Posted in Uncategorized

অঘটনঘটনপটিয়সী

শুরুটা সে-ই ত্রিবেণীতে। এক বছরের জন্মদিনের সময় যাওয়া হয়েছিল ত্রিবেণী। অবশ্যই এ গপ্পটা আমার মনে নেই। তবে শুরুরও তো শুরু থাকে, তাই একে বাদ দিই কি করে! আর গত দশ বছরে ডাকুদাদা অন্ততঃ দশ হাজার বার গপ্পটা মনে করিয়ে দিয়েছে।

ত্রিবেণীর কোয়ার্টারের সুন্দর সবুজ ঘাসে মোড়া লন দেখে আমি না কি ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ‘চুল চুল’ বলে ছুটে গিয়েছিলুম। তারপর সেই সবুজ চুলে ঘুরে বেড়ানো কুচকুচে কালো একটি ডেউ পিঁপড়েকে ভারী উপাদেয় খাবার মনে করে সোজা মুখের মধ্যে চালান করেছিলুম। সেও মহা খুশী হয়ে ছোট্ট জিভের ডগায় দিল বিরাট এক মরণ কামড়! তারপরটুকু অবশ্য ডাকুদাদার সংযোজন। “টুম্পা আগে সব খেতো। তাই এই মোটা ছিল। তারপর একদিন একটা পিঁপড়ে খেয়ে নিল। তারপর সব খাওয়া ছেড়ে দিল আর রোগা হয়ে গেল!” বন্ধুরা যারা শত ডায়েটিং করেও রোগা হতে পারছ না, এই দাওয়াইটা একবার পরখ করে দেখতে পারো।

পরের গল্পটা গোয়াবাগানের বাড়িতে। সকালবেলা মা রান্নাঘরে ব্যস্ত। আর আমিও সেই ফাঁকে চুলের কাঁটা, সেফটি পিন এ সব নিয়ে আমার গবেষণা শুরু করলুম। বসার ঘরের দেওয়ালে বেশ নিচের দিকে একটা প্লাগ পয়েন্ট ছিল। খুব মন দিয়ে প্রথমে তাতে সেফটি পিনটি ঢোকাই। বিশেষ সুবিধে মনে হয় নি। তারপর মাথার কাঁটাটা বেশ করে বেঁকিয়ে প্লাগের গর্তের মধ্যে ঢুকিয়ে যেই না সুইচটি অন করেছি – ব্যস, আর যায় কোথায়! ঝাঁ করে কারেন্ট এক্কেবারে টুঁটি টিপে ধরে। মা এসে কিভাবে যে সে যাত্রায় উদ্ধার করে কে জানে!

মাথার কাঁটা-ক্লিপ নিয়ে গবেষণার এটাই ইতি নয় মোটেই। ইঞ্জিনীয়রিং-এ ফেল করে এবার ডাক্তারি। মানে রীতিমতো চোখের সার্জারি। বেচারা মুনদিদি। ছোটবোনকে আদর করে কোলে বসিয়েছে। আর আমিও হাতে টেস্টার আর মুনদিদিরই চুলের হেয়ারপিন খুলে নিয়ে খুব মনযোগ সহকারে মুনদিদির চোখে থানিট (ছানি) অপারেশন করতে লেগে গেছি। তার ঠিক আগেই নদাদির চোখে ‘থানিট’ পড়েছে, অপারেশন করতে হবে – এই সুসংবাদটি কানে গেছে আর কি! একটুর জন্যে সে যাত্রায় মুনদিদির চোখটা বেঁচে যায়। মানে চোখের সাদা অংশ ছেড়ে তখনও কালো মণিতে হাত পড়ে নি আর কি!

বাবা-মার সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছি দিল্লি। সেখান থেকে আবার দেরাদুনে গিয়ে ডাকুদাদার হোস্টেল দেখতে যাওয়া হবে। ট্রেন থেকে নেমে কান্তিদাদুর বাড়ি ওঠা হয়েছে। ভোরবেলা, তখন দুধ আনার সময়। সবে সবে দিল্লিতে তখন মাদার ডেয়ারীর অটোমেটেড মেশিন বসানো হয়েছে। পয়সা ফেললে না কি আপনি দুধ পড়ে! ভারি মজার জিনিস! দাদু বললেন, “চলো তোমায় দেখিয়ে আনি”। সাইকেলের রডে বসিয়ে নিয়ে গেছেন। আসার পথে নয়াদিল্লির সব বড় বড় বাড়ি দেখাতে দেখাতে আসছেন। এটা এই, ওটা ওই। এদিকে আমার মাথায় তো ঘুরছে বাহ্‌, সাইকেলের চাকাটা তো দিব্যি ঘুরছে। ওই সরু সরু স্পোকের মধ্যে পা ঢুকিয়ে দিলে কেমন হয়! পা-টাও বেশ ঘুরবে চাকার সঙ্গে! ব্যস, আর যায় কোথায়! যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পা কেটে ছড়ে রক্তারক্তি। একটুর জন্যে হাড় ভাঙে নি এই যা। কোনরকমে বাড়ি এনে ডাক্তার-বদ্যি, ওষুধ-ব্যাণ্ডেজ – সমস্ত বেড়ানো পণ্ড। পুরো ছুটি শুধু যে গৃহবন্দী তা নয়, একেবারে ঘরবন্দী।

কিছু লোক ঠেকেও শেখে না – আমি হচ্ছি সেই দলে। কারণ এরপর টালায় একবার সমরদার সাইকেলে চেপে ফের চাকায় পা ঢুকিয়ে দেখতে গিয়েছিলুম আগের বার ঠিক কি হয়েছিল আর কতটা লেগেছিল। যা হোক ছোটবেলার সে ব্যথা না থাকুক পায়ের সে কাটার দাগ আজও রয়ে গেছে।

সে এক শনিবার। দুপুরবেলা অফিস থেকে ফিরে বাবা খেতে বসেছে। আমি ততক্ষণে রেডি – শ্যামনগর যাওয়া হবে মামুদের জুট মিলে। খুব মজা! গাড়ির চাবিটা হাতে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসেছি। সঙ্গে ভরত – মায়ের হুকুমবরদার। আমার পা তখনও গাড়ির আক্সিলেটার অবধি পৌঁছোয় না। তাই ভরত বসেছে ড্রাইভারের সিটে। আর আমি পাশে বসে নির্দেশকের ভুমিকায়। ফিয়াট গাড়ির হ্যাণ্ড গিয়ার। গিয়ার তো আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। এবার যেই না চাবি ঘুরিয়েছে গাড়ি গ্যাঁক করে এগিয়ে গেছে পাশের খোলা ড্রেনের দিকে। ভাগ্যিস পাড়ার মোড়ে দাদারা আড্ডা মারছিল। তাই দেখতে পেয়ে হৈ হৈ করে গাড়ি থামিয়ে বাবাকে খবর দেয়। উফ্‌, খুব বেঁচে গেছি সেবার!

তবে ওই খোলা ড্রেনের হাত থেকে বাবুদাদা বেচারা নিস্তার পায় নি। সে-ই মেজঠাম্মার বিখ্যাত ষোলো ইঞ্চির সাইকেলে চেপে সাঁ সাঁ করে আসতে গিয়ে সটাং ড্রেনের জলে। ভাগ্যিস কোণের কাছে পাইপটা ছিল! তাই পুরো ডুবে যায় নি। পাঁকে পড়ে, ওই দাদারাই ছুটে এসে তোলে। পাড়ার মোড়ে বখাটে ছেলেদের আড্ডা মারারও উপকারিতা আছে, মানতেই হবে!

তারপর ধরো সেবারের সেই কালীপুজোয় -। দুপুরবেলা বাজী রোদ্দুরে দেওয়া হয়েছে। তর সয় না আর! এক্ষুণি পোড়াতে হবে। দিনের বেলা তো কি হয়েছে! সাপবাজী তো জ্বালানোই যায়! লাল-নীল দেশলাই তো সঙ্গেই আছে। মোমবাতি জ্বালিয়ে দুই মক্কেলে নিজেরাই সাপবাজী জ্বালাতে বসেছি – আমি আর বিল্লু। দুষ্টু সাপবাজীতে আগুন ধরেই না কিছুতেই। আমিও মাথাটা ততটাই ঝুঁকিয়ে দিই। হঠাৎ দেখি চড়চড় করে আমার মাথার ঠিক পাশেই ফুলঝুরি জ্বলছে। আরে বিল্লুটা করে কি! অত মুখের কাছে কেউ ফুলঝুরি জ্বালায়! ও মা ওই তো বিল্লু সামনে দাঁড়িয়ে – মুখে ভয়! আরে তবে এ ফুলঝুরিটা জ্বালায় কে! হে ভগবান – ফুলঝুরি নয় – আমারই মাথার চুলগুলো পটপট করে জ্বলছে! মা গো, বাঁচাও! আর করব না!

মানছি এ যাবৎ সবই আমার দোষ। তা বলে ওই ছেলেধরার খপ্পরে পড়াটায় আমার কোনোও হাত ছিল না। আমার মায়ের একটা ছোটবেলার ইমিটেশন হার ছিল। তার লকেটটা ভা-রি সুন্দর। এই এত্তোবড় টুকটুকে লাল পাথর বসানো। পারতপক্ষে সেটা আমি হাতে পেতুম না। তবে গ্রহের ফের আর কি! দোষের মধ্যে সেদিন সেই হারটা পরে দুপুরবেলা ওই আমি আর বিল্লু চরতে বেরিয়েছি। বাপ্পাদাও সাইকেল নিয়ে ঘুরছে। আর আমরাও ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছি। ঠিক হল বাপ্পাদা আমাদের ওর সাইকেলে চাপিয়ে একটু ঘোরাবে। বিল্লু হল কি না গেস্ট। তাই ওর চান্স আগে। আমি সিঁড়িতে একা একা বসে অপেক্ষায়। সামনে বাবুদের জানলা থেকে বাবু আর বাবুর মায়ের গলা পাওয়া যাচ্ছে। দেখি একটা নেপালি ছেলে উদ্দেশ্যবিহিনভাবে ঘুরতে ঘুরতে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার গলার লকেটটায় হাত দিয়ে বলে “এটা আমায় দাও”। মামদোবাজি আর কি! ওটা বলে মায়ের এতও শখের জিনিস, আমাকেই পরতে দেয় না। আজ অতি কষ্টে পেয়েছি! খুব সাহস করে বলি, “এটা ইমিটেশন”। বলে – “তুমি আমার সঙ্গে চলো”। ব্যস, সমস্ত সাহস হাউই-এর মতো ফুস্‌। চোখ বন্ধ করে একটা রাম চিৎকার দিই – মা—। ও মা, লোকটা হেলতে দুলতে চলে গেল যেন কিছুই হয় নি। আমার ওদিকে হাত-পা সব ঠকঠক করে কাঁপছে। ঘরে যাবারও যেন আর শক্তি নেই। অথচ চারদিকের এতও লোকজন সত্ত্বেও লোকটার কোনও বিকার নেই!

এতোদিন ছেলেধরা শুধু গল্প কথাতেই শুনেছি। বড়জোর খবরের কাগজের পাতায়। এ যে জলজ্যান্ত ছেলেধরা! কোনোরকমে বাড়ি ঢুকে গলার হার, কানের দুল সব খুলে মায়ের হাতে দিই। দরকার নেই বাপু আমার গয়না পরে! উফ্‌, সেদিন যা ভয়টাই না পেয়েছিলুম, মনে করে এখনও আমার হাত পা সব ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।।

 

Posted in Uncategorized

রু-মু-সু-কু

সক্কালবেলা whatsapp দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল মুকুরের। ‘মা আসছেন’ ছবি সঙ্গে এবারের নতুন ‘গানপাড়ার গান’ পাঠিয়েছে সুকু – সুকান্তা। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে কলকাতা, দিল্লি থেকে দুবাই – সব্বাইকে সব কাজ ফেলে পুজোয় একজোট হবার গান – নইলে নাকি আড়ি! আহা কলকাতায় বসে ওরা কি করে বুঝবে প্রবাসী মনের ছটফটানি!

মুকুর, সুকান্তা, রুক্মিনী আর কুঙ্কুম – মুকু-সুকু-রুকু আর কুঙ্কু – নাম মিলিয়ে মিতালী। সেই ঘুনসি যুগ থেকে একসঙ্গে বড় হওয়া। এক সোসাইটি, এক স্কুল। যেখানে যায় যা করে চারমূর্তি একসঙ্গে। তারপর কালের নিয়মে একেকজন একেকদিকে ছিট্‌কে গেছে। রুকু-সুকু দুজনেই যদিও কলকাতায় তবু সবাই এখন নিজের নিজের জীবনে ব্যস্ত। তাই দেখা সাক্ষাৎ বলতে ওই পুজোর সময়ই। সোসাইটির পুজোয় নবমীর মাংস-ভাত খাবার হাতছানিটা উপেক্ষা করা খুব কঠিন!

ছেলেমেয়েদের নাচ-গান-আঁকা-টিউশনের ব্যস্ত রুটিনের মাঝে নিজেদের জন্য সময় বের করাই দায়। ফলে মাঝে যোগাযোগটা কমেই গিয়েছিল। এই ঘোর সংসারী মহিলাদের দেখে কে বলবে ক’বছর আগেও এদের ছাদ থেকে ছাদে ‘সুকু, সুকু’, ‘মুকু, মুকু’ ডাকে সোসাইটির আনেকেরই সকাল শুরু হতো। ভাগ্যিস এই Facebook-Whatsapp টা হয়েছে। তাই তো আবার চারজনে সেই হারানো দিনগুলোয় ফিরে যেতে পেরেছে।

কুঙ্কু তো সেই কবে থেকেই বলছে। সে কিনা বেঙ্গালুরুর ব্যস্ত IT ঘরনী। নিজেও teacher. তাই এসব ব্যপারে বাকীদের চেয়ে এক কদম এগিয়ে। এখন তো স্কুল-কলেজের সমস্ত Official Notice সুদ্ধু whatsapp এ আসছে। students, colleagues, guardians  তার সঙ্গে ছেলেমেয়ের বন্ধুদের, তাদের মায়েদের, তাদের নাচের, আঁকার এমন সাত-সতেরো গ্রুপের ভীড়ে track রাখাই মুস্কিল। তবু তার মধ্যে এই ‘রুমুসুকু’ এক ঝলক টাটকা বাতাস। আজকাল এখানে Good Morning করে চারজনের দিন শুরু। আর যত রাতই হোক Good Night না করলে ঘুমই আসে না।

এবারের ideaটাও কুঙ্কুরই। চারজনের চারের ঘরে পা দেবার special celebration. বুঝলে না – সব ‘চল্লিশ পেরোলেই চাল্‌সে’! তাই এবারের পুজোটা সেই ছোটবেলার মত একসঙ্গে কাটানোর মতলব।

রুকুর মেয়ে এবার পুজোয় নাচ করছে – মহিষাসুরমর্দিনী। কদিন ধরে Group chat এ শুধু তারই আলোচনা। ‘মা দুর্গা’র লাল টুকটুকে জরিপাড় শাড়ী চাই, ‘ঠাকুরের সাজ’ চাই। কোথায় গেলে পাওয়া যাবে! ভাল অথচ সস্তা! রুকুর নিজের বিয়ের লাল বেনারসীটা আছে – কিন্তু সেটা যা জগদ্দল ভারি! ওই পরে যুদ্ধ করতে গেলে শেষটায় মা দুগ্‌গাই না স্টেজে হোঁচট খেয়ে চিৎপটাং হয়ে পড়ে।

মুকু বললে, ‘হাতিবাগানে চলে যা না – সুর্য্য বস্ত্রালয়। Fixed price র দোকান। ঝামেলা কম। ওখানে নিশ্চয় লাল সিন্থেটিক মিক্স ঠাকুরের শাড়ি পেয়ে যাবি। নেহাৎ দরকার হলে সম্রাট তো আছেই, জরির পাড় কিনে বসিয়ে দিস’। কথাটা মন্দ নয়। কিন্তু এখন পুজোর মুখে সবাই last minute shopping  এ ব্যস্ত। হাতিবাগানে অটো থেকে নেমেই ভীড়ের ঠেলায় সোজা শ্যামবাজার! দোকানে কি ঢোকা যাবে! আর ‘ঠাকুরের সাজ’! সে কি আবার কুমোরটুলি ছুটতে হবে! ‘আহা, মুচিবাজারটা দেখ না একবার’। নইলে নাহয় Dresser  ভরসা।

মনে পড়ে যায় নিজেদের ছোটবেলার দিনগুলো। সেই এক দেড় মাস আগে থেকে রিহার্সাল! সেখানে কত্ত মজা আর হৈ চৈ। পড়াশুনো শিকেয় তুলে এর ওর পেছনে লাগা, ঠাট্টা তামাসা। সত্যি পুজো শুরু হতে হতেই মন খারাপ! পঞ্চমীর দিন থেকেই সুকু বলতো ‘যাঃ, পুজো শেষ হয়ে গেল’! অর্থাৎ ওই আবার সেই পড়াশুনোর গোয়ালে ঢোকা!

এখন তাই রুকুর মেয়ের মধ্যে দিয়েই নিজেদের ছোটবেলায় ফিরে যাওয়া। মেয়ে বড় হচ্ছে – তার হাজার বায়না। এখন ‘লাল ফিতে, চিরুনী আর আয়না’ লালঝুঁটিদের মন ভরায় না! বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়া হবে। তাই লিপস্টিক-নেলপলিশ-কাজল-লাইনার এসব চাই! রুকু তো রেগেই আগুন! ইস্কুলের গণ্ডী পেরোয় নি, এখন থেকেই এই! মাসিদের অগাধ প্রশ্রয়। ‘আহা দে না’! আসলে চারজনের ওই একটাই মেয়ে। এক মাস আগেই কুঙ্কুমানী জন্মদিনে গিফট পাঠিয়েছে ‘Nail Art’.  মেয়ের আনন্দ দেখে কে! সুকুর ইচ্ছে পুজোয় Baby Lips Candy gift  করে।

খালি মুকু এক্কেবারে চুপচাপ। যতই কুঙ্কু planning করুক না কেন তার যে ছেলের পরীক্ষা! কলকাতার বাইরে তায় মিশনারী স্কুল! বাঙ্গালী students রা যতই উষ্মা প্রকাশ করুক, প্রতি বছর ঠিক অষ্টমীতে অঙ্ক নয় নবমীতে science exam.  নেহাত দশমীটা National Holiday!

বেঙ্গালুরুতে দসেরার দশ দিন ছুটি। যতই কাবেরী বিতর্কে বন্ধ্‌ হোক না কেন, কুঙ্কু তো এখন থেকেই দিন গুনছে কলকাতায় গিয়ে মার্কেটিং এর finishing touch দেবার। এ সব আলোচনা শুরু হলেই মুকু মনমরা হয়ে যায়। অবশ্য এখনও সাহস করে বন্ধুদের বলে উঠতে পারে নি তার না যাবার কথা। আসলে নিজের মনকেই এখনও কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারছে না। সারা বছরে মাত্র চারটে দিন কি সে ছুটি পেতে পারে না! আবার গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া – সেদিন সকালে তারাহুড়োয় ছেলের টিফিন দিতে গিয়ে রান্নাঘরে ধাক্কা খেয়ে পায়ের কড়ে আঙ্গুলটা এক্কেবারে ভেঙ্গেই গেছে। এখন আঙ্গুলে প্লাস্টার লাগিয়ে কাজ চলছে।

কি আর করা। শেষ পর্যন্ত বলেই দেয় বন্ধুদের। “হল না রে! ‘চমকানো চাল্‌সে’র উদ্‌যাপনে আমায় তোরা বাদ দে”! মানে টা কি! শুনেই তো বন্ধুরা চাঁদা তুলে চিৎকার! পারলে ফোনের মধ্যেই গণধোলাই দেয়!

মুকু যত মুখ শুকিয়ে বাড়িতে ঘোরে ততই দেখে বাবা-ছেলের কি যেন চোখাচোখি হয়। ‘তাই তো! সব স্বাধীনতা তো চিরকাল তোমাদেরই! আমার সব প্ল্যান মাটি হল এবার খুশী তো! থাক্‌, আমি মার্কেটিংও করবো না, পুজোয় বাড়ি থেকেও বেরবো না!’ এতও ‘সেন্টু’তেও কোনই লাভ হয় না। আজকাল মুকু যেন বাড়িতেও একঘরে। একে তো পায়ের ব্যথায় বেশী এ ঘর ও ঘর করতে পারে না! দেখো যতক্ষণ বাবা বাড়িতে রয়েছে দু মাথা এক্কেবারে এক! দুই বন্ধু যেন! মুকুর যেন কোন প্রয়োজনই নেই! আবার দেখিয়ে দেখিয়ে দুজনে্র নতুন শার্ট-প্যন্ট-জিন্‌স-টি-শার্ট মায় জুতো আর পারফিউম সুদ্ধু এল! ব্যাপারটা কি! এ কি মুকুর স্বপ্নভঙ্গের উৎসব! চোখ ফেটে জল আসে।

মহালয়া গেল অভিমানী চোখের জলে। রাগ করে ফোনটাও বন্ধ করে রেখেছে। কাউকে চাই না! থাক সব দূরে! আজ পঞ্চমী শেষ হয়ে গেল। টিভি খুললেই কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় পুজো। উদ্বোধন তো দুদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে গেছে। ভাল্লাগে না, কিচ্ছু ভল্লাগে না! এতও মার্কেটিং এর পরেও কাল ছেলের নামে এত্ত বড় পার্সেল এল ক্যুরিয়ারে। তাকে আবার কিছু জিজ্ঞাসা করাও যাবে না। তার প্রাইভেসি তে interfere করা হয়ে যাবে! বাব্বা, কবে এতও বড় হ’লি রে! এই তো দুদিন আগেও মা, মা করে পেছন পেছন ঘুরতিস! বাড়ি ঢুকে প্রথম কথা ছিল ‘মা কোথায়?’ পাখীর ছানা বড় হয়ে গেছে, ডানা মেলে উড়তে শিখে গেছে। তাকে আর কুলায়ে বেঁধে রাখা যাবে না!

ষষ্ঠীর সকাল – কাক ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো ছেলের ডাকে – ‘Happy Puja মা’। মুকু দেখে ছেলের এক হাতে একটা নতুন Designer saree – ওর পছন্দের রঙ – অন্য হাতে একটা দারুণ সুন্দর সালোয়ার-স্যুট। সঙ্গে আবার Matching jewelry  আর Hand bag. অবাক চোখে চেয়ে দেখে পাশে দাঁড়ানো ছেলের পিতৃদেব, মুখে হাসি আর হাতে একটা খাম। ‘ওঠো, ওঠো, এবার কিন্তু দেরী হয়ে যাবে। এই নাও তোমার কলকাতা যাবার প্লেনের টিকিট। এক্ষুনি উঠে রেডি না হলে প্লেন মিস্‌ করবে। তখন তো আবার আমাদের বাপ-বেটারই দোষ হবে’।

কলকাতায় ওদের সোসাইটির পুজোয় তখন সবে দেবীর বোধন শুরু হয়েছে। সুকু-রুকু আর কুঙ্কুর মাঝের ফাঁকা জায়গাটায় চুপচাপ গিয়ে মুকু যখন দাঁড়ালো মনে হল মা দুর্গার মুখখানা যেন হাসিতে একেবারে ঝলমল করে উঠেছে।।

NB: This article was written for Bidhan Nibas Puja Magazine 2016.

Posted in Uncategorized

আচারি দুপুর

গরমের ছুটিতে দুপুরবেলা এক বাটি আমের আচার নিয়ে বসে বসে ঠ্যাং নেড়ে নেড়ে গল্পের বই পড়ার মজাটাই আলাদা! এইতো সেদিন দুপুরবেলা গল্পের বইটা পড়তে পড়তে কেবলি মনে হতে লাগল কি যেন নেই! হঠাৎ মনে হল – ইস্‌, একবাটি বেশ টক্‌-ঝাল-মিষ্টি চানাচুর না হলে বইটা ঠিক জমছে না। গল্পে ‘বাসুমামু’ যতই আইনি মারপ্যাঁচ শেখাবার চেষ্টা করুন, মাথায় যেন ঠিক ঢুকছে না। নিদেন পক্ষে একটু আমসত্ত্ব হলেও হয়। কপাল আমার, এ পোড়া শহরে অমন অর্ডারমাফিক আমসত্ত্ব, তেঁতুল, হজমিগুলি মেলা ভার। ছুটতে হবে সেই ব্যাপার কেন্দ্র।

আচ্ছা, চুরি করে আচার-আমসত্ত্ব খাওয়াটা কি ঠিক ‘চুরির’ আওতায় পড়ে! কখ্‌খোনো না! এ সেই গোপালের ননীচুরির মতো। বাড়িতে বারান্দায় বা ছাতে আচার শুকোতে দেওয়া হয়ই বাড়ির ছোটরা দুপুরবেলা সেগুলো খাবে বলে। তাই যদি না হবে তো মা-ঠাকুমার এতও পরিশ্রমটাই তো বৃথা!

নিজের বাড়ির ফ্রিজ খুলে আমসত্ত্ব খাওয়াটা কি চুরির পর্যায় পড়তে পারে! বিশেষতঃ এখন বলে আমি বাড়ির আসিস্ট্যান্ট গিন্নি! আর সেই কাঁচা আম ছোট্ট ছোট্ট করে কুচিয়ে নুন-লঙ্কা-চিনি আর সর্ষের তেল দিয়ে রোদ্দুরে শুকিয়ে – সসসসস্‌ আঃ। তবে শুকো্নোর চান্সটা নেহাতই কম থাকতো। এই টক্‌ আর ঝাল ঠিক হয়েছে কিনা চাখতে চাখতেই তো বাটি খালি!

ছোটবেলায় মা কিন্তু মোট্টে আচার করতে পারতো না। মায়ের যত সব মোরোব্বা – কাঁচা আমের মোরোব্বা, বেলের মোরোব্বা – দুর্‌ অত মিষ্টি ভাল লাগে না কি! কোথায় বেশ টক্‌ টক্‌ – ঝাল ঝাল -। তবে পেয়ারার জেলিটা ছিল ইস্‌পেসাল। দোকানের কোনো জেলি আমার কোনদিনই ভাল লাগে নি। সারাজীবন টিফিনের পাঁউরুটিগুলো সিংহভাগই ওই মায়ের তৈরী জেলি দিয়ে সদ্‌গতি হয়েছে। তবে আজকাল মা বেশ টক্‌-ঝাল কুচো আমের আচার করতে শিখে ফেলেছে আর আমারও একটুতেই দাঁত টকে সেই আচার খাবার সুখ ঘুচে গেছে!

কিন্তু সেই একবার সন্তুদিদা বেশ ছড়া তেঁতুলের আচার করে দিয়েছিলেন। উফ্‌, সে দুদিনেই শেষ হয়ে গেল! আর ফুচুদের বর্ধমানের দেশের বাড়ি থেকে আনা পাকা তেঁতুল – ইস্‌, কি ভাল যে খেতে! একটুও দাঁত টকে নি! সবটুকু তো এক দুপুরেই শেষ। আচার চাইতে কি লজ্জা পেতে আছে! পাড়ায় সঞ্জয়দার মায়ের কাছ থেকেও প্রথম দিনই চেয়েচিন্তে এক বাটি তেঁতুলের আচার জোগাড় করেছিলুম। আবার বললেন কি না কুলের আচারটা ফুরিয়ে গেছে! কি যে দুখখু হয়েছিল! পরেরবার তৈরী করে আবার দেবেন বলেছিলেন – কিন্তু সেই পরেরবার আর এলই না!

আর ইস্কুলের সেই হজমিওয়ালার কাছে আমচুর আর কুলের আচার! আর ছোট্ট ছোট্ট সেই বৃন্দাবনী কুল – তাতে টক ঝাল নুন দেওয়া – ! আহ্‌! কালো কারেন্ট নুন আর লাল টক নুন দেওয়া হজমিগুলির চেয়ে তার আকর্ষণ কিছু কম ছিল না। চণ্ডীমেলায় অনেক খুঁজে খুঁজে ওই আমচুরের আচারের যখন সন্ধান পেলুম, বছর বছর সেটাই হয়ে গেল ওই মেলার মুখ্য আকর্ষণ। কিন্তু সেও আর এখন কোথায়! বরং পুণায় ‘দাজি’ কিন্তু ঠিক প্রতি বছর এক ঠোঙ্গা ‘চানিয়ামানিয়া’ (বৃন্দাবনী কুল), ‘আওড়া’ (পাকা আমলকী) আর গাছ থেকে পেড়ে ‘চিঞ্চ’ (পাকা তেঁতুল) নিয়ে আসত আমাদের জন্যে।

তবে টিফিনের সময় স্কুলের গেটের পাশে ওই যে আলুকাবলি আর ঝাল মটর পাওয়া যেত – তার কোনও তুলনাই হয় না। আর সেই ঘুগনির গন্ধ এখনও যেন নাকে লেগে আছে! আমি তো চিরকালই লেডি পেলারাম – তাই টিফিনে কখনই পয়সাকড়ি মিলত না। কিন্তু দীপ্তি ছিল মুস্কিল আসান। রোজ রোজ বেচারি নিজে টিফিন না খেয়ে আমাকে আলুকাবলি আর ঝাল মটর খাওয়াতো। বিশেষ করে চপলাদির স্বাস্থ্য ক্লাসে ওই কলেরা আর টাইফয়েডের আক্রমণের হাত থেকে বাঁচতে হলে দীপ্তির ঝাল মটরের শরণ না নিয়ে কোনও উপায়ই ছিল না। দীপ্তি রে – কোথায় যে গেল সে সব দিন!

পরে অবশ্য N.B. র (ক্লাসের দুষ্টু ছেলেরা বলত ‘নেচো বুড়ো’) Differential Calculus ক্লাসের চক ঘুরিয়ে ‘Suppose’ এর হাত থেকে বাঁচতে জলযোগের ওই একপয়সার ঝাল লজেন্স আর গঙ্গোত্রীর মিছিরি আর সঁফের অনেক সদ্‌ব্যবহার হয়েছে। ঝিল্‌পার্কে দাদাদের কাছেও বায়না করে অনেক আলুকাবলি র ঝাল মটর আদায় করেছি এক কালে। কিন্তু সেই ছোটবেলার স্বাস্থ্য-প্রকৃতি-নীতিশিক্ষা-ইতিহাস-ভূগোল ক্লাসে বসে দিদিমণিদের চোখে ফাঁকি দিয়ে এমন রসিয়ে রসিয়ে আলুকাবলি আর চানাচুর খাবার মতো পরিবেশ আর মজা কোনোওদিন পাই নি।।

PC: Google Images