার দুয়েক গেছি। কিন্তু ম্যাটাডোরে করে ঠাকুরের সঙ্গে ভাসানে যাবার মজাটাই অন্যরকম। সারা রাস্তা সামলে সামলে চলা এই বুঝি গণেশ উলটে গেল, এই বুঝি কার্তিক ঠাকুর ম্যাটাডোর থেকে লাফিয়ে পড়ল! গঙ্গার ঘাটে গিয়ে অবশ্য আমাদের ম্যাটাডোর থেকে নামতে দেওয়া হল না। ‘না, মানে না! Strict NO!’ কিন্তু নিচে থেকেই সাপ্লাই আসতে থাকল আইসক্রিম, বেলুন এইসব।
ভাসানের পর মা দুর্গার অস্ত্রশস্ত্রের ভাগ বাঁটোয়ারা শুরু হল। আমার ভাগে পেয়েছিলুম একটা শাঁখ। সেটা আমার পড়ার বইএর তাকে রাখা থাকত। সরু লম্বা বেলুনগুলো ভারি মজার। সেগুলো ভাঁজ করে কেউ মাথায় পরছে, আবার কেউ মুড়ে হাত ওপরে করে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। চলন্ত ম্যাটাডোরের হাওয়ার ধাক্কায় তার থেকে মিষ্টি শব্দ আসছে কিরিকিরি কিরিকিরি। ফিরতি পথে পাশাপাশি সব ম্যাটাডোর থেকেই এই একই আওয়াজ। তবে মিষ্টি আওয়াজে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি তো কম খেলে না – বেড়ে যায়! যেই একজনের বেলুন কোনভাবে ফেটে যাচ্ছে অমনি সে একটা সেফটিপিন নিয়ে তাক করে কতক্ষণে বাকিদের বেলুন ফাটিয়ে দেওয়া যায়।
বিসর্জনের গাড়ি ফিরে এলে ঢাক বাজিয়ে আবার সবাইকে জানান দেওয়া হত। পল্টুদা গঙ্গায় চান করে মাথায় করে নিয়ে আসত শান্তির জলের ঘট। শূন্য কম্যুনিটি হলে সবাই জড়ো হলে শান্তির জল আর মিষ্টির প্যাকেট দিয়ে তারপর শুরু হত বিজয়ার প্রণাম আর কোলাকুলি। আমরা প্রণাম করার জন্যে সেই যে একবার নিচু হতুম মাথা না তুলেই পরপর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেই যেতুম। এই করে করে একেকজনকে হয়তো তিন-চারবারও প্রণাম করেছি। সেই পায়ের মিছিলে হয়তো আমাদের চেয়ে ছোট কি সিকিউরিটি, জমাদার তারাও থাকত।
কেউ কেউ বলতেন এখানে প্রণাম নেবো না, বাড়ি আসতে হবে। আমাদের তো পোয়া বারো। সোসাইটির ১১৮টা ফ্ল্যাটে বিজয়া করতে করতে লক্ষ্মীপুজো এসেই যেত। মানে ততদিন সন্ধ্যে থেকে পড়াশোনার ইতি, আর রাত্তিরে বাড়ির রুটি তরকারি খাওয়া থেকেও মুক্তি। কাউকে কাউকে আগে থেকে বলে রাখা হত বিজয়ার স্পেশাল কিছু খাবার চাই। যেমন সোমাদের বাড়ি কাকিমার হাতের মাংসের ঘুগনি, আমার মায়ের মাংসের খিচুড়ি, কাশীকাকুর বাড়ি কাকিমার হাতের চিকেন রোল – দোকানকেও হার মানায় সে। আর মানসকাকুর বাড়ি বিভার হাতের মোগলাই পরোটা সঙ্গে মানসকাকুর স্পেশাল কৃষ্ণের মত বাঁশি বাজিয়ে নাচ আর কিশোর কুমারের নকল করা। কিন্তু নিচে ভাসানের পরিক্রমার সময় কোনদিন মানসকাকুকে নাচতে দেখি নি।
দুর্গাপুজোর পর দেখতে দেখতেই লক্ষ্মীপুজো। আমাদের তো সোমাদের বাড়ি সারা বছরই স্থায়ী ঠিকানা। তবে সবার নজর থাকতো কানাইজেঠুর বাড়ির সেবারের নিমন্ত্রণ পত্রের দিকে। কানাইজেঠুর বাড়ির পুজো প্রতি বছরই ওনার ‘মেয়ের বিয়ে’। বিরাট প্রমাণ সাইজের প্রতিমা বেনারসি শাড়ি আর সোনার গয়না দিয়ে সাজানো। খাওয়া-দাওয়ার আয়োজনও দেখার মত। আনন্দবাজারের কর্মী সহ কলকাতার শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী মহলের এমন কেউ বোধহয় ছিলেন না যিনি শ্রী কনাইলাল বসুর বাড়ির লক্ষ্মীপুজোয় না আসতেন। অনেকে শুধু নিমন্ত্রণ পত্রের জন্য নিমন্ত্রণ চেয়ে নিতেন। বাবারা বলত ‘কানাইদার ফ্যাক্টরি’। পুজোর কয়েক মাস আগে থেকে শ’য়ে শ’য়ে ছোট ছোট মিনিয়েচার কৌটো, হাঁড়ি, সরা, আয়না, মাটির ডাব, প্লাস্টিকের কলাগাছ সব জেঠু নিজে হাতে স্পেশাল আঠা দিয়ে বসে বসে জুড়ে কোনোবার করতেন দ্বারঘট, কোনোবার কনকাঞ্জলির কুলো, কি বরণডালা, কখনও দর্পণ বিসর্জন, লক্ষ্মীর ঝাঁপি। তার গায়ে সরু সাদা কাগজে লাল কালি দিয়ে লেখা থাকত ‘বাড়িতে লক্ষ্মী পুজো, সন্ধ্যায় আসবেন। ইতি – কানাইলাল বসু।‘ সঙ্গে বাংলায় সন তারিখ লেখা। পুজোর সময় ঢাক বাজানো হত। সানাইয়ের রোশনচৌকি বসত। আর তুবড়ি, রংমশাল এই সব বাজিও পোড়ানো হত।
সোসাইটির সব লোক একবার কানাই জেঠুর বাড়ি, একবার সোমাদের বাড়ি আর একবার নিচের পূজামণ্ডপে পালা করে ঘুরতেন। কানাইজেঠুর বাড়ির এই রাজকীয় ব্যবস্থার পাশাপাশি সোমাদের বাড়ি কাকু-কাকিমার আন্তরিক আপ্যায়ন সবার মন ভরিয়ে দিত। তুলনায় প্যান্ডেলে ঠাকুরমশাই একা একাই পুজো করতেন। এমন কি এই দুই বাড়ির পুজো আর অনেকেই নিজেদের বাড়ির পুজো সামলে নিচে সোসাইটির পুজোয় গিয়ে সময়মত জোগাড় দিতে যেতে পারতেন না।
কানাইজেঠুর বাড়ির তুবড়ি দেখে অনেকেই বাবাকে একবার বললেন কালীপুজোয় তুবড়ি বানাতে। বাবা তুবড়ি বানালে আমি তো তার আসিস্ট্যান্ট আছিই। মশলা মাখা থেকে তুবড়ির খোল শুকিয়ে মশলা ভরা – পারি না পারি সবেতেই হাত লাগাই। ওপরে সুভাষকাকু আবার রংমশাল বানাতেন। কিন্তু সে এক্কেবারে চুপিচুপি। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে। পাছে বাজির মশলার কাছে গেলে কারুর কোনও অঘটণ ঘটে! কিন্তু বাজি যখন হল তখন আমাদের পায় কে! বাবা কাকাদের হাতে তৈরী ভেজালহীন বাজি। বাবার তুবড়ি যত তিন-চার তলা অবধি ওঠে, কাকুর রংমশালও তেমনি কতক্ষণ ধরে জ্বলে!
কালীপুজোর আগের দিন আবার সৌরেনজেঠু আমাদের গাড়ি করে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যেতেন। একদিকে কলেজ স্ট্রিটে ফাটাকেষ্টো-সোমেন মিত্রের ঠাকুর। অন্যদিকে বারাসাত। সঙ্গে রাস্তায় আরও একটা আধটা অন্য ঠাকুর। জেঠুদের ড্রাইভার উত্তমদার এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী উৎসাহ। কালীপুজোর রাত জেগে পূজো দেখা তারপর সবাই মিলে বসে ভোগ খাওয়া তারও একটা আলাদা মজা ছিল। পুজো প্যাণ্ডেলের আড্ডাখানায় একবার দাদারা নিয়ে এল একটা হুঁকো। আমরাও সবাই এক এক টান দিয়ে দেখলুম হুঁকো খাওয়া কেমন ব্যাপার। তেমনি কালীপুজোর পর এসে বলল হাঁ কর, হাঁ কর – তারপর সবার মুখে দিয়ে গেল এক এক ফোঁটা করে ‘মা কালীর প্রসাদ’। এই একসঙ্গে কাজ করা, ফাংসন করা, গল্প-আড্ডা-মজা এক প্রজন্মের সঙ্গে পরের প্রজন্মকে একটা অভিনব বন্ধনে বেঁধে দেয়। এই সোসাইটির মধ্যেই বেঁচে থাকে আগেকার একান্নবর্তী পরিবারের পারস্পরিক ভালবাসা, সৌহার্দ্য, স্নেহ-শ্রদ্ধার ঐতিহ্য।