ছোটবেলা থেকে বড়বাবুর ভারি সমস্যা। তিনি কে? একে তো তাঁর নামের ছড়াছড়ি। জন্মাতে না জন্মাতে দাদাই নাম ঠিক করে ফেলেছে ‘নীল’। আর কেন যে নীল তার আবার প্রায় এক পাতা জোড়া যুক্তি আর ব্যাখ্যা। বাড়ীতে দাদু আবার সে নামের সঙ্গে ‘মাধব’ জুড়েছেন। তাঁর শিবঠাকুরের চেয়ে কেষ্টবাবুর ওপর টানটা বেশী। তাই নাম হয়ে উঠেছে নীলমাধব; কখনও ছোট করে মাধব। কখনও আদর করে শুধুই ‘ভাইয়া’।
দিয়া আবার খুঁজে খুঁজে গালভরা নাম বের করেছে – ‘রুদ্ররূপ’ – মায়ের অত্যধিক ‘ঝিন্দের বন্দী’ প্রীতির স্মরণিকা আর কি। এদিকে যেদিন থেকে রুদ্ররূপ নাম ঠিক হয়েছে ছেলের মেজাজ গেছে বিগড়ে। অমন ঠাণ্ডা-শান্ত ছেলে জুড়ে দিয়েছে তুমুল কান্না। কিছুতেই থামানো যায় না। পাড়া-প্রতিবেশী সুদ্ধু অস্থির! ছুটে আসে ছেলে ভোলাতে!
তার ওপর আবার আদরের শতেক নাম। দিদি বলে ‘কুট্টুস’, দিয়া বলে ‘বাব্লা’, বাবা বলে ‘বাতলাল’, ‘বন্তু’। গান গেয়ে গেয়ে ঘুম পাড়ায় ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে, বন্তু গেল ক্ষেপে’ -। আর মায়ের আদরের ডাক ‘বিবু’।
তখন এই বছর দেড়েক বয়স হবে। দুপুরে এক ছিলিম ভাত-ঘুম দিয়ে উঠে বাবু ‘ছানা-কলা’ খেয়ে ঠাম্মার সঙ্গে খেলা করেন। একদিন দেখি সারা দুপুর বলে চলেছে – “আমি কে? বিবু”। “আমি কে? বিবু”। অর্থাৎ নাম মুখস্ত চলছে।
বেশ চলছিল। মুশকিল হল পুণেতে এসে। একদিন ছেলের কি রাগ! “কেন আমার নাম বসু হল! আমার নাম দেশপাণ্ডে, কুলকার্নী দিতে পারলে না!” যত বলি “ওরে আমরা যে বাঙ্গালী। বসু তো কত ভাল। এই দ্যাখ না নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, বিপ্লবী রাসবিহারী বসু, আচার্্য্য জগদীশ চন্দ্র বসু, দাদাই-এর দাদু বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু – সবাই সারা পৃথিবী বিখ্যাত”। ছেলের সে রাগ কিছুতেই পড়ে না।
তখন ওর একটা ছোট্ট ধূতি ছিল। দাদু রোজ মাল্কোচা মেরে সে ধূতি পরিয়ে দিতেন। ছেলে ধূতি পরে কাঁধে গদা নিয়ে বিকেলে খেলতে নামতো। পাড়ার ছেলেরা জিজ্ঞাসা করেছে “তোমার নাম কি?” উনিও বলে এসেছেন, “আমার নাম হনুমান”। একদিন বিকেলবেলা ছেলের খেলা দেখতে নিচে নেমেছি। ও মা দেখি আমার অমন ভাল ছেলেকে সবাই ডাকাডাকি করছে ‘হনুমান’ বলে। কি আপদ! আমাদের বাঙ্গালীদের কাছে হনুমান বলা মানে যে গাল পাড়া! ‘পাজী ছেলে’, ‘বাঁদর একটা!’ ‘হনুমান কোথাকার!’ রীতিমতো অপমান! তা বন্ধুদের দোষ কি! ছেলে যেমন নাম বলেছে।
একদিন নিচে থেকে রাগে গর্গর্ করতে করতে ছেলে বাড়ী এল। “কি হয়েছে রে?” কিছুতেই বলে না। শেষে অনেক সাধ্যিসাধনার পর বললে, “আমায় ওরা হনুমান বলে কেন?” “কি করবে বাবা; তুমিই তো ওদের বলেছ তোমার নাম হনুমান”। “কেন ওরা আমায় কৃষ্ণ বলতে পারে না?”! বোঝো কাণ্ড! নীল নয়, রুদ্র নয় – তখন উনি কৃষ্ণ অবতার! কে কি করে বুঝবে বাবা! শুধু কি কৃষ্ণ! সেই ধূতিখানা আবার শাড়ীর মতো জড়িয়ে মাঝে মাঝেই বলতো “আমি রাধা”।
কত বড় বয়সেও যে এরকম পরিচয় বিভ্রাট ঘটেছে! তখন চলছে হ্যারি পটারের যুগ। আমার কলেজে সাল্ভি স্যার ওর ঐ চশমা পরা মুখ দেখেই বলতো “আরে হ্যারি পটার!” আর ছেলেও তাতে রেগে যায়। আমি ভাবি আহা এখন বোধহয় বড় হয়ে গেছে, তাই লজ্জা পায়। ও মা, ছেলে বলে কিনা, “সাল্ভি আঙ্কেল আমায় হ্যারি পটার বলে কেন? ছোটা ভীম বলতে পারে না!”
তবে সেবার আমি যে কি বিপদে পড়েছিলুম উফ্!!! সবে ছেলেকে চান টান করিয়ে ইস্কুলের জামাকাপড় পরাতে যাব। দেখি মুড খুবই ভালো, বেশ হাসি হাসি মুখ। বললে, “বল তো আমি কে?” “কে আবার, তুমি তো আমার বিবু”। “না হল না”। “তুমি নীল, তুমি রুদ্ররূপ”। “না, না, হল না”। সেই কাকেশ্বর কুচকুচের মতো করে যেন ছেলে মাথা নাড়ে – ‘হয় নি, হয় নি, ফেল’। “তবে তুমি কৃষ্ণ”। “উঁহু”। “তবে বুঝি হনুমান। আচ্ছা, রাধা”। যাই বলি, বলে “না”। এবারে ছেলের মেজাজের পারা চড়ছে। মুখের হাসি ক্রমশঃই কান্নায় পরিণত হচ্ছে। আর মায়ের কল্পনা শক্তিও তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে। “তবে কি তুমি রাবণ”? (মাঝে মাঝে রাবণও হোতো কি না! তবে রামচন্দ্র হয় নি কোনোদিনই।) এবার চূড়ান্ত পর্যায়। রেগে বলে- “আমি জামা প্যান্টুও পরবো না, ইস্কুলেও যাবো না”। কি কেলো রে বাপ্! শেষে বুদ্ধি বের করি – “আচ্ছা বল দেখি, তুমি কে? তুমি আমাকে বলে দাও। তবে তো আমি জানবো”। ঘোষণা হল – “আমি হিরণ্যকশিপু”।
কোনোও মা কি স্বপ্নেও ভাবতে পারে তার সাধের বাছা ‘ভক্ত পেহ্লাদ’-কে ছেড়ে তার বাবাটিকে পাকড়াও করবে!!!