শুরুটা সে-ই ত্রিবেণীতে। এক বছরের জন্মদিনের সময় যাওয়া হয়েছিল ত্রিবেণী। অবশ্যই এ গপ্পটা আমার মনে নেই। তবে শুরুরও তো শুরু থাকে, তাই একে বাদ দিই কি করে! আর গত দশ বছরে ডাকুদাদা অন্ততঃ দশ হাজার বার গপ্পটা মনে করিয়ে দিয়েছে।
ত্রিবেণীর কোয়ার্টারের সুন্দর সবুজ ঘাসে মোড়া লন দেখে আমি না কি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ‘চুল চুল’ বলে ছুটে গিয়েছিলুম। তারপর সেই সবুজ চুলে ঘুরে বেড়ানো কুচকুচে কালো একটি ডেউ পিঁপড়েকে ভারী উপাদেয় খাবার মনে করে সোজা মুখের মধ্যে চালান করেছিলুম। সেও মহা খুশী হয়ে ছোট্ট জিভের ডগায় দিল বিরাট এক মরণ কামড়! তারপরটুকু অবশ্য ডাকুদাদার সংযোজন। “টুম্পা আগে সব খেতো। তাই এই মোটা ছিল। তারপর একদিন একটা পিঁপড়ে খেয়ে নিল। তারপর সব খাওয়া ছেড়ে দিল আর রোগা হয়ে গেল!” বন্ধুরা যারা শত ডায়েটিং করেও রোগা হতে পারছ না, এই দাওয়াইটা একবার পরখ করে দেখতে পারো।
পরের গল্পটা গোয়াবাগানের বাড়িতে। সকালবেলা মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। আর আমিও সেই ফাঁকে চুলের কাঁটা, সেফটি পিন এ সব নিয়ে আমার গবেষণা শুরু করলুম। বসার ঘরের দেওয়ালে বেশ নিচের দিকে একটা প্লাগ পয়েন্ট ছিল। খুব মন দিয়ে প্রথমে তাতে সেফটি পিনটি ঢোকাই। বিশেষ সুবিধে মনে হয় নি। তারপর মাথার কাঁটাটা বেশ করে বেঁকিয়ে প্লাগের গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে যেই না সুইচটি অন করেছি – ব্যস, আর যায় কোথায়! ঝাঁ করে কারেন্ট এক্কেবারে টুঁটি টিপে ধরে। মা এসে কিভাবে যে সে যাত্রায় উদ্ধার করে কে জানে!
মাথার কাঁটা-ক্লিপ নিয়ে গবেষণার এটাই ইতি নয় মোটেই। ইঞ্জিনীয়রিং-এ ফেল করে এবার ডাক্তারি। মানে রীতিমতো চোখের সার্জারি। বেচারা মুনদিদি। ছোটবোনকে আদর করে কোলে বসিয়েছে। আর আমিও হাতে টেস্টার আর মুনদিদিরই চুলের হেয়ারপিন খুলে নিয়ে খুব মনযোগ সহকারে মুনদিদির চোখে থানিট (ছানি) অপারেশন করতে লেগে গেছি। তার ঠিক আগেই নদাদির চোখে ‘থানিট’ পড়েছে, অপারেশন করতে হবে – এই সুসংবাদটি কানে গেছে আর কি! একটুর জন্যে সে যাত্রায় মুনদিদির চোখটা বেঁচে যায়। মানে চোখের সাদা অংশ ছেড়ে তখনও কালো মণিতে হাত পড়ে নি আর কি!
বাবা-মার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি দিল্লি। সেখান থেকে আবার দেরাদুনে গিয়ে ডাকুদাদার হোস্টেল দেখতে যাওয়া হবে। ট্রেন থেকে নেমে কান্তিদাদুর বাড়ি ওঠা হয়েছে। ভোরবেলা, তখন দুধ আনার সময়। সবে সবে দিল্লিতে তখন মাদার ডেয়ারীর অটোমেটেড মেশিন বসানো হয়েছে। পয়সা ফেললে না কি আপনি দুধ পড়ে! ভারি মজার জিনিস! দাদু বললেন, “চলো তোমায় দেখিয়ে আনি”। সাইকেলের রডে বসিয়ে নিয়ে গেছেন। আসার পথে নয়াদিল্লির সব বড় বড় বাড়ি দেখাতে দেখাতে আসছেন। এটা এই, ওটা ওই। এদিকে আমার মাথায় তো ঘুরছে বাহ্, সাইকেলের চাকাটা তো দিব্যি ঘুরছে। ওই সরু সরু স্পোকের মধ্যে পা ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়! পা-টাও বেশ ঘুরবে চাকার সঙ্গে! ব্যস, আর যায় কোথায়! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পা কেটে ছড়ে রক্তারক্তি। একটুর জন্যে হাড় ভাঙে নি এই যা। কোনরকমে বাড়ি এনে ডাক্তার-বদ্যি, ওষুধ-ব্যাণ্ডেজ – সমস্ত বেড়ানো পণ্ড। পুরো ছুটি শুধু যে গৃহবন্দী তা নয়, একেবারে ঘরবন্দী।
কিছু লোক ঠেকেও শেখে না – আমি হচ্ছি সেই দলে। কারণ এরপর টালায় একবার সমরদার সাইকেলে চেপে ফের চাকায় পা ঢুকিয়ে দেখতে গিয়েছিলুম আগের বার ঠিক কি হয়েছিল আর কতটা লেগেছিল। যা হোক ছোটবেলার সে ব্যথা না থাকুক পায়ের সে কাটার দাগ আজও রয়ে গেছে।
সে এক শনিবার। দুপুরবেলা অফিস থেকে ফিরে বাবা খেতে বসেছে। আমি ততক্ষণে রেডি – শ্যামনগর যাওয়া হবে মামুদের জুট মিলে। খুব মজা! গাড়ির চাবিটা হাতে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসেছি। সঙ্গে ভরত – মায়ের হুকুমবরদার। আমার পা তখনও গাড়ির আক্সিলেটার অবধি পৌঁছোয় না। তাই ভরত বসেছে ড্রাইভারের সিটে। আর আমি পাশে বসে নির্দেশকের ভুমিকায়। ফিয়াট গাড়ির হ্যাণ্ড গিয়ার। গিয়ার তো আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। এবার যেই না চাবি ঘুরিয়েছে গাড়ি গ্যাঁক করে এগিয়ে গেছে পাশের খোলা ড্রেনের দিকে। ভাগ্যিস পাড়ার মোড়ে দাদারা আড্ডা মারছিল। তাই দেখতে পেয়ে হৈ হৈ করে গাড়ি থামিয়ে বাবাকে খবর দেয়। উফ্, খুব বেঁচে গেছি সেবার!
তবে ওই খোলা ড্রেনের হাত থেকে বাবুদাদা বেচারা নিস্তার পায় নি। সে-ই মেজঠাম্মার বিখ্যাত ষোলো ইঞ্চির সাইকেলে চেপে সাঁ সাঁ করে আসতে গিয়ে সটাং ড্রেনের জলে। ভাগ্যিস কোণের কাছে পাইপটা ছিল! তাই পুরো ডুবে যায় নি। পাঁকে পড়ে, ওই দাদারাই ছুটে এসে তোলে। পাড়ার মোড়ে বখাটে ছেলেদের আড্ডা মারারও উপকারিতা আছে, মানতেই হবে!
তারপর ধরো সেবারের সেই কালীপুজোয় -। দুপুরবেলা বাজী রোদ্দুরে দেওয়া হয়েছে। তর সয় না আর! এক্ষুণি পোড়াতে হবে। দিনের বেলা তো কি হয়েছে! সাপবাজী তো জ্বালানোই যায়! লাল-নীল দেশলাই তো সঙ্গেই আছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে দুই মক্কেলে নিজেরাই সাপবাজী জ্বালাতে বসেছি – আমি আর বিল্লু। দুষ্টু সাপবাজীতে আগুন ধরেই না কিছুতেই। আমিও মাথাটা ততটাই ঝুঁকিয়ে দিই। হঠাৎ দেখি চড়চড় করে আমার মাথার ঠিক পাশেই ফুলঝুরি জ্বলছে। আরে বিল্লুটা করে কি! অত মুখের কাছে কেউ ফুলঝুরি জ্বালায়! ও মা ওই তো বিল্লু সামনে দাঁড়িয়ে – মুখে ভয়! আরে তবে এ ফুলঝুরিটা জ্বালায় কে! হে ভগবান – ফুলঝুরি নয় – আমারই মাথার চুলগুলো পটপট করে জ্বলছে! মা গো, বাঁচাও! আর করব না!
মানছি এ যাবৎ সবই আমার দোষ। তা বলে ওই ছেলেধরার খপ্পরে পড়াটায় আমার কোনোও হাত ছিল না। আমার মায়ের একটা ছোটবেলার ইমিটেশন হার ছিল। তার লকেটটা ভা-রি সুন্দর। এই এত্তোবড় টুকটুকে লাল পাথর বসানো। পারতপক্ষে সেটা আমি হাতে পেতুম না। তবে গ্রহের ফের আর কি! দোষের মধ্যে সেদিন সেই হারটা পরে দুপুরবেলা ওই আমি আর বিল্লু চরতে বেরিয়েছি। বাপ্পাদাও সাইকেল নিয়ে ঘুরছে। আর আমরাও ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছি। ঠিক হল বাপ্পাদা আমাদের ওর সাইকেলে চাপিয়ে একটু ঘোরাবে। বিল্লু হল কি না গেস্ট। তাই ওর চান্স আগে। আমি সিঁড়িতে একা একা বসে অপেক্ষায়। সামনে বাবুদের জানলা থেকে বাবু আর বাবুর মায়ের গলা পাওয়া যাচ্ছে। দেখি একটা নেপালি ছেলে উদ্দেশ্যবিহিনভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার গলার লকেটটায় হাত দিয়ে বলে “এটা আমায় দাও”। মামদোবাজি আর কি! ওটা বলে মায়ের এতও শখের জিনিস, আমাকেই পরতে দেয় না। আজ অতি কষ্টে পেয়েছি! খুব সাহস করে বলি, “এটা ইমিটেশন”। বলে – “তুমি আমার সঙ্গে চলো”। ব্যস, সমস্ত সাহস হাউই-এর মতো ফুস্। চোখ বন্ধ করে একটা রাম চিৎকার দিই – মা—। ও মা, লোকটা হেলতে দুলতে চলে গেল যেন কিছুই হয় নি। আমার ওদিকে হাত-পা সব ঠকঠক করে কাঁপছে। ঘরে যাবারও যেন আর শক্তি নেই। অথচ চারদিকের এতও লোকজন সত্ত্বেও লোকটার কোনও বিকার নেই!
এতোদিন ছেলেধরা শুধু গল্প কথাতেই শুনেছি। বড়জোর খবরের কাগজের পাতায়। এ যে জলজ্যান্ত ছেলেধরা! কোনোরকমে বাড়ি ঢুকে গলার হার, কানের দুল সব খুলে মায়ের হাতে দিই। দরকার নেই বাপু আমার গয়না পরে! উফ্, সেদিন যা ভয়টাই না পেয়েছিলুম, মনে করে এখনও আমার হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।।