Posted in Reflections

ঠাকুর আর আমি

টালায় যেতে না যেতেই গোলদাদি এক্কেবারে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ম্যাডামের কাছে ইস্কুলে ভর্তি করতে। টাইনি টট নার্সারি স্কুল – লোয়ার নার্সারি ক্লাস। ইস্কুলে সক্কলকে একটা করে ডায়রি দেওয়া হল। তার প্রথম পাতাতেই পাতা জোড়া একমুখ দাড়িওয়ালা একজনের ছবি। শুনলুম ইনি হলেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব। পরের পাতায় একটা গান লেখা – ‘ওম্‌ জয় জগদীশ হরে …’। রোজ সকালে ইস্কুলে গিয়েই গাইতে হত। যদিও আমি যেতে যেতে বেশিরভাগ দিন গান শেষ! সেই আমার ঠাকুরের সঙ্গে দেখা।

তবে পড়াশোনা ব্যাপারটা কোনওদিনই আমার মোট্টে ভাল লাগে না। কাজেই বইখাতা খোলার মত বিরল ঘটনা তখন কচ্চিৎ কদাচিৎই ঘটতো, ডায়রি তো দূরের কথা। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক সেই ডায়রিটা বহুদিন পর অবধিও আমার খেলনার ঝুড়িতে থেকে গিসল। তাই মাঝে মাঝে সেই ছবিটার দিকে নজর পড়ত। মহারাজ তো বলেইছেন ‘কাঁচাখেকো ঠাকুর’ – ওই ছবির মধ্যে দিয়েই কোন ফাঁকে টুক করে মনের মধ্যে ঢুকে পড়েন। এক্কেবারে ঠিক কথা। পাতাজোড়া একমুখ দাড়িওয়ালা ঠাকুর কেমন করে যেন মনের অবচেতনে ঢুকে গিয়েছিলেন।

তুলনায় গানটা কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারে নি। ওই প্রথম দু লাইনেই থমকে গিয়েছিল। বাকি কথাগুলো কিছুই বুঝতে পারতুম না। আর তখন ‘জগদীশ’ শুনলেই আমার গোলদাদির ‘কেতকীর বর’এর কথা মনে হত। আর ভাবতুম রোজ ইস্কুলে খামোখা গোলদাদির জগদীশকে নিয়ে গান হয় কেন? সে কি কেবল ম্যাডামের চেনা লোক বলে! তখন আমার ওইরকম অনেক বেয়াড়া প্রশ্ন মনে হত। ‘বিল্লুর’ নাম ‘বিল্লু’ কেন? মা কে ‘মা’ বলে কেন? এইরকম সব। আর কুমারকান্তি, অরুন্ধতী, নন্দিনীপ্রিয়দর্শিনী, মালবিকা – এই সব বড় বড় নামের পাশে আমার চন্দ্রানী নামটা নেহাৎই পাতে দেবার অযোগ্য মনে হত। এক্কেবারেই বিচ্ছিরি – না আছে কোনও সুর, তাল, ছন্দ! মানে ওইখানেই আমার self esteemএর দফা রফা – হীনমন্যতার শুরু।

যাহোক, টালা থেকে মাঝে সাঝে বাবার সময় থাকলে দাদি নদাদি সবাই মিলে শ্যামনগরে মামুর জুটমিলে যাওয়া হত। একদিন সকালে শুনলুম আজ দক্ষিণেশ্বর যাওয়া হবে। শুরু হল আমার হাজারো প্রশ্ন। সেখানে কি আছে? কতদূর? আর কতক্ষণ লাগবে? কালীবাড়ি তো গোয়াবাগানেই আছে নদাদির সঙ্গে যাই, এখানে কেন? তা সেখানে গিয়ে দেখলুম ঠাকুরের ঘর – সেখানে পাশাপাশি দুটো খাট। দাদির ঘরেও তো দুটো খাট – একটা দাদার, একটা দাদির। কিন্তু এখানে দুটোই ঠাকুরের! একজন মানুষের দুটো খাট কি দরকার! তাও গায়ে গায়ে লাগা। আবার দুটো খাটের ওপরই টানটান করে পাতা সাদা ধবধবে চাদর, বালিশ, পাশবালিশ, ওপরে মশারী। দুটো খাটেই ঠাকুরেরই ছবি রাখা!

গোলদাদির ঠাকুরঘরেও ছোট্ট একটা খাটে মশারির মধ্যে আদ্যামার ছবি শয়ন দেওয়া হত। ছবিকে শয়ন দেবার ব্যাপারটা বেশ অন্যরকম যা হোক। আর কোথাও তো দেখি নি! মায়ের ঠাকুরের ছবি তো শয়ন দেয় না! মায়ের ঠাকুরের তো কোনও খাটই নেই! দাদির গোপালের অবশ্য সিংহাসন, খাট, তোষক, বালিশ, পাশবালিশ, শীতকালের লেপ – সবই আছে। কিন্তু গোয়াবাগানে কোনও মশা নেই বাপু, তাই নিজেদেরও মশারি নেই, গোপালেরও নেই।

ঠাকুরের ঘর থেকে বেরোলে পেছনের দিকে নহবত। তার নিচের ওই ছোট্ট ঘরটায় মা সারদা থাকতেন। দেখছ তো কতটুকু ঘর! ওরই মধ্যে ঠাকুরের খাবার, সিকেতে মিষ্টি, জিয়োলো মাছ – সব সব থাকত। তবে এই ঘরটা আমার বেশ ভাল লাগত। কেমন ছ’কোণা ঘর, ছোট্ট দরজা! তখন তো আর বুঝি না ঠাকুর কি মা আমাদের মতই রক্তমাংসের মানুষ। মা ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী। ওই দরজা দিয়ে ঢুকতে বেরতে মাথা ঠুকে যেত। আমার ধারণায় ঠাকুর ঠাকুরই। আর বাড়ির ঠাকুরের তো ছোট ছোট থালা, গেলাস,খাট পালঙ্ক। মানে আমার পুতুলের সংসারের সঙ্গে মা-দাদির ঠাকুরের সংসারের বিশেষ তো কোনও ফারাক নেই। কাজেই ছোটখাট নহবতখানা আর তার বিচিত্র ছ’কোণা ঘর আমার কাছে তখন উলটে মনে হত বেশ বড় সড় পুতুলের বাড়ি।

নহবতের পাশে মায়ের বকুলতলার ঘাট। কালীবাড়ির বড় বাঁধানো ঘাটের থেকে বেশ আলাদা, বেশ একটা নিজের মত। তারপর ছিল পঞ্চবটি। এই দেখো এই পঞ্চবটিতে বসে ঠাকুর ধ্যান করতেন। কিন্তু পঞ্চবটি তখন ফিরিওয়ালাদের দখলে। আর বড় বড় গাছের ছায়ায় বেশ অন্ধকার। সেখানে রামচন্দ্রের সেনাবাহিণীর তখন প্রবল প্রতাপ!

দক্ষিণেশ্বরে প্রায়ই যাওয়া হত। সেখানে মাকালীকে দর্শন করার বড়ই ভিড়। পাশে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। সেখানে আবার আলাদা ঘরে একটা কৃষ্ণের মুর্তি রাখা, যার নাকি পা ভেঙ্গে গিসল। ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজে হাতে সেই ভাঙা পা জুড়ে দিয়েছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে গেলে সেই কৃষ্ণের মুর্তি দেখার একটা বিরাট আকর্ষণ। কিন্তু কোথায় যে পা ভাঙ্গা আর কেমন করে সেটা জোড়া হল কিছুতেই বুঝতে পারি না। দিব্যি সুন্দর ঠাকুর! উল্টোদিকে সারি সারি শিবমন্দির এক্কেবারে ফাঁকা। ভেতরে গিয়ে শিবলিঙ্গ স্পর্শ করে পুজো করা যায়। কখনও কখনও ঠাকুরমশাই একা একা বসে বসে পুজো করতেন। আর মন্দিরের পেছনদিকে দাঁড়ালে দেখা যায় ভরা গঙ্গা। অবশ্য দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছেই প্রথমেই যাওয়া হত গঙ্গার ঘাটে গঙ্গা স্পর্শ করে নিজেকে শুদ্ধ করতে। দূরে দেখা যেত বালী ব্রীজ, কখনও কখনও ট্রেন যেতেও দেখা যেত। হাওড়া ব্রীজ দিয়ে বড়জোর ট্রাম চলে। তবে বালী ব্রীজের ট্র্যাফিক জ্যাম তখন বিখ্যাত। একবার সেই জ্যামে আটকালে হয়েছে আর কি! দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার আমার আরেকটা আকর্ষণ ছিল ‘C’ লেখা শাঁখের আংটি। যদিও বাড়ি আসতে আসতেই সেটা কোথাও না কোথাও ধাক্কা লেগে শেষ!

রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-মা সারদা নামগুলোর সঙ্গে আরেকটু পরিচয় বাবার ছোটবেলার গল্পের মাধ্যমে – বিবেকানন্দ ইস্কুলে বাদলবাবুর গাওয়া গান, বেলুড় বিদ্যামন্দিরের বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সময়, মাঝে মাঝে ইস্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা অথবা বিদ্যামন্দিরের রি-ইউনিয়নে যাওয়া। দাদুর বাড়ির দোতলার মাঝের ঘরে কথা বলতে বলতে বাবা একদিন আমাদের বলল – ‘ও মা, তোরা এ গানটা শুনিস নি! মা আছেন আর আমি আছি ভাবনা কি আছে আমার!’ বাবার নিজস্ব সুরে গাওয়া গান শুনে শুনে আমরাও শিখে গেলুম সে গান। কখনও বলত বিদ্যামন্দিরে সবাই মিলে ধুতি পরে প্রেয়ার করতে যাওয়া। আমরা যখন বাড়িতে আমাদের ইস্কুলের সকালের গান বা প্রার্থনা বলতুম বাবাও নিজের ভুলভাল সুরে গাইত ‘গুরুদেব দয়া করো দীনজনে’। কিংবা হাত তালি দিয়ে গাইত ‘খণ্ডন ভব বন্ধন’…। তাই এ দুটো গানের টুকরো টুকরো কথা আর সুর সেই ছোটবেলাতেই মনে গেঁথে গিয়েছিল।

দক্ষিণেশ্বর মন্দির যেমন বেশ ‘চেনা জায়গা’ হয়ে উঠেছিল বেলুড় মঠ কিন্তু তা ছিল না। বিদ্যামন্দিরে তো আর আমরা যেতে পারতুম না! ছোট্‌ঠাম্মারা এলে ছুটির দিন বাবা একবার বেলুড় মঠে নিয়ে গেল। সেই প্রথম আমার ঠাকুরের খাস তালুকে যাওয়া। হাল্কা হাল্কা মনে পড়ে বিকেল বেলা স্বামীজীর মন্দিরের ওপরে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছি। তখন সবে মন্দির খুলছে। বাবা বলল, ‘স্বামী ব্রহ্মানন্দের মন্দিরে চলো’। নামটা কোনওভাবে ‘কানের ভিতর দিয়ে মরমে’ পশেছিল। তারপর আবার বলল স্বামীজীর ঘর দেখতে যেতে হবে। কি confusing ব্যাপার রে বাবা! এই বললে স্বামীজীর মন্দির দেখা হল আবার এই বলছ স্বামীজীর ঘর! আবার স্বামী ব্রহ্মানন্দের মন্দির দেখালে কিন্তু তার ঘর দেখালে না! মায়ের মন্দির, ঠাকুরের মন্দির – কত মন্দির রে বাবা! কত হাঁটতে হবে! আবার দেখি বাবা ওখানে কোন মহারাজের সঙ্গে কথা বলছে – আমি বিদ্যামন্দিরের ছাত্র ছিলাম। এই মহারাজ এখন কোথায় আছেন? ওই মহারাজ কেমন আছেন?

তখন আমার বেড়াতে যাওয়া ব্যাপারটাই ভাল লাগতো না। রাজ্যের ভীড়, ট্যাঁংশ ট্যাঁংশ করে ঘোরা, এই দেখো, সেই দেখো! বসার জায়গা নেই, খাবার জল নেই, গরম, ঘাম! তবে কন্যাকুমারিকায় গিয়ে খুব ভাল লেগেছিল। সমুদ্রের ধার থেকে দেখা যাচ্ছে ওই দূরে বড় পাথর। ভারতবর্ষের শেষ প্রান্ত। উত্তাল সমুদ্র সাঁতরে পার হয়ে ওই পাথরের ওপর বসে স্বামীজী তিনদিন ধরে ধ্যান করেছিলেন। তবে ওই বিবেকানন্দ স্মৃতি মন্দিরে যেতে সমুদ্রের ঢেউ তে যখন নৌকো দুলতে লাগল, এই বুঝি উলটে যায়‌, তখন প্রাণ পাখী খাঁচা ছাড়া দশা! আর ওখানে এত্তো হাওয়া যে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঠাম্মা তো পড়েই গেল। কিন্তু ভেতরে গিয়ে ওই শান্ত, শীতল ধ্যানকক্ষের স্তিমিত আলোয় সবার মন আপনিই জুড়িয়ে যায়।

ঠাকুর মানে তো আর একা ঠাকুর নন। ঠাকুর মানে ঠাকুর-মা-স্বামীজী, ঠাকুরের সব পার্ষদ – ত্যাগী, গৃহী – ঠাকুরের সংঘ শরীর। ততদিনে কিছু কিছু নাম শুনে শুনে জানা হয়ে গেছে। মানাদিদির পিসিমা রোজ বিকেল হলেই বলরাম মন্দিরে যান ‘পাঠ শুনতে’। সেই ‘পাঠ শোনাটা’ যে ঠিক কি তা অবশ্য জানি না। তবে এক এক দিন গাড়ি করে আসতে আসতে রাস্তার ঠিক মঝখানে গিরিশ ঘোষের স্ট্যাচু আর বাড়ি দেখেছি। আর তার পাশেই সেই বলরাম মন্দির। গিরিশ ঘোষের বাড়িটাও ভারি অদ্ভুত! রাস্তার মোড়ে অনেক জায়গায় কারুর মূর্তি থাকে আর তার দু পাশ কেন চার পাশ দিয়েই চারদিকে গাড়ি চলে। আর শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে তো বলাই হচ্ছে পাঁচটা রাস্তা। মামার বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরতে রোজই তো ওই পাঁচ মাথার মোড় পেরোতে হয়। তাই বলে রাস্তার মাঝখানে আস্ত একটা বাড়ি! যেন তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। আর বাড়িটাও যে কি অদ্ভুত! এই শুরু এই শেষ। এখানে মানুষ থাকে কি করে? আরেকটা নামও তখন খুব শোনা যেত। গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন আর স্বামী লোকেশ্বরানন্দজী। পিসিমা এসে বলতেন মহারাজ মানাকে খুব ভালবাসেন মাঝে মাঝে ডেকে পাঠান।

একদিন বাবার সঙ্গে সন্ধ্যেবেলা গাড়ি করে সিমলে পাড়ায় স্বামীজীর বাড়ি খুঁজতে যাওয়া হল। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে, ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রিট, ভাঙ্গাচোরা হলদে রঙের দেওয়াল, আধভাঙা রংচটা কাঠের দরজা – সামনে লেখা ‘স্বামী বিবেকানন্দের পৈত্রিক বাড়ি’ – মনটা বেশ খারাপই হয়ে গেল। স্বামীজীর ছোটবেলার কত গল্প শুনেছি। ঝকঝকে দক্ষিণেশ্বরের পাশে এটা যেন একেবারেই বেমানান।

ইতিমধ্যে একদিন সন্তুদিদা এসে মা কে বললেন সারদা মঠে নতুন মন্দির হয়েছে। গৌতম তার দায়িত্বে আছে। ওরা আমায় দেখতে নিয়ে যাবে তুমি যাবে? তা মা কি বাবা কোথাও যাওয়া মানেই তো সঙ্গে আমি ফুচকার ফাউ। সেই প্রথম সারদা মঠে যাওয়া। শ্রীমায়ের বিরাট বড় করে নতুন মন্দির তৈরী হয়েছে। তাতে অপূর্ব সুন্দর কারুকাজ। তবে সারদা মঠের ভেতরে তো ছেলেদের যাওয়া বারণ, তাই বাবার সঙ্গে ওখানে বিশেষ যাওয়া হত না। যদিও সেবার ছোট্‌ঠাম্মা আসার পর ছোট্‌ঠাম্মা, পিসি, মা, বিল্লু, আর্ণি সবাইকে নিয়ে বাবা সারদা মঠে গিয়েছিল। আমরা মেয়েরা সবাই যখন পুরনো মন্দিরের দিকে মাতাজীদের প্রণাম করতে গেছি তখন বাবা আর আর্ণি গেটের কাছে টুলে বসে মশার কামড় খাচ্ছে! 

তখন ক্লাস ফাইভ। প্রথম দিন ক্লাসে এসেই ছোট তৃপ্তিদি বলেছেন সবাইকে নিজের নিজের নামের মানে জেনে আসতে হবে। আবার ক্লাসে এসে একেকজনকে জিজ্ঞেসও করেন তাদের নামের মানে। আমি পড়লুম মহা সমস্যায়। বাড়ি এসে জিজ্ঞেস করায় শুনলুম নাম তো রেখেছে মুনদিদি। ইস্কুল থেকে শুনে এসে বলেছিল ‘চন্দ্রানী রাখতে পারো’। আর বাবার জগৎ তো খেলার জগৎ। ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচে  ইডেন গার্ডেন্সে ইন্ডিয়া জিতেছে আর চন্দ্রশেখর দারুণ ফর্মে – কাজেই ‘চন্দ্র’ওয়ালা নাম ফাইনাল। তার অন্য কোনও মানের প্রয়োজন থাকতেই পারে না! কেউ কেউ বলত চন্দ্রানী – চাঁদের রাণী। এতদিন আমি সেই শুনে দিব্যি খুশি ছিলুম। এখন নামের সত্যিকারের মানে খুঁজতে গিয়ে পড়লুম মুশকিলে। চাঁদ কি একটা দেশ যে তার রাণী থাকবে! তখন অবশ্য আমার নিজস্ব একটা উঁচুদেশ ছিল। আবার কেউ বলল চন্দ্রের স্ত্রী। এটাও ঠিক পছন্দ হল না। কোথায় কোন বইতে লেখা আছে শুনি!

আমার তখন প্রাণের বন্ধু সোমা দেবনাথ। ক্লাসে পাশাপাশি বসি আবার এক বাসেও যাই। তবে প্রতি পিরিয়ডে দুজনের একশোবার করে আড়ি হয় আর ভাব! একদিন সোমা এসে বলল ‘সোমা’ মা দুর্গার নাম। সেই শুনে আমার আরও মন খারাপ! ও তো বেশ মা দুর্গার নাম পেয়ে গেল।তা সারদা মঠে মাতাজীরা তখন আমাদের সবার নাম জিজ্ঞেস করছেন। এখনও আবছা আবছা মনে পড়ে তখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। আর কলকাতার তখনকার রোজকার নিয়ম মেনে ঝপ করে লোডশেডিং। পুরনো মন্দিরের সিঁড়ির সামনে আমরা কজন। আর উল্টোদিকের বাড়িতে তখন বোধহয় মিস্ত্রি কাজ চলছে। মাতাজীরা ওই আধো আলো আধো আঁধারিতে গরমে সামনের বারান্দায় বসে। আমি বড় মাতাজীকে প্রণাম করে নাম বলতেই ওনার সেবিকা মাতাজী বলে উঠলেন ‘চন্দ্রানী তো মা দুর্গার নাম। তাই না মাতাজী?’ হুররে, কি যে আনন্দ হল! আমার নামের মানেও মা দুর্গার নাম! মঠে মাতাজীরা যখন বলে দিয়েছেন তখন এর ওপর তো আর কোনও কথা হতেই পারেনা! কালই ইস্কুলে গিয়ে সোমাকে বলতে হবে।

এখন লিখতে বসে মনে হচ্ছে ঠিক কথাই তো! সোম থেকে সোমা যদি মা দুর্গা হন তাহলে চন্দ্র থেকে চন্দ্রানীও তো তাইই হবে! সবাই বলে ওই তো ‘ইন্দ্রানী-চন্দ্রানী’। না বাপু, ইন্দ্রকে আমার মোটেই বিশেষ সুবিধের মনে হয় না। কেউ একটু তপস্যা করতে বসলেই তার মনে ভয়! অমনি তপস্যা ভঙ্গ করতে ঊর্বশী-মেনকা-রম্ভাকে পাঠান। এতো ভয় কেন রে বাপু! এতোদিনে বুঝেছি ইন্দ্র আসলে তো কোনও একজন দেবতা নন – ওটা একটা পোস্ট। ‘রাজা’ মানেই ইন্দ্র। তাই এতো গদি হারানোর ভয়!

তখনও মাঝে মাঝে চন্দ্রানীর সঙ্গে মা দুর্গার সম্পর্কটা খোঁজার চেষ্টা করি। ঠাম্মা তো রোজ সকালে চন্ডী পড়ে – দেবী কবচ। ঠাম্মাকেই পাকড়াও করি, চন্ডী থেকে মা দুর্গার সমস্ত নাম আমায় লিখে দাও। নাঃ, চন্দ্রানী কোথাও পাওয়া গেল না! তখন বলল আরে চন্দ্র তো শিবের জটায় থাকেন। তাই চন্দ্রের ‘বস’ শিব, কাজেই চন্দ্রানী দুর্গা। হ্যাঁ এটা বেশ মনের মত কথা! শিবঠাকুর আমার বেজায় পছন্দের – কেমন একটুতেই খুশি, আশুতোষ। কেষ্টবাবুর মত অত প্যাঁচ পয়জার নেই, আর রামচন্দ্রের মত সীতাকে বনবাসেও পাঠান না, অগ্নিপরীক্ষাও নেন না। পার্বতীকে নিয়ে কৈলাসে ‘সুখের সংসার’। তাই তো ছোটবেলায় শিব-পার্বতী খেলতে অত ভাল লাগত।

কিন্তু সবাই যে বলে ‘যেই রাম, যেই কৃষ্ণ এযুগে তিনিই রামকৃষ্ণ’! একদিন কথায় কথায় মণিমালা কাকিমা বললেন ঠাকুর তো শিব তাই জন্মের পরেই গড়িয়ে গড়িয়ে রান্নাঘরে ছাইএর গাদায় চলে গিয়েছিলেন। ঠাকুর শিব! ঠাকুর শিব! হ্যাঁ তাই তো – সেই যে ছোটবেলায় গ্রামে শিবরাত্রির যাত্রাপালায় শিব সেজে অভিনয় করতে করতে ঠাকুরের সমাধি হয়েছিল! উঃ, কি মজা, কি আনন্দ, কি শান্তি!

বাড়িতে একটা বই ছিল – রসিক বিদ্যাসাগর। সেই বই পড়ে তখন ঠাকুরের সঙ্গে বিদ্যাসাগর মশায়ের অনেক কথা জেনেছি। ঠাকুর বলেছেন ‘এতোদিনে খাল বিল ছেড়ে এবার সাগরে এসে পড়েছি’। বিদ্যাসাগরও বলেছেন ‘তাহলে একটু নোনাজল নিয়ে যান’। তাতে ঠাকুর বলেছেন ‘এ তো যে সে সাগর নয় এ হল বিদ্যার সাগর’। কখনও মনে হত এ সব নিশ্চয় লেখকের কল্পনা প্রসূত। পরে কথামৃত পড়ে দেখি আর এক্কেবারে ঠিক ঠিক এই কথাগুলোই তো লেখা! তাহলে এসব তো বানানো গল্প নয়!

পয়লা জানুয়ারী মানেই দাদুর জন্মদিন। সকাল থেকে গোয়াবাগান যাওয়া। কত লোক আসা, কত হৈ হৈ। কিছুদিন পর শুনলুম পয়লা জানুয়ারী ঠাকুরের কল্পতরু উৎসব। ওইদিন ঠাকুর কাশীপুর উদ্যানবাটিতে সব ভক্তদের আশীর্বাদ করেছিলেন ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। যদিও কাশীপুরেই শিবুজেঠুদের বাড়ি, কাশীপুর পেরিয়েই দক্ষিণেশ্বর যেতে হয়, বাবা প্রায়ই ‘ফল্ট’ সারাতে অফিসের কাজে নিউ কাশীপুর যায়, কিন্তু উদ্যানবাটিটা যে ঠিক কোথায় আমি কোনদিন দেখি নি। আর ভীড়ের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দেওয়া – তাও বিল্লুদের বাড়ির হৈ চৈ ছেড়ে –  একেবারেই অসম্ভব! তাই মা যখন কল্পতরু উৎসবে কাশীপুর যেত আমি কোনদিনই সঙ্গে যাই নি। আমাদের, বিশেষ করে ঠাম্মাকে গোয়াবাগানে নামিয়ে দিয়ে বাবা যেত মা কে একটু ‘এগিয়ে’ দিতে। একবার মা তো সেই সকাল থেকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছে। বাবা দুপুরে খাবার সময় একবার গেল আনতে। ফিরে এসে বলল ‘ওরে বাবা, সে বিশাল লাইন। এখনও ভেতরে ঢুকতেই পারে নি।‘ খাওয়া দাওয়ার পর আবার গেল বাবা। সেবার বোধহয় মা ঘণ্টা ছয়েক লাইন দিয়ে ঠাকুরের দর্শন পেয়েছিল। পরের দিকে গোয়াবাগান যাওয়ার আগে মা আর আমি যোগোদ্যানে গিয়ে কল্পতরু উৎসবের দিন ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম।

এই ভীড় আর লাইনের ভয় বলরাম মন্দিরে রথ টানতেও আমার যাওয়া হয় নি কখনও। এই লকডাউনের আগে অবধি মা যেত। অনেক সময় উল্টোরথের দিন। না যেতে পারলে মায়ের মন খারাপ হয়ে যেত। আর মায়ের সঙ্গে গোপালের একটা অলিখিত চুক্তি ছিল – মা যখনই বাগবাজার স্ট্রিট দিয়ে বলরাম মন্দিরের দিকে যেত ঠিক তখনই গোপালের রথও ওইখান দিয়েই যেত।

হায়ার সেকেণ্ডারী পড়ার সময় প্রাণের বন্ধু হল বর্ণালী – বেলুড়ে বাড়ি, মঠের ঠিক পেছনে। ওর বাবা বেলুড় মঠের ডাক্তার। এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে! বর্ণালীকে বললুম ছুটির মধ্যে তোর বাড়ি যাব। কিন্তু আমায় বেলুড় মঠে নিয়ে যেতে হবে আর সন্ধ্যারতি দেখাবে হবে। ওর সঙ্গে গিয়ে পুজনীয় প্রেসিডেন্ট মহারাজের দর্শন প্রণাম। মায়ের মন্দির, স্বামীজীর মন্দির, রাজা মহারাজের মন্দির ঘুরে তখন সন্ধ্যারতি দেখার পালা। ভাবছি ভেতরের দিকে একটু সামনে করে যদি কোথাও বসা যায়। বর্ণালী বলেছে ওর একটা special ভাল জায়গা আছে। ও বাবা, নিয়ে গিয়ে বসাল মন্দিরের বাইরে গর্ভমন্দিরের দিকে একটা দরজার আড়ালে। ব্যস্‌, শুরু হয়ে গেল দুই বন্ধুর খিটির মিটির। আমি বলি দুর্‌, এখান থেকে ঠাকুরের মুখটাই দেখা যায় না! ও বলে ভেতরে আরতিটাই তো দেখা যায় না অত পেছন থেকে – সামনে সব সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী তারপর লম্বা লম্বা পুরুষের ভীড় পেরিয়ে মহিলাদের জায়গা! মহারাজ এত ভাল আরতি করেন এখান থেকে সেটা খুব সুন্দর দেখা যায়। তবে কিনা আমার সব কথাই বর্ণালী তখন শেষ পর্যন্ত মেনে নিত, তার ওপর আমি guest. কাজেই প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভেতরে গিয়েই বসা হল। কি লাভ হল! এর ওর ফাঁক দিয়ে কোনরকমে ঠাকুরকে দেখা – যত ভীড় তত গরম! এর চেয়ে বাইরে থেকে আরাতিটাও ভাল দেখা যেত গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়াও ছিল। কিন্তু বেলুড় মঠের সন্ধ্যারতি দেখা আর ভজন শোনার অভিজ্ঞতাই অন্যরকম। আরত্রিকের ওইরকম গমগমে আওয়াজ আর কোনও আশ্রমে পাওয়া যায় না। ঠাকুরের হেড অপিস বলে কথা!

বেলুড় মঠে পরে টুকটাক যাওয়া হয়েছে, কিন্তু আরতি পুরো শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করা যায় নি। দক্ষিণেশ্বর থেকে লঞ্চ পেরিয়ে গেলে ততক্ষণে ফেরী বন্ধ। আর ফেরার গাড়ি পাওয়া যায় না। রাস্তায় বাসে তখন অফিস ফেরতা জনতার প্রচন্ড ভীড়। গাড়ি নিয়ে গেলেও বালীব্রীজ হাওড়া ব্রীজের ট্র্যাফিক জ্যামের ভয়।

মন্দিরের ভোগ প্রসাদ পেতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। বাবুরাম মহারাজ যেমন বলেছিলেন প্রসাদ খাইয়ে উনি ভক্তদের ঠাকুরের কাছে টেনে আনেন। একবার বেলার দিকে বেলুড় মঠে গেছি। মন্দির দর্শন করে বেরিয়ে সামনেই দেখি বাবার ‘অরুণদা’, মঠের অনেক পুরনো কর্মী। আমাদের দেখে তিনিই প্রসাদ পাবার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরে বিয়ের পর ছোটকাকা-কাকিমার সঙ্গে গিয়েও প্রসাদ পাওয়া গেছে।

আর সারদা মঠে গেছি পিসির সঙ্গে, কানাইজেঠু-ইলাজেঠিমার সঙ্গে। সকালের দিকে যাওয়া মানেই মাতাজীর দর্শন প্রণামের পর প্রসাদ পাওয়া। পিসি আবার বলত শনি-মঙ্গলবারে গেলে মঠে সেদিন আমিষ প্রসাদ। প্রসাদ যা-ই হোক তার স্বাদই আলাদা। তাতে ঠাকুরের দৃষ্টি পড়ে কি না। একবার মনে হল ছোটবেলা থেকে এত যে দক্ষিণেশ্বর যাওয়া হয় রাণী রাসমনির ব্যবস্থাপনার মা ভবতারিণীর প্রসাদ পাব না? সেই রকম আদ্যাপীঠেও প্রসাদ পেয়েছি। আর কালীঘাটের মন্দিরের নিরামিষ মাংসও বাপী আমার ইচ্ছেপূরণ করতে বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করেছেন।

সারদেশ্বরী আশ্রমে গেলে যত সন্ধ্যেই হোক মাতাজীরা লালজীর প্রসাদ না পেয়ে আসতে দেন নি। কি যে ভাল লাগত মাতাজীদের পরম যত্ন করে সামনে বসে খাওয়ানো। ঠিক সেই রকমই পুণায় সারদা মঠে বা দিল্লীতে মিশনে গিয়ে দেখেছি মাতাজীদের কাছে ভক্তদের অবারিত দ্বার। কলেজ ফেরতা যাই বলে কক্‌খোনো শুধু মুখে ফিরতে দেন না। ভেতরে খাবার ঘরে বসিয়ে গরম চা, সঙ্গে মুড়ি, চানাচুর, চাকলি, বিস্কুট, মিষ্টি – যা হয় কিছু না কিছু খাইয়েছেন। হঠাৎ গিয়েও দিওয়ালীর আগে ভক্তদের করে আনা ‘খাউ’ (স্ন্যাক্‌স), দুর্গাপুজোয় volunteerদের সঙ্গে বসে ডাল-ভাত বা খিচুড়ি না খাইয়ে মাতাজীরা ছাড়েন নি। প্রবাসে থেকেও এই ‘মায়ের আদর’ শুধু আমি একা নই আমার শাশুড়ি মাও খুব ভালবাসতেন।

স্বামী স্তবপ্রিয়ানন্দ মাঝে মাঝে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কড়া ভাষায় বলেন ‘রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা নেওয়াটা আপনাদের একটা status symbol, craze!’ একেকসময় হয়তো আমারো সেই রকম মনে হত। চারপাশে সবাই দীক্ষা নিয়েছে। বিয়ের আগে বাবাকে বললে বলতো ‘কি হবে?’ সত্যি যে ‘কি হবে’ তখন কিছুই বলতে পারতুম না। তবে কোনদিন কোনও মঠে গেলে – মায়ের বাড়ি, যোগোদ্যান – দেখতুম লোকজন কেমন একটা ডাঁটের মাথায় ঘুরছে। যেন একটা authority, sense of belongingness. পরে বুঝেছি ওটা নিছকই আমাদের ভক্তদের নির্বুদ্ধিতা। শুধুই দীক্ষা নেওয়ায় ঠাকুর-মা-স্বামীজী বা মহারাজ-মাতাজীদের কিচ্ছু আসে যায় না! হ্যাঁ যে কেউই রোজ গেলে অবশ্যই তার সঙ্গে একটা পরিচিতি হয়ে যায়, তার বেশী কিছুই নয়।

যাই হোক, হয়তো কিছুটা হুজুগে পড়েই একে তাকে জিজ্ঞেস করি দীক্ষা নিতে গেলে কি করতে হয়? খুব ছোটবেলায় দু-একবার দাদিকে দেখেছিলুম ঠাকুরঘরে বসে ‘জপ’ করতে। সেই টাইনি-টটের ঠাকুরের ছবিটার মতই দাদির ওই জপ করার ছবিটাও মনের কোনও এক কোণে জমা হয়ে গিয়েছিল। আর ট্রেনে করে কুলটি যেতে ‘বেলানগর’ স্টেশন এলেই মা বলত ‘এখানে দাদির গুরুদেবের আশ্রম’। সেই গুরুদেব কথাটাও মনে গেঁথে গিয়েছিল। একবার সোমাকে জিজ্ঞেস করলুম কি করে ‘কড় গুণতে’ হয় বল তো? সোমা দেখিয়ে দিল। নিজের মনে নিজের খেয়াল খুশী মত অং বং মন্ত্র বলে মাঝে মাঝে ‘কড় গুণতুম’। বড় হয়ে একবার পিসিও দেখালো ‘কড় গোণা’। মণিমালা কাকিমার কাছ থেকে এনে ঠাকুর-মা-স্বামীজীর ছোট জীবনী পড়া হল আর কিছুটা কথামৃত। সব কিছুর খেয়ালের মত বই পড়ারও খেয়াল। স্বামীজীর কর্মযোগ আর অন্য দু একটা লেখাও ‘পড়ে ফেলা’ গেল। কিন্তু ‘সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে’ শুনে যে মেয়ের মাথা খারাপ হয়ে যায়, সাপ বিধাতার সঙ্গে কি করে লুডো খেলতে পারে ভেবে, স্বামী বিবেকানন্দের লেখা পড়ে বোঝা যে তার মোটা মাথার কম্মো নয় বলাই বাহুল্য। মনে হয় সামনে বসিয়ে কেউ লাইন বাই লাইন পড়ে বুঝিয়ে দেয় তো বেশ হয়।

সব সন্তানেরই ‘শেষ আশ্রয়’ ‘মা’। ওই জন্যেই বোধহয় বাবা প্রথমেই শিখিয়ে দিয়েছিল ‘মা আছেন আর আমি আছি ভাবনা কি আছে আমার?’। নিত্যদিনের সংসারে যখন কোন দিশা পাই না, মন যখন কোন কারণে এক্কেবারে জর্জরিত, ভারাক্রান্ত, মায়ের কাছে গিয়েই চোখের জলে ভেসেছি। আশ্চর্যজনকভাবে সাড়াও পেয়েছি। মায়ের ওপর অনেক সময় অনেক অভিমানও করেছি – সবাইকে কাছে ডাকো, আমি বুঝি তোমার সন্তান নই! আমি বুঝি সবার অধম, সবার চেয়ে খারাপ! তা তুমিই তো বলেছো ‘আমার সন্তান ধুলোকাদা মেখে এলে আমিই তাকে কোলে তুলে ধুলো ঝেড়ে দেবো’।

একবার কোন একজনের সাক্ষাৎকারে পড়েছিলুম তাঁর ঘরের একদিকের দেওয়াল জুড়ে শ্রী শ্রী মায়ের ছবি আর একদিকের দেওয়াল জুড়ে স্বামীজীর ছবি। যাতে বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি মাকে আর স্বামীজীকে দেখতে পান। কিন্তু ঠাকুর এতই বড়, এতই বিশাল যে ঠাকুরকে রাখার মত কোনও দেওয়াল তাঁর ঘরে নেই। স্বামী সমর্পণানন্দজী বলেন ‘Person, personality, principle’. কিন্তু টাইনি-টটের সেই ছোট্ট বোকা মেয়েটা তো কোনওদিন বুঝতেই পারে নি যে ডায়রির ওই দাড়িওয়ালা মানুষটা এত্তো বিশাল!!

Posted in Uncategorized

শিবের গীত

পুজো আসছে। আসছে আবার কি! এসেই পড়েছে। দেখছ না কলকাতার সব নামী-দামী পুজোর উদ্‌বোধন শুরু হয়ে গেছে। হোক না পিতৃপক্ষ, সেই কবে দেবীপক্ষ শুরু হবে তার জন্যে কেউ বসে থাকে! আসলে উদ্‌বোধন জিনিসটা একটা শিল্প, বুঝলে শিল্প! এরপর উদ্‌বোধন শিল্পেরও কত মাস আগে থেকে মহড়া দিতে হবে। সেই যে বিশপ ইস্কুলে Prize Dayর কতদিন আগে থেকেই রোজ রিহার্সাল হতো – কিরকম স্টেজের পেছনে পর পর লাইন দিয়ে বসতে হবে। তারপর নাম ডাকার পর কি রকম করে Chief guest কে bow করে তাঁর হাত থেকে prize নিতে হবে, তারপর কতক্ষণ কোন দিকে তাকিয়ে ছবি তোলার জন্যে পোজ দিতে হবে, ঠিক কতটা হাসতে হবে আর সব শেষে স্টেজের কোন দিক দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে। এখানেও হয়। আসলে এ তো আর ‘আমাদের সময়’ নয়! এখন বাচ্ছাদের এক্কেবারে সেই Play School থেকেই এসব Stage management, etiquette শেখানো হয়। বলা তো যায় না, হয়তো বড় হয়ে এটাই হবে তাদের অন্যতম রুজি রোজগারের পথ। ফিতে কাটার জন্যে কার দর কত!

কথায় বলে বারো মাসে তেরো পার্বণ। আরে সে তো ছিল সেই সেকালে! এখন তো একেক দিনেই তেরো পার্বণ। এখন কি আমরা নিছক বাঙালী! কবি থাকলে আজ কিছুতেই বলতে পারতেন না ‘রেখেছো বাঙালী করে’। এখন আমরা বিশ্ব-নাগরিক। বিশ্বায়ণ, বুঝলে বিশ্বায়ণ! তাই আমাদের পুজোও শুরু হয় সেই গণেশ পুজো, না না জন্মাষ্টমী থুড়ি রথযাত্রা থেকে! লোকমান্য তিলক আজ বেঁচে থাকলে নিশ্চয় দেখে খুশী হতেন যে তাঁর স্বপ্নের গণেশ উৎসবে বাংলা শুধু হৈ হৈ করে যোগই দিচ্ছে না, তাঁর সাধের মহারাষ্ট্র পুণাকে প্রায় টেক্কা দিতে চলেছে। আর দু-এক বছর! ‘লালবাগ চি রাজা’ ছেড়ে এরপর লোকে ‘লালদিঘির রাজা’কে দেখতে ছুটবে! তোমাদের তো ওই মজে যাওয়া মূলা-মূথা – পারবে আমাদের মা গঙ্গার সঙ্গে পাল্লা দিতে! যতই গণপতি বিসর্জনের বড়াই করো না কেন, আমাদের পুজোর ভাসান রীতিমত কার্নিভাল – শিল্প, ভাই শিল্প! এসব ব্যাপারে মতামতের জন্যে ওই পুতুল পুজোর ঘোর বিরোধী রবি ঠাকুরকে কেউ ডাকে!

যাক গে যাক, যাক গে যাক – ভাসানের কথা পরে হবে। এখন তো উদ্‌বোধন। এরপর কত নতুন নতুন খেতাব হবে- উদ্‌বোধনশ্রী, উদ্‌বোধনভূষণ, উদ্‌বোধনবিভূষণ, উদ্‌বোধনরত্ন! ফিতেটা ঠিক কত উঁচুতে কত শক্ত করে বাঁধা থাকবে। কাঁচিটা ঠিক কিভাবে ফিতের কোন অংশে কিভাবে ঠেকিয়ে রাখতে হবে। তার সঙ্গে মুখে ঠিক কতটা হাসি, ঘাড়টা কতটা কাত, চোখটা ঠিক কতটা তোলা, ক্যামেরা থেকে কত দূরে, কিভাবে কতটা আলো ‘নিতে হবে’, চেহারা, মেক আপ, পোষাক?

পোষাক! এইটে হচ্ছে কথা! পুজো মানেই নতুন শাড়ি, নতুন জামা। ছোটবেলা থেকে যে সেই কত কথাই মনে পড়ছে! সেই যে সেই শিবদুর্গা, ডালিয়া! শিবদুর্গায় অবশ্য বেশিরভাগ শাড়ি কাচতে দেওয়া হত – কোরা ধুতি, শাড়ি আড়ন ধোলাই। ডালিয়ার শাড়ির তখন রমরমা বাজার! খানদানি-বনেদি-রইসী খরিদ্দারের ভিড়।

সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিড়ের মধ্যে ঠেলাঠেলি, কাড়াকাড়ি – ছোট্ট সরু দোকান, বসার জায়গা মেলা ভার! কি যে বিরক্ত লাগতো! তার ওপর মায়ের সঙ্গে কোনওদিন কোনো ব্যাপারেই আমার পছন্দ মেলে না। সেই যে ‘তেরো পার্বণে’ গোরা গান গেয়েছিল না –

‘দাদা যদি ডানদিকে যায় বৌদি যাবে বাঁয়ে,

দাদা যদি চিনি কম খায় বেশী চিনি দেবে চায়ে’-

পুরো সেই কেস! কিন্তু কি আশ্চর্য! বাবা যেটা পছন্দ করতো সেটা কেমন আমার আর মায়ের দুজনেরই পছন্দ হয়ে যেতো! তো সেখানে পিসির শাড়ি, জেঠিমার শাড়ি, মাইমার শাড়ি, দাদির চওড়া লাল ঢালা পাড়, নদাদির কালো ইঞ্চিপাড়, ঠাম্মার নীল-সবুজ-খয়েরি ইঞ্চিপাড় – শাড়ির পর শাড়ির পর শাড়ি। ছোটখাট পাহাড়! আর তার সঙ্গে অলোকবাবুর বিরামহীন ধারাভাষ্য। কি আশ্চর্য! এতো বয়সী, এতো বৈচিত্র্যের এতো খরিদ্দার – সবার পছন্দ যেন ভদ্রলোকের নখদর্পণে!

কখনো সখনো পিসি আর বিল্লুও সঙ্গে যেত। সেবার আমার মহা আনন্দ! মনের সুখে দুজনে মিলে গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর। মা-বাবা নিজেদের জন্যে কখনই কিছু কিনতে চাইত না। অলোকবাবু বলতেন – বৌদিদের জন্যে তো নিলেন এবার নিজের একটা নিন! কোনো শাড়ি খুব পছন্দ হয়ে গেলে অনেক সময় বাবা জোর করেই মায়ের জন্যে সেটা কিনে দিত। তাছাড়া এই লেনদেন, exchange offerএ মায়ের এমনিই তিন-চারটে শাড়ি হত। বাবা ধুতি টুতি বিশেষ পরত না। তবে একবার একটা মুগার কাজ করা ধাক্কাপাড় ধুতি সবারই খুব পছন্দ হয়ে যাওয়ায় বাবার জন্যে কেনা হয়েছিল। তখনই সেটার দাম তখনকার হিসেবে অনেক! সামনে মুনদিদির বিয়ে – বৌভাতের দিন সেজেগুজে ‘মাঞ্জা’ দিয়ে সেটা পরার ইচ্ছে। সেটা কালিপুজোর রাতে ঠাকুর বসানোর সময় একবার শুধু কোনোরকম করে পরেই বাড়ি এসে তুলে রেখে দিয়েছিল। বিয়ের সব তত্ত্ব-নমস্কারি শাড়ি কিনতে তখন ওই দোকানে যাওয়াই হচ্ছে, তাই হাতে অনেক সময় নিয়েই সেই ধুতি কোঁচাতে দেওয়া হল। দুঃখের বিষয় সেই বাবার কেনা এবং একবার পরা ধুতিটি কোনো এক রইসী খরিদ্দারের চোখে পড়ে যায়। তা সেটি যেকোনো লোকেরই চোখে পড়ার মতো ছিল তো বটেই! কাজেই তারপর থেকে যতবারই সেই কোঁচানো ধুতি আনতে যাওয়া হয় সবসময়ই শোনা যায় কাল আসুন, পরশু আসুন…। এদিকে বিয়েবাড়িতে অনেক কাজ। দিন এগিয়ে আসে। গাড়ি ড্রাইভার বলতে তো তখন ওই বাবাই। তার মধ্যে অযথা দোকানের চক্কোর কাটার কার সময়! শেষে একদিন মা আর বাবা রাগে গরগর করতে করতে একটা অন্য ধুতি হাতে বাড়ি ফিরল। তাতে কোথায় মুগা! সাদা ফ্যাটফ্যাটে পাড়ে জরি ক্যাটক্যাট করছে। আবার এই নকল ধুতির জন্যে আরও কিছু আক্কেল সেলামী দিতেও হয়েছে! এমনিতে বাবা আমার সদাশিব, অজাতশত্রু। কারুর সঙ্গে ঝগড়া, বচসা, কথার কচকচির ধার দিয়েও যায় না। কিন্তু কোনও কারণে একবার মেজাজ বিগড়ে গেলে – ব্যাস্‌। কাজেই এরপর মা বা বাবা আর দ্বিতীয়বার ওই দোকানমুখো হবে না বলাই বাহুল্য।

বড়দের শাড়ি তো হল। আর ছোটদের! সে হবে সেই হগ সাহেবের ডেরা থেকে। সেও সব দাদির পছন্দের দোকান, দর্জি। তখন তো আর এখনকার মতো readymade এর যুগ নয়। প্রথমে কাপড় কেনা, তারপর বানানো। মোটামুটি দুপুর থেকে রাত। এ দোকান সে দোকান ঘুরে ঘুরে ছিট দেখেই যাচ্ছে, দেখেই যাচ্ছে। মুনদিদি, চিল্লুদিদি, বিল্লু, বুড়ি, পুতু, রূপু; তারপর দাদা, মামু, বাবুদাদা, ডাকুদাদা … দীর্ঘ লিস্টি। দোকানে না আছে বসার জায়গা না জল! কি বিরক্তি, কি বিরক্তি! খুব স্বাভাবিক একটু পর থেকেই আমার ঘ্যান্‌ঘ্যান আর মায়ের বকাবকি। তারপর সারা বছরে নববর্ষ, পুজো, জন্মদিন মিলে সবার দেওয়া রাজ্যের ছিটকাপড় বস্তা বোঝাই করে দর্জির দোকান।

গ্লোবের পেছনের রাস্তায় সেই ইংরেজ আমলের এক ভুতুড়ে বাড়ির ওপরতলায় সেই দর্জি। দাদির পছন্দের লোক বাবাঃ। মোটামুটি আমার ছ’টা জামা হতো। তাতে দুর্গা পুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো দিব্যি চলে যেত। মাঝে মাঝে ওই সঙ্গে জন্মদিনেরও একটা জামা। পুজোর পরেই annual পরীক্ষা। শেষ হতেই পরের দিন জন্মদিন, কাজেই!

রাঙ্গাদাদু আমায় ছোটবেলায় বলতেন গাবলু। ছোড়দাদু বললেন গাবলু এখন পেংলু হয়ে গেছে। সেই পেংলু প্যাঁকাঠির ছ’টা জামার ডিজাইন বাছতে অন্ততঃ বারোটা বই আর ঘণ্টা তিনেকের মামলা। তারপর সেই – মার যেটা পছন্দ আমার সেটা কিছুতেই পছন্দ হয় না। না আছে পকেট, না আছে বেল্ট। আর আমার পছন্দ? প্রশ্নই নেই। প্রথমে কিছুক্ষণ একটা আধটা রংচঙে বই উলটে পালটে আমার তখন নজর পুঁটলি পুঁটলি বাতিল হওয়া ছাঁট কাপড়, লাল-নীল-সাদা খড়ি, মাপের ফিতে আর – একসঙ্গে কত সাইজের কত কাঁচি! বারান্দার এক কোণে সেসব নিয়ে আমি বেজায় ব্যস্ত। তারপর মাপ দেওয়া, একদিন আবার Trial দেওয়া! অত্যন্ত বোরিং!

তো সেই দর্জি বুড়ো হয়ে গেল। নিজে আর সব জামা করতে পারে না, সময়মতো দিতেও পারে না। কাজেই কালের নিয়মে তার পর্ব মিটল। পিসি বলল হাতিবাগানে সুশ্রী টেলার্স বেশ ভাল। আমারও ‘বেশ ভাল’। বিল্লু আর আমি একসঙ্গে যাই জামা করাতে। বেশ একরকম জামা হবে কি মজা! ও মাঃ, জামা পরতে গিয়ে দেখি কোথায় একরকম! বিল্লুর জামায় কেমন সুন্দর বেশী বেশী পকেট। আবার সিস্টারদের মতো পাশে পকেট। তখন ফ্রকে পাশে পকেট নতুন নতুন উঠছে। আর আমার যদি বা কোনও জামায় সামনে এক আধটা পকেট আছে, সে এত্তো ছোট তাতে তো কিছুই রাখা যায় না! আর জামার হাতা? ওর কি সুন্দর লম্বা প্লেন হাতা A-line ফ্রক, আর আমার বেলায় সেই কোমরে একগুচ্ছের কুচি দেওয়া বোকা বোকা ঘটি হাতা জামা। অসহ্য! ঘটি হাতা কুঁচি দেওয়া জামা হলে নাকি একটু কম রোগা দেখাবে! আমাদের ছোটবেলায় কেন যে এরকম zero figure craze ছিল না! তাহলে আমার Miss Zero Figure খেতাব জেতা কে আটকাতো!

সুশ্রীর পর এল উদ্দিন। মানে তখন সুশ্রীতে এত ভীড় যখনই যাওয়া হয় বলে দেরী হয়ে গেছে আর অর্ডার নেওয়া হবে না! আর এত ভীড়ে Miss Zero Figure এর জামা যে ভুল্ভাল হবে বলাই বাহুল্য! তখন অল্টার করার সময় নেই। আর কোনওকিছুই একবার বিগড়োলে  তাকে সিধে করা নেহাতই দুরূহ – সে জামাকাপড়ই হোক কি সম্পর্ক, গানের সুর হোক কি কলকব্জা, অথবা ছেলেমেয়ে সন্তান সন্ততি!

উদ্দিন বাড়িতে এসে কাপড় আর মাপ নিয়ে যেত, তারপর আবার বানিয়ে দিয়েও যেত। কিন্তু তার ছিল দুটো মুস্কিল। ওর কাছে কোনো ডিজাইনের বই ছিল না। মন থেকে নয়তো ম্যাগাজিন দেখে বলতে হত। আর যতই বলা হোক একটু ঢিলেঢালা জামা বানাতে সে ততই tight fitting করতো। ফলে আমাকে দেখে মনে হত একটা সরু কাঠির গায়ে কাপড় পেঁচিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে উদ্দিনের কাছে যেটা থাকতো সে হল রাজ্যের গল্প। ওর কাছেই প্রথম শোনা আজমীর শরিফের মাহাত্ম্য, কিংবা ইসলাম ধর্মের অনেক খুঁটিনাটি রীতি-রেওয়াজ।

আবার নিউ মার্কেট, এবার French. হরেক রকম ডিজাইনের ফ্রক, স্কার্ট, জ্যাকেট পরা হল কিছুকাল। তারপর সবাই বলল French বড্ড বেশী চার্জ নেয়। পাশেই সুষমা সস্তা অথচ ভাল। সেও গেল কিছুদিন। কিন্তু দিনে দিনে ভীড় বাড়তে লাগলো সব জায়গাতেই। আর ইস্কুল অফিসের ঝামেলা সামলে মানুষ কতদিন আগে থেকেই বা পুজোর বাজার করতে পারে! Baggy design এর ঢোলা জামা আর readymade dress এসে কিছুদিনের জন্যে মুক্তি পাওয়া গেল। কিন্তু ওই রোজই ফ্যাসন পালটায়!

পৃথিবীর কোনও পোষাকই আমার জন্যে মানানসই হয় না! নিজের আলমারি ঘেঁটে দেখি সবরকম মাপের জামা আর ব্লাউজে ভাঁড়ার বোঝাই! মানে আমি একাই সচ্ছন্দে একটা দোকান দিতে পারি। সব জামাই আমার মতে আমার দিব্যি হয়! তবে কথায় আছে কিনা ‘পররুচি পহননা’। আমাকে দেখে লোকের যখন সহ্যের সীমা পেরিয়ে যায় তখন রকম রকম উপদেশাবলী আমার ওপর বর্ষণ হয়।  পুণায় একজন লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই বসলেন ‘tailor change কিজিয়ে’।

সালোয়ার কামিজ, কুর্তি নাহয় রেডিমেড দিয়ে কাজ চালানো গেল, কিন্তু ব্লাউজ? অনেক দোনামোনা করে একজনে কাছে গেলুম। এক্কেবারে পাশের ফ্ল্যাট। মা তাকে দিয়ে অনেক ব্লাউজ ইতিমধ্যে করিয়েছেন। অনেক মাপজোপ, অনেক আনুসঙ্গিক চাহিদা – ঝুল বড় চাই, গলা ছোট, গায়ে ঢোলা – মানে ব্লাউজ না হাফ শার্ট বোঝা দায়। এরকম দাবি মানতে লোকের বয়েই গেছে! কাজেই ব্লাউজ আসার পর দেখি সে আর অঙ্গেই উঠছে না। সেই ইস্কুলে ব্লাউজ তৈরী শিখেছিলুম না, যার কোনও মাপ জোপের বালাই নেই! দেখে শুনে ভাবি বললেন ‘আপকা চেহরা থোড়া আচ্ছা হো গয়া’! বোঝো কাণ্ড! বাংলা করলে দাঁড়ায় ওই মাপ দেওয়া থেকে ব্লাউজ পাওয়ার মধ্যের সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই আমি একাই লোরেল-হার্ডির গল্প হয়ে গেছি! ফলম্‌ – ভাবি মহা নিষ্ক্রমণম্‌।

গাড়ি হাঁকিয়ে রোজ কলেজ যাই। হাঁকিয়ে না কচু – বিশুদ্ধ কাঁপতে কাঁপতে ইষ্টনাম জপতে জপতে! তা কলেজ পাড়াতেই কে কে মার্কেট, সেখানে অনেক টেলার। খুঁজে খুঁজে একজনের কাছে গেলুম – পতঙ্গ। তখন বাড়িতে এদিক ওদিক করে বেশ কিছু dress material জমেছে। তা প্রথম খেপে পতঙ্গ সময়ের আগেই সব জামা করে দিল। আর সবই বেশ ভদ্রস্থ। মনটা বেশ খুশী খুশী। অতি উৎসাহে ওখান থেকেই আরও দু-একটা কাপড় কিনে ফেলা গেল। পাশেই তো সারি সারি দোকান। ব্যস্‌, সব খেল খতম! এরপর বেশ কদিন আমার দৈনিক কাজ হল কলেজ ফেরতা পতঙ্গকে জামার জন্য তাগাদা দেওয়া। আজ দিচ্ছি আর কাল দেব! অতি কষ্টে সে যাত্রায় পতঙ্গর কামড় থেকে মুক্তি মিলল। না কি পতঙ্গের আমার হাত থেকে মুক্তি!

রূপালী বললে ‘শান্তিনী’ ভাল। ওম্‌ শান্তি! কুছ পরোয়া নেহি। কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পথে ইন্দিরানগরের মোড় থেকে বাঁ দিকে গেলে কে কে মার্কেট আর ডান দিকে বেঁকলেই শান্তিনী। শান্তিনীও প্রথম প্রথম নির্দিষ্ট  দিনের আগেই জামা দিয়ে দিত। তবে একবার করে পাশের দিকের একটা করে সেলাই খোলাতে হত। আমার কেমন মনে হত ওরা ইচ্ছে করে একটা করে সেলাই বেশী দেয় আবার করে খুলবে বলে! কিন্তু জীবনে শান্তি কি বেশীদিন থাকে। আবার নতুন শহর আবার ‘রাম সে গিণা’।

এখানে এসে ওব্বাবা সোসাইটির মধ্যেই tailoring shop! সবাই দেখি জামা কাপড় করাচ্ছে, সব সময়ই ভীড়। একদিন ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করতে গেলুম ‘ফলস্‌ পিকো করতে কত নেন?’ কি ঘ্যাম রে বাবা! তিন তিনবার জিজ্ঞেস করেও কোনও উত্তর নেই! শেষকালে বললে ‘সময় হবে না’! দুত্তোর, নিকুচি করেছে এমন টেলারের! ‘আমি কি ডরাই সখি!’ গজগজ করতে করতে বাড়ি ফিরে নিজেই বসিয়ে ফেললুম ফলস্‌ পিকো, একটা কুর্তির হাতা। ভারি তো সেলাই! এইসব বাজে কাজের জন্য অযথা তেল মারতে পারব না বাপু! মা বলল তবে সেলাই শিখেছিসই বা কেন? আরে সেলাই তো শিখেছিলুম কাঁচি দিয়ে কুচকুচ করে কাপড় কাটব বলে। বাবা বলত না আমায় ‘কাঁচি পাগলা’! ঠিক আছে দেখিয়ে দিচ্ছি কেন সেলাই শিখেছি আর কেমন সেলাই শিখেছি!

রে রে করে একটা সালোয়ার কামিজ তৈরী হয়ে গেল। বাড়িতে সবাই বলতে লাগলেন একদিনে অত কোরো না ঘাড়ে ব্যথা হবে। কে শোনে কার কথা! কিন্তু এ তো নেহাত সুতির কাপড়। আলমারিতে যে সিল্ক আর সিন্থেটিক কাপড় পড়ে রয়েছে তার কি হবে! তাছাড়া বেশিক্ষণ কোনও কাজ করা আমার পোষায় না বাপু!

গুরগাঁও এসে সবচেয়ে লাভজনক আবিষ্কার ব্যাপার কেন্দ্রে বুড়োর দোকান। বড়বাবু বলে ‘chinless দাদু’। সেই প্রথম দিন থেকেই কি খাতির! বলে আরে আপনি কি আমার দোকানের আজকের কাস্টমার! সেই কবে থেকে আসছেন! তাই বটে! নির্ঘাৎ পূর্ব জন্মের হিসেব। কারণ এ জন্মে তো এই সবে এ শহরে এলুম।

দাদুর দোকানে সবচেয়ে বড় সুবিধে আমায় কিছু বলতে হয় না। দাদুর ছেলে এক্কেবারে ঠিক ঠিক মাপ মত আর পছন্দসই জামা বের করে দেয়।

কর্তামশাই বললেন চল দাদুর দোকানে গিয়েই বলবে একটা  ভাল দর্জির সন্ধান দিতে। এখানে সব দোকানের সামনেই একজন করে সেলাই মেসিন নিয়ে বসে থাকে, টুকটাক ঝুল ছোট করা হাতা লাগানো এসব করার জন্য। দাদু বললে একেই দাও না। কোনও অসুবিধে নেই। তোমার যেমন চাই, যবে চাই করে দেবে। আমি ‘গ্রান্টি’ দিচ্ছি। দাদুর কথায় ঝোলা ভর্তি কাপড় তাকেই দিয়ে ভারমুক্ত হলুম। সমস্যা সেই কোনও বই নেই ডিজাইন বাছার। কাজেই ভুল্ভাল দর্জি, ভুল্ভাল ডিজাইন, ভুল্ভাল মাপ। মানে – ‘ভুল, সবই ভুল’! দর্জিদের একটা বিরাট গুণ যেদিন জামা দেবে বলে লিখে দেয়, সেদিন কিছুতেই দেয় না। এদিকে দাদুর তো পুরো প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন! শেষে কর্তামশাই আর ‘chinless দাদু’র যৌথ চাপে বেচারা স্যান্ডউইচ দর্জি কাঁচুমাচু মুখটি করে কথা দিল পরের দিনই বাড়ি এসে সব জামা দিয়ে যাবে। নাঃ, সে যাত্রা কথা রেখেছিল। বরং আমার ট্র্যাক রেকর্ড ভেঙে বেশ ভালই সেলাই করেছিল!

পরেরবার তো আমার সাহস গেল বেড়ে। আগেরবারের ভরসায় যেখানে যত ভালভাল সিল্কের কাপড় – কামিজ-কুর্তি, ব্লাউজ – সব একসঙ্গে নিয়ে হাজির! ওমা, কোথায় কে! সব ভোঁ ভা। দাদু বললে – ও সে ভারি ‘বদমাস’, তাকে দিয়েছি দূর করে। দেখি তার জায়গায় বসে কিশোর কুমারের ‘হাফ টিকিট’ সিনেমায় ‘চিল চিল চিল্লাকে’ গানে ট্রেনে বসে বকের মত মুণ্ডু নাড়া এক লোক! স্বভাবতঃই হ্যাঁ, হ্যাঁ করে দাদু সেই বকদর্জির অনেক গুণ গাইলেন আর আমিও ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি ভেবে ঝোলা সুদ্ধু তার জিম্মা করে দিলুম।

ডিজাইন? সব ‘এক সে বড়কর এক’। প্রথমেই বাপীর ভাষায় ‘তারার সঙ্গে ভেড়া’ মানে sea green raw silk এর ঘাড়ে কড়া রাণী কালারের সুতির ব্লাউস পিসের জোড় দিয়ে একটা হযবরল। তারপর একটা কটসুলের কাপড় – সামনে শীত আসবে বলে পুরো গলাবন্ধ, পুরোহাতা পাঠানী কাবুলিওয়ালা মার্কা কুর্তি – কর্তামশাই এর ভাষায় ছেলেদের না মেয়েদের বোঝার উপায় নেই! তারপর ওই মরালগ্রীবা টেলারসাহেবের হাতে পড়ে সে ওই একমাত্র বক অথবা জিরাফ ছাড়া কারুর গলায় ফিট হবে না! ব্লাউজ তো এত বছরের এত পরীক্ষা নিরীক্ষার পর পুরোপুরি ‘ভজা’ – মানে ভগবান জানেন! তার যে আবার ডিজাইন, কাট ইত্যাদি, প্রভৃতি বলার দরকার ছিল সে তো আমার অতি ঊর্বর মাথাতেই আসে নি! ওদিকে বাইরে যখন এই সব তুলকালাম চলছে তখন দোকানের ভেতর থেকে কর্তামশাই হাঁকডাক করেই চলেছেন, ‘ওসব ছেড়ে এক্ষুনি এদিকে এসে বল কোন জামা পছন্দ’। পরের দিন জামা আনতে গিয়ে তো মাথায় হাত! সবই পাতে দেবার অযোগ্য! ওই কুর্তিগুলোর কথা নাহয় বাদই দিলুম। কিন্তু আমার এত শখ করে কেনা মেখলার ব্লাউজ! চোখ ফেটে জল আর তার সঙ্গে কর্তামশায়ের বকুনি। ভাল করে দেখে দেবে না! ঘুরতে ঘুরতে সেই আগেরবারের ‘বদমাস’ দর্জিরও দেখা মিলল। কিন্তু তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। আর কোনই লাভ নেই। যা বুঝলুম এসব alter করা বকবাবাজীর কর্ম নয়! তবু কিছু করানোর ব্যর্থ চেষ্টা যে হয় নি তা নয়। তারপর নিজের কিছু কারিকুরি আর অসংখ্য সেপ্টিপিনের ভরসায় ব্লাউজ তো পরা হল; কিন্তু ওই ‘তারার সঙ্গে ভেড়া’!

কাজ করা ব্লাউজপিসটা বন্ধুর ভালবেসে দেওয়া আর সিল্কের পিসটা কর্তার। সেই থেকে মতলব ভাঁজছি কি করা যায়! ভয়ে নতুন শাড়ি কেনাই ছেড়ে দিয়েছি! এদিকে রোজ বাড়িতে ঢুকতে বেরোতে, বারান্দায় দাঁড়াতে নিচের দর্জিকে দেখা যায়। সবসময়ই একটা কর্মচঞ্চলতা। একা নয়, সঙ্গে আ্ররও তিন-চারজন কারিগর। রোজই পাঁয়তাড়া কষি একবার যাব কি যাব না! প্রায় একমাসের প্রচেষ্টায় অবশেষে দুগ্‌গা বলে গিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললুম – একটা ব্লাউজ বানিয়ে দেবে? কিম্‌ আশ্চর্যম্‌ অতঃপরম্‌! খুব ভাল করেই শাড়ি থেকে মাপ করে ব্লাউজপিস কেটে ব্লাউজ করে দেবে বলল! বোধহয় এতদিন ধরে দেখে দেখে পুরো ছিটগ্রস্ত বদ্ধপাগল ভেবে আমার ওপর তার দয়া হয়েছে! কারণ এক কথায় সেই ‘তারা-ভেড়া’র ঝামেলাও মেটাবার চেষ্টা করবে বলে কথা দিল!

এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে। তক্ষুনি আবার হাজির হই ‘তারা-ভেড়া’ আর বাকি টুকরো কাপড় নিয়ে। কিন্তু নিজেরই মতের ঠিক না থাকলে যা হয়! আজ গিয়ে বলি এই ডিজাইন করে দাও। কালই আবার বলি না, না পালটে এরকম কর। সুবিধেও খুব – একবার নিচে নামলেই হল। প্রথমে বলেছিল কাপড় আর যা লাগবে কিনে এনে দেবেন। আমিও বলি – না বাপু, ওসব তুমিই এনো। তারপর বাড়ি এসে বাক্স হাতড়ে খানিকটা অস্তরের কাপড় হাতে হাজির হই – চলবে! সেই না দেখে সে তো অজ্ঞান হয়ে যায় আর কি! আমার ওপর যেটুকু ভরসা ছিল সেও গেল। বলেছিল কাপড়ের স্যাম্পেল দেখে যাবেন। আমার স্যাম্পেল দেখে পরে বলল আমিই আপনাকে খবর দেব। আমিও বসে আছি – এই খবর দেয়। কোথায় কি! এই করে করে জামার delivery date এসে গেল। তাও দিন দুই পার করেই গেলুম। তবু মনে স্থির বিশ্বাস ও জামা কিছুতেই হয় নি। ওমা, বলে কি সব রেডি! আর সেই কালো জামা? সেও রেডি! স্যাম্পেল না দেখিয়েই! নাঃ, সে প্রয়োজন আর বোধ করে নি।

এত সহজে সব মিটবে! বাড়ি এসে জামা পরতে গিয়ে দেখি সেই এক কেস! এক সপ্তাহের মধ্যেই ‘চেহরা আচ্ছা হো গয়া’। চিরকালের অভ্যাসমত একেও পৈ পৈ করে বলে এসেছিলুম ভেতরে কাপড় রাখবে আর বেশ ঢোলা ঢোলা করে করবে। হায় রে, এই তার নমুনা! মোবাইলে ছবি তুলে নিয়ে আবার যাই বড় করাতে। আর – কি সাহস! সঙ্গে করে নিয়ে যাই আরও একটা ভালো শাড়ির ব্লাউজপিস। আর? একটা রেডিমেড ঢলঢলে ব্লাউজ। বলি এরকম কাটের করে দিতে পারবে না বুঝি! বলে কেন পারব না? আমি তো জিজ্ঞেস করেছিলাম। ঠিকঠিক মাপমত ব্লাউজ দিলে খুব ভালই হয়। আমি বলি – তা মেপে দেখ দিকি এটার কি অবস্থা? মাপতে গিয়ে তো তার চোখ কপালে। বলে এতো দেখি তিন ইঞ্চি বড়! আচ্ছা ঠিক আছে মাপে এক ইঞ্চি করে বাড়িয়ে দিচ্ছি। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে তাকে এইরকম বিচিত্র মাপ, বিচিত্র নমুনা আর বিভিন্ন বিচিত্র নির্দেশ দিয়ে ফিরতে ফিরতে ভাবি – আরেকবার যাব না কি? কিছুই তো লিখে নিল না! আদৌ কোনও কথা শুনবে তো! এবার যতক্ষণ না সব জামাগুলো আবার ফেরত পাচ্ছি বিভিন্ন দুর্ভাবনা আর দুঃস্বপ্নে এখন আমার বিনিদ্র রজনীযাপনের পালা।

কালই ঘটেছে বাপু এতো কাণ্ড, তাই আজ ধান ভানতে এই শিবের গীত।।

P.C. : Google images.