Posted in Uncategorized

ধন্যি ছেলের অধ্যবসায়

ছোটরা একটু ‘ছোট’ বলে তাদের ওপর কি অত্যাচারটাই না হয়! এতদিন তবু বছরের কোটায় পৌঁছলে বাড়ির নিশ্চিত আদুরে আশ্রয় ছেড়ে বাইরে যেতে হতো। কিন্তু এখন! ছোট পরিবারের ‘সুখের’ চক্কোরে চার-সাড়ে চার মাস বয়স থেকেই তাদেরও দৈনিক যুদ্ধ শুরু! মায়েদের কাজের সঙ্গে সঙ্গে তাদেরও ‘খেলাঘর’ যাত্রা। মুখে বুলি ফোটার আগে থেকেই শুরু হল ‘A, B, C, D, …, 1, 2, 3, 4, ….., Nursery Rhymes’। সঙ্গে আবার হিন্দি ছড়া, বাংলা-মারাঠী-পাঞ্জাবী-তামিল-তেলেগু-কানাড়া’ – ওই শুরু হয়ে গেল প্রথম-দ্বিতীয়-তৃতীয় ভাষা শিক্ষা! এর নাম নাকি ‘Play School’! আচ্ছা, তোমরাই বল, ইস্কুল কখনো খেলার হয়! ইস্কুল মানেই হল ছোটদের জেলখানা। লাইন করে দাঁড়াও, লাইন করে চল, একসঙ্গে Poem বল, একসঙ্গে ‘টিপিন’ খাও, তাও আবার নিজে নিজে! তবু যদি ওই ‘হ্যারি পটারের ইস্কুল’ হত। সেখেনে কি মজা জানো – সবাই নিজের পছন্দের সুর-তাল-লয়ে বিষম স্বরে School Song গাইতে পারে!

ও বাবা, ছোটবেলার খেলা-ইস্কুলের ‘সিঙ্গিল মেলালিং’ সেরেই হবে না, এরপর লেখা পরীক্ষা, ইন্টারভিউ, মা-বাবার পরীক্ষা, লটারি – সব বাধা পার হয়ে তবে গিয়ে বড় ইস্কুল! ঢুকতে না ঢুকতেই ‘প্রথম ভাষা’ – ইংরিজি! নিজের মাতৃভাষা এখন অপাংক্তেয়, সাহেবি ভাষার কদরই বেশি! আলু সেদ্ধ-ভাত খাওয়া বাঙালীর ছানা এখন Steamed rice & mashed potato খেয়ে ইস্কুল যায়। বাড়ি ফিরে spoon দিয়ে ‘Puffed rice’.  চামচে চারটে মুড়ি উঠলে পাখার হাওয়ায় তিনটেই আবার উড়ে যায়!

এরপর দ্বিতীয় ভাষা – হিন্দি – হু হু বাবা, রাষ্ট্রভাষা বলে কথা! সে বিন্ধ্য পর্বতের নিচের লোকেরা যতই আপত্তি করুক না কেন! বেচারা ভেতো বাঙালী বাবা-মায়ের সাহেবী ছানারা নিজেদের ভাষা শেখার সুযোগই পায় না। আর মায়েরা পরীক্ষার পড়া তৈরী করাতেই এতও busy  যে আবার একটা নতুন ভাষা শেখানোর risk  নিতে পারে না। আর শেখাবেই বা কখন! খেলা-ইস্কুল থেকেই তো complain আসে – বাচ্চা ইনজিরি বুঝতে পারে না। Please, converse with him/her in English. নইলে তো আবার বড় স্কুলে No entry.  কেজি ক্লাসে উঠেছ কি, ইংরিজি Capital letters, small letters এর গুঁতো পেরিয়ে হিন্দির দেবনাগরী।

বহুজাতিক সংস্থায় ছিন্নমূল বাঙালী আজ মুম্বাই, কাল বেঙ্গালুরু পরশু দিল্লি। ফলে নতুন নতুন প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মারাঠী-কানাড়া-তামিল-তেলেগু-পাঞ্জাবী সব ভাষাই ‘সোনার বাংলা’ কে পেছনে ফেলে আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। তাই পঞ্চম শ্রেণীর তৃতীয় ভাষার পছন্দ তালিকাতেও ‘আ মরি বাংলা ভাষা’র ‘ঠাঁই নাই’। French, German, Spanish, Japanese এর ঠে্লা সামলে মারাঠী, কানাড়া, তামিল অথবা – সংস্কৃত – দেবভাষা!

উঁহু উঁহু, ছেলেবেলার অং-বং-চং এর বিভীষিকা এখনও ভুলিনি! তাই বড় ছেলের বেলায় চোখ বন্ধ করে ‘ইকড়ে-তিকড়ে’র গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছিলুম। মারাঠি রাষ্ট্রভাষা না হোক, রাজ্যভাষা তো বটে! পররাজ্যে থাকতে হলে পরীক্ষার গুঁতোয় অন্ততঃ যদি লোকের কথা বোঝার মতোও জ্ঞান হয়! কোনরকম সাহসিকতা না দেখিয়ে প্রথম থেকেই প্রাইভেট টিউটরের দ্বারস্থ হয়েছি বটে, কিন্তু পরীক্ষার আগের রাতে – সেই ‘ম্যা’! “এটার মানে কি? ওটার উত্তর কি?” আরে মশাই কোন নীতিশাস্ত্রের বইতে লেখা আছে বলুন তো যে মা কে দুনিয়ার স-ব কিছু জানতে হবে!!! তবু শেষ পর্যন্ত কলেজের সহকর্মীদের ফোন করে কার্যোদ্ধার হয়েছে। “একটু বলে দে ভাই”!

বিশাল বীরত্ব দেখিয়ে ছোটছেলের বেলাও একই পথে হাঁটতে শুরু করেছিলুম। কিন্তু বাদ সাধলো ওই – ট্রান্সফার! রাজধানীর কাছে এসে তো আর মারাঠি শেখার উপায় নেই! নতুন স্কুলে ভর্তির ফর্মে option : French, German আর সংস্কৃত। ও বাবাঃ, এক ওই ‘ইনজিরি’র বানান নিয়েই নিজের যা কাহিল দশা তারপর German!   সবই তো সেই ‘নিউমোনিয়ার বোবা পি’ আর ‘থাইসিসেস PH’। কি দরকার বাপু! French তুলনায় নিরীহ মনে হলেও আবার সেই ‘Uno, Doux, Quatr…’. থাক গে, কপাল ঠুকে ‘জয় মা’ বলে টিক দিয়ে দিই সংস্কৃতর মাথায়।

হিন্দি যখন পড়ছে তখন তৎসম শব্দের কল্যাণে কিছু শব্দ তো বুঝবে! তারপর ধর না কেন ব্যাকরণ – বাংলাই বল, হিন্দিই বল – পাণিনীকে তো আর কেউ বেশি দূরে সরিয়ে রাখতে পারে নি! আর ওই শেষমুহুর্তের ‘ম্যা’ ডাককেও তো ভুললে চলবে না! ‘দুগ্‌গা-দুগ্‌গা’, তাহলে সংস্কৃতই হোক। প্রথম প্রথম মা-ছেলে দুজনেরই প্রবল উৎসাহ। ‘বালকঃ বালকৌ বালকাঃ’! ক্লাস টেস্টে কুড়ি তে কুড়ি! নতুন ইস্কুলের বন্ধুরা সেই ক্লাস ফোর থেকে পড়ে উনিশ আর ইনি প্রথম ক্লাস সিক্সে শুরু করেই কুড়ি! আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ! আর তার ফলস্বরুপ ছেলের সংস্কৃতপাঠ এক্কেবারে লাটে!

কিন্তু, তা বলে পরীক্ষা বাবাজী তো আর ছেড়ে কথা কইবে না! যেদিন থেকে পরীক্ষার সিলেবাস এসেছে আমার তো খিদে ঘুম সব চলে গেছে। ছেলে এদিকে নির্বিকার। পরের ক্লাস টেস্টের নম্বর দেখে চেপে ধরতে আবিষ্কার হল সে নাকি প্রশ্নের মানেই বুঝতে পারে নি!

চোখের সামনে নিজের ছোটবেলার সেই ভয়াবহ দিনগুলো ভেসে উঠতে লাগল। আমাদের আবার ক্লাস ফাইভে ছিল হিন্দি। ‘অ সে অনার’, ‘আ সে আম’ ‘ছোটি ই ম ল মে বড়ী ঈ কি মাত্রা – ইমলী – ইমলী মানে তেঁতুল’…। ক্লাসে দুলে দুলে পড়তে হত। কেবল ‘ছোটি ই’ পড়তে গিয়ে একেবারে ‘বড়ী ঈ কি মাত্রা’এ কেন পৌঁছতে হল আজ অবধি বুঝে উঠতে পারি নি! সবে তো ‘ছোটি ই’ চলছে -। সারা হিন্দি শব্দকোষে শুধু ‘অ, আ, ই’ দিয়ে কি কোনোও শব্দই হয় না! এলিজাবেথদি ভীষণ রাগী! এসব অবান্তর প্রশ্ন করার মতো দুঃসাহস কারোর নেই! ওদিকে তিনি বছরের মাঝখানে আমাদের অকূল পাথারে ভাসিয়ে ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন। হাল ধরতে যিনি এলেন তিনি বেচারি তো কোনদিন ‘WOH’ কে ‘অহো’ ছাড়া কিছু বলতেই পারলেন না! ফলে ওই হল আমাদের হিন্দি শেখার ইতি। ভাগ্যিস টিভি সিরিয়াল ছিল। তাই দুটো হিন্দি কথা বলতে পারছি!

এরপর ক্লাস সেভেনে আমাদের শুরু হল সংস্কৃত। সদাহাস্যময়ী সবিতাদির ‘নরঃ নরৌ নরাঃ’ চলছিল ভালই। কিন্তু দোষ আমারই। ছোট থেকে কোনদিন কিস্যু মুখস্ত করতে পারি না। কাজেই পুরো সংস্কৃত ব্যাকরণ ‘তি-তস্‌-অন্তি, সি-থস্‌-থ, মি-বস্‌-মস্‌’ এই আটকে গেলো।

কাজেই ছেলেকে সংস্কৃত পড়াতে নিজেই চোখের জলে নাকের জলে। ছেলে কিন্তু বিন্দাস। শব্দরূপ লিখতে বললুম – সে বললে ‘বেঞ্চির ওপর দাঁড়া, বেঞ্চি গেলো সরে …’। কেলোটা আমিই করেছি, বলাই বাহুল্য। বাবার কাছে ‘এক কড়া পো গণ্ডা, দুই কড়া আধা গণ্ডা, তিন কড়া পৌনে গণ্ডা, চার কড়া এক গণ্ডা’ শিখে হিসেবটা কড়ায়-গণ্ডায় পাকা হয়ে গেলেও ‘নর’ ওই বেঞ্চি থেকে পড়েই গেলো!ঠাম্মাকে আবার কিছু জিজ্ঞেস করলেই আত্মনেপদী, পরস্মৈপদী কত কি যে বলত! তবে সেই যে ঠাম্মা কুড়ির নামতা শিখিয়েছিল ‘কুড়ি এক্কে কুড়ি, কুড়ি দুগুণে মুড়ি, তিন কুড়িং কড়াইভাজা, চার কুড়িং খেতে মজা, পাঁচ কুড়িং শ’, ঘরে পালাই চ’ – ছেলেকে সংস্কৃত পড়াতে বসে ওইটাই আমার একমাত্র উপায় বলে মনে হল – ‘য পলায়তি স জীবতি’।

পরীক্ষার আগের রাতে বই খুলে একেকটা চ্যাপ্টার দেখি আর চক্ষু চড়ক গাছ! রিডিং পড়তে গিয়ে নিজেই হোঁচট খেয়ে মরি। ‘স্বচ্ছায়াসংস্তরণম্‌’ পড়তে গিয়ে যা নাকানি চোবানি – মনে হল সেই ‘তারে জমিন পর’ এর মতো দেবনাগরি হরফেরা চোখের ওপর দিয়ে যেন নেচে বেড়াচ্ছে। তারপর আবার তার মানে! ‘নমস্যসি’ মানেই যাদের কাছে দুর্বোধ্য তাদের ওপর শেষ আঘাত হানল ‘আত্মদুর্ব্যবহারস্য’ আর ‘সদ্‌ব্যবহর্তব্যং’।

তার মধ্যেও ছেলের মাথায় কুটিল বুদ্ধির কমতি নেই। পড়া লিখতে বললেই উলটো প্রশ্ন ‘ম এ হসন্ত কখন হবে আর অনুস্বর কখন হবে’? কি জ্বালা রে ভাই! উৎসাহ দিতে ঠিক লেখায় ‘Good’ দিয়েও রেহাই নেই। বলি, “যা লেখা আছে পড়ে মুখস্ত কর না বাপু!”

গোদের ওপর বিষ ফোঁড়া! নিজেদের পাঁচ-ছয় লাইন অনুচ্ছেদ লিখতে হবে ‘প্রদূষণস্যদুষ্প্রভাব’। ওহে গোলাম হোসেন, বাংলা হরফে এই কথাগুলো পড়ে ভাবছ তো কি আর এমন শক্ত কথা – দেবনাগরির ডাণ্ডা খেলে দেখতুম তোমার এত বীরত্ব কোথায় যায়! বিশেষ করে যখন মূর্তিমান বিপদ্‌তারণ ‘ওং গুগলায় নমঃ’ মন্ত্র ডাহা ফেল মেরে যায়! একটা কথাই শুধু হাড়ে হাড়ে টের পেলুম, ‘ফলং ভবতি দুঃখদম্‌’।

এই দুঃখের ফল আরও দু বছর অন্ততঃ ভোগ করতে হবে এটা মনে করেই সব উৎসাহ হাউইয়ের মতো উড়ে চলে যাচ্ছে। শেষটায় রাত বারোটার ঘন্টা পার করে ছেলের চোখের গঙ্গোদকে এবারের মতো ক্ষান্ত দিলুম যা হোক।।

PC: Google

Posted in kids - Chandrabhal Basu

Independence Day

jai Hind

15th August 1947 is a red letter day in the history of India. It is the day on which India got her independence after a long drawn struggle. The history of this struggle for freedom can be traced back to the first war of Independence fought against the rulers – British as far back as in 1857. The causes might have been any, but the spirit and sentiment behind it was to break away from the bounds and shackles of the British. This day reminds us all the sacrifices made by the freedom fighters to save our motherland. The ‘Tiranga’ is hoisted in the Red Fort and India Gate, where many citizens gather together and recite ‘Jana-Gana-Mana’ and ‘Jai Hind’ that quenches the hearts of all citizens that we are free as Indians. It is a Government holiday, so that everyone can celebrate the Independence Day!!!

So celebrate to your fullest with Mother India, for it comes once in a year!!!

15th August 2017

PC: Google

Posted in Uncategorized

বন্ধনে রাখী

rakshabandhan-2013

সম্প্রতি দেশ জুড়ে মহোৎসব পালিত হল – ‘রক্ষাবন্ধন’, আমাদের কথায় রাখী। বোনের রক্ষার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ভাইয়ের হাতে বন্ধন। এই অঙ্গীকারবন্ধন পরিবারের সীমানা ছাড়িয়েও এমনকি ধর্মের গণ্ডী পেরিয়েও এগিয়ে গেছে বহুদূর – সেই মেবারের রাণী কর্ণাবতীর তরফে বাদশা হুমায়ূনের হাত পর্যন্ত। বাঙালীর কাছেও এই রাখীবন্ধন দেশভাগের প্রতিবাদে হিন্দু-মুসল্মানের সম্প্রীতি বন্ধন। রবি ঠাকুরের হাত ধরেই এ উৎসব পরিণত হয়েছে মহোৎসবে।

তবে আমাদের ছোটবেলায় বাঙালীর কাছে ভাই-বোনের মিলন উৎসব মানেই ভাইফোঁটা। রাখীর সময় রাস্তার মোড়ে সুন্দর সুন্দর স্পঞ্জের রাখী দেখা যেত বটে, কিন্তু আমার তো ভাই-ই নেই! নদাদির বাপের বাড়ির রাধাকৃষ্ণের হাতে রাখী পরানো হোতো কিনা – তাই নদাদিই আজ রাখী, কাল রাসপূর্ণিমা এসব গল্প করত। আর ঠাকুরের ঝুলন উৎসবের পর যেমন প্রতিবার সোলার কাকাতুয়া-টিয়া এসব ঠিক আমার জন্যে এনে হাজির করত, তেমনি রাখীর পর দু-একটা স্পঞ্জের রাখীও আমার ঠিকই জুটে যেত। তাই বলে সেদিনই নয় কিন্তু। কি করে হবে! আমাদের খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে দোল-দুর্গোৎসব অবধি ঠিক আছে, তাই বলে রাখী-বিশ্বকর্মায় তো আর ছুটি হত না! বিশ্বকর্মা পুজোর ঘুড়িও কিন্তু আমার বাদ যেত না। যত্ত ঘুড়ি ভোঁ-কাট্টা হয়ে মামারবাড়ির চারতলার ছাদে কিংবা নিমগাছের ডালে এসে আটকাত, নদাদি ঠিক আঁকশি দিয়ে সেগুলো উদ্ধার করে আমার জন্যে রেখে দিত। আমি ঘুড়ি ওড়াতে না পারলে কি হবে! আহা, ছোট মেয়ে রংবেরঙের ঘুড়ি পছন্দ হবে না নাকি! পরে অবশ্য সেসব ঘুড়ি বিল্লুকে দিয়ে দিতুম। ও ঘুড়ি ওড়াতো আর আমি ওর লাটাই ধরে থাকতুম।

যা হোক, ক্লাস ফাইভে উঠে প্রথম মনে হল রাখীটা একটা বন্ধুদের মধ্যে পালন করার মতো উৎসব হতেই পারে। কারণ ততদিনে খেয়াল পড়েছে বাসের বড় দিদিরা বন্ধুদের দেবে বলে মহা উৎসাহে রাখী বানাতে ব্যস্ত। সাটিনের সুতো কিনে দিনরাত তাকে দাঁতমাজার বুরুশ দিয়ে আঁচড়েই চলেছে।

ক্লাস ফাইভে আমার প্রাণের বন্ধু ছিল সোমা দেবনাথ। ক্লাসে দুজনে পাশাপাশি বসতুম, আর প্রতি পিরিয়ডেই নাহোক একবার করে আমাদের ঝগড়া হতো আর ভাব হতো। বহু উদ্ভট পরিকল্পনাও হতো তারই মধ্যে। যেমন সেবার হাওড়ায় শৈলীমার বাড়ি গিয়ে বাবাদের ছোটবেলার হাতে লেখা ম্যাগাজিন দেখে খেয়াল হল আমাদেরও একটা হাতে লেখা ম্যাগাজিন বার করতে হবে। কদিন ধরে তাই নিয়ে দুজনে মত্ত। অনেক বন্ধু তারজন্যে অনেক লেখা-আঁকা-কবিতা-গল্পও দিয়েছিল।

তা সেই সোমার জন্যেই প্রথম রাখী বানিয়েছিলুম – বাবার সিগারেটের প্যাকেটের রূপোলী রাংতার ওপর গোলাপী তুলো বসিয়ে (সাটিন সুতো পাবো কোথায়!) তার ওপর চুমকি টুম্‌কি কিছু বসিয়েছিলুম হয় তো!

সেবারই প্রথম পাড়ায় এসে গুরুপদদাদা দাবি করে – “কি রে আজ রাখী, আমাদের রাখী পরালি না?” আমিও তেমনি বললুম, “আমার কাছে তো রাখী নেই”। বেচারা নিজেই সঙ্গে করে দোকানে নিয়ে গিয়ে নিজের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে আমার পছন্দমতো রাখী কিনে দিল। বলাই বাহুল্য দাদাদের য’টা না পরালাম তার থেকে বেশি আমি পেলাম। তারপর দাবি “রাখী পরালে মিষ্টি খাওয়াতে হয় জানিস না?!” পাড়ার সব দাদাদের মধ্যে আধখেপা গুরুপদদা কোনদিনই আমার বিশেষ পছন্দের ছিল না, কিন্তু আজও রাখীর দিন এলে সবার আগে আমার ওর কথাই মনে পড়ে।

এরপর ধীরে ধীরে যত স্কুলের ওপরের ক্লাসে উঠেছি রাখী তৈরী আর বন্ধুদের রাখী পরানোর উৎসবে মেতেছি। বন্ধুদের মধ্যেই কাউকে দিয়ে সম্রাট থেকে রেশমী সুতো, রাখীর ওপরের ফুল-পাতা জোগাড় হয়েছে। তারপর ক্লাস নাইনে আমার ঝুলিতেও বন্ধুদের দেওয়া অনেক রাখী ভরে উঠেছে। আজকের এই ‘Friendship Day’ আমাদের কাছে ছিল সেদিনের সেই রাখীবন্ধন।

কিন্তু সবচেয়ে বিশেষ ছিল ক্লাস টেনের রাখীর দিন। স্কুল থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে বন্ধুদের সঙ্গে সব দিদিমণি ও সিস্টারদের হাতেও রাখী বেঁধে দেওয়ার পরিকল্পনা। পুরো ক্লাসের পক্ষ থেকে রাখী আনা হল। খুব সুন্দর সুন্দর রাখী। যে সব দিদি ও সিস্টাররা খুবই পপুলার, তাঁদের হাতে কে রাখী বাঁধবে তার লড়াই। কিন্তু মুশকিল হল নীলিমাদি, শোভাদি এরকম যাঁরা একটু প্রাচীনপন্থী, মোটেই রাখী পরতে চান না তাঁদের নিয়ে। তাঁদের বক্তব্য একদিনের এই লোকদেখানো উৎসব না করে সারাবছর ভাল বাধ্য ছাত্রী পেলে তাঁরা বেশী খুশী হবেন। এদিকে আমরাও তখন নাছোড়বান্দা। ‘ছাত্রীর মেয়ে’ বলে আমার প্রতি শোভাদি একটু সদয়। তাই বহু ঘ্যান্‌ঘ্যানানির পর অবশেষে বললেন, “ও সব গদা-টদা ওলা রাখী পরতে পারব না”। মনে আছে তার বদলে আমার বাক্স থেকে একটা পিট্‌পিটে চোখ লাগানো রাখী নিজে পছন্দ করে পরতে রাজি হলেন। সেদিনের সেই ক্লাসসুদ্ধু বন্ধুর দেওয়া অজস্র রাখী আজও আমার অমুল্য সম্পদ।

তখন বাড়িতে বাবুদাদা হাজির। তাই রাখী-ভাইফোঁটা আমার জীবনেও তখন বিশেষ দিন। তবে সেই পাড়ার দাদাদের হাতে রাখী পরানোর পর থেকে আমার কোনোদিনই আর ‘রাখীভাই’এর অভাব হয় নি। কলেজে ঢুকে ‘জয়েশ-ভাস্কর’ থেকে পুণেতে এসেও ‘নলাওড়ে-মোরে’ জীবনের প্রতি বাঁকে আমি আমার রাখীভাইদের পেয়ে গেছি। পুণায় গিয়ে বাড়তি পাওনা ছিল ডাকুদাদাকে রাখী পরানো আর ছেলেদেরও ফুলনের থেকে রাখী পাওয়া। ছোট থেকে যে দাদা সবসময় দূরেই থেকেছে সেই কখন সবচেয়ে কাছের নির্ভরতার স্থান হয়ে গেছে। তার চেয়েও বড় পাওয়া বৌদির মতো হিতৈষী বন্ধু। তবে এবছর রাখীবন্ধন ‘Whatsapp’ র শুভেচ্ছা-বিনিময়েই সাঙ্গ হল এই যা।

P.C.: Google image