টালায় যেতে না যেতেই গোলদাদি এক্কেবারে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন ম্যাডামের কাছে ইস্কুলে ভর্তি করতে। টাইনি টট নার্সারি স্কুল – লোয়ার নার্সারি ক্লাস। ইস্কুলে সক্কলকে একটা করে ডায়রি দেওয়া হল। তার প্রথম পাতাতেই পাতা জোড়া একমুখ দাড়িওয়ালা একজনের ছবি। শুনলুম ইনি হলেন ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব। পরের পাতায় একটা গান লেখা – ‘ওম্ জয় জগদীশ হরে …’। রোজ সকালে ইস্কুলে গিয়েই গাইতে হত। যদিও আমি যেতে যেতে বেশিরভাগ দিন গান শেষ! সেই আমার ঠাকুরের সঙ্গে দেখা।
তবে পড়াশোনা ব্যাপারটা কোনওদিনই আমার মোট্টে ভাল লাগে না। কাজেই বইখাতা খোলার মত বিরল ঘটনা তখন কচ্চিৎ কদাচিৎই ঘটতো, ডায়রি তো দূরের কথা। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক সেই ডায়রিটা বহুদিন পর অবধিও আমার খেলনার ঝুড়িতে থেকে গিসল। তাই মাঝে মাঝে সেই ছবিটার দিকে নজর পড়ত। মহারাজ তো বলেইছেন ‘কাঁচাখেকো ঠাকুর’ – ওই ছবির মধ্যে দিয়েই কোন ফাঁকে টুক করে মনের মধ্যে ঢুকে পড়েন। এক্কেবারে ঠিক কথা। পাতাজোড়া একমুখ দাড়িওয়ালা ঠাকুর কেমন করে যেন মনের অবচেতনে ঢুকে গিয়েছিলেন।
তুলনায় গানটা কিন্তু বিশেষ সুবিধে করতে পারে নি। ওই প্রথম দু লাইনেই থমকে গিয়েছিল। বাকি কথাগুলো কিছুই বুঝতে পারতুম না। আর তখন ‘জগদীশ’ শুনলেই আমার গোলদাদির ‘কেতকীর বর’এর কথা মনে হত। আর ভাবতুম রোজ ইস্কুলে খামোখা গোলদাদির জগদীশকে নিয়ে গান হয় কেন? সে কি কেবল ম্যাডামের চেনা লোক বলে! তখন আমার ওইরকম অনেক বেয়াড়া প্রশ্ন মনে হত। ‘বিল্লুর’ নাম ‘বিল্লু’ কেন? মা কে ‘মা’ বলে কেন? এইরকম সব। আর কুমারকান্তি, অরুন্ধতী, নন্দিনীপ্রিয়দর্শিনী, মালবিকা – এই সব বড় বড় নামের পাশে আমার চন্দ্রানী নামটা নেহাৎই পাতে দেবার অযোগ্য মনে হত। এক্কেবারেই বিচ্ছিরি – না আছে কোনও সুর, তাল, ছন্দ! মানে ওইখানেই আমার self esteemএর দফা রফা – হীনমন্যতার শুরু।
যাহোক, টালা থেকে মাঝে সাঝে বাবার সময় থাকলে দাদি নদাদি সবাই মিলে শ্যামনগরে মামুর জুটমিলে যাওয়া হত। একদিন সকালে শুনলুম আজ দক্ষিণেশ্বর যাওয়া হবে। শুরু হল আমার হাজারো প্রশ্ন। সেখানে কি আছে? কতদূর? আর কতক্ষণ লাগবে? কালীবাড়ি তো গোয়াবাগানেই আছে নদাদির সঙ্গে যাই, এখানে কেন? তা সেখানে গিয়ে দেখলুম ঠাকুরের ঘর – সেখানে পাশাপাশি দুটো খাট। দাদির ঘরেও তো দুটো খাট – একটা দাদার, একটা দাদির। কিন্তু এখানে দুটোই ঠাকুরের! একজন মানুষের দুটো খাট কি দরকার! তাও গায়ে গায়ে লাগা। আবার দুটো খাটের ওপরই টানটান করে পাতা সাদা ধবধবে চাদর, বালিশ, পাশবালিশ, ওপরে মশারী। দুটো খাটেই ঠাকুরেরই ছবি রাখা!
গোলদাদির ঠাকুরঘরেও ছোট্ট একটা খাটে মশারির মধ্যে আদ্যামার ছবি শয়ন দেওয়া হত। ছবিকে শয়ন দেবার ব্যাপারটা বেশ অন্যরকম যা হোক। আর কোথাও তো দেখি নি! মায়ের ঠাকুরের ছবি তো শয়ন দেয় না! মায়ের ঠাকুরের তো কোনও খাটই নেই! দাদির গোপালের অবশ্য সিংহাসন, খাট, তোষক, বালিশ, পাশবালিশ, শীতকালের লেপ – সবই আছে। কিন্তু গোয়াবাগানে কোনও মশা নেই বাপু, তাই নিজেদেরও মশারি নেই, গোপালেরও নেই।
ঠাকুরের ঘর থেকে বেরোলে পেছনের দিকে নহবত। তার নিচের ওই ছোট্ট ঘরটায় মা সারদা থাকতেন। দেখছ তো কতটুকু ঘর! ওরই মধ্যে ঠাকুরের খাবার, সিকেতে মিষ্টি, জিয়োলো মাছ – সব সব থাকত। তবে এই ঘরটা আমার বেশ ভাল লাগত। কেমন ছ’কোণা ঘর, ছোট্ট দরজা! তখন তো আর বুঝি না ঠাকুর কি মা আমাদের মতই রক্তমাংসের মানুষ। মা ছিলেন দীর্ঘাঙ্গী। ওই দরজা দিয়ে ঢুকতে বেরতে মাথা ঠুকে যেত। আমার ধারণায় ঠাকুর ঠাকুরই। আর বাড়ির ঠাকুরের তো ছোট ছোট থালা, গেলাস,খাট পালঙ্ক। মানে আমার পুতুলের সংসারের সঙ্গে মা-দাদির ঠাকুরের সংসারের বিশেষ তো কোনও ফারাক নেই। কাজেই ছোটখাট নহবতখানা আর তার বিচিত্র ছ’কোণা ঘর আমার কাছে তখন উলটে মনে হত বেশ বড় সড় পুতুলের বাড়ি।
নহবতের পাশে মায়ের বকুলতলার ঘাট। কালীবাড়ির বড় বাঁধানো ঘাটের থেকে বেশ আলাদা, বেশ একটা নিজের মত। তারপর ছিল পঞ্চবটি। এই দেখো এই পঞ্চবটিতে বসে ঠাকুর ধ্যান করতেন। কিন্তু পঞ্চবটি তখন ফিরিওয়ালাদের দখলে। আর বড় বড় গাছের ছায়ায় বেশ অন্ধকার। সেখানে রামচন্দ্রের সেনাবাহিণীর তখন প্রবল প্রতাপ!
দক্ষিণেশ্বরে প্রায়ই যাওয়া হত। সেখানে মাকালীকে দর্শন করার বড়ই ভিড়। পাশে রাধাকৃষ্ণের মন্দির। সেখানে আবার আলাদা ঘরে একটা কৃষ্ণের মুর্তি রাখা, যার নাকি পা ভেঙ্গে গিসল। ঠাকুর রামকৃষ্ণ নিজে হাতে সেই ভাঙা পা জুড়ে দিয়েছিলেন। দক্ষিণেশ্বরে গেলে সেই কৃষ্ণের মুর্তি দেখার একটা বিরাট আকর্ষণ। কিন্তু কোথায় যে পা ভাঙ্গা আর কেমন করে সেটা জোড়া হল কিছুতেই বুঝতে পারি না। দিব্যি সুন্দর ঠাকুর! উল্টোদিকে সারি সারি শিবমন্দির এক্কেবারে ফাঁকা। ভেতরে গিয়ে শিবলিঙ্গ স্পর্শ করে পুজো করা যায়। কখনও কখনও ঠাকুরমশাই একা একা বসে বসে পুজো করতেন। আর মন্দিরের পেছনদিকে দাঁড়ালে দেখা যায় ভরা গঙ্গা। অবশ্য দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছেই প্রথমেই যাওয়া হত গঙ্গার ঘাটে গঙ্গা স্পর্শ করে নিজেকে শুদ্ধ করতে। দূরে দেখা যেত বালী ব্রীজ, কখনও কখনও ট্রেন যেতেও দেখা যেত। হাওড়া ব্রীজ দিয়ে বড়জোর ট্রাম চলে। তবে বালী ব্রীজের ট্র্যাফিক জ্যাম তখন বিখ্যাত। একবার সেই জ্যামে আটকালে হয়েছে আর কি! দক্ষিণেশ্বরে যাওয়ার আমার আরেকটা আকর্ষণ ছিল ‘C’ লেখা শাঁখের আংটি। যদিও বাড়ি আসতে আসতেই সেটা কোথাও না কোথাও ধাক্কা লেগে শেষ!
রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-মা সারদা নামগুলোর সঙ্গে আরেকটু পরিচয় বাবার ছোটবেলার গল্পের মাধ্যমে – বিবেকানন্দ ইস্কুলে বাদলবাবুর গাওয়া গান, বেলুড় বিদ্যামন্দিরের বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সময়, মাঝে মাঝে ইস্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করা অথবা বিদ্যামন্দিরের রি-ইউনিয়নে যাওয়া। দাদুর বাড়ির দোতলার মাঝের ঘরে কথা বলতে বলতে বাবা একদিন আমাদের বলল – ‘ও মা, তোরা এ গানটা শুনিস নি! মা আছেন আর আমি আছি ভাবনা কি আছে আমার!’ বাবার নিজস্ব সুরে গাওয়া গান শুনে শুনে আমরাও শিখে গেলুম সে গান। কখনও বলত বিদ্যামন্দিরে সবাই মিলে ধুতি পরে প্রেয়ার করতে যাওয়া। আমরা যখন বাড়িতে আমাদের ইস্কুলের সকালের গান বা প্রার্থনা বলতুম বাবাও নিজের ভুলভাল সুরে গাইত ‘গুরুদেব দয়া করো দীনজনে’। কিংবা হাত তালি দিয়ে গাইত ‘খণ্ডন ভব বন্ধন’…। তাই এ দুটো গানের টুকরো টুকরো কথা আর সুর সেই ছোটবেলাতেই মনে গেঁথে গিয়েছিল।
দক্ষিণেশ্বর মন্দির যেমন বেশ ‘চেনা জায়গা’ হয়ে উঠেছিল বেলুড় মঠ কিন্তু তা ছিল না। বিদ্যামন্দিরে তো আর আমরা যেতে পারতুম না! ছোট্ঠাম্মারা এলে ছুটির দিন বাবা একবার বেলুড় মঠে নিয়ে গেল। সেই প্রথম আমার ঠাকুরের খাস তালুকে যাওয়া। হাল্কা হাল্কা মনে পড়ে বিকেল বেলা স্বামীজীর মন্দিরের ওপরে সিঁড়ি দিয়ে উঠেছি। তখন সবে মন্দির খুলছে। বাবা বলল, ‘স্বামী ব্রহ্মানন্দের মন্দিরে চলো’। নামটা কোনওভাবে ‘কানের ভিতর দিয়ে মরমে’ পশেছিল। তারপর আবার বলল স্বামীজীর ঘর দেখতে যেতে হবে। কি confusing ব্যাপার রে বাবা! এই বললে স্বামীজীর মন্দির দেখা হল আবার এই বলছ স্বামীজীর ঘর! আবার স্বামী ব্রহ্মানন্দের মন্দির দেখালে কিন্তু তার ঘর দেখালে না! মায়ের মন্দির, ঠাকুরের মন্দির – কত মন্দির রে বাবা! কত হাঁটতে হবে! আবার দেখি বাবা ওখানে কোন মহারাজের সঙ্গে কথা বলছে – আমি বিদ্যামন্দিরের ছাত্র ছিলাম। এই মহারাজ এখন কোথায় আছেন? ওই মহারাজ কেমন আছেন?
তখন আমার বেড়াতে যাওয়া ব্যাপারটাই ভাল লাগতো না। রাজ্যের ভীড়, ট্যাঁংশ ট্যাঁংশ করে ঘোরা, এই দেখো, সেই দেখো! বসার জায়গা নেই, খাবার জল নেই, গরম, ঘাম! তবে কন্যাকুমারিকায় গিয়ে খুব ভাল লেগেছিল। সমুদ্রের ধার থেকে দেখা যাচ্ছে ওই দূরে বড় পাথর। ভারতবর্ষের শেষ প্রান্ত। উত্তাল সমুদ্র সাঁতরে পার হয়ে ওই পাথরের ওপর বসে স্বামীজী তিনদিন ধরে ধ্যান করেছিলেন। তবে ওই বিবেকানন্দ স্মৃতি মন্দিরে যেতে সমুদ্রের ঢেউ তে যখন নৌকো দুলতে লাগল, এই বুঝি উলটে যায়, তখন প্রাণ পাখী খাঁচা ছাড়া দশা! আর ওখানে এত্তো হাওয়া যে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ঠাম্মা তো পড়েই গেল। কিন্তু ভেতরে গিয়ে ওই শান্ত, শীতল ধ্যানকক্ষের স্তিমিত আলোয় সবার মন আপনিই জুড়িয়ে যায়।
ঠাকুর মানে তো আর একা ঠাকুর নন। ঠাকুর মানে ঠাকুর-মা-স্বামীজী, ঠাকুরের সব পার্ষদ – ত্যাগী, গৃহী – ঠাকুরের সংঘ শরীর। ততদিনে কিছু কিছু নাম শুনে শুনে জানা হয়ে গেছে। মানাদিদির পিসিমা রোজ বিকেল হলেই বলরাম মন্দিরে যান ‘পাঠ শুনতে’। সেই ‘পাঠ শোনাটা’ যে ঠিক কি তা অবশ্য জানি না। তবে এক এক দিন গাড়ি করে আসতে আসতে রাস্তার ঠিক মঝখানে গিরিশ ঘোষের স্ট্যাচু আর বাড়ি দেখেছি। আর তার পাশেই সেই বলরাম মন্দির। গিরিশ ঘোষের বাড়িটাও ভারি অদ্ভুত! রাস্তার মোড়ে অনেক জায়গায় কারুর মূর্তি থাকে আর তার দু পাশ কেন চার পাশ দিয়েই চারদিকে গাড়ি চলে। আর শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে তো বলাই হচ্ছে পাঁচটা রাস্তা। মামার বাড়ি থেকে বাড়ি ফিরতে রোজই তো ওই পাঁচ মাথার মোড় পেরোতে হয়। তাই বলে রাস্তার মাঝখানে আস্ত একটা বাড়ি! যেন তার ঘাড়ের ওপর দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে। আর বাড়িটাও যে কি অদ্ভুত! এই শুরু এই শেষ। এখানে মানুষ থাকে কি করে? আরেকটা নামও তখন খুব শোনা যেত। গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশন আর স্বামী লোকেশ্বরানন্দজী। পিসিমা এসে বলতেন মহারাজ মানাকে খুব ভালবাসেন মাঝে মাঝে ডেকে পাঠান।
একদিন বাবার সঙ্গে সন্ধ্যেবেলা গাড়ি করে সিমলে পাড়ায় স্বামীজীর বাড়ি খুঁজতে যাওয়া হল। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে, ৩ নং গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রিট, ভাঙ্গাচোরা হলদে রঙের দেওয়াল, আধভাঙা রংচটা কাঠের দরজা – সামনে লেখা ‘স্বামী বিবেকানন্দের পৈত্রিক বাড়ি’ – মনটা বেশ খারাপই হয়ে গেল। স্বামীজীর ছোটবেলার কত গল্প শুনেছি। ঝকঝকে দক্ষিণেশ্বরের পাশে এটা যেন একেবারেই বেমানান।
ইতিমধ্যে একদিন সন্তুদিদা এসে মা কে বললেন সারদা মঠে নতুন মন্দির হয়েছে। গৌতম তার দায়িত্বে আছে। ওরা আমায় দেখতে নিয়ে যাবে তুমি যাবে? তা মা কি বাবা কোথাও যাওয়া মানেই তো সঙ্গে আমি ফুচকার ফাউ। সেই প্রথম সারদা মঠে যাওয়া। শ্রীমায়ের বিরাট বড় করে নতুন মন্দির তৈরী হয়েছে। তাতে অপূর্ব সুন্দর কারুকাজ। তবে সারদা মঠের ভেতরে তো ছেলেদের যাওয়া বারণ, তাই বাবার সঙ্গে ওখানে বিশেষ যাওয়া হত না। যদিও সেবার ছোট্ঠাম্মা আসার পর ছোট্ঠাম্মা, পিসি, মা, বিল্লু, আর্ণি সবাইকে নিয়ে বাবা সারদা মঠে গিয়েছিল। আমরা মেয়েরা সবাই যখন পুরনো মন্দিরের দিকে মাতাজীদের প্রণাম করতে গেছি তখন বাবা আর আর্ণি গেটের কাছে টুলে বসে মশার কামড় খাচ্ছে!
তখন ক্লাস ফাইভ। প্রথম দিন ক্লাসে এসেই ছোট তৃপ্তিদি বলেছেন সবাইকে নিজের নিজের নামের মানে জেনে আসতে হবে। আবার ক্লাসে এসে একেকজনকে জিজ্ঞেসও করেন তাদের নামের মানে। আমি পড়লুম মহা সমস্যায়। বাড়ি এসে জিজ্ঞেস করায় শুনলুম নাম তো রেখেছে মুনদিদি। ইস্কুল থেকে শুনে এসে বলেছিল ‘চন্দ্রানী রাখতে পারো’। আর বাবার জগৎ তো খেলার জগৎ। ইংল্যান্ডের সঙ্গে টেস্ট ম্যাচে ইডেন গার্ডেন্সে ইন্ডিয়া জিতেছে আর চন্দ্রশেখর দারুণ ফর্মে – কাজেই ‘চন্দ্র’ওয়ালা নাম ফাইনাল। তার অন্য কোনও মানের প্রয়োজন থাকতেই পারে না! কেউ কেউ বলত চন্দ্রানী – চাঁদের রাণী। এতদিন আমি সেই শুনে দিব্যি খুশি ছিলুম। এখন নামের সত্যিকারের মানে খুঁজতে গিয়ে পড়লুম মুশকিলে। চাঁদ কি একটা দেশ যে তার রাণী থাকবে! তখন অবশ্য আমার নিজস্ব একটা উঁচুদেশ ছিল। আবার কেউ বলল চন্দ্রের স্ত্রী। এটাও ঠিক পছন্দ হল না। কোথায় কোন বইতে লেখা আছে শুনি!
আমার তখন প্রাণের বন্ধু সোমা দেবনাথ। ক্লাসে পাশাপাশি বসি আবার এক বাসেও যাই। তবে প্রতি পিরিয়ডে দুজনের একশোবার করে আড়ি হয় আর ভাব! একদিন সোমা এসে বলল ‘সোমা’ মা দুর্গার নাম। সেই শুনে আমার আরও মন খারাপ! ও তো বেশ মা দুর্গার নাম পেয়ে গেল।তা সারদা মঠে মাতাজীরা তখন আমাদের সবার নাম জিজ্ঞেস করছেন। এখনও আবছা আবছা মনে পড়ে তখন দিন গড়িয়ে সন্ধ্যে নেমেছে। আর কলকাতার তখনকার রোজকার নিয়ম মেনে ঝপ করে লোডশেডিং। পুরনো মন্দিরের সিঁড়ির সামনে আমরা কজন। আর উল্টোদিকের বাড়িতে তখন বোধহয় মিস্ত্রি কাজ চলছে। মাতাজীরা ওই আধো আলো আধো আঁধারিতে গরমে সামনের বারান্দায় বসে। আমি বড় মাতাজীকে প্রণাম করে নাম বলতেই ওনার সেবিকা মাতাজী বলে উঠলেন ‘চন্দ্রানী তো মা দুর্গার নাম। তাই না মাতাজী?’ হুররে, কি যে আনন্দ হল! আমার নামের মানেও মা দুর্গার নাম! মঠে মাতাজীরা যখন বলে দিয়েছেন তখন এর ওপর তো আর কোনও কথা হতেই পারেনা! কালই ইস্কুলে গিয়ে সোমাকে বলতে হবে।
এখন লিখতে বসে মনে হচ্ছে ঠিক কথাই তো! সোম থেকে সোমা যদি মা দুর্গা হন তাহলে চন্দ্র থেকে চন্দ্রানীও তো তাইই হবে! সবাই বলে ওই তো ‘ইন্দ্রানী-চন্দ্রানী’। না বাপু, ইন্দ্রকে আমার মোটেই বিশেষ সুবিধের মনে হয় না। কেউ একটু তপস্যা করতে বসলেই তার মনে ভয়! অমনি তপস্যা ভঙ্গ করতে ঊর্বশী-মেনকা-রম্ভাকে পাঠান। এতো ভয় কেন রে বাপু! এতোদিনে বুঝেছি ইন্দ্র আসলে তো কোনও একজন দেবতা নন – ওটা একটা পোস্ট। ‘রাজা’ মানেই ইন্দ্র। তাই এতো গদি হারানোর ভয়!
তখনও মাঝে মাঝে চন্দ্রানীর সঙ্গে মা দুর্গার সম্পর্কটা খোঁজার চেষ্টা করি। ঠাম্মা তো রোজ সকালে চন্ডী পড়ে – দেবী কবচ। ঠাম্মাকেই পাকড়াও করি, চন্ডী থেকে মা দুর্গার সমস্ত নাম আমায় লিখে দাও। নাঃ, চন্দ্রানী কোথাও পাওয়া গেল না! তখন বলল আরে চন্দ্র তো শিবের জটায় থাকেন। তাই চন্দ্রের ‘বস’ শিব, কাজেই চন্দ্রানী দুর্গা। হ্যাঁ এটা বেশ মনের মত কথা! শিবঠাকুর আমার বেজায় পছন্দের – কেমন একটুতেই খুশি, আশুতোষ। কেষ্টবাবুর মত অত প্যাঁচ পয়জার নেই, আর রামচন্দ্রের মত সীতাকে বনবাসেও পাঠান না, অগ্নিপরীক্ষাও নেন না। পার্বতীকে নিয়ে কৈলাসে ‘সুখের সংসার’। তাই তো ছোটবেলায় শিব-পার্বতী খেলতে অত ভাল লাগত।
কিন্তু সবাই যে বলে ‘যেই রাম, যেই কৃষ্ণ এযুগে তিনিই রামকৃষ্ণ’! একদিন কথায় কথায় মণিমালা কাকিমা বললেন ঠাকুর তো শিব তাই জন্মের পরেই গড়িয়ে গড়িয়ে রান্নাঘরে ছাইএর গাদায় চলে গিয়েছিলেন। ঠাকুর শিব! ঠাকুর শিব! হ্যাঁ তাই তো – সেই যে ছোটবেলায় গ্রামে শিবরাত্রির যাত্রাপালায় শিব সেজে অভিনয় করতে করতে ঠাকুরের সমাধি হয়েছিল! উঃ, কি মজা, কি আনন্দ, কি শান্তি!
বাড়িতে একটা বই ছিল – রসিক বিদ্যাসাগর। সেই বই পড়ে তখন ঠাকুরের সঙ্গে বিদ্যাসাগর মশায়ের অনেক কথা জেনেছি। ঠাকুর বলেছেন ‘এতোদিনে খাল বিল ছেড়ে এবার সাগরে এসে পড়েছি’। বিদ্যাসাগরও বলেছেন ‘তাহলে একটু নোনাজল নিয়ে যান’। তাতে ঠাকুর বলেছেন ‘এ তো যে সে সাগর নয় এ হল বিদ্যার সাগর’। কখনও মনে হত এ সব নিশ্চয় লেখকের কল্পনা প্রসূত। পরে কথামৃত পড়ে দেখি আর এক্কেবারে ঠিক ঠিক এই কথাগুলোই তো লেখা! তাহলে এসব তো বানানো গল্প নয়!
পয়লা জানুয়ারী মানেই দাদুর জন্মদিন। সকাল থেকে গোয়াবাগান যাওয়া। কত লোক আসা, কত হৈ হৈ। কিছুদিন পর শুনলুম পয়লা জানুয়ারী ঠাকুরের কল্পতরু উৎসব। ওইদিন ঠাকুর কাশীপুর উদ্যানবাটিতে সব ভক্তদের আশীর্বাদ করেছিলেন ‘তোমাদের চৈতন্য হোক’। যদিও কাশীপুরেই শিবুজেঠুদের বাড়ি, কাশীপুর পেরিয়েই দক্ষিণেশ্বর যেতে হয়, বাবা প্রায়ই ‘ফল্ট’ সারাতে অফিসের কাজে নিউ কাশীপুর যায়, কিন্তু উদ্যানবাটিটা যে ঠিক কোথায় আমি কোনদিন দেখি নি। আর ভীড়ের মধ্যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দেওয়া – তাও বিল্লুদের বাড়ির হৈ চৈ ছেড়ে – একেবারেই অসম্ভব! তাই মা যখন কল্পতরু উৎসবে কাশীপুর যেত আমি কোনদিনই সঙ্গে যাই নি। আমাদের, বিশেষ করে ঠাম্মাকে গোয়াবাগানে নামিয়ে দিয়ে বাবা যেত মা কে একটু ‘এগিয়ে’ দিতে। একবার মা তো সেই সকাল থেকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছে। বাবা দুপুরে খাবার সময় একবার গেল আনতে। ফিরে এসে বলল ‘ওরে বাবা, সে বিশাল লাইন। এখনও ভেতরে ঢুকতেই পারে নি।‘ খাওয়া দাওয়ার পর আবার গেল বাবা। সেবার বোধহয় মা ঘণ্টা ছয়েক লাইন দিয়ে ঠাকুরের দর্শন পেয়েছিল। পরের দিকে গোয়াবাগান যাওয়ার আগে মা আর আমি যোগোদ্যানে গিয়ে কল্পতরু উৎসবের দিন ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম।
এই ভীড় আর লাইনের ভয় বলরাম মন্দিরে রথ টানতেও আমার যাওয়া হয় নি কখনও। এই লকডাউনের আগে অবধি মা যেত। অনেক সময় উল্টোরথের দিন। না যেতে পারলে মায়ের মন খারাপ হয়ে যেত। আর মায়ের সঙ্গে গোপালের একটা অলিখিত চুক্তি ছিল – মা যখনই বাগবাজার স্ট্রিট দিয়ে বলরাম মন্দিরের দিকে যেত ঠিক তখনই গোপালের রথও ওইখান দিয়েই যেত।
হায়ার সেকেণ্ডারী পড়ার সময় প্রাণের বন্ধু হল বর্ণালী – বেলুড়ে বাড়ি, মঠের ঠিক পেছনে। ওর বাবা বেলুড় মঠের ডাক্তার। এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে! বর্ণালীকে বললুম ছুটির মধ্যে তোর বাড়ি যাব। কিন্তু আমায় বেলুড় মঠে নিয়ে যেতে হবে আর সন্ধ্যারতি দেখাবে হবে। ওর সঙ্গে গিয়ে পুজনীয় প্রেসিডেন্ট মহারাজের দর্শন প্রণাম। মায়ের মন্দির, স্বামীজীর মন্দির, রাজা মহারাজের মন্দির ঘুরে তখন সন্ধ্যারতি দেখার পালা। ভাবছি ভেতরের দিকে একটু সামনে করে যদি কোথাও বসা যায়। বর্ণালী বলেছে ওর একটা special ভাল জায়গা আছে। ও বাবা, নিয়ে গিয়ে বসাল মন্দিরের বাইরে গর্ভমন্দিরের দিকে একটা দরজার আড়ালে। ব্যস্, শুরু হয়ে গেল দুই বন্ধুর খিটির মিটির। আমি বলি দুর্, এখান থেকে ঠাকুরের মুখটাই দেখা যায় না! ও বলে ভেতরে আরতিটাই তো দেখা যায় না অত পেছন থেকে – সামনে সব সন্ন্যাসী, ব্রহ্মচারী তারপর লম্বা লম্বা পুরুষের ভীড় পেরিয়ে মহিলাদের জায়গা! মহারাজ এত ভাল আরতি করেন এখান থেকে সেটা খুব সুন্দর দেখা যায়। তবে কিনা আমার সব কথাই বর্ণালী তখন শেষ পর্যন্ত মেনে নিত, তার ওপর আমি guest. কাজেই প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভেতরে গিয়েই বসা হল। কি লাভ হল! এর ওর ফাঁক দিয়ে কোনরকমে ঠাকুরকে দেখা – যত ভীড় তত গরম! এর চেয়ে বাইরে থেকে আরাতিটাও ভাল দেখা যেত গঙ্গার ঠাণ্ডা হাওয়াও ছিল। কিন্তু বেলুড় মঠের সন্ধ্যারতি দেখা আর ভজন শোনার অভিজ্ঞতাই অন্যরকম। আরত্রিকের ওইরকম গমগমে আওয়াজ আর কোনও আশ্রমে পাওয়া যায় না। ঠাকুরের হেড অপিস বলে কথা!
বেলুড় মঠে পরে টুকটাক যাওয়া হয়েছে, কিন্তু আরতি পুরো শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করা যায় নি। দক্ষিণেশ্বর থেকে লঞ্চ পেরিয়ে গেলে ততক্ষণে ফেরী বন্ধ। আর ফেরার গাড়ি পাওয়া যায় না। রাস্তায় বাসে তখন অফিস ফেরতা জনতার প্রচন্ড ভীড়। গাড়ি নিয়ে গেলেও বালীব্রীজ হাওড়া ব্রীজের ট্র্যাফিক জ্যামের ভয়।
মন্দিরের ভোগ প্রসাদ পেতে আমার ভীষণ ভাল লাগে। বাবুরাম মহারাজ যেমন বলেছিলেন প্রসাদ খাইয়ে উনি ভক্তদের ঠাকুরের কাছে টেনে আনেন। একবার বেলার দিকে বেলুড় মঠে গেছি। মন্দির দর্শন করে বেরিয়ে সামনেই দেখি বাবার ‘অরুণদা’, মঠের অনেক পুরনো কর্মী। আমাদের দেখে তিনিই প্রসাদ পাবার ব্যবস্থা করে দিলেন। পরে বিয়ের পর ছোটকাকা-কাকিমার সঙ্গে গিয়েও প্রসাদ পাওয়া গেছে।
আর সারদা মঠে গেছি পিসির সঙ্গে, কানাইজেঠু-ইলাজেঠিমার সঙ্গে। সকালের দিকে যাওয়া মানেই মাতাজীর দর্শন প্রণামের পর প্রসাদ পাওয়া। পিসি আবার বলত শনি-মঙ্গলবারে গেলে মঠে সেদিন আমিষ প্রসাদ। প্রসাদ যা-ই হোক তার স্বাদই আলাদা। তাতে ঠাকুরের দৃষ্টি পড়ে কি না। একবার মনে হল ছোটবেলা থেকে এত যে দক্ষিণেশ্বর যাওয়া হয় রাণী রাসমনির ব্যবস্থাপনার মা ভবতারিণীর প্রসাদ পাব না? সেই রকম আদ্যাপীঠেও প্রসাদ পেয়েছি। আর কালীঘাটের মন্দিরের নিরামিষ মাংসও বাপী আমার ইচ্ছেপূরণ করতে বাড়িতে আনার ব্যবস্থা করেছেন।
সারদেশ্বরী আশ্রমে গেলে যত সন্ধ্যেই হোক মাতাজীরা লালজীর প্রসাদ না পেয়ে আসতে দেন নি। কি যে ভাল লাগত মাতাজীদের পরম যত্ন করে সামনে বসে খাওয়ানো। ঠিক সেই রকমই পুণায় সারদা মঠে বা দিল্লীতে মিশনে গিয়ে দেখেছি মাতাজীদের কাছে ভক্তদের অবারিত দ্বার। কলেজ ফেরতা যাই বলে কক্খোনো শুধু মুখে ফিরতে দেন না। ভেতরে খাবার ঘরে বসিয়ে গরম চা, সঙ্গে মুড়ি, চানাচুর, চাকলি, বিস্কুট, মিষ্টি – যা হয় কিছু না কিছু খাইয়েছেন। হঠাৎ গিয়েও দিওয়ালীর আগে ভক্তদের করে আনা ‘খাউ’ (স্ন্যাক্স), দুর্গাপুজোয় volunteerদের সঙ্গে বসে ডাল-ভাত বা খিচুড়ি না খাইয়ে মাতাজীরা ছাড়েন নি। প্রবাসে থেকেও এই ‘মায়ের আদর’ শুধু আমি একা নই আমার শাশুড়ি মাও খুব ভালবাসতেন।
স্বামী স্তবপ্রিয়ানন্দ মাঝে মাঝে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কড়া ভাষায় বলেন ‘রামকৃষ্ণ মিশনে দীক্ষা নেওয়াটা আপনাদের একটা status symbol, craze!’ একেকসময় হয়তো আমারো সেই রকম মনে হত। চারপাশে সবাই দীক্ষা নিয়েছে। বিয়ের আগে বাবাকে বললে বলতো ‘কি হবে?’ সত্যি যে ‘কি হবে’ তখন কিছুই বলতে পারতুম না। তবে কোনদিন কোনও মঠে গেলে – মায়ের বাড়ি, যোগোদ্যান – দেখতুম লোকজন কেমন একটা ডাঁটের মাথায় ঘুরছে। যেন একটা authority, sense of belongingness. পরে বুঝেছি ওটা নিছকই আমাদের ভক্তদের নির্বুদ্ধিতা। শুধুই দীক্ষা নেওয়ায় ঠাকুর-মা-স্বামীজী বা মহারাজ-মাতাজীদের কিচ্ছু আসে যায় না! হ্যাঁ যে কেউই রোজ গেলে অবশ্যই তার সঙ্গে একটা পরিচিতি হয়ে যায়, তার বেশী কিছুই নয়।
যাই হোক, হয়তো কিছুটা হুজুগে পড়েই একে তাকে জিজ্ঞেস করি দীক্ষা নিতে গেলে কি করতে হয়? খুব ছোটবেলায় দু-একবার দাদিকে দেখেছিলুম ঠাকুরঘরে বসে ‘জপ’ করতে। সেই টাইনি-টটের ঠাকুরের ছবিটার মতই দাদির ওই জপ করার ছবিটাও মনের কোনও এক কোণে জমা হয়ে গিয়েছিল। আর ট্রেনে করে কুলটি যেতে ‘বেলানগর’ স্টেশন এলেই মা বলত ‘এখানে দাদির গুরুদেবের আশ্রম’। সেই গুরুদেব কথাটাও মনে গেঁথে গিয়েছিল। একবার সোমাকে জিজ্ঞেস করলুম কি করে ‘কড় গুণতে’ হয় বল তো? সোমা দেখিয়ে দিল। নিজের মনে নিজের খেয়াল খুশী মত অং বং মন্ত্র বলে মাঝে মাঝে ‘কড় গুণতুম’। বড় হয়ে একবার পিসিও দেখালো ‘কড় গোণা’। মণিমালা কাকিমার কাছ থেকে এনে ঠাকুর-মা-স্বামীজীর ছোট জীবনী পড়া হল আর কিছুটা কথামৃত। সব কিছুর খেয়ালের মত বই পড়ারও খেয়াল। স্বামীজীর কর্মযোগ আর অন্য দু একটা লেখাও ‘পড়ে ফেলা’ গেল। কিন্তু ‘সাপলুডো খেলছে বিধাতার সঙ্গে’ শুনে যে মেয়ের মাথা খারাপ হয়ে যায়, সাপ বিধাতার সঙ্গে কি করে লুডো খেলতে পারে ভেবে, স্বামী বিবেকানন্দের লেখা পড়ে বোঝা যে তার মোটা মাথার কম্মো নয় বলাই বাহুল্য। মনে হয় সামনে বসিয়ে কেউ লাইন বাই লাইন পড়ে বুঝিয়ে দেয় তো বেশ হয়।
সব সন্তানেরই ‘শেষ আশ্রয়’ ‘মা’। ওই জন্যেই বোধহয় বাবা প্রথমেই শিখিয়ে দিয়েছিল ‘মা আছেন আর আমি আছি ভাবনা কি আছে আমার?’। নিত্যদিনের সংসারে যখন কোন দিশা পাই না, মন যখন কোন কারণে এক্কেবারে জর্জরিত, ভারাক্রান্ত, মায়ের কাছে গিয়েই চোখের জলে ভেসেছি। আশ্চর্যজনকভাবে সাড়াও পেয়েছি। মায়ের ওপর অনেক সময় অনেক অভিমানও করেছি – সবাইকে কাছে ডাকো, আমি বুঝি তোমার সন্তান নই! আমি বুঝি সবার অধম, সবার চেয়ে খারাপ! তা তুমিই তো বলেছো ‘আমার সন্তান ধুলোকাদা মেখে এলে আমিই তাকে কোলে তুলে ধুলো ঝেড়ে দেবো’।
একবার কোন একজনের সাক্ষাৎকারে পড়েছিলুম তাঁর ঘরের একদিকের দেওয়াল জুড়ে শ্রী শ্রী মায়ের ছবি আর একদিকের দেওয়াল জুড়ে স্বামীজীর ছবি। যাতে বিছানায় শুয়ে শুয়েই তিনি মাকে আর স্বামীজীকে দেখতে পান। কিন্তু ঠাকুর এতই বড়, এতই বিশাল যে ঠাকুরকে রাখার মত কোনও দেওয়াল তাঁর ঘরে নেই। স্বামী সমর্পণানন্দজী বলেন ‘Person, personality, principle’. কিন্তু টাইনি-টটের সেই ছোট্ট বোকা মেয়েটা তো কোনওদিন বুঝতেই পারে নি যে ডায়রির ওই দাড়িওয়ালা মানুষটা এত্তো বিশাল!!