Posted in Reflections

জিজ্ঞাসুর এক বছর

দেখতে দেখতে হৈ হৈ করে একটা বছর পার হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এই তো সেই দিন। নিজের দুশ্চিন্তার পাহাড়ে পুরোপুরি বিধ্বস্ত; রাতের ঘুম চোখ থেকে উধাও। দিনের বেলাও ‘দিন কাটে না’। সারাদিন শুয়ে শুয়ে বোকাবাক্সে একই সিরিয়ালের একই পর্ব দেখে চলেছি। রোজই সেই একই জিনিস। আসলে নিজের মুখোমুখি হতেই ভয়। এই বুঝি আবার গ্রাস করলো দুশ্চিন্তা। মূঢ়তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ যাকে বলে। এদিকে আবার বিবেক দংশনও হয়। কি করছি!

বই পড়তে যাই – দু চার লাইনের বেশি এগোয় না। অত যে প্রিয় শরদিন্দু সেও না। আচ্ছা শরদিন্দু না হয় সাধুভাষা, কিন্তু অন্য বই! লীলা মজুমদার, নবনীতা দেবসেন! নাহ্‌, তাও ভাল লাগে না। চেষ্টা যে করছি না তা নয়। তার সঙ্গে ইস্কুলের দাওয়াই – প্রার্থনা। হচ্ছে না!

কিসের দুশ্চিন্তা এত! বোঝাতে পারি না কাউকেই। নিজেকেই কি বোঝাতে পারি! আমাদের মস্ত বড় ভরসার জায়গা এই ‘পবিত্র শিশুপাল’ – অক্সিজেন সিলিণ্ডার না, যেন পুরো একটা অক্সিজেনের প্ল্যাণ্ট। কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই। দেখি সব বন্ধুই কম বেশি সেই আমার মতই ‘মন খারাপ’এর শিকার। কেউ বলল ‘Mid-life crisis’, ‘Separation anxiety’, ‘Hormonal change’, দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধি। বেশির ভাগেরই ছেলে মেয়ে বাইরে পড়তে চলে গেছে। তা পাখীর ছানা বড় হলে ডানা মেলে তো উড়বেই।  তার ওপর এই করোনার ছোবল। অনেকেই অনেক কাছের মানুষকে হারিয়ে দিশাহারা। কাজেই অক্সিজেন প্ল্যাণ্টও যথেষ্ট অক্সিজেন দিতে পারছে না। দেবে কি করে – কাঁচামালেই যে টান! কে কাকে উৎসাহ জোগায়! উলটে চারিদিকের এত ডিপ্রেসন যে কারুর সঙ্গে কথা বলতেই ভয় হয়। মন ভাল হবার বদলে আরও খারাপ হয়ে যায়।

নাহ্‌, এভাবে চলতে পারে না। কেন ভগবদ্গীতার ৬.৫ ভুলে গেলে!

উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ।

আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ॥

নিজেই নিজেকে উদ্ধার করতে হবে। তা নিজে করলেও সঙ্গীসাথী সঙ্গে থাকলে তো মন্দ হয় না। ওই বন্ধুদেরই শরণাপন্ন হলুম। সারাদিন ওই এক গাছ-ফুল, পোষাক-আশাক, রান্না রেসিপি, ঘোরা-বেড়ানো, পরচর্চা আর না হলেই সেই পরীক্ষার রেসাল্ট, এ ফার্স্ট ও লাস্ট। আরে বাবা কেউ না কেউ তো ফার্স্ট হবেই! চেনা নেই শোনা নেই তার রেসাল্ট জেনে আমি নিজের টেনশন বাড়াই কেন!

দুচারজনকে পাকড়াই। চল না অন্ততঃ একটা দিন একটা ঘন্টা একসঙ্গে কোনোও একটা বই পড়া শুরু করি? তা কিছু সঙ্গী জুটে যায়– সকব’র ভাষায় মুর্গী। কিন্তু কি বই পড়া যাবে? আরে আজ না রামনবমী? তা আদিকাব্য রামায়ণ দিয়েই শুরু করা যাক না! যতই সেই ছোটবেলা থেকে রামায়ণ শুনে বড় হই না কেন, রামায়ণের অনেক কিছু না জানা, না বোঝা, ভুল বোঝা রয়ে গেছে। আর অনেক প্রশ্নও। কেউ কেউ বলে তাই বলে রামজীর নিন্দা কিন্তু শুনতে পারব না! নিন্দা কেন হবে! দেখা যাক না যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে, হয়তো তাতে রামচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েও যেতে পারে। অন্ধ বিশ্বাস নয় – যুক্তিগ্রাহ্য শ্রদ্ধা। ভগবান রাম নন, মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম – শ্রেষ্ঠ মানুষ যিনি। যাঁকে দেখে নিজেদের জীবনটাকেও একটু tune করে নেওয়া যায়। শ্রদ্ধেয়া মুক্তিপ্রাণা মাতাজীর ‘রামায়ণ প্রসঙ্গ’ বইটা বাড়িতেই ছিল। এরকম কত বই যে কেনা আছে, কবে পড়া হবে জানা নেই! ছোট বই। শুরুটা ছোটই ভাল। আগে দেখা তো যাক পরীক্ষা কতটা সফল হয়!

দিদিমণি, বড়দিমণি, স্বরূদি, Master Chef, আর সঙ্গে সোমা – ছোট থেকে আমার মাথার সব উদ্ভট খেয়াল যে বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছে। আর এসেছে সেই আরেকজন! সেই সকব’র কথায় অসুস্থ বলে যাকে দেখতে তার বাড়ি গিয়েই কাল হয়েছে। বইএর আলমারীতে রাখা ভগবৎগীতার বই দেখেই পাগলীর মাথার পোকা নড়ে উঠেছে আর ‘খপাৎ খপাৎ’ করে ছেলেধরার মত মুর্গী ধরে ছোটু তার পাঠশালা ভর্তি করছে।  

জিজ্ঞাসুর প্রথম দিন সকব’র প্রতিক্রিয়া

তা জয়া ছাড়া কি বিজয়া থাকতে পারে!জয়াদিদিমণিও এসেছে। নবাংকুরের বাকিরা ইস্কুল অফিস নিয়ে ব্যস্ত, কাজেই তাদের ছাড় দিতেই হয়। এসেছে পরম পূজনীয় মহারাজের বড় আদরের ‘দিদি’। এসেছে সাড়ে বারো আর পিটিম্যামও। মুখপুস্তিকায় জীবনজিজ্ঞাসা ভরা পোস্ট দেখে লায়লাকেও ডেকে নিলুম দলে। বাকি পবিত্র শিশুপালেরা কেউ কেউ ‘এ রসে বঞ্চিত’ আর কেউ কেউ ‘কাজের মানুষ’। তাই ইচ্ছে থাকলেও তাদের উপায় নেই। প্রথম দিনে বই পড়া জমলো ভালই। আর উৎসাহরও শেষ নেই সবার মনে। তক্ষুণি হোয়াটস্‌আপে গ্রুপ তৈরী হয়ে গেল। তার বেশ গালভরা নাম – জিজ্ঞাসু।

সেই তো শুরু হল যাত্রা। এই যাত্রার শুরুতেই পেয়েছি পুজনীয় বিমোক্ষানন্দজী মহারাজের আশীর্বাদ। আমাদের উৎসাহ দেখে মহারাজ নিজে থেকেই এই বইটা কিনে একদিন আমাদের সঙ্গে রামায়ণের ওপর আলোচনা করতেও রাজী হয়ে যান। ওনার এই অযাচিত কৃপায় আমরা আপ্লুত। তবে কেউ কেউ একটু যেন আড়ষ্ট। কখনও এমন সামনাসামনি কোনো সাধুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার অভিজ্ঞতা নেই তো! কিন্তু মহারাজের এই আসার জন্যে আমাদের অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। একাধিকবার সব ঠিকঠাক হয়েও শেষ মুহুর্তে মিটিং বানচাল হয়ে গেছে। তখন মনে হয়েছে শ্রীরামচন্দ্র বুঝি আমাদের এইসব অর্বাচীনের মত প্রশ্নে কুপিত হয়েছেন।

ইতিমধ্যে আমাদের সাপ্তাহিক একদিনের ক্লাস বেড়ে দুদিন তারপর চারদিন, সোম থেকে বৃহস্পতি হয়েছে। আবার কখনও কখনও তাতেও হয় না। শুক্রবারেও হাত পড়ে। তারপর শুরু হয়েছে একাদশী উপলক্ষ্যে ‘রামনাম সংকীর্তন’। যত আমি রামচন্দ্রকে ‘মোট্টে পছন্দ করতুম না’ তত যেন রামচন্দ্র জড়িয়ে ধরেন আমায়! আর সেই দেখে নির্ঘাৎ সেই দাড়িওয়ালা ‘পেরবীন’ মানুষটিও মুখ টিপে টিপে হাসেন। ভাবেন ‘কেমন জব্দ’!

অবশ্য তাঁর সঙ্গে আরেকজনও হাসেন – উদ্দাত্ত কণ্ঠে ‘হা হা’ করে, যিনি ওই দাড়িওয়ালা পেরবীনকে বলেন ‘দোস্ত’! সেই ‘দোস্ত’কে জানতে গেলে তো তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্যকে পড়তে, জানতে, বুঝতে হবেই! ‘ভাষ্য’ না পড়লে কি ‘সূত্র’ বোঝা যায়! আর শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত তো নবযুগের ‘বেদ’। সেই বেদ জানতে গেলে স্বামীজীর লেখা তো পড়তেই হয়। আর সবাই মিলে একসঙ্গে ঝাঁপ দিলে ঠিক সাঁতরে পার হওয়া যাবে। একেই অন্যকে টেনে নিয়ে যাবে। নইলে বন্ধু কিসে!

আমাদের এমন অবস্থা, যে বই পড়তে যাই, হয় কিছুই বুঝি না, নয় অনেক প্রশ্ন। কাউকে তো চাই যাঁর কাছে এইসবের উত্তর পাওয়া যাবে। ভাষ্য বোঝার জন্যেও যেমন চাই টিকা, আমাদেরও তেমনি মহারাজদের ব্যাখ্যা বোঝার জন্যে আরও কোনো ব্যাখ্যাকার চাই। আমাদের স্তরে নেমে এসে যিনি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। একা SwV মাসের ওই একটা ক্লাসে আর কত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন! তাছাড়া অনেক সময় ওনার অন্য অসুবিধেও থাকে, ক্লাস নিতে পারেন না। এদিকে আমাদের প্রশ্নের পাহাড় তো ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে।

বিল্লু তো চিরকালই আমার মুশকিল আসান। বলল SwS কে জিজ্ঞেস করব? সে হলে তো খুব ভালই হয়। রাজিও হয়ে যান মহারাজ। ঠিক হয় মাসে দুদিন করে ক্লাস নেবেন মহারাজ। তা স্বামীজী কে দিয়েই শুরু করা যাক। কারণ স্বামীজীর লেখা পড়তে গিয়ে আমাদের শুধুই হোঁচট খেতে হচ্ছে। দুজন মহারাজ এক্কেবারে দুই মেরুর  – SwV যত ধীর স্থির, আসতে আসতে এগোন। যেকোনো জিনিসের একেবারে মূল থেকে শুরু করেন আর যতক্ষণ না সবার বোঝা হচ্ছে পরের বিষয়ে যান না, SwS-এর যেন তত তাড়া। থেকে থেকেই করুণ স্বরে বলতে হয় মহারাজ একটু সবুর করুন। ছোট মহারাজ প্রথমেই ডিক্রি জারি করে দিলেন systematically না পড়লে কিস্যু হবে নি। আর ঠাকুর-মা-স্বামীজীকে ঠিকমতো বুঝতে হলে একটু শাস্ত্র অন্ততঃ প্রকরণ গ্রন্থ পড়তেই হবে। আর সে সব উনি ইতিমধ্যেই অন্য জায়গায় পড়িয়ে ফেলেছেন। কাজেই সেসব বক্তৃতা শুনেই নিজেদের শিখে নিতে হবে।

সেই শুরু হল আরেক পর্ব। নিজেরা নিজেরা YouTube video দেখে বোঝার চেষ্টা। তবে ‘তত্ত্ববোধ’ জিজ্ঞাসুর বোধশক্তি বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে। আজকাল নিজেরা বই পড়তে গেলে মনে হয় শব্দগুলো যেন চেনা চেনা। আর না চেনা হলেও কুছ পরোয়া নেহি! মহারাজ তো আছেন পড়া বুঝিয়ে দেবার জন্যে। আর এমন মজার কাণ্ড – আমরা যখন যে পড়াটা পড়ি দেখি সব বইএর বিষয়গুলো কেমন এক! এ বাপু ওই ‘দাড়িওয়ালা’র কারসাজি ছাড়া কি!

এদিকে এত শক্ত শক্ত পড়ার ভয়ে পাঠশালা থেকে রোজই ছাত্রী পালায়। ছোটুর খপাৎ খপাৎ আর কোনওই কাজে আসে না। ফ্যাল ফ্যাল করে দেখে ছোটু – দুরুদুরু বুকে। শেষকালে এমন সাধের পাঠশালা উঠে যাবে না তো! ছোটু তাহলে বাঁচবে কি নিয়ে? এই যে রোজ সকাল থেকে ছোটুর ব্যস্ততা, আর এই যে নিয়মিত পড়ার বাইরে প্রায়শঃই বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান! কত নতুন নতুন গল্প, গান, স্তোত্র শোনা, পাঠশালা ছুটি হয়ে যাবার পরও আরও কতক্ষণ আড্ডা – এগুলোই তো ছোটুর আসল অক্সিজেন। আর একা ছোটুই বা বলি কেন, আফিঙ্গের মৌতাতে তো আরও অনেক ময়ূরই মজেছে।

ভরসা একটাই ওপর থেকে যিনি সব কলকাঠি নাড়ছেন, মহারাজদের মধ্যে দিয়ে যাঁর কৃপা জিজ্ঞাসুর ওপর ঝরে পড়ছে, প্রথম জন্মদিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের সব বিশেষ বন্দোবস্তও আসলে যিনি করছেন তিনিই টেনে নিয়ে যাবেন এই জিজ্ঞাসু – এটাই আশা, এটাই ভরসা আর এটাই প্রার্থনা।

Author:

I do whatever I like and whenever I like :) ;P

2 thoughts on “জিজ্ঞাসুর এক বছর

Leave a comment