Posted in Reflections

জিজ্ঞাসুর এক বছর

দেখতে দেখতে হৈ হৈ করে একটা বছর পার হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এই তো সেই দিন। নিজের দুশ্চিন্তার পাহাড়ে পুরোপুরি বিধ্বস্ত; রাতের ঘুম চোখ থেকে উধাও। দিনের বেলাও ‘দিন কাটে না’। সারাদিন শুয়ে শুয়ে বোকাবাক্সে একই সিরিয়ালের একই পর্ব দেখে চলেছি। রোজই সেই একই জিনিস। আসলে নিজের মুখোমুখি হতেই ভয়। এই বুঝি আবার গ্রাস করলো দুশ্চিন্তা। মূঢ়তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ যাকে বলে। এদিকে আবার বিবেক দংশনও হয়। কি করছি!

বই পড়তে যাই – দু চার লাইনের বেশি এগোয় না। অত যে প্রিয় শরদিন্দু সেও না। আচ্ছা শরদিন্দু না হয় সাধুভাষা, কিন্তু অন্য বই! লীলা মজুমদার, নবনীতা দেবসেন! নাহ্‌, তাও ভাল লাগে না। চেষ্টা যে করছি না তা নয়। তার সঙ্গে ইস্কুলের দাওয়াই – প্রার্থনা। হচ্ছে না!

কিসের দুশ্চিন্তা এত! বোঝাতে পারি না কাউকেই। নিজেকেই কি বোঝাতে পারি! আমাদের মস্ত বড় ভরসার জায়গা এই ‘পবিত্র শিশুপাল’ – অক্সিজেন সিলিণ্ডার না, যেন পুরো একটা অক্সিজেনের প্ল্যাণ্ট। কিন্তু সেখানেও শান্তি নেই। দেখি সব বন্ধুই কম বেশি সেই আমার মতই ‘মন খারাপ’এর শিকার। কেউ বলল ‘Mid-life crisis’, ‘Separation anxiety’, ‘Hormonal change’, দ্বিতীয় বয়ঃসন্ধি। বেশির ভাগেরই ছেলে মেয়ে বাইরে পড়তে চলে গেছে। তা পাখীর ছানা বড় হলে ডানা মেলে তো উড়বেই।  তার ওপর এই করোনার ছোবল। অনেকেই অনেক কাছের মানুষকে হারিয়ে দিশাহারা। কাজেই অক্সিজেন প্ল্যাণ্টও যথেষ্ট অক্সিজেন দিতে পারছে না। দেবে কি করে – কাঁচামালেই যে টান! কে কাকে উৎসাহ জোগায়! উলটে চারিদিকের এত ডিপ্রেসন যে কারুর সঙ্গে কথা বলতেই ভয় হয়। মন ভাল হবার বদলে আরও খারাপ হয়ে যায়।

নাহ্‌, এভাবে চলতে পারে না। কেন ভগবদ্গীতার ৬.৫ ভুলে গেলে!

উদ্ধরেদাত্মনাত্মানং নাত্মানমবসাদয়েৎ।

আত্মৈব হ্যাত্মনো বন্ধুরাত্মৈব রিপুরাত্মনঃ॥

নিজেই নিজেকে উদ্ধার করতে হবে। তা নিজে করলেও সঙ্গীসাথী সঙ্গে থাকলে তো মন্দ হয় না। ওই বন্ধুদেরই শরণাপন্ন হলুম। সারাদিন ওই এক গাছ-ফুল, পোষাক-আশাক, রান্না রেসিপি, ঘোরা-বেড়ানো, পরচর্চা আর না হলেই সেই পরীক্ষার রেসাল্ট, এ ফার্স্ট ও লাস্ট। আরে বাবা কেউ না কেউ তো ফার্স্ট হবেই! চেনা নেই শোনা নেই তার রেসাল্ট জেনে আমি নিজের টেনশন বাড়াই কেন!

দুচারজনকে পাকড়াই। চল না অন্ততঃ একটা দিন একটা ঘন্টা একসঙ্গে কোনোও একটা বই পড়া শুরু করি? তা কিছু সঙ্গী জুটে যায়– সকব’র ভাষায় মুর্গী। কিন্তু কি বই পড়া যাবে? আরে আজ না রামনবমী? তা আদিকাব্য রামায়ণ দিয়েই শুরু করা যাক না! যতই সেই ছোটবেলা থেকে রামায়ণ শুনে বড় হই না কেন, রামায়ণের অনেক কিছু না জানা, না বোঝা, ভুল বোঝা রয়ে গেছে। আর অনেক প্রশ্নও। কেউ কেউ বলে তাই বলে রামজীর নিন্দা কিন্তু শুনতে পারব না! নিন্দা কেন হবে! দেখা যাক না যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে, হয়তো তাতে রামচন্দ্রের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েও যেতে পারে। অন্ধ বিশ্বাস নয় – যুক্তিগ্রাহ্য শ্রদ্ধা। ভগবান রাম নন, মর্যাদা পুরুষোত্তম রাম – শ্রেষ্ঠ মানুষ যিনি। যাঁকে দেখে নিজেদের জীবনটাকেও একটু tune করে নেওয়া যায়। শ্রদ্ধেয়া মুক্তিপ্রাণা মাতাজীর ‘রামায়ণ প্রসঙ্গ’ বইটা বাড়িতেই ছিল। এরকম কত বই যে কেনা আছে, কবে পড়া হবে জানা নেই! ছোট বই। শুরুটা ছোটই ভাল। আগে দেখা তো যাক পরীক্ষা কতটা সফল হয়!

দিদিমণি, বড়দিমণি, স্বরূদি, Master Chef, আর সঙ্গে সোমা – ছোট থেকে আমার মাথার সব উদ্ভট খেয়াল যে বিনা বাক্যে মেনে নিয়েছে। আর এসেছে সেই আরেকজন! সেই সকব’র কথায় অসুস্থ বলে যাকে দেখতে তার বাড়ি গিয়েই কাল হয়েছে। বইএর আলমারীতে রাখা ভগবৎগীতার বই দেখেই পাগলীর মাথার পোকা নড়ে উঠেছে আর ‘খপাৎ খপাৎ’ করে ছেলেধরার মত মুর্গী ধরে ছোটু তার পাঠশালা ভর্তি করছে।  

জিজ্ঞাসুর প্রথম দিন সকব’র প্রতিক্রিয়া

তা জয়া ছাড়া কি বিজয়া থাকতে পারে!জয়াদিদিমণিও এসেছে। নবাংকুরের বাকিরা ইস্কুল অফিস নিয়ে ব্যস্ত, কাজেই তাদের ছাড় দিতেই হয়। এসেছে পরম পূজনীয় মহারাজের বড় আদরের ‘দিদি’। এসেছে সাড়ে বারো আর পিটিম্যামও। মুখপুস্তিকায় জীবনজিজ্ঞাসা ভরা পোস্ট দেখে লায়লাকেও ডেকে নিলুম দলে। বাকি পবিত্র শিশুপালেরা কেউ কেউ ‘এ রসে বঞ্চিত’ আর কেউ কেউ ‘কাজের মানুষ’। তাই ইচ্ছে থাকলেও তাদের উপায় নেই। প্রথম দিনে বই পড়া জমলো ভালই। আর উৎসাহরও শেষ নেই সবার মনে। তক্ষুণি হোয়াটস্‌আপে গ্রুপ তৈরী হয়ে গেল। তার বেশ গালভরা নাম – জিজ্ঞাসু।

সেই তো শুরু হল যাত্রা। এই যাত্রার শুরুতেই পেয়েছি পুজনীয় বিমোক্ষানন্দজী মহারাজের আশীর্বাদ। আমাদের উৎসাহ দেখে মহারাজ নিজে থেকেই এই বইটা কিনে একদিন আমাদের সঙ্গে রামায়ণের ওপর আলোচনা করতেও রাজী হয়ে যান। ওনার এই অযাচিত কৃপায় আমরা আপ্লুত। তবে কেউ কেউ একটু যেন আড়ষ্ট। কখনও এমন সামনাসামনি কোনো সাধুর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার অভিজ্ঞতা নেই তো! কিন্তু মহারাজের এই আসার জন্যে আমাদের অনেক অপেক্ষা করতে হয়েছে। একাধিকবার সব ঠিকঠাক হয়েও শেষ মুহুর্তে মিটিং বানচাল হয়ে গেছে। তখন মনে হয়েছে শ্রীরামচন্দ্র বুঝি আমাদের এইসব অর্বাচীনের মত প্রশ্নে কুপিত হয়েছেন।

ইতিমধ্যে আমাদের সাপ্তাহিক একদিনের ক্লাস বেড়ে দুদিন তারপর চারদিন, সোম থেকে বৃহস্পতি হয়েছে। আবার কখনও কখনও তাতেও হয় না। শুক্রবারেও হাত পড়ে। তারপর শুরু হয়েছে একাদশী উপলক্ষ্যে ‘রামনাম সংকীর্তন’। যত আমি রামচন্দ্রকে ‘মোট্টে পছন্দ করতুম না’ তত যেন রামচন্দ্র জড়িয়ে ধরেন আমায়! আর সেই দেখে নির্ঘাৎ সেই দাড়িওয়ালা ‘পেরবীন’ মানুষটিও মুখ টিপে টিপে হাসেন। ভাবেন ‘কেমন জব্দ’!

অবশ্য তাঁর সঙ্গে আরেকজনও হাসেন – উদ্দাত্ত কণ্ঠে ‘হা হা’ করে, যিনি ওই দাড়িওয়ালা পেরবীনকে বলেন ‘দোস্ত’! সেই ‘দোস্ত’কে জানতে গেলে তো তাঁর সবচেয়ে প্রিয় শিষ্যকে পড়তে, জানতে, বুঝতে হবেই! ‘ভাষ্য’ না পড়লে কি ‘সূত্র’ বোঝা যায়! আর শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত তো নবযুগের ‘বেদ’। সেই বেদ জানতে গেলে স্বামীজীর লেখা তো পড়তেই হয়। আর সবাই মিলে একসঙ্গে ঝাঁপ দিলে ঠিক সাঁতরে পার হওয়া যাবে। একেই অন্যকে টেনে নিয়ে যাবে। নইলে বন্ধু কিসে!

আমাদের এমন অবস্থা, যে বই পড়তে যাই, হয় কিছুই বুঝি না, নয় অনেক প্রশ্ন। কাউকে তো চাই যাঁর কাছে এইসবের উত্তর পাওয়া যাবে। ভাষ্য বোঝার জন্যেও যেমন চাই টিকা, আমাদেরও তেমনি মহারাজদের ব্যাখ্যা বোঝার জন্যে আরও কোনো ব্যাখ্যাকার চাই। আমাদের স্তরে নেমে এসে যিনি আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন। একা SwV মাসের ওই একটা ক্লাসে আর কত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন! তাছাড়া অনেক সময় ওনার অন্য অসুবিধেও থাকে, ক্লাস নিতে পারেন না। এদিকে আমাদের প্রশ্নের পাহাড় তো ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে।

বিল্লু তো চিরকালই আমার মুশকিল আসান। বলল SwS কে জিজ্ঞেস করব? সে হলে তো খুব ভালই হয়। রাজিও হয়ে যান মহারাজ। ঠিক হয় মাসে দুদিন করে ক্লাস নেবেন মহারাজ। তা স্বামীজী কে দিয়েই শুরু করা যাক। কারণ স্বামীজীর লেখা পড়তে গিয়ে আমাদের শুধুই হোঁচট খেতে হচ্ছে। দুজন মহারাজ এক্কেবারে দুই মেরুর  – SwV যত ধীর স্থির, আসতে আসতে এগোন। যেকোনো জিনিসের একেবারে মূল থেকে শুরু করেন আর যতক্ষণ না সবার বোঝা হচ্ছে পরের বিষয়ে যান না, SwS-এর যেন তত তাড়া। থেকে থেকেই করুণ স্বরে বলতে হয় মহারাজ একটু সবুর করুন। ছোট মহারাজ প্রথমেই ডিক্রি জারি করে দিলেন systematically না পড়লে কিস্যু হবে নি। আর ঠাকুর-মা-স্বামীজীকে ঠিকমতো বুঝতে হলে একটু শাস্ত্র অন্ততঃ প্রকরণ গ্রন্থ পড়তেই হবে। আর সে সব উনি ইতিমধ্যেই অন্য জায়গায় পড়িয়ে ফেলেছেন। কাজেই সেসব বক্তৃতা শুনেই নিজেদের শিখে নিতে হবে।

সেই শুরু হল আরেক পর্ব। নিজেরা নিজেরা YouTube video দেখে বোঝার চেষ্টা। তবে ‘তত্ত্ববোধ’ জিজ্ঞাসুর বোধশক্তি বেশ বাড়িয়ে দিয়েছে। আজকাল নিজেরা বই পড়তে গেলে মনে হয় শব্দগুলো যেন চেনা চেনা। আর না চেনা হলেও কুছ পরোয়া নেহি! মহারাজ তো আছেন পড়া বুঝিয়ে দেবার জন্যে। আর এমন মজার কাণ্ড – আমরা যখন যে পড়াটা পড়ি দেখি সব বইএর বিষয়গুলো কেমন এক! এ বাপু ওই ‘দাড়িওয়ালা’র কারসাজি ছাড়া কি!

এদিকে এত শক্ত শক্ত পড়ার ভয়ে পাঠশালা থেকে রোজই ছাত্রী পালায়। ছোটুর খপাৎ খপাৎ আর কোনওই কাজে আসে না। ফ্যাল ফ্যাল করে দেখে ছোটু – দুরুদুরু বুকে। শেষকালে এমন সাধের পাঠশালা উঠে যাবে না তো! ছোটু তাহলে বাঁচবে কি নিয়ে? এই যে রোজ সকাল থেকে ছোটুর ব্যস্ততা, আর এই যে নিয়মিত পড়ার বাইরে প্রায়শঃই বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠান! কত নতুন নতুন গল্প, গান, স্তোত্র শোনা, পাঠশালা ছুটি হয়ে যাবার পরও আরও কতক্ষণ আড্ডা – এগুলোই তো ছোটুর আসল অক্সিজেন। আর একা ছোটুই বা বলি কেন, আফিঙ্গের মৌতাতে তো আরও অনেক ময়ূরই মজেছে।

ভরসা একটাই ওপর থেকে যিনি সব কলকাঠি নাড়ছেন, মহারাজদের মধ্যে দিয়ে যাঁর কৃপা জিজ্ঞাসুর ওপর ঝরে পড়ছে, প্রথম জন্মদিনের বিশেষ অনুষ্ঠানের সব বিশেষ বন্দোবস্তও আসলে যিনি করছেন তিনিই টেনে নিয়ে যাবেন এই জিজ্ঞাসু – এটাই আশা, এটাই ভরসা আর এটাই প্রার্থনা।

Posted in Reflections

তব কথামৃতম্‌

তব কথামৃতং তপ্তজীবনং, কবিভিরীড়িতং কল্মষাপহম্‌।

শ্রবণমঙ্গলং শ্রীমদাততং, ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ।।

[গোপীগীতা, রাসপঞ্চাধ্যায়]

শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের একত্রিংশতি অধ্যায়ের নবম শ্লোক – বৈষ্ণবভক্তদের মধ্যে তো বটেই কিন্তু আজ সমধিক প্রচলিত ও প্রসারিত শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমণ্ডলীর কাছে। রামকৃষ্ণ ভাবাশ্রয়ীদের কাছে পরম শ্রদ্ধেয় মাস্টারমশাই ‘শ্রীম’, তাঁর রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রথমেই এই শ্লোকটির উল্লেখ করেছেন। রচনার মঙ্গলাচরণ করেছেন এই শ্লোক দিয়েই। আর আমরাও তোতাপাখীর বাঁধা বুলির মত কথামৃত পড়ার আগে এইটি আউড়ে যাই। কিন্তু সত্যিই কি ভেবে দেখেছি এই কথাগুলোর কি তাৎপর্য!

কথা মানে শুধুই কি ‘বাণী’? কথার তো আরেকটা মানে হয় গল্প বা আখ্যান। আসুন না ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণদেবের বাণীর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর জীবনের আখ্যানের নিরিখে একটু আলোচনা করা যাক এই শ্লোকের মর্মার্থ।

কথামৃতকার মাস্টারমশাই ঠাকুরের ‘কথা’ কে শুধু ‘কথা’ বলেই ক্ষান্ত হন নি – বলেছেন ‘কথামৃত’। এই অমৃত জীবনদায়ী। কিন্তু কার কাছে? উত্তর!

১) তপ্তজীবনম্‌ –

সংসারের তাপে দগ্ধ ক্লান্ত মানুষ যখন দুঃখে কষ্টে মুহ্যমান – মনে করে আর কেন! শেষ করে দিই জীবনটা তখন ঠাকুরের কথা, ঠাকুরের জীবন নতুন করে তাদের বাঁচার রসদ জোগায়। বিশ্বাস না হলে স্বয়ং কথামৃতকারের জীবনের দিকেই একবার ফিরে তাকান না! জীবনের প্রতি হতশ্রদ্ধ মাস্টারমশাই তখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন কলকাতার কাছাকাছি এ বাগান, সে বাগান – জীবনটা মনের মত চলছে না, কিন্তু জীবনের ইতি টানার জায়গাটা তো মনের মত খোঁজা যায়! ঘুরতে ঘুরতেই এসে পড়লেন ‘রাসমণির বাগানে’। প্রথম দর্শনেই ঠাকুরকে দেখে তাঁর মনে হল ‘সাক্ষাৎ শুকদেব ভাগবৎ-কথা কহিতেছেন, আর সর্বতীর্থের সমাগম হইয়াছে। অথবা যেন শ্রীচৈতন্য পুরীক্ষেত্রে রামানন্দ স্বরূপাদি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন ও ভগবানের নামগুণকীর্তন করিতেছেন’। সেই পরিচয় ঠাকুরের সঙ্গে। সম্পূর্ণ বদল হয়ে গেল একটা জীবন। ঠাকুরের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরের কথাকার হয়ে গেলেন অমর।

ঠাকুরের অন্তরঙ্গ দলের শেষ সদস্য – ঈশ্বরকোটি তিনি – পূর্ণ তাঁর নাম। সংসারের জ্বালায় জর্জরিত। ঠিক করলেন এবার শেষ করে দিতে হবে এই জীবনটাকে। প্রস্তুত হয়ে ভাবলেন শেষবারের মত একটু ঠাকুরের কথা পড়ে নি। সেই চিন্তা করতে করতে পাড়ি দেওয়া যাবে পরপারে। কথামৃত হাতে নিয়ে অমনিই উল্টোলেন পাতা। দেখেন লেখা রয়েছে, ‘পূর্ণের বয়স পনর হইবে। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিবার জন্য ব্যাকুল হইয়াছেন’। ব্যস্‌, মনের মধ্যে ওঠে নতুন তরঙ্গ – ‘ঠাকুর সবসময় আমার মঙ্গল চিন্তা করেন! আর সেই আমি নিজের জীবন শেষ করার কথা ভাবছি!’ মৃত্যুচিন্তা মুছে গেল মন থেকে।

আদরের কন্যাটিকে হারিয়ে ডাক্তার রামচন্দ্র দত্ত জীবনের মানে খুঁজে পান না। যে মেয়ে এই ছিল এক লহমায় সে নেই হয়ে গেল! অস্থির মনে একদিন গিয়ে পড়েন দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের ঘরে। দুপুর থেকে সন্ধ্যে গড়িয়ে যায় কথায় কথায়। বাড়ি ফেরেন রাম দত্ত – যেন এক নতুন মানুষ।

শোকাতুরা বিধবা ব্রাহ্মণী হারিয়েছেন তাঁর একমাত্র মেয়েটিকেও। ঠাকুরের ঘরের বাইরে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনেন ঘরের ভেতরের কথা। সেই কথাই শেষ পর্যন্ত ভুলিয়ে দেয় তাঁর সে শোক। খুঁজে পান বেঁচে থাকার নতুন দিশা।

ঠাকুর আমাদের বালক স্বভাব। যেখানে যা নতুন কিছু শোনেন তাই দেখতে ছোটেন। নইলে কেউ কোনদিন শুনেছে সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী থিয়েটার দেখতে যান! ‘নিমাই সন্ন্যাস’ পালা। দেখে বললেন ‘আসল নকল এক বোধ হল’। পালটে গেলো বিনোদিনী সহ আরও সব নটীদের জীবন। অমৃতের সন্ধান পেলেন তাঁরা। শুদ্ধতার মূর্তরূপ ঠাকুর যিনি এতটুকু অশুদ্ধ সহ্য করতে পারতেন না, সাহেবরূপী ছদ্মবেশী তারাসুন্দরীকে কৃপা করলেন – কোথায়? সেও সেই কাশীপুরে, শেষ অসুখের সময়। বারাঙ্গনা নটীদের তাপিত চিত শীতল হল সেই অমৃতের পরশে।

২) কবিভিরীড়িতম্‌ –

কবি অর্থাৎ মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি, জ্ঞানী যাঁরা, তাঁরা প্রশংসা করেন যাঁর, হয়ে যান সেই অমৃতের ভাগী। সে তো সেই শুরুর কাল থেকেই। ভৈরবী ব্রাহ্মণীর উৎসাহে মথুরবাবুর ব্যবস্থাপনায় বৈষ্ণবচরণ সহ বড় বড় পণ্ডিতেরা আসেন তর্কসভায় ঠাকুরের অবতারত্ব প্রমাণ করতে। ইঁদেশের গৌরী পণ্ডিত সেদিন ছিলেন না। পরে এসে তিনি ঠাকুরকে বলেন, ‘বৈষ্ণবচরণ আপনাকে অবতার বলে? তবে তো ছোট কথা বলে। আমার ধারণা, যাঁহার অংশ হইতে যুগে যুগে অবতারেরা লোক-কল্যাণসাধনে জগতে অবতীর্ণ হইয়া থাকেন, যাঁহার শক্তিতে তাঁহারা ঐ কার্য সাধন করেন, আপনি তিনিই!’  বালক স্বভাব ঠাকুর বলেন, ‘কে জানে বাবু, আমি তো কিছু জানি না’।

পশ্চিমদেশ থেকে আসা দার্শনিক পণ্ডিত নারায়ণ শাস্ত্রী – তিনি ঠাকুরের মধ্যে ‘শাস্ত্রের সূক্ষ্ম বিষয় সমূহ উপলব্ধ’ লক্ষ্য করেছিলেন। তাই নবদ্বীপ থেকে নব্যন্যায়ে ব্যুৎপত্তি লাভ করে ফেরার পথে আবার আসেন দক্ষিণেশ্বরে। জেদ ধরে শেষ পর্যন্ত ঠাকুরের কাছে সন্ন্যাসধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনি ঠিক চিনেছিলেন ঠাকুরকে।

সে সময়ের বিদগ্ধ বক্তা শ্রী কেশব চন্দ্র সেন। স্বয়ং ইংল্যাণ্ডের রাণী যাঁর বক্তৃতা শুনতে আগ্রহী, তিনি সময় পেলেই ছুটে আসেন ঠাকুরের কথা শুনতে। বিভিন্ন পত্রিকায় তিনিই প্রথম প্রচার করলেন ঠাকুরের কথা। সেই লেখা পড়েই সে সময়ের কলকাতার বড় বড় বিদ্বান-বুদ্ধিজীবী থেকে কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা একে একে আসতে শুরু করল ঠাকুরের কাছে।

রামচন্দ্র দত্ত ঠাকুরের বাণী প্রচার করতে লাগলেন পুস্তিকার আকারে, বক্তৃতার মাধ্যমে। নাট্যাচার্য গিরিশ চন্দ্র ঘোষ তাঁর বিভিন্ন নাটকে ঠাকুরেরই ভাব, তাঁরই কথা প্রচার করলেন। তিনি বলতেন ‘নাটক লিখতে তিনিই শিখিয়েছেন’।

স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ঠাকুরের সঙ্গে কথা বলার পর বলেন ‘আজ একটি নতুন কথা শিখলাম ‘।

৩) কল্মষাপহম্‌ –

ঠাকুরের কথামৃত মানুষের দেহ-মন থেকে কালিমা-কলুষ দূর করে দেয়।

গিরিশ চন্দ্র ঘোষ নিজের সম্বন্ধে বলতেন তিনি নাকি এত পাপ করেছেন যে তিনি যেখানে দাঁড়ান সেখানে মাটি সাত হাত নিচে নেমে যায়। ঠাকুরের পবিত্র পরশে সেই গিরিশ চন্দ্র হয়ে উঠলেন ‘ভক্ত ভৈরব’। ঠাকুরের কৃপা স্পর্শে তিনি মনে করতেন তিনি গঙ্গাস্নান করলে মা গঙ্গা তাঁর পাবনী শক্তি ফিরে পাবেন।

সেই রকমই অপরিচিত জনৈক ভক্ত একদিন দক্ষিণেশ্বরে এসে ঠাকুরের ঘরের দরজার আড়ালে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। নিজেকে মনে করেন ক্ষমাহীন পাপী। বাইরে থেকেই ঠাকুরের কথা শোনেন আর চোখের জল ফেলেন। পরম কারুণিক ঠাকুর নিজে ঘর থেকে বেরিয়ে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে আসেন তাকে। বলেন, ‘বল, আমি মাদুর্গার ছেলে। আমার কোনও পাপ নেই! আর আজ থেকে আর কোনও পাপ কর্ম কোরো না’। ব্যস্‌, তুমি শুদ্ধ, বুদ্ধ, মুক্ত – এত সহজ!

কালীপদ ঘোষ, সুরেশ মিত্র আকণ্ঠ মদ্যপানে মাতাল। ঠাকুর একবারও বললেন না তাঁদের মদ খাওয়া ছাড়তে। শুধু বললেন মা কালীকে নিবেদন করে খেতে। মায়ের ছেলে মাকে কি খারাপ জিনিস দিতে পারেন! ধীরে ধীরে দুজনেরই মনের পরিবর্তন হতে দেখা যায়। একসময় সুরেশ মিত্র হয়ে ওঠেন ঠাকুরের অন্যতম রসদদার। তিনি না থাকলে আমরা আজ এই রামকৃষ্ণ সঙ্ঘ পেতুম কি!

ঠাকুর ও মা মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। একটি ভক্ত মেয়ে হঠাৎ বেশ কিছুদিন মায়ের কাছে আসে না। করুণাময়ী জননী খবর নিতে পাঠান। শোনেন সে এগজিমা রোগে আক্রান্ত তাই মায়ের কাছে আসতে পারে না। ডেকে পাঠালেন তাকে। ঠাকুরের চরণামৃত দিয়ে রোজ দু ফোঁটা করে খেতে বলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই সেই মেয়েটি রোগমুক্ত হয়ে ওঠে।

মদ্যপ পদ্মলোচন – গভীর রাতে তার মাতলামিতে অতিষ্ঠ সবাই। সে কিন্তু রাস্তায় দাঁড়িয়েই গান শুরু করে মায়ের ঘরের বন্ধ জানলার দিকে চেয়ে। ‘ওঠ গো করুণাময়ী, খোলো গো কুঠির দ্বার’। ভক্তের সে ডাকে জননী কি সাড়া না দিয়ে পারেন! খুলে যায় মায়ের ঘরের জানলা। দূর থেকেই মা কে দেখে চলে যায় সে। রাস্তার মাঝেই পড়ে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। কিন্তু করুণাময়ী যার সহায় তার আর চিন্তা কিসের! মা বলেন পদ্মলোচনকে ঠাকুর এসে নিয়ে গেছেন।

পরিব্রাজক স্বামী বিবেকানন্দ ঘুরতে ঘুরতে পৌঁছেছেন রাজস্থানের খেতড়িতে। রাজ অতিথির মনোরঞ্জনের জন্যে রাজা গানের আসর বসান। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, একজন বাঈজীর গান শুনবেন!আসর ছেড়ে উঠে যান স্বামীজী। ঘর থেকে শুনতে পান ভেসে আসছে যমুনা বাঈএর সেই বুকফাটা আর্তি – ‘প্রভু মেরে অবগুণ চিৎ না ধরো। সমদর্শী হ্যায় নাম তোহারো চাহে পার করো’। ঘোর ভাঙ্গে স্বামীজীর। কি একজন মানুষকে ঘৃণা করছেন তিনি! তিনি না সন্ন্যাসী! সেই মহান সন্ন্যাসীর দর্শনেই পালটে গেল যমুনা বাঈএর জীবনও। এরপর বাকি জীবন তিনি এক ছোট্ট কুটিয়ায় থাকতেন আর গান শোনাতেন শুধুমাত্র তাঁর কৃষ্ণ ভগবানকে।

৪) শ্রবণমঙ্গলম্‌ –

শ্রীম বলতেন ঠাকুরের সব কথাই মন্ত্র। যা ত্রাণ করে তাই তো মন্ত্র। সেই মন্ত্র সব সময়ই মঙ্গলপ্রদ। তবু তারও মধ্যে থেকে যদি বিশেষ কোনো আখ্যান বলতে হয় তবে সেই মাস্টার মশাইকে দিয়েই শুরু করতে হয়। সেই সে শুরুর দিনের কথা। তখনকার দিনের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ পাস মাস্টারমশাই এক গরীব নিরক্ষর পূজারি ব্রাহ্মণের কাছে সেই প্রথম দিনেই শুনলেন ‘এককে জানার নাম জ্ঞান আর বহুকে জানার নাম অজ্ঞান’। জানলেন ‘নিরাকারও সত্য আবার সাকারও সত্য’। শুনলেন, জানলেন ‘মানব জীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বর লাভ’।

ঘর ভর্তি লোক; বৈষ্ণবদের সম্বন্ধে বলতে বলতে ঠাকুর ভাবস্থ। বললেন, ‘জীবকে দয়া করার তুই কে? দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীব সেবা’। সেদিনের সেই এক ঘর ভক্তের মাঝে এক কলেজে পড়ুয়া ছেলে নরেন্দ্রনাথের প্রাণে বাজলো সে কথা। বললেন ‘যদি কোনওদিন সুযোগ হয় আজ যা শুনলুম তা কাজে করে দেখাবো’। উত্তরকালে সেই আদর্শই জন্ম দিল ‘রামকৃষ্ণ মিশন’।

নিরাকারবাদী কেশব সেন, ব্রাহ্মনেতা। ঠাকুরের প্রভাবে ধীরে ধীরে মানতে আরম্ভ করলেন ব্রহ্মের শক্তি – মা কালী। পরিবর্তন হল তাঁর মত প্রভাবশালী মানুষের জীবন দর্শন।

যুবক ভক্ত যোগীন্দ্র। প্রশ্ন করে বসে ঠাকুরকে ‘কাম যায় কি করে?’ ঠাকুরের সহজ দাওয়াই – ‘হাততালি দিয়ে হরিনাম করলেই কাম যাবে’। এত সহজ! বিশ্বাস হয় না যোগীন্দ্রের। তারপর ভাবে ঠাকুর যখন বলছেন একবার করেই দেখা যাক। কি আশ্চর্য! কিছুদিনের মধ্যে সত্যি সত্যিই মিলে গেল ঠাকুরের কথা, ফল পেলেন হাতে নাতে।

পরম আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ কৃষ্ণকিশোর। দেওঘরে গিয়ে জলতেষ্টায় কাতর। জল তুলছিল সে এক মুচি। ব্রাহ্মণ বললেন ‘বল শিব। তুই শুদ্ধ’। নির্দ্বিধায় খেলেন সেই ‘মুচির হাতের জল’। ঠাকুরের মুখে শোনা এ ঘটনারই পরবর্তী ধাপ মায়ের কথা – ভক্তের কোনো জাত হয় না। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে এই তো সেই সমন্বয়ের বাণী!

বাংলাদেশের এক প্রত্যন্ত গ্রামের এক গরীব বিধবা বধূ শ্রীশ্রীমা। তীর্থে গেছেন দক্ষিণ ভারত। মায়ের অমোঘ আকর্ষণে ব্যাঙ্গালোরে আশ্রমে উপচে পড়া ভক্তের ভিড়। সবাই মায়ের কথা শুনতে চায়। কিন্তু কেউ তো কারুর ভাষা জানেন না। কুছ পরোয়া নেই। নীরবতাই যেখানে অন্তরের ভাষা সেখানে শব্দও কম পড়ে যায়। সেদিন সব ভক্ত বাড়ি ফিরেছিলেন মনের মধ্যে পরম পরিতৃপ্তি নিয়ে।

৫) শ্রীমদ্‌ আততম্‌ –

শ্রীমৎ – অর্থাৎ, ভগবানের কথা শ্রী বা সৌন্দর্য ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ। আর তা আততম্‌ – মানে, সুদূরপ্রসারী এবং সহজপ্রাপ্ত।

ঠাকুরের কথা যে সুদুরপ্রসারী তা তো ঠাকুরের জীবনী থেকেই দেখা যায়। সাধনকালে সারা দেশের কোথা কোথা থেকে একে একে এসেছেন ভৈরবী ব্রাহ্মণী, তোতাপুরী, রামাইত সাধু। আবার কোথা থেকেই বা এসেছেন নারায়ণ শাস্ত্রী, বৈষ্ণবচরণ, গৌরী পণ্ডিত! আবার কেশব সেনের সঙ্গে এসেছেন ক্যাপ্তেন কুক। এসেছেন নেপালের রাজকর্মী ক্যাপ্তেন উপাধ্যায়, এসেছেন সিন্ধুপ্রদেশের হীরানন্দ। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসূদন, শশধর পণ্ডিত তাঁরাও এসেছেন ঠাকুরের কথা শুনতে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট অধর সেন তো ঠাকুরের পরম প্রিয় ভক্তদের একজন। আর যিনিই এসেছেন তিনিই সমৃদ্ধ হয়েছেন তাঁর জীবনে।

চিকিৎসা করতে শ্যামপুকুরে থাকার সময় হঠাৎই একদিন এসেছিলেন এক খ্রীষ্টান ভক্ত; যিনি ঠাকুরের মধ্যেই দেখেছিলেন তাঁর প্রভু যীশুকে।

সেরকম মায়ের আকর্ষণও কিছু কম নয়। সিনেমা জগতের বিধর্মী পার্সী সোরাব মোদি কিসের টানে এসেছিলেন মায়ের কাছে? দুজনে তো দুজনের ভাষা জানতেন না! তবু পুর্ণ হয়েছে সবার হৃদয়, ধন্য তাঁদের জীবন।

৬) ভুবি গৃণন্তি যে ভূরিদা জনাঃ –

যাঁরা বহু সুকৃতি সঞ্চয় করেছেন, উদার চিত্ত যাঁরা, সংসারের ভোগবাসনা যাঁদের চলে গিয়েছে, একমাত্র ব্রহ্মানন্দ ভোগ করতে চান যাঁরা, তাঁরাই এই অমৃত পানে পরম আনন্দ ভোগ করেন এবং অন্যকেও এই অমৃতের আস্বাদন করান।

ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানেরা অহোরাত্র কেবল ঠাকুরের ভাবেই বুঁদ হয়ে থাকতেন। যতিশ্রেষ্ঠ স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন পশ্চিমে তিনি কেবল ঠাকুরের কথাই বলেছেন। কথামৃতকার শ্রীম বলতেন ঠাকুরের কথা ছাড়া আর কি জানি! তাই শুধু কথামৃত রচনা নয়, তাঁর কাছে যখনই কেউ আসতেন পরিচিত কি অপরিচিত তিনি সবার কাছে শুধুই ঠাকুরের কথাই বলতেন। সেই অমৃতবারি সিঞ্চন করতেন সবার ওপর।

আমাদের অনেকেরই হয়তো কখনও কখনও মনে হয়েছে, আমরা কেন এত পরে জন্মালুম। ঠাকুরের পার্ষদ, ঠাকুরের সন্তান, ঠাকুরের ভক্ত – যাঁরা এই চর্মচক্ষে দেখেছেন ঠাকুর-মা-স্বামীজীকে, শুনেছেন তাঁদের মধুর অমৃতময়ী বাণী, ধন্য হয়েছে তাঁদের জীবন সে অমৃত ধারায় – তার থেকে আমরা কি চির বঞ্চিতই থেকে গেলুম! কিন্তু না, অহৈতুকী কৃপাসিন্ধু ঠাকুর হঠাৎ করেই নিজে থেকে ধরা দিয়েছেন কোনোও কোনোও ভক্তের কাছে, আজও এই সময়ও।

এক মহারাজ কথায় কথায় বলেন ‘কাঁচাখেকো ঠাকুর’ – কখন কি ভাবে যে কার মনের মধ্যে ঢুকে পড়েন কেউ টেরটিও পায় না। তাই তো শুধু কথামৃতকার বা বালক ভক্ত পূর্ণই নন আজও শোনা যায় কোনো মহিলা আত্মহননের জন্য অনুকূল মুহূর্তের অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে আনমনা ভাবেই খুলে পড়েন পাশে রাখা একটা বই আর সেই বই আমূল পরিবর্তন করে তার সম্পুর্ণ জীবনবোধ, কোথায় চলে যায় নিজেকে শেষ করে দেবার সেই পরিকল্পনা। বলাই বাহুল্য সে বই আজকের যুগের বেদ – শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত।

সাহিত্যিক জরাসন্ধ তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতিগ্রন্থ লৌহকপাটেও জানিয়েছেন এমন এক দুর্ধর্ষ মহিলা  কয়েদীর কথা। যে নাকি জেলখানার সমস্ত কর্মী এবং বাকি কয়েদীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল তার ব্যবহারে। আর কোনো উপায় না দেখে জেলার সাহেব তাকে জেলের লাইব্রেরী থেকে একটা বই পড়তে দেন। তারপর লাইব্রেরী থেকে সেই মেয়েটির নামে নালিশ জানানো হয়। সে কিছুতেই সেই বই ফেরৎ দেয় না, উলটে গালিগালাজ মারধর করে সেই লোকেদের তাড়িয়ে দেয়। মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করে জেলার সাহেব জানতে পারেন সেই বইএর মধ্যেই সে খুঁজে পেয়েছে জীবনের মানে। তাই কোনোওভাবেই সে সেই বইটি আর কাছছাড়া করতে রাজি নয়। এই তো সেই মধু যা সবাইকে সত্যের পথে, আলোর পথে, অমৃতের পথের সন্ধান দেয়।

তথ্য সূচীঃ

  1. শ্রীম কথিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত
  2. শ্রীমৎ স্বামী সারদানন্দজী বিরোচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ
  3. শ্রীমৎ স্বামী ভূতেশানন্দজী রচিত শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত-প্রসঙ্গ
  4. শ্রীমৎ স্বামী চেতনানন্দজী লিখিত ধ্যানলোকে শ্রীরামকৃষ্ণ
  5. শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত – প্রতিদিনের প্রয়োজন, বক্তাঃ- শ্রীমৎ স্বামী বিমোক্ষানন্দজী, SARAS অনলাইন সৎসঙ্গ ১০ই এপ্রিল ২০২৪
  6. কথামৃতের জাদু, বক্তাঃ- শ্রীমৎ স্বামী নিখিলেশ্বরানন্দজী, কথামৃত ভবন ৩০শে ডিসেম্বর ২০১৯
Posted in Uncategorized

বাপী ডা-ব খাবি রে!

উত্তর ভারতের হাড়কাঁপানো শীতটা গেছে কি যায় নি, নতুন গরম ভাল করে পড়তে পেল না, শুরু হয়ে গেল হাত চুলকানো, পা চুলকানো। উফ্‌, আর পারা যায় না বাপু! কদিন আগে গরম মোজা পরেও পায়ের আঙ্গুল ফেটে রক্ত – Frostbite! এখন সুতির মোজাও পায়ে দেবার উপায় নেই – এলার্জি, আমবাত, পেটগরম! সেই হযবরল-র মত কে যেন কানের কাছে বলছে – “বাপী, ডাব খাবি রে!”

ছোটবেলায় ডাবের জল জিনিসটা মোটেই সুবিধের বোধ হত না। কচি ডাব – খা, খা। দূর্‌ বিচ্ছিরি, কেমন নোনতা নোনতা। কেন বাপু নারকেলের জল তো কেমন মিষ্টি! আরে শাঁসওয়ালা ডাব মিষ্টি হয়। শাঁস! সে তো আরোও বাজে – ল্যাতল্যাত করছে। মানুষে খায়! কিসস্যু খেতে শেখে নি রে মেয়েটা! শাঁসটাই তো ভাল রে। ভালো না কচু!

উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর নতুন জামাইবাবু বললেন চল আমাদের সঙ্গে দুদিন দীঘা ঘুরে আসবে। বেশ কথা। জামাইবাবু বেজায় স্বাস্থ্যসচেতন। নো ভাজাভুজি, নো কোল্ডড্রিংস। সমুদ্রের ধারে এসেছ সারাদিন ঘোরো আর মনের সুখে (না কি দুখে!) ডাব খাও। এতদিন শুনতুম এই বিকেল হয়ে গেছে, সন্ধ্যে হয়ে গেছে আর ডাব খাওয়া যাবে না, ঠাণ্ডা লাগবে। দীঘায় গিয়ে জামাইবাবুর তো ঘণ্টায় ঘণ্টায় ডাব – সকালে ডাব, সন্ধ্যায় ডাব, খাবার আগে ডাব, খাবার পরে ডাব। জল ফুরোলেই শাঁস আর শাঁস ফুরোলেই জল! সোনা মুখ করে খেয়ে যাচ্ছি – আরে ভাই ‘পেস্টিক’ কা সাওয়াল! কিছুক্ষণ পরে মনে হল কই শাঁসটা তো সেইরকম বিচ্ছিরি ল্যাতল্যাত করছে না! বেশ তো খেতে! নির্ঘাৎ কলকাতার ডাবওলারাই ইচ্ছে করে বাজে জিনিস দেয়! আর ডাবটা তো নারকোলের চেয়েও ভাল! অনেক জল – যেমন ঠাণ্ডা, তেমন মিষ্টি – ওই গরমে প্রাণটা সত্যিই জুড়িয়ে যায়! নাঃ, এই দীঘার ডাবগুলোই ভাল।

কিছুকাল পর ‘খাস কলকাত্তার মাইয়া’ ‘বিয়া কইর‍্যা’ চালান হলুম বড়িষা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি গাড়ি চলছে তো চলছে। পথ যেন ফুরোয় না! আমার বলে গড়িয়াহাটই সিলেবাসের বাইরে! বাজার করতে গেলে বড়জোর নিউ মার্কেট, আর ছোটোবেলায় বেড়াতে যেতে আলিপুর চিড়িয়াখানা – ব্যস্‌, কলকাতার ভূগোল ওখানেই ইতি। শ্বশুরবাড়ি যৌথ পরিবার, সবাই মিলে এক বাড়িতে থাকা। বাড়ির পেছনে বাগান – সেখানে অন্ততঃ ১২ / ১৪ টা নারকোল গাছ। সন্ধ্যেবেলা টিভি দেখতে বসেছি কিংবা রাত্তিরে শুয়ে আছি হঠাৎ আওয়াজ – দুম্‌। প্রথম প্রথম চমকে উঠে শুনি ও কিছু না গাছ থেকে নারকোল পড়ল। আর ঝপাং করে আওয়াজ মানে তাদের সলিল সমাধি! পেছনের খোলা নালায় পড়ে ভেসে ভেসে হুস্‌। বাগানে মাঝরাত্তিরে নারকোল পড়লে ভোর হতে হতে তারা সাফ্‌। দিনদুপুরে পড়লে কোন কোন সময় মা কি বাপী কুড়িয়ে এনে ডিভানের তলায় রেখে দিতেন।

লক্ষ্মীপুজোয় সেই নারকোলের নাড়ু করতেন মা। অন্যসময় সেখান থেকেই দিতেন নাতনিদের – নিয়ে যা মুড়ির সঙ্গে খাবি। নয়তো বলতেন মাকে বলবি রান্নায় দিতে। বাগান মেজোজেঠুর। কাজেই দ্বারভাঙ্গা থেকে ছোটুদা এলে ডাব-নারকোল, আম এসব পাড়াতেন। যদিও যত্নের অভাবে আমগাছে তখন পোকা লেগেছে। ঝড়ে পড়ে যাওয়া কাঁচা আমের চাটনি-আচার খেলেও নিজেদের বাড়ির বাগানের ভালো গাছের পাকা আম আমার খাওয়া হয় নি। পাকা আম সবই পোকা ভর্তি। কিন্তু ছুটির দিন বেলার দিকে ডাব-নারকোল পাড়াতে পাড়াতে বাগান থেকে ছোটভাইকে হাঁক দিতেন, “ডাব খাবি রে?”

হালকা শাঁসওয়ালা মিষ্টি জল প্রাণটা জুড়িয়ে যেত। জল খাওয়া হয়ে গেলেই বাপী কাটারি হাতে রেডি। ততদিনে সবার ধারণা হয়েই গেছে ‘বউমা ডাবের হালকা শাঁস খেতে ভালবাসে’। বাড়িতে নারকোল গাছ থাকায় বাড়ির ছেলেরা সবাই ডাব-নারকোল কাটায় এক্কেবারে expert. আর বাইরে থেকে দেখে কেমন বুঝতে পারেন কোনটা কচি, কোনটায় হালকা শাঁস, কোনটা জল বেশি!

ঠিক যেমন বাবা এমনিতে রান্নাঘর না মাড়ালেও ছুরি দিয়ে নিমেষের মধ্যে নারকোল টুকরো করে দিতে পারে! তখন বাবার ছোটবেলার গল্পে শোনা হাওড়ার বাড়ির নারকোলের ছাদ আর ডাবের জলে ফোটানো ছুঁচোবাজির মসলা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

পুণায় কলেজ যাবার পথে বিব্বেওয়াড়ির সিগনালে ঠেলা করে ডাব বিক্রি হত। আর তার দাম দেখে মনটা হু হু করে উঠতো বেহালার বাড়ির জন্যে। যদিও সেই নারকোল গাছের শেকড়ের ঠেলা সামলাতে আমাদেরই বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। ঘরের মেঝে সারাতে গিয়ে দেখা গেল যত খোঁড়া হচ্ছে শুধুই নারকোলের শেকড়। মাটির ওপর একপেয়ে সরু লম্বা গাছ দেখে কে ভাবতে পারে মাটির নিচে লোকচক্ষুর আড়ালে ধীরে ধীরে সে কি বিশাল সাম্রাজ্য বিস্তার করে বসে আছে! তবে ভেবে দেখলে মনে হয় ঠিকই তো – সমুদ্রের পাড়ে নরম বালিতে দাঁড়ানো সারি সারি নারকোল গাছ কত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের উপকূলরেখা রক্ষা করে আসছে!

যা হোক, পুণায় পরীক্ষার পর কলেজে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি হয় কিন্তু আমাদের হয় না! ধাঁ ধাঁ গরমে রোজ নিয়ম করে কলেজে গিয়ে বসে থাকতে হয়। আজ ISO কাল NBA পরশু NAAC। আর বাইরের রোদের দিকে তাকালে আর তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা কারুর মনে হয় না। নিয়মিত আটঘণ্টা কখন দেখি দশঘণ্টা হয়ে গেছে! সেবার ওইরকমই ছুটি তবু ছূটি নেই এর মধ্যে খবর পাওয়া গেল ক্যান্টিনে ‘নারল পানী’ পাওয়া যাচ্ছে। উফ্‌, আমাদের পায় কে! রোজই দুপুরবেলা ‘দাজি’কে পাঠানো হয় প্রায় আধ ডজন ডাব আসে। আহা, কি মিষ্টি ঠাণ্ডা জল! প্রাণ তো জুড়োলো। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মাথার পোকাও তো নড়ল জল যখন এতও মিষ্টি নিশ্চয় ‘হালকা মালাই’ আছে। সেটা ফেলে দেওয়া মোটেই যুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু সেই শাঁস বার করতে গিয়ে নাভিশ্বাস ওঠার দাখিল! মালাই যতটা ‘হালকা’ বলে মনে করা হয়েছিল দেখা গেল ঠিক তার উলটো। বরং তাকে ‘মালাই’ না বলে ‘নারকোল’ বললেই মানায় বেশি।

ডাবের মুখ চামচ দিয়ে তো কোনোভাবেই বড় করা যাচ্ছে না! সবার জিনিসপত্র হাতড়ে হাতড়ে বেরোলো পেনসিল কাটার ছোট্ট ছুরি, Examএর দড়ি কাটার ভোঁতা ছুরি, তস্য ভোঁতা একটা কাঁচি। এই অস্ত্র নিয়ে কি যুদ্ধ জেতা যায়? তাই বলে ‘হাম তো ছোড়নেওয়ালে নেহি হ্যায়!’

সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মত ‘আক্রমণ!’ বলে তড়িঘড়ি সবার টেবিল থেকে বইখাতা কাগজ পেনসিল উধাও। যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুত। সেখানে শুধুই জলশূন্য ডাব, ছুরি, কাঁচি আর চামচ! সবাই পাল্লা দিয়ে মালাই বার করার চেষ্টায় রত। এতটুকু মালাই বেরোলেই ‘ইউরেকা’! সবাই এতই মগ্ন যে কোন সময় পুরো Civil Engineering team inspect করতে এসেছে কারুর খেয়ালই নেই! ‘আরে ইধার তো ম্যাডাম লোগো কি নারল পার্টি চল রাহা হ্যায়’ – হঠাৎ সে কথায় চমক ভাঙ্গল সবার। হায় হায়, কি বেইজ্জত! ভাগ্যিস ওই টিমের সঙ্গে ডিরেক্টর স্যার কি HoD এসে পড়েন নি! স্টাফরুমে বসে গরমে ‘নারল পানী’ খাওয়ার সেই দিনই ইতি তো বটেই এমন কি শুনলুম রাতারাতি ক্যান্টিন থেকেও ‘নারল পানী’ উধাও!

এবাড়ির ছোট ছেলে্র তার মায়ের ছোটবেলার মতই ডাবের নরম শাঁস বিলকুল ‘না পসন্দ্‌’। সেও যখন ডাবের শাঁস দেখে বলে নারকোল দাও না আমার মনে হয় একেই কি বলে ‘runs in the blood!’ কিন্তু যখন সে ডাব কাটার জন্যে চামচ, ছুরি আর bottle opener নিয়ে ‘সরো, সরো’ করে তার বাবার সঙ্গে ঠেলাঠেলি করতে থাকে আমার মানস চক্ষে ভেসে ওঠে কাটারি হাতে আমাদের বাপী, বাপীর ছেলে আর বাপীর ছোট নাতির মুখ – সেই ট্র্যাডিশান সমানে চলেছে!!

P.C. Google Images

Posted in Uncategorized

পুজোর কড়চা

শ্রীসঞ্জয় উবাচ

আমার পুজো শুরু হত বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বাপীর সঙ্গে মেটাল বক্সে মাংস-ভাত খেয়ে ফেরার পথে রাদু থেকে নতুন জুতো কিনে। তারপর প্রতি রাতে খাটের তলা থেকে সেই জুতো বের করে মচ্‌মচ্‌ করে মার্চ পাস্ট – পুজোর সময় পায়ে ফোস্‌কা না পড়ে!

পঞ্চমীতে মামার বাড়ি যাবার প্রধান আকর্ষণ মাইমাদের কাছ থেকে পুজোর রসদ সংগ্রহ করে ষষ্ঠীতে ফেরা। যাতে পুজোর কটা দিন ফুটানিটা জমে ভাল। আধা রসদ ক্যাপ-বন্দুকেই শেষ। বাকিটা কোল্ড ড্রিংস আর বড়িষা কাফের পর্দা ঘেরা কেবিনে বসে বন্ধুদের সঙ্গে তেল চপচপে রবারের মত মোগলাই নিয়ে যুদ্ধ। আর মাকে লুকিয়ে হলে গিয়ে সিনেমা দেখা।

এরপর আসি পুজোর নাটকের মহড়ায়। ভরদুপুরে শেয়ালের মুখোশ পরে হযবরল-র শেয়াল পণ্ডিত সেজে ঘেমে নেয়ে একাক্কার। পরেরবার আবার হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালায় নেংটি ইঁদুর। মানুষ সেজে অভিনয় অধরাই রয়ে গেল।

পুজো প্যাণ্ডেলে আবার বিরাট দায়িত্ব – সকাল-বিকেল রেকর্ড প্লেয়ারে রেকর্ড পালটানো। পালা করে মান্না-কিশোর-হেমন্ত। আর দুপুরে বড়রা বাড়ি গেলেই তেড়ে হিন্দি গান চালানো আর ধরা পড়লে চরম বকুনি। সন্ধ্যেবেলা বেপাড়ায় ঠাকুর দেখা আর লুকিয়ে সিগারেটে সুখটান। কদিনের মত পড়াশোনা শিকেয় তোলা।

ঢাকীরা যখন দুপুরে প্যাণ্ডেলের পেছনে ঝিমোতো সেই ফাঁকে তাদের ঢাকে বেতালা চাঁটিতে তাদের কাঁচা ঘুমের দফা রফা। সেই সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ঢাকীদের ওপর একটা অন্যরকম মায়া পড়ে যেত। দশমীর পরের দিন তারা যখন বাড়ি বাড়ি যেত টাকাপয়সা আর জামাকাপড় পাবার আশায় আমিও উৎসুক হয়ে তাদের অপেক্ষায় থাকতাম। একবার পুরোনো জামা হাতের কাছে না পেয়ে বাপীর সে বছরের পুজোর নতুন জামা তাদের দিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর কপালে বকুনিও জুটেছিল বলাই বাহুল্য। পরের বছর যখন শুনলুম বনে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে সেই ঢাকী বাঘের পেটে গেছে আমার কি যে কষ্ট হয়েছিল বলার নয়। সে যেন স্বজন হারানোর দুঃখ। আজও সেই মুখটা চোখে ভাসে।

দশমীর দিন মোহিত হয়ে সেলুনের শান্তিদার ধুনুচি নাচ দেখে তার অন্ধভক্ত হয়ে যাওয়া। তার ওপর শান্তিদা ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টার কাজেই আলাদা টান। তারপর সিদ্ধি খেয়ে পুকুর ঘাটে সটান শুয়ে থাকা আর উঠে বসতে গেলেই বেদম হাসি। তার ওপর কোন উপকারী বন্ধু গজা খাওয়ানোয় হাসির ছর্‌রা বেড়ে দশগুণ।

পাড়ার এক দাদার খুব রাগ ছিল এক কাকুর ওপর, কারণে অকারণে খ্যাচখ্যাচ করত বলে। সেবার মোক্ষম সুযোগ এসে গেল। ঠাকুর বিসর্জনের সময় অন্ধকারে মওকা বুঝে কার্তিক-গণেশের আগেই সেই কাকুকে পেছন থেকে এক ঠেলা। হেমন্তের কনকনে ঠাণ্ডায় এঁদো পুকুরের জলে পড়ে সে কাকুর যে কি নাজেহাল দশা!

আর্টিস্ট ভাগ্নে বলে মামাবাড়িতে ভারি খাতির। মেজমাইমার রঙ চটে যাওয়া চিনেমাটির মাদুর্গা রঙ করে রাখা ছিল বিজয়ার পর গিয়ে ফেরত দেব বলে। সেবার বিসর্জনের ঢাকের বাদ্যি মাথার পোকা দিল নাড়িয়ে। ঘোরের মধ্যে ঘরে গিয়ে সেই সপরিবারে মা দুর্গার মূর্তি নিয়ে এসে ‘বল দুগ্‌গা মাঈ কি জয়!’ বলে এক্কেবারে ঝপাং করে জলে।

P.C. Google Images

Posted in Reflections

শ্রীরামকৃষ্ণ-স্তোত্র দশকম্‌

শ্রীরামকৃষ্ণ-স্তোত্র দশকম্‌

-স্বামী বিরজানন্দ

ব্রহ্ম-রূপমাদি-মধ্য-শেষ-সর্ব-ভাসকম্,
ভাব-ষটক-হীন-রূপ-নিত্য-সত্যমদ্বয়ম্।
বাঙমনোঽতি-গোচরঞ্চ নেহি-নেতি-ভাবিতম্,
ত্বং নমামি দেব-দেব-রামকৃষ্ণমীশ্বরম্।।১

আদিতেয়ভীহরং সুরারি-দৈত্য-নাসকম্
সাধু-শিষ্ট-কামদং মহী-সুভার-হারকম্।
স্বাত্মরূপ-তত্ত্বকং যুগে যুগে চ দর্শিতম্,
ত্বং নমামি… ।।২

সর্বভূত-সর্গ-কর্ম-সূত্র-বন্ধ-কারণম্
জ্ঞান-কর্ম-পাপ-পুণ্য-তারতম্যসাধনম্।
বুদ্ধি-বাস-সাক্ষী-রূপ-সর্ব-কর্ম-ভাসনম্,
ত্বং নমামি… ।।৩

সর্ব-জীব-পাপ-নাশ করাণং ভবেশ্বরম্,
স্বীকৃতঞ্চ গর্ভবাস দেহধানমীদৃশম্।
যাপিতং স্ব-লীলয়া চ যেন দিব্যজীবনম্,
ত্বং নমামি… ।।৪

তুল্য-লোষ্ট্র-কাঞ্চনঞ্চ হেয়-নেয়-ধীগতম্,
স্ত্রীষু নিত্য-মাতৃভাব-শক্তিরূপ ভাবুকম্।
জ্ঞান-ভক্তি-ভুক্তি-মুক্তি-শুদ্ধ-বুদ্ধি-দায়কম্,
ত্বং নমামি… ।।৫

সর্ব-ধর্ম-গম্য-মূল-সত্য-তত্ত্ব-দেশকম্,
সিদ্ধ-সর্ব-সম্প্রদায়-সম্প্রদায়-বর্জিতম্।
সর্ব-শাস্ত্র-মর্ম-দর্শি-সর্ববিন্নিরক্ষরম্,
ত্বং নমামি… ।।৬

চারুদর্শ-কালিকা-সুগীত-চারু-গায়কম,
কীর্ত্তনেষু মত্তবচ্চ নিত্য-ভাবহিহ্বলম্।
সূপদেশ-দায়কং হি শোক-তাপ-বারকম্,
ত্বং নমামি… ।।৭

পাদপদ্ম-তত্ত্ব-বোধ-শান্তি-সৌখ্য-দায়কম্
সক্ত-চিত্ত ভক্ত-সূনু নিত্য-বিত্ত-বর্ধকম্।
দম্ভি-দর্প-দারণন্তু নির্ভয়ং জগদগুরুম্,
ত্বং নমামি… ।।৮

পঞ্চবর্ষ-বাল-ভাব-যুক্ত-হংস-রূপিণম্,
সর্ব লোকরঞ্জনং ভবাব্ধি-সঙ্গ ভঞ্জনম্।

শান্তি-সৌখ্যসদ্ম-জীব-জন্মভীতি-নাশনম্,
ত্বং নমামি… ।।৯
ধর্ম-হান-হারকং ত্বধর্ম-কর্ম-বারকম্,
লোক-ধর্ম-চারণঞ্চ সর্ব-ধর্ম-কোবিদম্।

ত্যাগি-গেহি-সেব্য-নিত্য-পানাঙ্ঘি-পঙ্কজম্,
ত্বং নমামি… ।।১০
স্তোত্রশূন্য-সোমকং সদীশ-ভাব-ব্যঞ্জকম্,
নিত্য-পাঠকস্য বৈ বিপত্তি-পুঞ্জ-নাশকম্।

স্যাৎ তদাপি জাপ-যাগ-যোগ-ভোগ-সৌলভম্,
দুর্লভন্তু রামকৃষ্ণ-রাগ-ভক্তি-ভাবনম্।।১১

ইতি শ্রীবিরজানন্দ-রচিতং ভক্তি-সাধকম।
স্তব-সারং সমাপ্তং বৈ শ্রীরামকৃষ্ণ-তূণকম্।।১২

১। পরব্রহ্মরূপঃ

শ্রীরামকৃষ্ণ সেই নির্গুণ নিরাকার পরব্রহ্ম যাঁর আলোয় সৃষ্টির আদি-মধ্য-অন্ত আমাদের কাছে প্রতিভাত হচ্ছে। তিনি জন্মাদি ষড়বিকাররহিত কারণ তিনি স্বরূপতঃ ব্রহ্ম। তিনি নিত্য-সত্য স্বরূপ, তিনি অদ্বয় – তাঁর কোনোও দ্বিতীয় নেই। তিনি বাক্য ও মনের অগোচর – পঞ্চইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নাম-রূপাদি কোনো বস্তুদ্বারাই তাঁকে ব্যাখ্যা করা যায় না।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

২। সগুণ-সাকার অবতাররূপঃ

পাপের ভারে পৃথিবী যখন ভারাক্রান্ত তখন যুগে যুগে তিনি অবতাররূপ পরিগ্রহ করে দেবতাদের শত্রু দৈত্যদের নাশ করে আদিত্যাদি দেবতার ভয় দূর করেন এবং সাধু মহাত্মাদের কাম্যবস্তু দান করেন। তিনি নিজের আত্মরূপে প্রতিষ্ঠিত হলেও অবতার রূপে জন্ম নিয়ে তিনি সাধারণের মতই ব্যবহার করেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৩। কর্মফলদাতা সাক্ষীরূপঃ

তিনি সৃষ্টি ও জীবের কর্মফলের নিয়ন্ত্রা। পঞ্চভূতের সংমিশ্রণে সৃষ্টির রহস্য, পরা-অপরাবিদ্যা সব তাঁর অধিগত এবং জীবের জ্ঞান ও কর্ম অনুসারে তিনি তাদের ফলদান করেন। তিনি বিবেক-বুদ্ধিরূপে জীবের অন্তরে বাস করেন এবং সাক্ষীরূপে তাদের সকল কর্ম অবলোকন করেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৪। অবতারত্ব ও নরলীলাঃ

তিনি জগতের ঈশ্বররূপে শরণাগত জীবের সর্ব পাপ নাশ করে তাদের কর্মফল থেকে মুক্তি দিতে পারেন। তিনি কর্মবন্ধনরহিত হয়েও স্বেচ্ছায় মানবজন্ম স্বীকার করে ধরায় অবতীর্ণ হন এবং জীবকল্যাণে এক অনবদ্য দিব্যজীবনের চিত্র আমাদের সামনে রেখে গেছেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৫। ব্রহ্মজ্ঞানী লক্ষণ – স্থিতপ্রজ্ঞরূপঃ

তিনি দ্বৈতবুদ্ধিরহিত। তাঁর কাছে লোহা ও সোনা সমান এবং কোনও কিছুই ত্যাজ্য বা গ্রাহ্য নয়। তিনি সর্বাবস্থায় সকল স্ত্রীলোককে মাতৃরূপে, জগজ্জননীর প্রকাশরূপে দর্শন করেন। তিনি পরা-অপরা বিদ্যা, বিবেক বুদ্ধি, জ্ঞান-ভক্তি দান করতে পারেন। আবার তিনি জীবকে তাদের কামনা অনুযায়ী একাধারে জাগতিক সম্পদ ও জন্ম-মৃত্যুচক্র থেকে মুক্তিও দান করতে পারেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৬। শাস্ত্ররূপী শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তিনি সর্বধর্মের মূলে যে প্রকৃত সত্য – সেই তত্ত্বের জ্ঞাতা। কারণ তিনি সব পথ দিয়েই সেই সত্যকে নিজে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনি কোনও সম্প্রদায়কেই অশ্রদ্ধা করেন না কিন্তু নিজে সমস্ত সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধে। তিনি আপাত দৃষ্টিতে নিরক্ষর হলেও সর্ব শাস্ত্রের প্রকৃত মর্মদর্শী ও সর্বশাস্ত্রের রক্ষক।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৭। সিদ্ধসাধক শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তিনি তাঁর ভক্তিপূর্ণ সঙ্গীতে মা কালীকে প্রসন্ন করে মায়ের দর্শন লাভ করেছিলেন। তিনি অহোরাত্র ঈশ্বরের ভাবে বিহ্বল হয়ে থাকতেন এবং ভাবের ঘোরে কীর্তনানন্দে মত্ত হয়ে যেতেন। তিনি তাঁর শিষ্যগণকে সম্যক উপদেশ দিতেন যাতে তাঁরা সংসারের শোকতাপ থেকে মুক্ত হতে পারেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৮। অভয় ও করুণামূর্তি, ভক্তবৎসল শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তাঁর মহিমা জেনে যাঁরা তাঁর পাদপদ্মে শরণ নিয়েছেন তিনি তাঁদের সুখ ও শান্তি প্রদান করেন। আবার জাগতিক বিষয়ে আসক্ত ভক্তকে তিনি নিত্য জাগতিক সম্পদ দান করেন। তিনি জগৎগুরুরূপে নির্ভীক হস্তে জীবের দম্ভ ও দর্প হরণ করে তাদের সঠিক মার্গ দর্শন করান।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

৯। ঈশ্বররূপী শ্রীরামকৃষ্ণ – বাল্যলীলাঃ

পাঁচবছর বয়সে আকাশে কালো মেঘের গায়ে সাদা বকের সারি দেখে তাঁর প্রথম ভাব হয়েছিল। তিনি সেই বালক বয়সেই তাঁর রঙ্গপ্রিয়তা ও সরস বাক্যালাপের মাধ্যমেই তাঁর গ্রামের মানুষের সংসারাসক্তি ও মোহবন্ধন মোচন করেন। শান্তি ও সুখের মূর্তপ্রতীক তিনি লোকের মন থেকে জন্ম-মৃত্যুর ভয় দূর করেন।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

১০। ধর্মসংস্থাপক শ্রীরামকৃষ্ণঃ

তিনি ধর্মের হানি, ধর্মের গ্লানি নাশ করেন এবং অধর্ম কর্ম দূরীভূত করেন। তিনি সর্বধর্মের মূল সত্য জেনেও প্রচলিত লোকাচার সমূহ মেনে চলেন। ত্যাগী ও গৃহী, ভক্ত-অভক্ত সকল মানুষেরই সংসারের সকল কলুষ ও সংসারাগ্নি থেকে মুক্তিলাভের জন্য তাঁর পবিত্র, পাবনী চরণকমলই একমাত্র আশ্রয়।

সেই দেবের দেব শ্রীরামকৃষ্ণরূপী ঈশ্বরকে নমস্কার জানাই।

১১। ফলশ্রুতিঃ

নিত্য স্তোত্রপাঠে লোকের সকল বিপত্তি নাশ হবে ও তাদের মনে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি দুর্লভ অনুরাগ ও ভক্তিভাব জাগ্রত হবে এবং তাদের জপ-যোগের সকল ফললাভ হবে ও সুকৃতির ফল বহুগুণে বর্ধিত হবে।।

Kind acknowledgement :

Swami Shantivratanandaji, Minister-in-Charge, EIRE Vedanta Society, Ireland.

Posted in Uncategorized

ফিরে দেখা

এক শ্রাবণের সকালবেলা দুরুদুরু বক্ষে, ভীরু পায়ে মনে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে এসে দাঁড়ালুম বালিগঞ্জ সারকুলার রোডে ‘তারকনাথ পালিত শিক্ষাপ্রাঙ্গণ’ বা সাধারণের ভাষায় বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক – সে বহু বহু কালের। পৃথিবীর আলো দেখার আগে থেকে এখানে আমার যাতায়াত। আমার চেতন-অবচেতনে এর অস্তিত্ব। এর আগে সজ্ঞান শিক্ষাজীবনের এগারো বছর কেটেছে মায়ের স্কুলে, হোলি চাইল্ড – আমার হোলি চাইল্ড। নাঃ, মায়ের কলেজে আমার পড়া হয় নি, মায়ের বিষয়ও না। তবে আবার এসে পৌঁছলুম মায়ের ইউনিভার্সিটি – বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ।

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশাল আট-ন’ তলা বাড়ি। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের দূরদৃষ্টির সাক্ষর তার বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের অবস্থানেই প্রমাণ হয়। Anthropology, Zoology, Botany, Geography, Statistics, Bio-Chemistry সব পেরিয়ে সবার মাথার ওপর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ‘Department of Pure Mathematics’ – ‘বিশুদ্ধ গণিত বিভাগ’। এমনিতেই সাধারণ লোকের ধারণায় অঙ্কের লোকেরা ‘আধপাগল’, ‘ছিটগ্রস্ত’  মানে তাদের মানসিক অবস্থান বাস্তব দুনিয়া থেকে অনেক দূরে। কাজেই অঙ্ক কষতে কষতে তাদের মাথা গরম হয়ে উঠলে সেই চিন্তাতরঙ্গ সোজা ছাদ ভেদ করে ছড়িয়ে যাবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোণায় কোণায়। অন্যান্য বিষয়ের চিন্তাজাল সেই তরঙ্গস্রোতকে সহজে ছিন্ন করতে পারবে না।

প্রথমদিন কোলাপসিবিল গেট দিয়ে ঢুকে দুপাশে একের পর এক অধ্যাপক অধ্যাপিকাদের নাম লেখা দরজা পেরিয়ে এসে পৌঁছলুম করিডোরের এক্কেবারে শেষপ্রান্তে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাসরুমে। বিরাট ঘর – সামনে দেওয়াল জোড়া ব্ল্যাক – থুড়ি গ্রিন বোর্ড। তিনসারি বেঞ্চ সবই প্রায় ছেলেদের দখলে। এতদিনের প্রচলিত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে ব্যাকবেঞ্চারের তুলনায় সামনের সিটের চাহিদাই বেশী। অঙ্ক কিনা, সবেতেই তাই ব্যাতিক্রমই নিয়ম! কলেজে অনার্স ক্লাসে পনেরোজনের মধ্যে আমরা বারোজনই ছিলাম মেয়ে। আমাদের দৌরাত্ম্যে হারাধনের ওই বাকি তিনটি ছেলের টিকির দেখা মিলত না। এখানে এসে দেখি প্রায় পঞ্চাশ-পঞ্চান্নজন ছেলের মাঝে টিমটিম করছে আট-দশজন মেয়ে।

ভালভাবে বোর্ড দেখতে গেলে মাঝের রো’য় বসাই ভাল। তা প্রথম বেঞ্চেই তো দেওয়াল হয়ে বসে আছে দু-তিনটে ছেলে! তারপর তিনটে বেঞ্চে জনা তিনেক করে মেয়ে – ব্যাস্‌, মহিলা মহল খতম! থার্ড বেঞ্চে একজন বেশ হাসিখুশি লম্বা মত মেয়ে তার মাথায় ইয়া মোটা বিনুনি, পাশের শান্ত-শিষ্ট ফর্সা ফর্সা বন্ধুর সঙ্গে গল্পে মত্ত। তার পাশেই গিয়ে বসলুম। আলাপ হল – বিনীতা সেনগুপ্ত, পাশে আশালতা। দুজনেই কৃষ্ণনগর গভরমেণ্ট কলেজ থেকে এসেছে। আর ফার্স্ট বেঞ্চের ওই কোঁকড়া চুলের ছেলেটি জয়ন্ত – ওদের কলেজের ফার্স্ট বয়, অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া! ভাবলুম এদের কেমন মজা – আগে থেকেই বেশ বন্ধু নিয়ে এসেছে!

এরপর আমাদের পাশে এসে বসল মৌসুমী – অত্যন্ত প্রাণচঞ্চল কিঞ্চিৎ ছিটগ্রস্ত। সামনের সারির ভীষণ সিরিয়াসে দলে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আসা সুচেতা, দিল্লির সোনালী আর বর্ণালী। পেছনে শান্তশিষ্ট মিতা, স্বপ্না আর রুমা। কিছুদিন পর এসে যোগ দিয়েছিল সীমা জৈন আর সাথী। সুচেতা খুব ভাল গান করত, বিশেষ করে নজরুলগীতি।

জয়ন্তর পাশের ছেলেটি সুদীপ্ত – সাউথ পয়েন্ট থেকে পাশ করে তারপর আশুতোষ কলেজে পড়েছে। চটপটে স্মার্ট বলিয়ে-কইয়ে গোছের লিডার টাইপ! বেশিরভাগ ছেলেমেয়েই কলকাতার বাইরে থেকে হয় ট্রেনে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে নয়তো হস্টেলে থাকে। বিনীতা আর আশাও কিছুদিন পর লেডিস হস্টেলে চলে এল।

এরপর একে একে স্যার ও ম্যাডামদের সঙ্গে পরিচয়। তখন হেড ছিলেন বাদলবাবু, BC – পড়ান Propositonal Logic. বিষয়টা সহজ ও মজার আর স্যার পড়ানও খুব সহজ করে। Predicate Logic পড়ান MC – মানে মিহিরবাবু। উস্কোখুস্কো চুলে সুকুমার রায়ের হেড অপিসের বড়বাবু মার্কা গোঁফে স্যারকে দেখলেই আমার আইনস্টাইনের কথা মনে হত – typical absent-minded professor! সামনে দিয়ে আমরা চলে গেলেও ওনার চোখে পড়তুম কিনা সন্দেহ হত। তাই পরে যেদিন আবিষ্কার করেছিলুম যে উনি আসলে আমাকে ‘চেনেন’ সেদিন কি প্রচণ্ড যে অবাক হয়েছিলুম!

কুচকুচে কালো চুল, কালো মোটা গোঁফ আর মোটা কালো ফ্রেমের চশমা চোখে খদ্দরের পাঞ্জাবী আর ধুতি পরা রাশভারি শোভাকরবাবু যেন পরিবারের কর্তা – সামান্য খুঁটিনাটি বিষয়ও যাঁর কড়া নজর এড়ায় না! শোভাকরবাবুর কথা সীতাংশুকাকুর মুখে আগেই শুনেছিলুম – কাকুদের বন্ধু। তখন আমরা সবাইকে BC, SG, JD, DG – এভাবেই চিনি। শোভাকরবাবুর এতে ভারি আপত্তি। বলেন ‘শুনলেই নিজেকে কেমন কয়েদি, কয়েদি মনে হয়!’ আমারও সেই শুনে মনে পড়ে গেল ‘মা খু চিহল ও পঞ্জম হস্তম’। সীতাংশুকাকু যেমন আমরা স্যার বললেই বলতেন ‘কাকু বলতে পারিস না! কি ষাঁড়, ষাঁড় করছিস!’ শোভাকরবাবুর মধ্যে একটা ‘ক্যারিশ্মা’ ছিল। ক্লাসে ঢুকেই আমাদের সম্বোধন করলেন ‘My friends’! পড়াতে পড়াতেও বলতেন ‘now my friends …’। শুনতে বেশ মজা লাগত। চক ধরে যখন বোর্ডে লিখতেন মনে হত যেন তুলি ধরে ছবি আঁকছেন। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতেন ‘মা জননী’ বলে, যেটা অর্ণবদাও অনুকরণ করত। তবে স্যার ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্রদের বেশী পছন্দ করতেন আর ওনার ওই পক্ষপাত বেশ বোঝা যেত। যেমন আমাদের তারক ছিল স্যারের খুব প্রিয়।

আর সেবার যখন সবাই মিলে পেছনের জানলা দিয়ে Miss Universe Sushmita Sen কে দেখার জন্যে হামলে পড়েছিল স্যার দেখতে পেয়ে যা বকুনি দিয়েছিলেন! সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা যে মানুষের সাফল্যের মাপকাঠি হতে পারে সে কথা স্যার কোনওমতেই মেনে নিতে পারেন নি। তবে তাতে করে আমাদের ক্লাসরুমের জানলা দিয়ে সারা বছর উঁকি ঝুঁকি মেরে আরেকজন সৌন্দর্যের সম্রাজ্ঞী সুচিত্রা সেনকে দেখার চেষ্টা বন্ধ করতে পারেন নি।

শোভাকরবাবুর সঙ্গে সবসময় একসঙ্গে গল্প করতে বাড়ি যেতে যাঁকে দেখা যেত আকৃতি ও প্রকৃতিতে তিনি ছিলেন শোভাকরবাবুর বিপরীত। ফর্সা, লম্বা, মাথায় ধবদবে সাদা চুল, শ্মশ্রুগুল্‌ফহীন মুখ চোখে সরু ফ্রেমের চশমা সত্ত্বগুণের প্রতিমূর্তি মৃদুলবাবু – MKS এক্কেবারে স্নেহময় পিতা – সব সন্তানের প্রতি যাঁর অগাধ প্রশ্রয়।

প্রাপ্তে তু ষোড়শে বর্ষে পুত্রং মিত্র বদাচরেৎ – এই শাস্ত্রবাক্য মেনে সকাল থেকেই MNM এর ঘরে টাটকা চা আর সিগারেটের গন্ধ ম’ ম’ করত। আসরের মধ্যমণি শোভাকরবাবু, মানববাবু ও সভ্যকূলে দুজনের যত রিসার্চ স্কলার। MNMএর নামটা যত বড় রোগাসোগা ছোটখাট মানুষটি ঠিক তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঝড়ের গতিতে হাঁটেন, চলেন, কথা বলেন আর লেখেন!

ক্লাসে ঢুকে কোনও কথা না বলে বোর্ডের বাঁদিকের ওপরের কোণা থেকে ছোট ছোট অক্ষরে লিখতে শুরু করতেন যেন সবুজ ঘাসের ওপর সারি দিয়ে সাদা পিঁপড়ে চলে যাচ্ছে! আমরা যতক্ষণে বাঁদিকের অংশের নোট টুকে শেষ করতে ব্যস্ত স্যারের তিন কি চার সারি নোট লিখে প্রথম অংশ মুছে বোঝানো শুরু হয়ে যেত। প্রথম দিকে থৈ কূল পেতুম না, লেখা শেষ করব না পড়া বোঝানোয় মন দেব! একটু হাত থেমেছে কি বোর্ডের নোট মুছে গেছে! বিনীতা খুব speedএ নোট লিখত আর ওর হাতের লেখাও ছিল মুক্তোর মত। বেশিরভাগ সময় বিনীতার খাতাই ছিল আমার ভরসা। শুধু MNMএর ক্লাসেই নয় TDর ক্লাসেও।

আমি ফাঁকিবাজ Linear Algebraর ওই একই রকম একশোটা প্রুফ লিখতে একদম ভালবাসতুম না। কিন্তু বিনীতা কৃষ্ণনগর-কলকাতা ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করেও সব কাজ এক্কেবারে complete. TDও তাই প্রথম থেকেই বিনীতাকে খুব পছন্দ করতেন। ছাত্রছাত্রীদের সমস্ত গতিবিধি TDর সন্ধানী দৃষ্টির গোচরে। ছাড় নেই কারুরই।

ডিপার্টমেন্টের করিডোরে রামানুজান, Gauss, Laplace, Euler, Riemannএর ছবির সঙ্গে একটা ছবি ছিল তাঁর টাকমাথা মুখটা দেখলেই মনে হত PKS! PKSও TDর মত মুখরোচক খবরের সন্ধানে থাকলেও তুলনায় ওনার জনপ্রিয়তা ছিল একটু কম। তবে ক্লাসে এসে বাঁ হাতটা নিচু করে নোটের কাগজ ধরে আড় চোখে চেয়ে যখন বোর্ডে লিখতেন দেখতে খুব মজা লাগত – ঠিক যেন টুকলি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবেন!

ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেই বাঁহাতে যেমন MNMএর ঘর, ডান হাতে ছিল DKB-SKAর ঘর। SKA সবসময়ই নার্ভাস, ভীরু, আর DKB বড় দাদার মত ওনাকে সবসময় আগলে রেখেছেন। কিছুদিনের জন্যে এই ঘরে আমার যাতায়াত বেশ বেড়ে যায় তবে সে কথায় পরে আসছি।

স্যারেদের কথা বলতে যাঁর নাম হয়তো আমার সবচেয়ে আগে বলা উচিত ছিল তাঁর কথা বলি সবার শেষে। DG – ছাত্রছাত্রীদের কাছে কিছুটা ব্রাত্য কিছুটা হাসির মানুষ। দুপুর আড়াইটের আগে কোনদিন আসেননা আর থাকেন সন্ধ্যে সাতটা-সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। পরণে এক্কেবারে কোঁচকানো-দোমড়ানো হাফ শার্ট, ঝড়ের মতো আসেন-যান। প্রথমদিন ক্লাসে ঢুকেই বললেন “আমি ‘take home’ দিই, না করলেই পরীক্ষায় নাকের জলে চোখের জলে।“ তারপর বললেন “আমি শনি-রবিবার ম্যারাথন ক্লাস নিই সকাল থেকে টানা ছ’ ঘন্টা।“ কার্যক্ষেত্রে অবশ্য সারা দু বছরে একটাই মাত্র শনিবার দু’তিন ঘন্টার জন্যে ‘ম্যারাথন ক্লাস’ হয়েছে।

প্রথমদিন সবাইকে নিজের নাম আর কলেজের নাম বলতে হয়। স্যার বললেন তোমাদের নাম আমি মনে রাখতে পারব না। কলেজের নাম ধরে ডাকব। যে কলেজ থেকে একের বেশী স্টুডেন্ট এসেছে যেমন কৃষ্ণনগর বললে যে কোন একজনকে উত্তর দিতে হবে। তা আমার তো নাম নিয়ে চিরকালের সমস্যা। বিধান নগর কলেজ থেকে গেছি। এদিকে বিধান বলে একটি ছেলে আছে ক্লাসে। তা স্যার ‘বিধান’ বললে সে উত্তর দেবে না আমি বোঝা মুস্কিল! তবে স্যার আমায় ‘সল্টলেক’ বলে ডাকতেন প্রথম প্রথম। তারপর বাবা-মায়ের দেওয়া নামে চিনতে খুব বেশী সময় নেন নি। কিন্তু যেদিন সিঁড়ির ওপর থেকে ‘নাটক’ বলে হূঙ্কার দিয়েছিলেন আমি বেজায় চমকেছিলুম বলাই বাহুল্য!

স্যার হলেন অত্যন্ত সংশয়ী প্রকৃতির কারুর ওপর ভরসা করে ভরসা করতে পারেন না। তার ওপর আবার যোগ হয়েছে স্যারের স্যার প্রফেসর এন সি বোস মজুমদারের মন্ত্রগুপ্তির শিক্ষা। বলতেন নিজের রিসার্চের কাজ নিজের পার্টনারকেও বলবে না। বাসুদা ডিপার্টমেন্টের সব স্যারেদের নামে লাইব্রেরি থেকে বই নেয়, কেবল DG ভরসা করে ওনার নামে বই তুলতে দিতেন না। যদি ঠিক সময় ফেরৎ না দেয়। অথচ বাসুদা ছিল স্যারের প্রিয় ছাত্র। আমাদের নোট দিতেন ওনার ছাত্র জীবনের ছোট বঙ্গলিপি খাতা থেকে। সেই খাতার তখন খুবই করুণ দশা। সব পাতা আলাদা আলাদা হয়ে খুলে যাচ্ছে। একদিন অনেক বলে কয়ে পরেরদিনই খাতার পাতা জুড়ে মলাট দিয়ে নিয়ে আসব এই কড়ারে আমায় একটা খাতা দিলেন। সেই খাতার পাল্টানো ভোল দেখে তার পর থেকে এক কথায় আমায় খাতা বা বই দিতে রাজি হয়ে যেতেন। এমন কি ওনার নামে লাইব্রেরির বইও।    

ম্যাডামদের মধ্যে প্রথমেই আসে জ্যোতিদির কথা। ছোট্টখাট্ট মানুষটি সাদা তাঁতের শাড়ি প্লিট দিয়ে সুন্দর করে পরা, মাথায় কাঁটা দিয়ে টানটান করে বাঁধা খোঁপা এক্কেবারে টিপটপ। ঘড়ি ধরে ক্লাসে আসেন ঘড়ি ধরে ক্লাস শেষ করেন। ক্লাসে ঢুকে প্রথম কাজ ছিল বোর্ড মোছা। যত পরিষ্কার করে মোছা বোর্ড হোক দিদির মোছার গুণে এক্কেবারে ঝকঝকে হয়ে যেত যেন সদ্য রঙ করা হয়েছে। এসেই বোর্ডে লম্বা লম্বা করে দাগ টেনে চার ভাগ করে নিতেন। আর ধরে ধরে মুক্তোর মতো হাতের লেখায় বাঁদিক থেকে লিখতে শুরু করতেন। বোর্ডে কি করে সুন্দর করে লিখতে হয়, কত সহজে কত কম কথায় পুরো বিষয়টা কি করে প্রেজেন্ট করতে হয় বি এড পড়ার ঢের আগেই জ্যোতিদি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। আর শিখিয়েছিলেন নিজে নিজে বই পড়ে কোনও বিষয় বোঝা আর নোট করা। বলতেন আমি তোমাদের ভবিষ্যতে রিসার্চ করার জন্য তৈরী করিয়ে দিচ্ছি। দিদির চেহারা, চালচলনে ব্যক্তিত্ব, আভিজাত্য যেন ফেটে পড়ত। ওনাকে দেখলে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে যেত।

বন্দনাদি ছিলেন জ্যোতিদির দোসর। দুজনে যেন দুই বোন। তবে বন্দনাদি যেন জ্যোতিদির ছায়া। একজন নিজস্ব স্বকীয়তায় জাজ্বল্যমান সূর্য আর অন্যজনের মধ্যে ছিল চাঁদের স্নিগ্ধতা।

JS আসতেন নিজের ফিয়াট গাড়ি চালিয়ে। বাকিরা যখন হেঁটে, বাসে বা ট্রেনে করে যাতায়াত করতেন তখন ম্যাডাম ডিপার্টমেন্টে ঢুকতেন হাতে নিজের গাড়ির চাবি ঝুলিয়ে। কিন্তু নিজে গাড়ি চালিয়ে আসা সেই ব্যক্তিত্বময়ী মহিলাকে ক্লাসের মধ্যে এক্কেবারেই মেলানো যেত না। সেখানে তিনি একেবারেই সাদামাটা, কিছুটা ম্লান। নির্দিষ্ট সময়ের ঢের আগেই ‘আজ থাক’ বলে ক্লাস শেষ করে দিতেন। সকালে আসতেন যেমন সবার আগে দুপুরে বাড়িও যেতেন সবার আগে। আমরা বলতুম JS আর  DGর ডিপার্টমেন্টের টাইমিং এর  intersection empty set.

MT বা MM বলতে মঞ্জুষাদি।ছাত্রছাত্রীদের এক্কেবারে my dear. Differential Geometry যদিও আমার বিশেষ ভাল লাগত না, কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক মঞ্জুষাদির অসীম স্নেহ পেয়েছি – ডিপার্টমেন্টে এবং ডিপার্টমেন্টের বাইরে। আমি যেমন বাড়ি থেকে দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছি দিদির বাড়ি দুর্গাপুজো দেখতে, তেমনি দিদি একমাত্র যিনি আমার বিয়েতে এসেছিলেন। আর পরে আমাদের পুণার বাড়িতেও এসে ঘুরে গেছেন।

ক্লাস করতে করতে ধীরে ধীরে স্যার ম্যাডামদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, ওই বাড়িটা আপন হয়ে উঠেছে, এমন কি লিফটম্যান দাদাও চিনে গেছে – লিফটে উঠে বলতে হয় না আপনি ৭ নম্বরে লিফট থামিয়ে দেয়। সহপাঠী সহপাঠিনীরাও ‘বন্ধু’ হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বড় পাওনা বিনীতা আর ওর সূত্রেই সুব্রত বিশ্বাস দা। দুজনেই মনের খুব কাছের মানুষ হয়ে গেছে। সীমা আমার যাতায়াতের সঙ্গী, এক বাসে একসঙ্গে বাড়ি ফিরি।

ছেলেদের মধ্যে অনির্বাণ, মৃণাল, অয়ন খুব সিরিয়াস। তারক তো অনার্সে ফার্স্টক্লাস পাওয়া – বিরাট fan following. দীপঙ্কর প্রচুর বাংলা গল্পের বই সাপ্লাই করত। সমীর, সুবিমল, শ্যামাপ্রসাদ, আনিসুর, উৎপল, অভিজিৎ, হাবিব, জার্জিস, অংশুমান – সবাইকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে পাশে পেয়েছি। শ্যামাপ্রসাদ, অয়ন আর আমার একই স্পেশাল পেপার। জ্যোতিদির ক্লাসের নোট তৈরী থেকে Prof. N. C. Bose Majumder memorial essay competitionএ একসঙ্গে participate করা। অয়ন নিজের দুনিয়ায় থাকত তবে কোনও সাহায্য চাইলে কখনও না বলত না। শ্যামাপ্রসাদের মধ্যে দেখেছি কি অসম্ভব ধৈর্য আর একাগ্রতা – tenacity and detailing. সে Monotonic Function এর essay লেখাই হোক, কি মধুবালার ছবি আঁকা।

ফার্স্ট বেঞ্চের সুদীপ্ত আর জয়ন্তর সঙ্গে সেই প্রথম দিন থেকেই ছিল খুনসুটির সম্পর্ক। আমাদের দেখে বোঝা যেত না আমরা ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে উঁচু ক্লাসে পড়ি না কি স্কুলের এক্কেবারে নিচু ক্লাসে। বোর্ড দেখতে পাচ্ছি না বলে সরে বসতে বললে দুজনে আরও পাশাপাশি ঘেঁষে বসত, আর আমার আর মৌসুমীর পেনের গুঁতো খেত। M.Sc.র শেষ দিনে আমার Slam Bookএ সুদীপ্ত লিখেছিল ‘আশাকরি আমাদের বন্ধুত্বটা চিরদিন অটুট থাকবে।‘ কিন্তু কালের নিয়মে জীবনের পথে চলতে চলতে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে যায়। এতদিন পর নতুন করে বন্ধুদের ফিরে পাওয়ার মুহূর্তে খবর পেলুম সুদীপ্ত আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে – না ফেরার দেশের বাসিন্দা!

আমাকে ফাঁসাতে গিয়ে সেবার সুদীপ্ত আর জয়ন্ত যে রাম বুদ্ধু হয়েছিল সে কথা এবার বলতেই হয়। ফার্স্ট ইয়ারে এই মাস দেড়-দুয়েক ক্লাসের পর একদিন টিফিনের সময় DKB সুদীপ্তদের দেখা করতে বললেন। একটু পরেই দুই মক্কেল এসে আমায় বলল স্যার তোকে ডাকছেন। আমার তো তখন কেউ ডাকছেন শুনলেই আত্মারাম খাঁচাছাড়া হয়ে যায়। মনে হয় ওরে বাবা কি করলুম আবার! অবশ্য সিস্টার রোমানার কথায় ভয় পাওয়াটা আমার বিলাসিতা! যত বলি কেন ডাকছেন বল। দুজনেই বলে জানি না। ভয়ে ভয়ে স্যারের ঘরে যেতেই স্যার জিজ্ঞেস করলেন ‘তুমি নাকি অভিনয় করো!’ আমার তো মহা বিস্ময়! এ কথা তো স্যারের জানার কথা নয়! বলি ‘হ্যাঁ স্যার করি তো’। ‘কোথায় করেছ?’ ‘পাড়ায় পুজোর নাটকে’। ‘সামনে ডিপার্টমেন্টের রি-ইউনিয়ন। তোমাকে নাটকে অভিনয় করতে হবে।‘ বুঝলুম এ ওই ‘দাদার কীর্তি’ কেস। আমাকে অপ্রস্তুতে ফেলতে দুই মক্কেল স্যারের কাছে আমার নাম বলেছে। স্যারের ঘরে আমার পিছু পিছু দুজনে এসেছিল রগড় দেখতে। আমার কথা শুনে একদম ‘বোলতি বন্ধ্‌’। বাইরে আসতেই বলে ‘সত্যিই তুই অভিনয় করিস!’ আমিও তখন ডাঁটের মাথায় বলি ‘করি কিনা দেখবি!’

স্যার বললেন ছুটির পর এস। আমায় আর পায় কে! সুন্দরমের দীপকদা, মাঙ্গলিকের সমীর বিশ্বাস, রঙ্গনা থিয়েটারের দেবকুমার সবাই আমার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন সময়ে সময়ে। মনোজ মিত্র স্বয়ং আমাদের নাটক দেখে গেছেন। ‘আমি কি ডরাই সখী …’। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল ফার্স্ট ইয়ার থেকে একমাত্র আমি নাটকে আছি। বাকি দু-একজন একদিন করে এসেই বিভিন্ন অছিলায় চলে গেছে – পরীক্ষার পড়ার ক্ষতি হবে, হ্যান-ত্যান।

এই নাটকের সূত্র ধরেই সিনিয়ার দাদা-দিদিদের সঙ্গে আমার খুব সুন্দর একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল। এরপর থেকে ডিপার্টমেন্টে আমার প্রচুর গার্জেন। অর্ণবদা Differential Equationএ পুরো বাঁধানো নোট দিয়ে দিল। চন্দনাদি দিল Special এর 9th Paper. সুব্রতদা বাড়ি এসে পরীক্ষার আগে Differential Geometry পড়িয়ে গেল। দীপ্তেনদা-বাসুদা রিসার্চের শুরুর দিনগুলোয় শেখালো কি করে Journal review করতে হয়, কোথা থেকে research papers জোগাড় করতে হয়, স্যারের ঘরে সেমিনারে নতুন নতুন টপিক নিয়ে আলোচনা। রীতাদি ডেকে ডেকে গোখেল কলেজে কাজ দিল আর শমিকদার বাইকে চড়ে কুড়ি মিনিটে বাড়ি।

তবে সবার ওপরে ছিলেন DKB. খবর নিতেন পড়াশোনা ঠিকমত হচ্ছে তো? দেখো বাপু ওটা যেন ঠিক হয়। বলতেন বিয়ে করলে আমার তোমার বয়সী একটা মেয়ে থাকত। নাটকের সূত্রেই সবাই মিলে একদিন স্যারের বাড়ি পিকনিক করতে যাওয়া হল। প্রধান উদ্যোক্তা অদিতিদি। সেই অদিতিদি, অর্ণবদাও এখন তারাদের দেশে!

জানুয়ারী মাসের রি-ইউনিয়নের জন্য শনি-রবিবার নাটকের রিহার্সাল। ক্লাসের বাকি সবাই বাড়িতে পরীক্ষার পড়া তৈরীতে ব্যস্ত। বেশী পড়াশোনা করা যদিও আমার কোনওদিনই পোষায় না তবু বিবেক দংশন হয়। পার্থদা বলল, ‘শোন যারা পড়ার বাইরে এইসব রি-ইউনিয়ন, নাটক এসব করে দেখবি পরীক্ষায় তাদের রেজাল্ট বেশী ভাল হয়। এই আমায় আর উৎপলকে দ্যাখ। আমরা আমাদের সময় re-union, excursion সব কিছুর পাণ্ডা ছিলাম। আমরাই ফার্স্ট আর সেকেণ্ড হয়েছিলাম।‘ নাঃ, ফার্স্ট-সেকেণ্ডের আশা করতুম না, তবে পার্থদার কথায় ভারি ভরসা পেয়েছিলুম। আরও একটা কথা বলেছিল পার্থদা – এই ডিপার্টমেন্টে যে যাঁরই প্রিয় ছাত্র বা ছাত্রী হোক না কেন পরীক্ষার খাতায় কোনদিন কোনও partiality হয় না।

নাটকে পার্থদা, ঊৎপলদা, মাধবদা ছাড়াও প্রথমে অতসীদির একটা গান ছিল। কিন্তু চন্দনাদি, অদিতিদি আর আমি যখন রিহার্সালের ফাঁকে চুটিয়ে গল্প করতুম অতসীদি কিন্তু সেখানে থাকত না। কেষ্টদা পুরো রিহার্সাল করার পরও একদম ফাইনালের দিন পারিবারিক কারণে আসতে পারে নি। আর ত্রিপাঠী ধূমকেতুর মত মাঝে মধ্যে একেকবার এসে রিহার্সাল করে যেত।

নাটকের মেন পার্টে স্যার নিজে আর সুব্রতদা। দুজনের কারুর এক লাইনও পার্ট মুখস্থ নেই। প্রম্পটার বাসুদা প্রম্প তো করছে কিন্তু কার যে ডায়লগ দুজনের কেউ ধরতেই পারছে না। হল ভর্তি দর্শক তো হেসে খুন! তাতেও শুনলুম স্যার নাকি ‘আমার ভয়ে’ রাত জেগে জেগে পার্ট মুখস্থ করেছেন!

রি-ইউনিয়নের দিন নাটকের শেষে বাড়ি ফেরার তাড়া – শীতের রাত। সুব্রতদা বলল আগে একবার ডিপার্টমেন্টে চ’। গিয়ে দেখি সেকেণ্ড ইয়ারের ক্লাসরুমে থিকথিকে ভীড়। কি ব্যাপার! একটু পরে MNM তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গতিতে ঘরে ঢুকলেন – প্রবল হাততালি। শুরু হল স্যারের গান। নিচের মূল অনুষ্ঠানে স্যার কিন্তু গান করেন না। ওটা রি-ইউনিয়নের বিশেষ আকর্ষণ। একটার পর একটা গান। শেষ গানের রেশ কানে নিয়ে বাড়ি ফিরলুম – ‘আবার হবে তো দেখা, এ দেখাই শেষ দেখা নয়তো’।।

Posted in Uncategorized

প্রাণ ভোমরা

কর্তামশাইয়ের প্রাণভোমরার ডানা ফড়ফড়ানির চোটে আমাদের আত্মারাম এক্কেবারে খাঁচাছাড়া। মশাই আমার বেজায় কাজপাগল। কাজ ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতে পারেন না। সেই প্রথম থেকে দেখে আসছি অফিসে যত কাজের চাপ, কাজের মান তত ভাল। ডেডলাইনের গুঁতো বাবুর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। বেশীরভাগ ডেডলাইনও তাই স্বকৃত। আর হাতে কাজ না থাকলেই মাথা গরম। নিজেও অস্থির আর বলা বাহুল্য চারপাশের লোকজনেরও ত্রাহি ত্রাহি দশা। সবসময়ই একটা কি করি, কি করি ভাব!

শুনেছি ছোটবেলায় পড়তে পড়তে মাথা গরম হয়ে গেলেই হাতে কাটারি নিয়ে হাজির সোজা পেছনের বাগানে। যেখানে যত কলাগাছ আছে সব ভবলীলা সাঙ্গ! অমন রাশভারি দাদু, যাঁর ভয়ে সারা বাড়ি থরহরি কম্প, এই নাতির বেলায় এক্কেবারে speakty not!

বিয়ের আগে রোজ নিয়ম করে ফোন আসত। সন্ধ্যের পর ফোন বাজলেই সবাই বলতো ‘ওই, এসে গেছে!’ হঠাৎ দেখি বেশ তিনচারদিন কোনও সাড়াশব্দ নেই। কি ব্যাপার! এমন সময় হবু শাশুড়ি মার ফোন। অফিসে অডিট চলছে। কারুর সঙ্গে কথা বলার সময় নেই। ‘মেয়েটা হয়তো ভাবছে’ – উত্তর এসেছে ‘ওসব মেয়েটা-ফেয়েটা ছাড়ো!’ বুঝলুম খুব জাঁদরেল সতীনের সঙ্গে ঘর করতে চলেছি – বাবুর ‘কাজ’!

আবার যেই না সেই কাজ শেষ হল শুরু হল মাথার পোকা নড়া। কাজ নেই। কি করে সময় কাটবে! তবে তারও একটা দাওয়াই আছে। সোজা রান্নাঘর। সব্‌জিপাতি, মাছ-মাংস যা আছে খস্‌খস্‌ করে সব কাটা হয়ে গেল, রান্না করা হয়ে গেল। ‘ওরে, আজকের রান্না সব হয়ে গেছে। এতো খাবার কে খাবে এখন!’ তা সেটা তো আর রাঁধুনির সমস্যা নয়!

দেখলুম কাজ করার জন্যে নিজের কাছেই নিজের ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা। সবচেয়ে প্রিয় জিনিস বিসর্জন। ‘ফোন করবো না’, তারই একটা। এরকমই ‘CA না হয়ে মামার বাড়ি যাব না’, পড়া তৈরী না হলে ঠাকুরের মুখ দেখব না, তার জন্যে চুল-দাড়ি কামাব না, নতুন জামা পরব না।

সতীনের জ্বালা কি আমার কম! যেই কোথাও বেরোতে যাব বলবে একটা ছোট্ট কাজ আছে, এই পাঁচ মিনিট। কাজটা করেই বেরবো। তোমরা তৈরী হওনা! পাঁচ মিনিট ক্রমে ক্রমে দশ-বিশ-পঁচিশ …। কারুর সঙ্গে দেখা করার কথা থাকলে দেরী অবশ্যম্ভাবী। হোটেলে টেবিল বুক থাকলে ফোনের পর ফোন। ছেলেদের স্কুলে ফাংসন থাকলে সামনের সব ভাল জায়গা ভর্তি।

সবচেয়ে বেশী পুজোর সময়। আমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তখন যেন অডিটের গুঁতো। সরকারী সময়সীমা তো আর দুর্গাপুজো অষ্টমী-নবমী দেখে হবে না! কলেজে ছুটি নিয়ে সকাল থেকে তৈরী হয়ে বসে আছি তো বসেই আছি। পাঁচ মিনিট যে ক্রমে ক্রমে কোথায় গিয়ে ঠেকছে! সকালের সাজ আর বেড়ানোর মেজাজ দিনের শেষে দুইই যখন এক্কেবারে ঘেঁটে ঘ’ ফোনের কবল থেকে মুক্তি মিলত। এবার নাকি হাসি হাসি মুখ করে বেড়াতে যেতে হবে আর ছবিও তুলতে হবে!

শনি-রবিবার বেরোনো মানেই রাস্তায় ফোন – গাড়িতে মাল লোড হয়ে আটকে আছে, এক্ষুনি ‘ক্রেডিট লক রিলিজ’ করতে হবে। বাইরে বেড়াতে গেলেও শান্তি নেই! ব্যাঙ্গালোরের লালবাগ তো পুরোটাই ‘ক্রেডিট লক’ এর গব্‌ভে।

কাজেই কোথাও গেলে আর কেউ সঙ্গে যাক না যাক বাবুর ‘লটপট’টি লটর পটর করতে করতে সবার আগে হাজির! হ্যাঁ মশাই ঠিকই ধরেছেন, ওটিই বাবুর প্রাণভোমরা।

তা এবার বাবু অনেকদিন পর অফিসের ট্যুরে গেছেন। আর কি বলব – বাড়ি থেকে বেরোতে না বেরোতেই যেন অভদ্রায় ধরেছে! কোথাও কিছু নেই হঠাৎ সোঁ-ও করে যেন একশ’ হাউই ছাড়া হয়েছে। আমি ভাগ্যিস অন্য ঘরে ছিলুম। শব্দভেদ করতে গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ! ঘরদোর ধোঁয়ায় ধোঁয়া। বাথরুমের গিজারের কি না হাউই সাজার ইচ্ছে হয়েছে! আমি তখন ন যযৌ ন তস্তৌ! কি যে করি, কাকে যে ডাকি! তার ওপর পৃথিবীতে কেউই আমার কোনও কথা পাত্তা দেয় না! ফোন করলেও কেউ আসে না। যা হোক, অসীম গুরুবল এ যাত্রায় হিটলারের গ্যাস চেম্বারের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি!

ওদিকে ট্যুরে গিয়েও অফিস-বাড়ি, ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের হাজারো চিন্তায় কর্তামশাইএর শরীর বেহাল, মন অস্থির। ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে সেদিন আর প্রাণভোমরার খোঁজ পড়ে নি। পরের দিন সকালে অফিস বেরোতে গিয়ে আচমকা আর্তনাদ ‘আমার ল্যাপটপ!’ এঘর, ওঘর, এ টেবিল, সে বিছানা সব ওলট-পালট করেও কোথায় কি! যত বলি আগে একটু স্থির হয়ে বসে ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখ দেখি শেষ কখন ওটা দেখেছ? বাবু তত তুড়িলাফ খান! যার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘অস্থির বোস’ সে কি কখনও স্থির হয়ে বসতে পারে! তার ওপর একেবারে প্রাণভোমরাই উড়ে গেলে!

কিছুক্ষণ পরে বলেন ‘এয়ারপোর্টেই গেছে। সিকিউরিটি চেকের পর নেওয়া হয় নি’। সে আবার কি! তা সরকারী লাল ফিতের চেয়ে এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি চেকিংএর ঠেলা কিছু কম না! রোজই তার নিয়ম পালটায়। একদিন বলবে মোবাইল, চার্জার সব কিছু ব্যাগের মধ্যে পুরে সব সুদ্ধু চেকিন হবে। পরের দিনই বলবে শুধু মোবাইলই নয় তার একশ’ টাকার হেডফোনটাও ব্যাগ থেকে বার করে চেক করাতে হবে। এমন কি জুতো, ছাতা, ঘড়ি, বেল্ট কিছুই বাদ যাবে না।

বাবার মুখে শুনেছিলুম কিছুদিন আগেও ভারত থেকে যারা সরাসরি ইংল্যাণ্ডে যেত তাদের নাকি এক্কেবারে জন্মদিনের পোষাকে ইমিগ্রেসন চেক করাতে হত। ‘ব্ল্যাকি হিদেন’দের অপমান আর নাকাল করার চূড়ান্ত! এও ধীরে ধীরে সেই দিকেই যাচ্ছে মনে হয়! কোনোদিন বলবে একটা বড় ট্রেতে সবকিছু একসঙ্গে রাখতে হবে। কোনোদিন বলবে একটা ট্রেতে একটাই জিনিস – অর্থাৎ ল্যাপটপ আলাদা ট্রে, পার্সের আলাদা ট্রে, জুতো আলাদা, ফোন আলাদা; বেল্ট-ঘড়িও আলাদা! কোনোদিন হ্যাণ্ডব্যাগ এমনি যাবে, কোনোদিন তাকেও সিংহাসনে অর্থাৎ ট্রেতে চড়াতে হবে – আহা তার বুঝি ইচ্ছে হয় না!

তারওপর ব্যাগে খুচরো পয়সা থাকলে বার করে দেখাও। ওষুধ সেও দেখাও। এইসব সাতসতেরোয় দুবার করে ব্যাগ চেক করিয়ে নিজেকে আবার স্যুটেড-বুটেড করতে গিয়ে ‘গ্রে’ ল্যাপটপ ‘গ্রে’ট্রের মধ্যেই গ্যাঁট হয়ে বসে রইলেন!

হৈ হৈ হুলুস্থুলের মাঝে কোনওরকমে গুগলগুরুকে ধরে, একে ওকে ফোন করে এয়ারপোর্টের নম্বর তো পাওয়া গেল। এদিকে অফিস যাওয়া তো মাথায় উঠল। আরে, লটপটই যদি সঙ্গে না থাকে তো কোথায় গিয়েই বা কি লাভ!

ইন্টারনেটে দেখা গেল একটা ‘সিলভার’ ল্যাপটপের হারানো-প্রাপ্তির খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে বুঝি ওই! সবাই কি আর ল্যাপটপ ফেলে যায়! এবার তাহলে ফেরত পাবার ব্যবস্থা করতে হয়। ওই নম্বরে ফোন করতে তার বলল খবর নিয়ে জানাচ্ছি। কি ভাগ্যি, বড়বাবু দিওয়ালির ছুটিতে আজই বাড়ি আসছে। তার রাত্তিরে ওই এয়ারপোর্টেই পৌঁছনোর কথা। সে যদি উদ্ধার করতে পারে তার বাবার প্রাণভোমরা।

কিন্তু বড়বাবু! সে কি পারবে? সে তো সন্ধ্যেবেলা হাইওয়ে দিয়ে তারই মত আরেক গোবেচারা বন্ধুর সঙ্গে গাড়ি করে এয়ারপোর্ট অবধি আসবে ভেবেই আমার সাতরাত চোখে ঘুম নেই! ও বাবা, ভুলে গেলে বুঝি! সে তো নিজেই সব জিনিস হারিয়ে ফেলার ওস্তাদ! নতুন Casio ঘড়ি – আনার পর শুনলুম ‘এটা তোমার’। ওমাঃ, পরতে গেলেই শুনি ‘এটা পরলে কেন? এটা ছেলে বড় হয়ে পরবে’। তথাস্তু! তা ছেলে পরলো, বড় হবার আগেই। গুজরাট বেড়াতে গিয়ে। সে আবার কোনও কিছুই বেশীক্ষণ হাতে পরে থাকতে পারে না, সে ঘড়িই হোক, কি রাখী। তা মনের ভুলে ঘড়িটি হাত থেকে খুলে গাড়ির সিটে রেখে সে পরম নিশ্চিন্তে গাড়ি থেকে নেমে আসে। শুধুই কি ঘড়ি? ব্যাট, বল, টুপি মায় ইস্কুলের ব্যাগটি পর্যন্ত। একদিন ইস্কুল থেকে খালি হাতে ড্যাংডেঙিয়ে বাড়ি ফিরলেন। ব্যাগ গায়েব! বললেন ‘ইমলি পাড়ছিলুম, আঙ্কেল এসে ডাকলো, চলে এসেছি!’ তারপর সেই চশমা! বিকেলবেলা খেলতে গেলেন চোখে চশমা এঁটে। বাড়ি ফিরলেন চশমা হাওয়া। বলল ‘ওই তো ওখানে খুলে রেখে খেলছিলাম, এখন নেই’! নেই মানে! আমি যত রাগে ফেটে পড়ি ছেলে তত নির্বিকার! তখন তো সেই মুশকিল আসান দাদু এক হাতে একটা বড় টর্চ আর এক হাতে ছোট ভাইকে ধরে সার্চ পার্টি বের করলেন।

তো এই বড়বাবু এখন বাবার একমাত্র ভরসা ল্যাপটপ উদ্ধারের। অবশ্য ছেলে দেড় মাস পরে প্রথম হোস্টেল থেকে ফেরার পরই দেখি তার বাবা সেই বাংলা সিনেমার কমল মিত্রের মত তাকে বলছেন ‘তোমার মা তোমার জন্যে চিন্তা করে রাত্তিরে ঘুমোচ্ছেন না। তুমি মাকে একটু ভাল করে বোঝাও!’ বাবা ছেলের কথাবার্তা শুনে আমি হাসব না কাঁদব ভেবে পাই না!

যা হোক, এখান থেকে ‘মেল’-আ-মেলি করে চিঠি চাপাটি, আরও দরকারি কাগজপত্র তো দেওয়া হল, কিন্তু আসল কাগজটা! ল্যাপটপটা যে তেনারই তার জন্যে তো ট্যাগ নম্বরটা দিতে হয়! অফিসে ফোন করে আরও গড়বড়। দুজনের কাছ থেকে দুটো নম্বর এল যার প্রথম সংখ্যাদুটো আলাদা! এই রে কেলো করেছে! কোন নম্বরটা ঠিক বুঝবে কি করে! সব জায়গাতেই দেখি ‘উদো-বুধো’র ছড়াছড়ি। শেষে দুটো নম্বরই ছেলেকে দেওয়া হয়। আর সারাদিন ঠাকুর ঠাকুর করে কাটে।

অবশ্য এর মধ্যে এয়ারপোর্টের লোকেরা ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে -হ্যাঁ একটা ‘গ্রে’ ল্যাপটপ পাওয়া গেছে। এই মরেচে, ইন্টারনেটের লিস্টি যে বলছে ‘সিলভার’! আবার দ্বন্দ্ব সমাস! সকাল থেকে এতবার এয়ারপোর্টে ফোন করা হয়েছে যে তারা বোধহয় সবাই চিনে গেছে। দিদিমুণি বললেন ‘নেটে যা আছে সেটা International Passenger list. Domesticএর খবর ওখানে পাবেন না’! এই রে!

বাবু বললেন বাড়িতেই আরেকবার ভাল করে খুঁজে দেখ। সত্যি সত্যি বাড়িতেই নেই তো! আবার বলেন যদি এয়ারপোর্টে ফেলে না এসে থাকি! গাড়ির ড্রাইভার নিশ্চয় ডিকি খুলে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপ বার করে নেবে না! হায় রে, হ্যামলেট-রাজকুমার কিছুতেই পিছু ছাড়ে না! এয়ারপোর্ট অফিস যদি বন্ধ হয়ে যায়! ছেলের তো যেতে যেতে রাত সাড়ে ন’টা, দশটা। আবার ফোন – ‘আপনারা খোলা থাকবেন তো?’ ‘হ্যাঁ মশাই হ্যাঁ, আমাদের অহোরাত্র ডিউটি!’ পরের ফোন – ‘দেখুন দাদা এখানে লিখেছে ২৪ ঘণ্টা হয়ে গেলে জিনিস অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু আমার ছেলে –‘ ওদিক থেকে সোজা ধমক আসে ‘আপনি তো বললেন আপনার ছেলে আসবে!’ ‘হ্যাঁ স্যার, হ্যাঁ স্যার, থ্যাংকু, থ্যাংকু’।

তা ছেলের কলেজ কি পাশে! সে আসছে তো আসছে। রাস্তা আর ফুরোয় না। এদিকে বাড়িতে বসে দুরুদুরু বক্ষে দুজনে মোবাইলে তার ‘live location’ দেখে যাচ্ছি। কতদূর এল, আর কতক্ষণ বাকি। বার বার ফোনও করা যাচ্ছে না তাকে। বন্ধুর সামনে এতবার বাড়ি থেকে ফোন – তার একটা ‘পেস্টিক’ নেই! প্রায় কাছাকাছি এসে লোকেসান আর দেখায় না! এক জায়গায় স্থির! নামছে বোধহয়। ফোন ধরতে গেলে আবার নিজের জিনিস না গাড়িতে ফেলে আসে।

রাত দশটা। নাঃ, আর ধৈর্য রাখা যাচ্ছে না! দুগ্‌গা বলে করেই ফেলা হল ফোন। ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ল্যাপটপ পেয়েছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ খুলে পাসওয়ার্ড দিয়ে দেখে নিয়েছি এটা তোমারই। এখন আমি sign করছি’। উঃ, কি শান্তি!

কি শান্তি – প্রাণভোমরা পাওয়া গেছে! কি শান্তি – ছেলে বড় হয়ে গেছে, দায়িত্ববান হয়ে গেছে!।।

Posted in Uncategorized

ড্যামকুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে – ৫

গুরগাঁও পর্বঃ

গুরগাঁও আসার ঠিক একমাসের মাথায় আমাদের মাথার ওপর থেকে সবচেয়ে বড় ছাতাটা সরে গেল। যে কোন পুজো হোক, যে কোন অনুষ্ঠান, বাড়িতে অতিথি – সবার আগে যিনি সেনাপতির মত সামনে দাঁড়াতেন সেই বাপী চলে গেলেন। কলকাতা হোক কি পুণা – মায়ের সব কাজের সবচেয়ে বড় ভরসা ছিলেন বাপী। আমরা যতক্ষণে তৈরী হয়ে পুজো মণ্ডপে যাব তার আগেই বাপীর মিষ্টি এনে কাগজে নাম-গোত্র লিখে সব কিছু রেডি। দশমীতে ঠাকুর বরণ, সিঁদুর খেলা – সেও সময় মত মিষ্টি পানপাতা সব হাজির। তাছাড়া অন্যান্য পুজো, ব্রত-উপবাস তো বটেই। আমরা মন্দিরে যাবার ঢের আগেই পুজো নিয়ে বাপী পৌঁছে যেতেন মন্দিরে। এমন কি পুণায় শেষবারের দুর্গাপুজোয় মায়ের শরীর বিশেষ ভাল নেই, এদিকে আমাদের বাইরে যাবার কথা, তখনও বাপীর মুখে সেই একই কথা – ‘আমি তো আছি, তোরা যা ঘুরে আয়’।

এখানে এসে সেই ‘আমি আছি’টাই এক্কেবারে ‘নেই’ হয়ে গেল। কিন্তু তখন মা যেন হয়ে উঠলেন একাধারে মা ও বাপী। আর বাপীর ছেড়ে যাওয়া ঊর্দিও উঠল বাপীর ছেলের গায়ে। নিজের মনখারাপ দূরে সরিয়ে রেখে ছেলেদের মন ভাল রাখতে নতুন জায়গায় এসে নতুন পুজো দেখার ছলে পুরোনোর অভাব ভুলিয়ে দেবার তার নিরন্তর চেষ্টা।

মায়ের তো সারা বছর পুজোপার্বণ, ব্রত-উপোস লেগেই থাকে। আর বেশী অনিয়মে বয়স্ক শরীরও মাঝে মাঝে বিদ্রোহ করে ওঠে। তখন মায়ের যত কিছু অভিমান অভিযোগ সব গিয়ে পড়ে ঠাকুর দেবতা, বিশেষ করে ওনার গুরুদেবের ওপর। এত পুজো উপোস করে যখন শরীরই খারাপ হল তখন ঠাকুরের মুখই দেখব না! কিন্তু পরের দিনই আবার নতুন ব্রত। আমরা কিছু বলতে গেলেই বলেন ‘ব্রত পালন করব না! কি বল?!’ তারপর এই লকডাউনের মধ্যে হঠাৎ তেড়ে উঠলেন ‘ঠাকুরের মুখ না দেখে আমার শরীর খারাপ; এবার আমি প্যাণ্ডেলে যাবই যাব!’

মহালয়ার দিন দিল্লিতে রামকৃষ্ণ সারদা মিশনে গান শুনতে যেতে মা খুব ভালবাসতেন। সেও আবার সবাই গান গাইছে দেখে মায়ের শখ হতো মায়ের বৌমাও গান করে। ওখানে সবার সামনেই আমায় খোঁচা লাগাতেন, সবাই গান করছে তুমি একটা গান করতে পারছ না! এদিকে আমার তো দরকারের সময় কিছুই মনে পড়ে না – সে কাজের কথাই হোক আর গান। আর তাছাড়া আমার ঝুলিতে একটা দুটোই গান আছে। ঠাকুর-মা-স্বামীজীর গান কি আগমনী গান হুট বলতেই কি আমি গাইতে পারি! শেষে একবার মাতাজীর কথায় একটা গান গাইতে মা যে কি খুশী হয়েছিলেন! মিশনের অনুষ্ঠানে বাংলা গান, বাংলা কথা, সবার ওপরে মাতাজীর অসীম ভালবাসার টান। যে কোন অনুষ্ঠান আছে জানতে পারলেই মা খুব উৎসাহের সঙ্গে মিশনে যেতেন।

মহালয়ার দিন বাড়িতে নামগানের আসর মা খুব মিস করতেন। কিন্তু  বাপী চলে যেতে মায়ের তো ডান হাতখানাই ভেঙ্গে গেল। বাপীহীন সংসারে নতুন শহরে আমাদের পক্ষে যে এতবড় অনুষ্ঠান আয়োজন করা সম্ভব নয় সেটাও মা খুব ভাল জানতেন। নিজেরও তখন শরীর-মনে আগের মত সেই জোর নেই। এখানে সোসাইটির মধ্যেই কিন্তু কীর্তন মন্ডলী আছে। মাঝে মধ্যেই দুপুর থেকে তাদের কীর্তনের আসর বসে। বিশেষ করে শারদীয়া ও বাসন্তী নবরাত্রিতে পুরো ন’দিন ধরেই চলে দৈনিক কীর্তনের আসর। মাও এক একদিন গান-বাজনার আওয়াজ পেলে সেখানে যেতেন কীর্তন শুনতে। কিন্তু ভাষাগত সমস্যা বা যে কোন কারণেই হোক আমাদের বাড়ি সেই আসর বসানো সম্ভব হয়ে ওঠে নি।

পুণায় কলেজে কাজ করার সুবাদে সহকর্মী বন্ধুদের কাছে বহু মারাঠী প্রথা, রীতি-রেওয়াজ সম্বন্ধে একটা সম্যক ধারণা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখানে এসে শামুকের খোলস ছেড়ে বেরোবার তাগিদটাই কোনদিন অনুভব করি নি। তাই ‘তীজ’ হোক কি ‘করোয়া চৌথ’, কীর্তন হোক কি দিওয়ালি মেলা – কোন কিছুতেই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারি নি। সে সম্পূর্ণ ভাবেই আমার ব্যর্থতা। তবে দূর থেকে দেখে কিছু জিনিস জেনেছি। যেমন বছরের দুটো নবরাত্রিতেই নবমীর দিন ‘কঞ্জক’ বা কন্যা পূজা। সেদিন অনেকেই সামনের জুগ্‌গির বা বাঞ্জারাদের ছোট ছোট মেয়েদের বাড়িতে ডেকে ভাল খাবার খাওয়ায়, নতুন জামা দেয়। হোক না দু-একদিনের জন্যে তবু সেই দু-একদিনও তো তারা শিশুর মুখে হাসি ফোটাতে পারে।

মা দুর্গা আমাদের ঘিরে রেখেছেন। এখানে আসতেই কুসু বলল আরে এই সামনের মাঠেই বঙ্গীয় পরিষদ গুরগাঁও এর বিরাট পুজো হয়। কদিন ধরে পুজো, খাওয়া-দাওয়া, আনন্দমেলা, দুপুরে ভোগ, সন্ধ্যেবেলা ফাংসন, কলকাতার আর্টিস্ট, মাঠজুড়ে কত রকম স্টল – দেখবি একটুও পুজোর আনন্দ বাদ পড়বে না। তাছাড়াও গুরগাঁওতে আরও বেশ কটা পুজো হয় দেখবি।

ওমা, সত্যি সত্যিই দোকান বাজারে যেতে আসতে দেখি রথের দিন খুঁটি পুজো হচ্ছে। তারপর বিরাট করে পুরো মাঠ ঘেরা হচ্ছে। দুদিকে দুটো গেট। গেট দিয়ে ঢুকেই পুজো কমিটির অপিস কাউন্টার। মাঝখানে পুজোর প্যাণ্ডেল। তার একেকবার একেকরকম থিম – কখনও গ্রাম বাংলা, কখনও কেদারনাথের মন্দির, কখনও চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার। পেছনের দিকে আলাদা করে স্টেজ আর মাথা ঢাকা বসার জায়গা। এপাশে ভোগ খাবার ব্যাবস্থা। স্টেজ আর খাবারের দিকে যেতে গেলে সেখানেও একটা গেট মত। বাইরের অবাঞ্ছিত লোক যাতে ঢুকতে না পারে। আবার প্রথম বছর এখানেও বাংলা বইএর স্টল – দেখেই মনটা খুশিতে ভরে গেল। তবে মাঠ জুড়ে বিরিয়ানি, কাবাব, চাইনিজ – খাবারেরই মেলা।

বঙ্গীয় পরিষদের পুজোর কর্মকর্তা ও কর্ত্রীরা সবাই অত্যন্ত ভাল মানুষ। এখানে গেলে কারোর মনেই হবে না যে সে নতুন এসেছে কি বাইরের লোক। অঞ্জলির লাইন হোক, কি সন্ধিপুজোয় প্রদীপ জ্বালানো অথবা দশমীর দিন সিঁদুরদান – নতুন-পুরোনো, কমিটি, বহিরাগত সবার সঙ্গে সমান ব্যবহার, সবার জন্যে এক নিয়ম। দুপুরে ভোগ খাবার ব্যবস্থাও খুব ভাল। সকালে গিয়ে বলতে হবে কটার ব্যাচের কজনের কুপন চাই। বসে খাবার মত ঠিক যত জনের ব্যবস্থা একেক ব্যাচের জন্য ঠিক ততগুলোই কুপন দেওয়া হয়। সেই সময়ের কুপন ফুরিয়ে গেলে অন্য কোন সুবিধেমত সময় নেওয়া যায়। আর কারুর যদি বেশী তাড়া বা দাঁড়িয়ে খেতে আপত্তি না থাকে তার জন্যে আছে আলাদা বুফের কুপন। পুজো নেবার ও প্রসাদ দেবারও একি রকম সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা।

একই রকম ভাবে আছে লক্ষ্মী পুজো, কালীপুজো, সরস্বতী পুজোতেও পুজো দেওয়া আর পুজোর পর খাবারের ব্যবস্থা। আমরা বাঙালীরা আবার কালীপুজোর সময় ঘোর তামসিক হয়ে উঠি। সেদিন পুজো শেষ হবার পর থাকে ঢালাও লুচি মাংসের ব্যবস্থা। খাওয়ানোর ব্যাপারে কোনও সময়ই কোনও কার্পণ্য নেই, কোনও আমি-তুমির ভেদ নেই। সবাই পেট ভরে মন ভরে তৃপ্তি করে খাবার খেতে পারে।

প্রথমবার দুর্গাপুজোয় যেতে গিয়ে দেখি ওমা, পেছনের দিকে সেক্টরের যে কম্যুনিটি হল সেখানেও একটা পুজো হচ্ছে। এরা বলে যেখানেই দশটা বাঙ্গালী সেখানেই একটা দুর্গা পুজো। আর পরের বছর সেই একটা পুজো ভেঙ্গে হয় দুটো পুজো। এটাই বাঙালী রীতি। এই পুজোতেও খাওয়াদাওয়া ফাংসন কলকাতার আর্টিস্ট সবই আছে, কেবল স্টল নেই। আমাদেরও পোয়া বারো। সুবিধে মত যে পুজো ইচ্ছে সেখানে যাই। তাছাড়াও আছে নির্বাণার পুজো, সুশান্ত লোকের পুজো, DLF এর পুজো। যদিও এসব পুজো সন্ধ্যেবেলাই দেখতে যাওয়া হত, কিন্তু এখানে একটা শান্তি ছেলেদের ইস্কুল অষ্টমী থেকে দশমী অবধি ছুটি।

এতদিনে একা একা মেট্রো চেপে দিল্লি যেতে আমি বেশ শিখে গেছি। তাই সপ্তমীর দিন বাকিরা যখন স্কুল আর অপিস নিয়ে ব্যস্ত আমি চলে যেতুম দিল্লি মিশনে। যদিও আমার নড়ে নড়ে তৈরী হয়ে এতদূর যেতে যেতে সকালের চন্ডীপাঠ ও হোম শেষ হয়ে যায়, কিন্তু তারপর চলে গান আর অঞ্জলি। মাকে অনেক বলেও পুজোর মধ্যে বাড়ি থেকে বার করা যেত না। আমি তাই একাই যেতুম। মাতাজীদের কোনও ক্লান্তি নেই। সকাল দশটা থেকে প্রায় বারোটা পর্যন্ত যে যখন যাচ্ছে তখনি তাকে অঞ্জলি দেওয়ান। তারপর সপ্তমী আর নবমীতে এমনিতে হাতে হাতে প্রসাদ। অষ্টমীর দিন খিচুড়ি প্রসাদ। তবে আমি তো একবার মিশনে গেলে আর বাড়ি আসার নামটি করি না, তাই মাতাজীও ভলেন্টিয়ারদের সঙ্গে আমাকে দুপুরে ভাত-ডাল খাইয়ে তবে ছাড়েন।

পুণায় প্রথমদিকে একবার অষ্টমীর দিন রামকৃষ্ণ মঠে গিয়েছিলুম ছেলেদের নিয়ে। অমৃতাও ছিল আমাদের সঙ্গে। ওখানে তখন হোম হচ্ছে। ছোটবাবু তখন বছর তিনেকের। বাড়ি ফেরার সময় গাড়িতে উঠে দেখি সে আপন মনেই বলে চলেছে ‘ওম্‌ স্বাহা’। সেই শুনে অমৃতার পরে কি হাসি! শেষের দিকে দুবছর অষ্টমীতে পুণায় সারদা মঠে গেছি। ওখানেও হোম শেষ হলে আরতি আর তারপর ভজন হয়। তারপর খিচুড়ি প্রসাদ পেয়ে মনে অসীম তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফেরা। দিল্লি মিশনে গিয়েও সেই একই তৃপ্তি একই আনন্দ।

নবমীর দিন চারজনে মিলে দিল্লি চিত্তরঞ্জন পার্কে ঠাকুর দেখতে যাওয়া। তবে এবার মেট্রোরেল নয় ক্যাব। দিল্লি তো কিছুই চিনি না। GK2 দিয়ে ঢুকে যেই না দেখেছি একটা মাঠে বিরাট করে প্যান্ডেল হয়েছে আর মাইকে মন্ত্র পড়ার আওয়াজ আসছে, গাড়ি থামান, গাড়ি থামান করে তো নেমে পড়েছি। ভেতরে গিয়ে ঠাকুর দেখা ছবি তোলা সব তো হল। আর কোনও পুজো হয় কি না আর হলেও কোথায় কত দূরে কিছুই জানি না। তবে সেই কলেজে পড়ার সময় রাজস্থান ট্যুরে যাবার পথে দিল্লি এসে দেখেছিলুম চিত্তরঞ্জন পার্কে একটা কালীবাড়ি আছে আর সেখানে দুর্গা পুজো হয়। দিল্লিতে যে কালীবাড়িও অনেকগুলো আছে আর সব জায়গাতেই দুর্গাপুজো হয় তাও তো তখন জানা নেই। আমার ধারণায় নিউ দিল্লি কালীবাড়ি মানেই এই চিত্তরঞ্জন পার্কের কালীবাড়ি। সেই কালীবাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করতে জানা গেল আরে এটা C. R. Parkই নয়। এটা ওই GK2র M-ব্লকের পুজো। বেরিয়ে এসে মাঠের পাশের দোকানদারদের জিজ্ঞেস করতে তারা তো বলে দিল এই রাস্তা দিয়ে এই দিকে গেলেই চিত্তরঞ্জন পার্ক।

হাঁটতে গিয়ে দেখি রাস্তা আর ফুরোয় না। প্রথমে খুব উৎসাহ নিয়ে তো শুরু করেছি। রাস্তার দুদিকে যে বাড়ির দিকেই তাকাই সব গেটেই বাঙালী পদবি লেখা – চ্যাটার্জী, মুখার্জী, বসু, সেনগুপ্তা এমনকি বক্সি। বক্সি দেখলেই আমার তো ব্যোমকেশের কথা মনে হয়। ছেলেরাও খুব উত্তেজিত। তারপরই রোদ্দুরে গরমে ঘামে জল তেষ্টায় সবার অবস্থা কাহিল। মাঝে মাঝে পথ চলতি লোকেদের জিজ্ঞেস করি ‘কতদূর, আর কতদূর’। রাস্তায় বাঁকের মুখে আরেকটা প্যান্ডেল। আরে দিল্লির ঠাকুর দেখতেই যখন বেরিয়েছি টুক করে ঠাকুরটা দেখে নিলে হয়! রাস্তার নাম দেখি বিপিন চন্দ্র পাল রোড। অবশেষে সেই রাস্তার বাঁক ঘুরে আবার একটা মাঠ। এখানে লেখা রয়েছে চিত্তরঞ্জন পার্ক কো-অপরেটিভ। হুররে, অবশেষে চিত্তরঞ্জন পার্ক পৌঁছনো গেছে।

দিল্লি-গুরগাঁওএ সব পুজোয় একই ছবি। পুণায় যেমন ঠাকুর আর ফাংসনের স্টেজ পাশাপাশি, এখানে ঠাকুরের আলাদা প্যাণ্ডেল। আর ফাংসনের স্টেজ তার থেকে একটু দূরে। (অবশ্য পুণার AFMC-র পুজোতেও তাই।) বহু জায়গায়ই ফাংসন শুধুমাত্র মেম্বারদের জন্যে। বাকিরা এসো, প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখো, চারদিকে ছড়িয়ে থাকা স্টল থেকে বম্বে চাট, দই পুরি, পাপড়ি চাট অথবা আমিষ হলে বিরিয়ানি, ফিস ফ্রাই তারপর মিষ্টি, আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিংস খেতে খেতে বড় জোর দূর থেকে মাইকে ফাংসন শোনো। বেপাড়ার লোক হয়ে মৌরসি পাট্টা গেড়ে বসে বসে ফাংসন দেখতে পাবে না বাপু! টাকা দিয়ে মেম্বার হও ফাংসন দেখো – ফেলো কড়ি মাখো তেল!

কো-অপরেটিভের পুজোয় দেখি বিজলিগ্রিলের স্টল। আহাঃ, আহাঃ – ফিস ফ্রাই, চিকেন কাটলেট না খেলে হয়! চিকেন ললিপপ, মোগলাই পরোটার চলটা এখানে বিশেষ নেই। রোল অবশ্য আছে – এগ, চিকেন, ভেজ; তবে আসল হল বিরিয়ানি। একেবারে ডিম, আলু দেওয়া শুকনো শুকনো কলকাতা বিরিয়ানি। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানিও আছে অবশ্য। পুণায় বাঙালীদের জন্যে খাবারের ভারি কষ্ট। বিশেষতঃ আমার মত যারা অতিরিক্ত মশলা মাখা দম বিরিয়ানি পছন্দ করে না। কলকাতার বিরিয়ানিই হয়ে উঠল আমাদের পুজোর প্রধান আকর্ষণ। তবে আমার জন্যে সোমবার, ষষ্ঠী, অষ্টমীতে বাদ। সেদিন শুধু মিষ্টি খেতে পার।

কো-অপরেটিভের পুজো দেখে এদিক ওদিক থেকে যা খবর পাওয়া গেল তাতে শুধু চিত্তরঞ্জন পার্কেই নাকি দশ-বারোটা দুর্গা পুজো হয়। প্রতি ব্লকের আলাদা পুজো। তাছাড়াও কিছু বাড়ির পুজোও আছে। ওদিকে আমাদের পা তো তখন জবাব দিয়েছে। মাঠ থেকে বেরোতেই শুনলুম এই তো সামনেই আরেকটা পুজো আছে। এই রাস্তা ধরে একটু এগোলেই। আর না। এবার টোটো। টোটো চালকরা সব বাঙালী। আমাদের নিয়ে গেল শিবমন্দির বা চিত্তরঞ্জন পার্ক কালীবাড়ি। এইতো সেই কালীবাড়ি যেটা আমি আগে দেখেছি! এক্কেবারে রাস্তা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে।

কালীমন্দিরের দুর্গাঠাকুর দেখে ভেতরে গিয়ে মা কালী, শিবঠাকুর আর রাধা-কৃষ্ণর সঙ্গেও দেখাটা সেরে নিলুম। ওদিকে নিচে তখন ভোগের বিশাল লাইন। মন্দিরের সামনে রামকৃষ্ণ মিশন আর আর্য সমাজ এদের বইএর স্টল। বাইরে মাঠের পাশে সারা রাস্তা জুড়ে রকম রকম দোকান। আচার-হজমি, ডাব, শোলার প্রতিমা, ইমিটেসন গয়না, ব্যাগ – কি আছে আর কি নেই! কিছুমিছু কেনাও হল।

এবার পরের ঠাকুর। B-ব্লকের ঠাকুর দেখার আগে রাস্তায় চোখে পড়ল চিত্তরঞ্জন ভবন। আর মাঠে ঢোকার মুখেই একটা বাড়ির গ্যারেজের মধ্যে থেকে তখন ঢাকের বাদ্যি শোনা যাচ্ছে। সেই বাড়ির ঠাকুরও দেখা হয়ে গেল আমাদের।

B-ব্লকের পুজোর বিরাট প্যাণ্ডেল। আর মাঠ জুড়ে খাবারের স্টল। দুর্গাঠাকুর দেখতে গিয়ে ফুচকা খাবো না তা কি হয়! যে ছেলেটি ফুচকা বিক্রি করছে পাশেই তার মা বসেছে ঝাল মুড়ি, মাংসের ঘুগনি, চুড়মুড় এই সব নিয়ে। মনের সাধ মিটিয়ে ছোটবেলার কলকাতার দুর্গাপুজো উপভোগ করছি মনে হল। আরে, ওই তো কোলা গোলাও আছে! আর বুড়ির মাথার পাকা চুল! মেলায় এসে ওটা না খেলে হয়! এটা দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্ক আর একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক, না কি সেই টালা পার্কের মেলা আর বিংশ শতাব্দীর আটের দশক। ঠিক যেন টাইম মেশিনে চড়ে ফিরে গেছি সেই ছোটবেলায়। মেলার এক কোণে ওই তো ঘুর্ণী-নাগরদোলা আর ওই যে বেলুন ফাটানোর স্টল! বেলুন ফাটানোয় ছেলেদের উৎসাহ দেখে মনে হল সিলুয়েটে আমাদের ছোটবেলাটাই দেখা যাচ্ছে!

চিত্তরঞ্জন পার্কে গিয়ে বাঙালীর ‘মাছ-মিষ্টি-মোর’ না হলে চলে? তাই পুজো প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে আবার ঘুরে যাওয়া হল ১ নং মার্কেটে। মোটামুটি দশ-পনেরো মিনিটের হাঁটা পথে আরও দু একটা পুজো প্যাণ্ডেল আছে বলে সবাই বলছে। কিন্তু ততক্ষণে ছেলেরা ভেটো দিয়ে দিয়েছে, এবারের মত দিল্লির ঠাকুর দেখা ইতি। তাছাড়া যত সময় বাড়ছে রাস্তায় ভীড়ও বাড়ছে, বহু রাস্তা ‘NO ENTRY’ করে দিচ্ছে। দিল্লি থেকে ফেরার পথে গুরগাঁওএর গাড়ি পাওয়াই মুশকিল। মেট্রো করে যাওয়াই যায়, কিন্তু কাছাকাছি মেট্রো স্টেশন ঠিক চিনি না। আর ছেলেদের মেট্রো পালটে যেতে হবে শুনেই মাথা গরম। ওদিকে আবার রামলীলা ময়দানে রাবণ দহন পালা শুরু হবে একটু পরেই।

মাছের বাজারে ঘুরে মেছো গন্ধে ছেলেদের নাক সিঁটকানির ভয়ে বেরিয়ে এসে এবার বাঙালী মিষ্টি। আর ঠিক উল্টোদিকে পুজোর জন্যে নাড়ু-বাতাসা, খই, ঘরের তৈরী আচার, গোবিন্দভোগ চাল, মটর ডাল – কি আর কি নয়! বাজারের ভারে হাত যখন ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম এদিকে একের পর এক ক্যাব বুকিং ক্যান্সেল করছে তখন কোনওক্রমে একটা গাড়ি তো পাওয়া গেল।

এরপর পুজোর সময় একদিন চিত্তরঞ্জন পার্ক যাওয়া আর ঠিক এই এই ঠাকুর দেখা আর ফেরার পথে মার্কেট থেকে এই মিষ্টি-নোনতা, নাড়ু-বাতাসা, ধূপ, আচার, খই, লাল চালের মুড়ি কেনাটাও একটা নতুন রেওয়াজে পরিণত হল। ঠিক যেমন পুজোর মধ্যে একদিন ভাল হোটেলে খাওয়া। সে কলকাতায় তাজ বেঙ্গল, Main Land China হোক, কি পুণায় Oh! Calcutta, China Grill অথবা গুরগাঁওতে বিজলি গ্রিল কি দিল্লিতে আমিনিয়া।

বড়বাবু অনেক খুঁজে ভেলোরে দুর্গা পুজো দেখতে গিয়ে বলল ‘একটুও মনে হচ্ছে না ভেলোরে আছি’। কলকাতা, পুণা, গুরগাঁও, দিল্লি কি ভেলোরের পুজো দেখে আমাদের এটাই মনে হয়েছে যে দেশের যে শহরই হোক সব জায়গাতেই ঘরোয়া পুজোর মূল সুর সেই একই। দুর্গা পুজো মানেই চার-পাঁচটা দিন সব বাঙালী একজোট হয়ে মায়ের পুজো, একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, নাচ-গান হৈ হুল্লোড়, পরস্পরের সঙ্গে আলাপ পরিচয়, নতুন বন্ধু – নতুনের মোড়কে সেই এক টান, সেই এক তান।।

Posted in Uncategorized

ড্যামকুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে -৪

পুণা পর্বঃ

পুণায় প্রথম সকালে ঘুম ভাঙ্গলো ষষ্ঠীর ঢাকের আওয়াজে। বিধান নিবাসের পুজোর জমজমাট আয়োজন পেছনে ফেলে পঞ্চমীর দিন যখন দুই ছেলে আর শাশুড়ি মা কে নিয়ে দমদম এয়ারপোর্টের দিকে রওনা দিলুম তখন পিছু ফিরে আর তাকাই নি মা-বাবার মুখের দিকে। নিজের চোখের জল আর মনের বেদনাকে চাপা দিয়েছিলুম প্রিয়জনের কাছে যাবার আগ্রহ ও নতুন শহর নতুন মানুষ চেনার উত্তেজনা নিয়ে। তার আগে পাড়ার সবাই যখন বলেছেন ‘পুজোটা কাটিয়ে যাস’, তখন ওদিক থেকে অভয় এসেছে ‘তোমার কোনও চিন্তা নেই, এক্কেবারে বাড়ির পাশেই দুর্গা পুজো হচ্ছে’। মুম্বাই থেকে গাড়ি করে পুণা এসে পৌঁছলুম তখন অনেক রাত। ততক্ষণে বাপী ট্রেনে করে আমাদের আগেই পৌঁছে গেছেন পুণায়।

নতুনের উত্তেজনা চোখে নিয়ে তাকিয়ে দেখি সত্যিই মা দুর্গা আমাদের অভ্যর্থনা করবেন বলে সেজেগুজে বসে আছেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তাটা পার হলেই সংকটহরণ মহাদেব মন্দির। সেই মন্দির চত্তোরেই হচ্ছে এক প্রবাসী বাঙ্গালী ভদ্রলোক শ্রী জয়ন্ত চক্রবর্তীর নিজস্ব দুর্গাপুজো – বিচক্ষণা দুর্গাপূজা।  

কলকাতার বাইরে এসে দেখলুম সনাতন ধর্ম মন্দির মানে একই চত্তোরের মধ্যে সব দেবতার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। গেট দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে রয়েছেন লাল টুকটুকে মহাবীর। বাঁদিকে শিবমন্দির তার সামনে বিরাট নাটমন্দির যা সবসময়ই সারমেয়কূলের দখলে। শিবলিঙ্গ স্পর্শ করতে হলে নিচু গর্তের মধ্যে দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে আবার পিছু ফিরে হামাগুড়ি দিয়ে বেরোতে হবে। দেবতার কাছে নতমস্তক হয়ে থাকাই দস্তুর কিনা! ওদিকে কষ্টেশিষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে দেখা গেল শিবঠাকুরের ঠিক পাশেই ঠাণ্ডায় আরামে গুড়িসুড়ি দিয়ে সুখের নিদ্রায় মগ্ন ধর্মরাজের সঙ্গীরা! আমার মত অসীম সাহসী ভক্তের পুজোয় ওখানেই ছেদ পড়ে। পাশে রয়েছেন কালো পাথরের গণপতি সঙ্গে নবগ্রহ। তারও পাশে শ্বেতপাথরের বৃন্দাবনলাল রাধারমণবিহারীজী। পেছনের দিকে আছেন দেবী সিংহবাহিনী। আর আছে গোশালা আর সবের দায়িত্বে বিরাট জটা্জুটোধারী মোহন্তবাবা ও তাঁর শিষ্য।

প্রথম সকালেই বাপী ছুটলেন মন্দিরে ষষ্ঠীর পুজো পৌঁছে দিতে। একটু পরেই দাদা-বৌদি ছেলে মেয়ে নিয়ে হাজির। চল, চল পুণার ঠাকুর দেখবি। দাদার গাড়ি করেই যাওয়া হল পুণার কর্পোরেসন গ্রাউণ্ডের দুর্গা ঠাকুর দেখতে। পুরো মাঠ ত্রিপল দিয়ে ঘেরা। ষষ্ঠীর সকাল বলে ঢোকার খুব বেশী লাইন নেই। বিরাট বড় আলাদা আলাদা চালচিত্রের প্রতিমা। ঠাকুরের বেদির পাশেই স্টেজ। কদিনভোর রোজই সন্ধ্যেবেলা সেখানে ফাংসন হবে। মাঠ জুড়ে চেয়ার পাতা। পুজো কমিটির মেম্বারদের জন্য এই কদিন দুপুরেও ভোগের ব্যবস্থা। পুজোয় মেম্বার যে কেউই হতে পারেন। চাঁদা দিলেই হাতে পেয়ে যাবেন ভোগের কুপন। আর দুপুরের দিকেও থাকে কিছু না কিছু ঘরোয়া কম্পিটিসন – মহিলাদের শাঁখ বাজানো, বয়স্কদের কুইজ, ছোটদের বসে আঁকো, আবৃত্তি এইরকম আর কি।

মেম্বার না হলেও খাবারের অভাব নেই। মাঠের চারদিকে বিভিন্ন স্টল রয়েছে। সেখানে কলকাতার মিষ্টি, কচুরি তরকারি, মিষ্টি দই তার সঙ্গে আচার-কাসুন্দি, হজমিগুলি, পুজোর জন্যে আলতা-সিঁদুর, শাঁখা-পলা সবই পাওয়া যায়। তেমনি রয়েছে চিকনের শাড়ি, কুর্তির স্টল, বাংলার শাড়ি, মাটির বা জুটের গয়না, বাড়ি সাজানোর সামগ্রী, ছবির স্টলও। আর আছে খাবারের স্টল। সবচেয়ে ভীড় সেখানেই। মোগলাই পরোটা, ফিস ফ্রাই, চিকেন রোল, কাটলেট কি আছে আর কি নেই! পরে দেখলুম ওখানে মোটামুটি সব বড় পুজোয় এই একই ধারা।  মারাঠীদের অবশ্য বিপুল বিস্ময় পুজোর সময় তোমরা ‘ননভেজ’ খাচ্ছো! আরে কি করে বোঝাই পুজো আমাদের কাছে শুধুই রীতি মেনে পুজো করা নয়, দুর্গাপুজো বাঙ্গালীদের মিলন উৎসব।

নাঃ, মা দুর্গা কোনওভাবেই পুজোর সময় মন খারাপ করতে দেবেন না। কর্পোরেসনের পুজো ছাড়াও আমরা দেখলুম আনন্দম, AFMC, কোরেগাঁও পার্ক আর খাড়কি কালীবাড়ির পুজো। এর মধ্যে AFMC -র পুজোও বাড়ির বেশ কাছেই, আর আনন্দমের পুজো তো রাস্তা দিয়ে একটু এগোলেই। বৌদিরা তখন আনন্দম আর খাড়কি কালীবাড়ির পুজোয় ফাংসন করে। প্রথমবার অত ছোট ছেলেদের নিয়ে ফাংসন দেখতে যাওয়া হয় নি ঠিকই। কিন্তু সন্ধ্যেবেলা তিন বছরের নীল আর সাড়ে সাতমাসের সোহমকে নিয়ে সবাই মিলে যাওয়া হল দুর্গাঠাকুর দেখতে।

তার আগে প্রবাস জীবনের আমার প্রথম পুজো-বাজার হল একটা প্যান্ট আর টপ। আর সেই নতুন কেনা পোশাক পরে সবাই মিলে গাড়ি করে গেলুম বাড়ির একদম পাশেই পাহাড় দেখতে। কলকাতার লোক আমরা, সমুদ্রের কাছাকাছি বাস। নিজেদের ঘরের জানলা থেকে পাহাড় দেখা আমাদের কাছে মস্ত বিস্ময়। নাই বা হল হিমালয়, পশ্চিমঘাট তো বটে!

জয়ন্তদা অত্যন্ত অমায়িক মানুষ। ওনার পুজোয় সবার অবারিত দ্বার। মন্দিরে গিয়ে বিচক্ষণা মা দুর্গার সামনে বসে থাকাটাও তখন মনে হয়েছিল বিরাট পাওয়া। আমাদের এগারো বছরের পুণা বাসে এমন কোনবার হয়নি যে বিচক্ষণায় পুজো দেখতে গেছি অথচ ভোগ প্রসাদ পাই নি। একবার তখন ছেলেরা আনন্দমে ফাংসন করেছে। ফাংসন শেষে দূরের এদিক ওদিক ঠাকুর দেখে বাড়ি ফেরার পথে রাত দেড়টার সময় বিচক্ষণায় এসেছি। মন্দির তখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তখনও জয়ন্তদার মুখে সেই এক কথা – ‘একটু মায়ের প্রসাদ পেয়ে যান’। তখন কেবলমাত্র ডাল ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। গেলাসে করে সেই ডালই দিয়েছেন প্রসাদ বলে।

সেবার নবমীর দিন আমাদের বাইরে যাবার কথা। বাড়িতে এসে তাড়াতাড়ি করে last minute packing সেরে বেরবো, বাপী ঢুকলেন হাতে বিচক্ষণার ভোগপ্রসাদের থালা। কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, ‘কি করব আমায় জোর করে প্রসাদ দিয়ে দিলে, বললে ‘মেসোমশাই বাড়ির জন্যে নিয়ে যান’।‘ সত্যি এই আন্তরিকতা এখন কোথায় মেলে!

পুণায় পুজোর সময় নতুন অভিজ্ঞতা স্কুল-কলেজ-অপিস সব খোলা। একমাত্র দশমীর দিন ছুটি। নাঃ, অভিযোগ জানানোর কিচ্ছু নেই। কারণ ঠিক মাসখানেক আগেই দশদিন ধরে হয়েছে গণপতি উৎসব। সেই সময়ও স্কুল-কলেজ-অপিস স-ব খোলা থাকে। কিন্তু তাতে উৎসবের আনন্দে এতটুকুও ভাটা পড়ে না। মহারাষ্ট্রে গণপতি উৎসব সত্যিই আমাদের দুর্গা পুজোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। মারাঠী অমারাঠী প্রায় প্রত্যেকে বাড়িতে ‘গণপতি বসায়’। তাছাড়া আছে ছোট বড় সব সোসাইটির পুজো। এমন কি স্কুল-কলেজ-অপিসের প্রত্যেক ডিপার্টমেন্টেও আলাদা আলাদা পুজো। এর ওপর তো আছে বিভিন্ন ‘মণ্ডলের পুজো’।

সারাদিন বাড়ির পুজো, উপবা্‌স, রকম রকম ‘প্রসাদ’ তৈরী করে নিয়ম মাফিক ঠিক সময়ে সবাই যে যার কাজে যায়। সেখানেও নিয়মিত কাজের ফাঁকে এই দশদিন দৈনিক পুজো-আরতি-রঙ্গোলি-প্রসাদ। একেকদিন একেকজনের ভাগে পড়ে সেদিনের প্রসাদের দায়িত্ব। প্রত্যেকের কাছে চাঁদা নিয়ে মূর্তি আনা থেকে সাজানো গোছানো সব হয়। বড় ডিপার্টমেন্ট হলে একেকদিনে একাধিক সদস্য প্রসাদের ব্যবস্থা করেন। ঠিক একই ভাবে হয় সোসাইটির পুজো। সেখানে অতিরিক্ত আকর্ষণ রোজ কিছু না কিছু অনুষ্ঠান। আজ বাচ্ছাদের স্পোর্টস্‌, কাল বসে আঁকো প্রতিযোগিতা, পরশু নাচ-গান বিচিত্রানুষ্ঠান, তারপরদিন রঙ্গোলি প্রতিযোগিতা, তারপর ‘Go as you like’ আর সবার ওপর Housie তো আছেই।

এই কদিন বাচ্ছাদের হোম ওয়ার্ক করার জন্যে আলাদা করে বলতে হয় না। বিকেলের মধ্যে সব সারা। তারপরই ‘আজ নিচে কি আছে মা?’ সেই প্রতিযোগিতায় বাচ্ছাদের উৎসাহর অন্ত নেই। মায়েদেরও। কে জিতল, কে ফার্স্ট হল? শেষদিন প্রাইজ দেওয়া হত। সেই নিয়েও কত জল্পনা কল্পনা। কি প্রাইজ দেওয়া হবে। বড়দেরও প্রাইজ আছে কি না। আর তারপর কম্যুনিটি ডিনার। বাইরে থেকে লোক ভাড়া করে রান্না করানো হবে। সেদিন আবার কেরালার লোকেদের ‘ওনাম’, তাদের দ্বিগুণ আনন্দ। এই দশদিনের ভেতর একদিন আবার হবে সত্য নারায়ণ পুজো। এটা একটা অবশ্য পালনীয় রীতি। নিচের আরতি, অনুষ্ঠান শেষ হলে আবার প্রতিবেশীদের ঘরে যাওয়া হত আরতিতে। না গেলেই ডাকতে আসত। সন্ধ্যেবেলা একবার বাড়ি থেকে বেরোলে কাউকেই আর কিছু বলতে হত না। এবার এর ঘরে, এবার ওর ঘরে, বাড়ি আসতে আসতে সন্ধ্যে কাবার। এই দশদিন ধরে সকাল বিকেল আরতি করতে করতে আমাদের অন্তত একটা মারাঠী ভজন শেখা হয়ে যেত। গণপতি উৎসব সত্যিই সবার মনে একটা একতার ভাব জাগায়। হিন্দু-মুসলিম-কৃশ্চান সবাই মিলে এসে যোগ দিত দশদিনের এই মহোৎসবে।

বাড়ি, অপিস-কাছারি, সোসাইটি সব সামলে এবার সবাই বের হত বড় বড় প্যান্ডেলের ঠাকুর দেখতে। কি তার সাজসজ্জা, কি তার আলোর রোশনাই! সারারাত ধরে চলত লোকের ঢল। কিন্তু পরের দিন সকাল থেকেই আবার সবাই যে যার রুটিন কাজে। সেখানে কোনও কামাই নেই, কোনও ফাঁকি নেই।

পুণা মারাঠী সংস্কৃতির মুলকেন্দ্র। আর গণপতি উৎসবকে নতুন করে জনপ্রিয় করার মুখ্য কারিগর লোকমান্য তিলকের বাসও ছিল এই পুণায়। তাছাড়া পুণা মারাঠীবীর শিবাজীর ছোটবেলার বাসভূমি। দাদাজী কোণ্ডদেবের ছত্রছায়ায় এই পুণার লালমহলেই জিজামাতার কাছে বড় হয়েছেন শিব্বারাও। কসবা পেঠের গণপতিকে স্বয়ং জিজামাতা পুজো করতেন। কাজেই মুম্বাই, নাসিককে ধরলেও গণপতি উৎসবে সম্মানের দিক থেকে পুণা এক কদম এগিয়ে।

গণপতি বিসর্জনও এখানে এক দেখবার মত ব্যাপার। দশদিন ধরে মহা সমারোহে পুজোর পর ধূমধাম করে ভাসান। পুণার পাঁচ জায়গার গণপতিকে বলা হয় ‘মানাচে গণপতি’ অর্থাৎ তাদের ‘মান’ সবার চেয়ে ওপরে। লোকমান্য তিলক নিজে ঠিক করে দেন এই মানের ক্রম। স্বাভাবিক কারণেই জিজামাতার পুজো করা ‘কসবা গণপতি’র স্থান এক নম্বরে। ইনি পুণার প্রধান বা ইষ্ট দেবতা। এরপর আছেন গ্রাম দেবতা ‘তাম্বে যোগেশ্বরী’। তাই এই যোগেশ্বরী মন্ডলের গণপতির স্থান দ্বিতীয়। এরপর ‘গুরুজী তালিম’ বা আখড়ার গণপতি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি বজায় রাখার ব্যাপারে এই তালিমের বিরাট অবদান। পদমর্যাদায় চতুর্থ হলেও আকারে সবার বড় সারস বাগের গণপতি। আর পঞ্চমে আছেন তিলকের প্রতিষ্ঠিত ‘কেসরি ওয়াড়া’ বা ‘কেসরি’ ভবনের গণপতি। ১৮৮১ সালে লোকমান্য তিলক এই পত্রিকা প্রকাশ করেন তাঁর লেখার মধ্যে দিয়ে দেশবাসীকে স্বদেশমন্ত্রে উদবুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে।  

বিসর্জনের দিন সকাল থেকে সব পূজা মন্ডপ শুনসান। তখন অন্য জায়গায় অন্য এক কর্মযজ্ঞ চলছে। গণপতি বিসর্জনের শোভাযাত্রার জন্যে তখন তৈরী হচ্ছে রথ। সেও একেক মণ্ডলের একেকরকম রথ, একেকরকম আলোর সাজ। আর বেশ কিছুকাল আগে থেকেই সব তালিমের ছাত্রছাত্রীরা মহড়া দেয় শোভাযাত্রায় তাদের বিভিন্ন কসরৎ দেখানোর, ঢোলক বাজানোর জন্যে। পুণাবাসীর কাছে এ এক বিরাট সম্মানের ব্যাপার। সন্ধ্যে থেকে সারারাত চলে এই শোভাযাত্রা আর কসরৎ। রাস্তার দুধারে মানুষের ভীড় এই শোভাযাত্রা দেখার জন্যে। তারপর ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে পরপর ক্রম অনুসারে ওই পাঁচ গণপতির নদীতে বিসর্জন হয়। এরপর অনুমতি পায় বাকি মন্ডল তাদের গণপতি বিসর্জন দেবার।

ছোটখাট সোসাইটির গণপতি বিসর্জনের অন্য ব্যবস্থা। তাদের অনন্ত চতুর্দশীর দিন সকাল থেকেই বিসর্জন হয় নির্দিষ্ট জায়গায়। আর বাড়ির গণপতি যে যার সাধ্য মত একদিন, তিনদিন, পাঁচদিন পরেও বিসর্জন দিয়ে দেন। এখন আবার বহু জায়গায় Eco-friendly মূর্তি। তারা বাড়িতেই জলের বালতিতে সেই গণপতি বিসর্জন দিয়ে সেই জল নিজেদের বাড়ির গাছের গোড়ায় দিয়ে দেন। আমাদেরও ছেলেরা একবার বাবার সঙ্গে আঁকার ক্লাস থেকে ফেরার পথে একটা প্রতিমা নিয়ে বাড়ি এল। তবে সেই প্রতিমা বিধি মেনে পুজো শুরু করা হয় নি। প্রতিদিন বাড়ির ঠাকুরকে পুজো করার সময় যেমন গণেশের পুজো হয় সেভাবেই পুজো করা হত, তাই সেই প্রতিমার বিসর্জনও হয় নি।

 বোস বাড়ির মহালয়ার নামগানের ধারা বড়মার পর মা আর মায়ের পর কাকিমা বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু পুণায় এসেও মহালয়ার দিন ভজন-কীর্তন মা বন্ধ হতে দেন নি। তবে তখন আর নামগান শুধুমাত্র ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ ধ্বনিতে সীমাবদ্ধ নেই। ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ মন্ত্র মেনে তখন মহালয়ায় ঠাকুরের গান করা হত। তবে প্রথম বার ওই মন্দিরের রাধাকৃষ্ণের পুজারী মহারাজকে ধরে মা আর বাপী পুষ্পাদি নামে একজন ভক্ত মহিলার সন্ধান পান। তাঁর ‘কীর্তনের দল’ এসে মহালয়ার দিন ওই মন্দিরেই ‘হরে কৃষ্ণ’ নাম করে।

মন্দিরে নামগানের মধ্যেই দেখি কোথা থেকে সব শিবঠাকুরের বাহনেরা সেজে গুজে গায়ে, সিং এ আলপনা কেটে গলায় ঘণ্টা ঝুলিয়ে লাইন করে জটাবাবার সঙ্গীর সঙ্গে বেড়াতে বেরিয়ে পড়ল। আবার কিছুক্ষণ পরে ফিরেও এল। পরে শুনলুম ওইদিন ওখানে ‘বৈল পূজন’। ওদেশের এক নতুন রীতি জানা গেল। আরও জানা গেল ওখানে আমাদের মত শুধু মহালয়ার দিনই তর্পণ হয় না, পিতৃপক্ষের পুরো পনেরো দিন ধরেই তিথি অনুযায়ী হয় পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণ। কারুর তিথি বাদ পড়ে গেলে বা বিশেষ কোনও কারণ থাকলে শেষে অমাবস্যায় তর্পণ করা হয়।

পরের বার আমাদের ফ্ল্যাটেই সোসাইটির সব মহিলারা এসে তাঁদের নিজের নিজের প্রদেশের প্রচলন অনুযায়ী কিছু কীর্তন গান করেন। তাতে ‘কিষণজী, গোপালা’র গান যেমন ছিল ‘মাতারাণী’র ভজনও ছিল। আর কুমার আন্টি আর তাঁর সাসুমা মিলে কিছু পাঞ্জাবী কীর্তনও শুনিয়ে দিলেন। এরপর আসেন ‘নারাণের বাবা’ – তিনি ইস্কনের একজন কর্মী প্রচারক। তাই তিনি এসে মায়ের মনমত ‘হরে কৃষ্ণ’ নাম শুনিয়ে যান। যদিও তারসঙ্গে বৌদি, বৌদির মা মাসিমা, গানের দিদি এঁরা এসে পরের দিকে বাংলা রবীন্দ্রসঙ্গীত বা অন্য কোনও ভক্তিগীতি গাইতেন। কিন্তু নিয়ম করে প্রতিবছর মহালয়ার অনুষ্ঠান ঠিকই হয়েছে। যদিও তখন গাইয়ের চেয়ে শ্রোতার সংখ্যাই অনেক বেশী।

গণপতি উৎসব আর দিওয়ালীর মধ্যে স্যান্ডুইচ হয়ে স্কুল কলেজে দুর্গা পুজোয় ছুটি তো দূরস্থ রীতিমত 1st Term আর Mid-semester exam চলত। আমি তবু পরের দিকে অষ্টমী বা নবমীর দিন সুবিধে মতো ছুটি নিয়ে নিতুম কিন্তু ছেলেদের অষ্টমী-নবমীতে প্রতি বছর অঙ্ক নয়তো সাইন্স নয়তো সোসাল স্টাডিস পরীক্ষা থাকত। কাজেই অষ্টমীর অঞ্জলি তো দূরের কথা পুজোর মধ্যে বসে বসে পরের দিনের পরীক্ষার পড়া তৈরী করতে হত। তবে ইস্কুল থেকে ফিরলেই চান করে নতুন জামা পরে দাদু-ঠাম্মার সঙ্গে তারা দুপুরে বিচক্ষণায় ভোগ খেতে যেত। আমি হয়তো তখনও কলেজ থেকে ফিরি নি।

সন্ধ্যেবেলা তাড়াতাড়ি করে পরের দিনের পরীক্ষার পড়া তৈরী করেই পুজোপ্যাণ্ডেলে ফাংসন দেখতে যাবার তাড়া। এখানেও সেই পঞ্চমী থেকেই ব্যস্ততা শুরু। সকালবেলা যেমন বিচক্ষণায় অঞ্জলি দেওয়া, ভোগ খাওয়া, সন্ধ্যেগুলো মোটামুটি আনন্দমের পুজোয়। পঞ্চমীর দিন আনন্দমে আনন্দমেলায় যাবার তাড়া। একটু দেরী হয়ে গেলেই স-ব খাবার শেষ। এদিকে স্কুল-কলেজে যেমন পরীক্ষার গুঁতো কর্তামশাইএর অপিসে তার চেয়েও বড় Audit এর গুঁতো। অপিসের Annual return সামলে সে যতক্ষণে এসে পৌঁছতো তার ঢের আগে মা-বাপী আর ছেলেদের নিয়ে আমি পৌঁছে যেতুম মাঠে। পরের দিকে কুপন কাউন্টারেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এদিকে খাবারের স্টল ফাঁকা। বাড়ি থেকে টিফিন বক্স নিয়ে গিয়ে খাবার কিনে রাখা হত। ছোটবাবুর প্রধান আকর্ষণ ছিল চিকেন ললিপপ। ওই কদিন রোজ তার চিকেন ললিপপ চাইই চাই। এদিকে ওই রঙ দেওয়া খাবার খেলেই তখন তার শরীর খারাপ হবেই।

অনেক দিন ফাংসন শেষ হবার পরেও আমরা চুপচাপ ফাঁকা মাঠে ঠাকুরের সামনে বসে থাকতুম। ছেলেরা তখন পুজো প্যাণ্ডেলে সদ্য পাতানো বন্ধুদের সঙ্গে স্টেজের ওপর উঠে নয়তো সারা মাঠে খেলা করতে প্রচন্ড ব্যাস্ত। পরের দিন যে ভোরবেলা উঠে স্কুলে পরীক্ষা দিতে যেতে হবে সে কথা না তাদের মনে থাকে না আমাদের। নবমীর রাতে একটু নিশ্চিন্ত। কিন্তু সেদিন পুজো শেষের দুঃখে মনটা ভার।

পুণার পুজোর ফাংসনে কলকাতা থেকে কোন না কোন আর্টিস্ট আসতেন – রাঘব চ্যাটার্জী, জয়তি চক্রবর্তী, রূপঙ্কর, শ্রীকান্ত আচার্য। ওনাদের দিন ভাগ করা থাকত পর পর। আজ আনন্দম, কাল কর্পোরেসন, পরশু খাড়কি তার পরেরদিন কোরেগাঁও পার্ক। অনেক সময় মুম্বাইতে ফাংসন করে তারপর আসতেন পুণা বা পুণা থেকে মুম্বাই যেতেন। তাছাড়া নিজেদেরও নাচ-গান, নাটক থাকতো।

বৌদিরা প্রতি বছর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কোনও না কোনও নৃত্যনাট্য করত মধুমিতাদির পরিচালনায়। বৌদি থাকত গানে, ফুলনদেবী নাচে আর মাঠের পেছনে ঘাড়ে করে handycam নিয়ে ছবি আর ভিডিওর দায়িত্বে ডাকুদাদা। নবমীর প্রোগ্রাম শেষ হলে দাদারা আর আমরা দুটো গাড়ি নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোতুম। মোটামুটি কয়েকটা ঠাকুর দেখা হতই। এমন কি আগে নিজেরা দেখলেও আবার করে একসঙ্গে যাওয়া হত। সেই মজাটাই আলাদা। ওই কর্পোরেসন, AFMC, খাড়কি, কোরেগাঁও পার্ক আর পরে পরে যোগ হল হড়পসার। একেকসময় দূর থেকে আলো দেখে হয়তো গিয়ে দেখা যেত সেখানে নবরাত্রি পালন হচ্ছে – সেখানে মা সিংহবাহিনী নন, মা শেরাওয়ালী।

পুজো প্যাণ্ডেলে যাওয়ার ছেলেদের প্রধান আকর্ষণ যেমন চিকেন ললিপপ, চিকেন রোল, মোগলাই পরোটা, আমার জন্যে ঠিক সেই রকম খাড়কি কালীবাড়িতে কলকাতার পাবলিসার্স-বুক সেলার্স গিল্ডের বাংলা বইএর স্টল। পুজো মানেই একগাদা বাংলা বই কেনা। কলকাতা বইমেলায় না যেতে পারার দুঃখ ওই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। আবার কোরেগাঁও পার্কের স্টল থেকে কেনা হত সে বছরের পূজাবার্ষিকী আর বাংলা গানের সিডি। কিছু পোড়া মাটি আর জুটের গয়নাও কিনেছিলুম একবার কর্পোরেসনের পুজো দেখতে গিয়ে।

প্রথম যেবার ছোটবাবু বিচক্ষণায় ষষ্ঠীর দিনের উদ্‌বোধনী অনুষ্ঠানে গানের দলে ভিড়লেন তখনও উনি পড়তে শেখেন নি। কোরাসের দলে ওরা সব দুধভাত। কিন্তু বড়বাবু খুব সিরিয়াস মুখ করে গানের সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করলেন। আমি সেবার স্টেজে এই সব আণ্ডাগাণ্ডা সামলানোর দায়িত্বে। তবে পরের সরস্বতী পুজোয় ছোটবাবু একটা সোলো গান করেছিলেন – ‘লাল নীল সবুজের মেলা বসেছে’। আর সেবার দুর্গাপুজোয় আনন্দমে নাটকে পেল স্বামী বিবেকানন্দর ছোটবেলার গল্পে ‘বিলের বন্ধু’র পার্ট। পরের বছর ‘ভাড়াটে চাই’ নাটকে করল ভাইপোর পার্ট। এক্কেবারে মায়ের যোগ্য ছেলে! এক লাইন পড়া মুখস্থ হয় না, এদিকে নাটকের ডায়লগ সব ঝরঝরে মুখস্থ! ছেলের বাবাও মহা উৎসাহে ক্যামেরা, handycam সব নিয়ে রেডি। ‘ভাড়াটে চাই’ নাটকে আবার বাবা ছবি এঁকেছিল -নাটকের সেট।

আনন্দমে দুপুরবেলা যে সব প্রতিযোগিতা হত তার মধ্যে ছেলেরা বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় নাম দিত। বড়বাবু তো  প্রায় পুরো সময় ধরে পেন্সিল দিয়ে এঁকেই যাচ্ছে। সে উদ্যোক্তাদেরই টেনসন। সময় শেষ হতে চলল এবার তুমি রঙ করা শুরু করো। সে কে শোনে কার কথা! কিন্তু শেষ দশ মিনিটের মধ্যে রঙ করে আঁকা কমপ্লিট। সেও তার বাবার ছেলে। আঁকায় একটা প্রাইজ নিয়ে বাড়ি আসতো। সেবার প্রাইজ দিল Crossword এর কুপন। পুজো প্যাণ্ডেল থেকে বেরিয়ে বই কিনে তবে বাড়ি ফেরা। ছোটবাবুর তো সবই বড় বড় ব্যাপার! বাচ্ছাদের মত রঙ করতে তাঁর ভাল লাগে না। তিনি পেন্সিল সেড করেন! স্বাভাবিক ভাবেই ওই রঙচঙে ছবির ভীড়ে তাঁর পেন্সিল সেড মাঠে মারা যেত সে আঁকা যতই ভাল হোক!

ছেলেদের নাটক, গান, পরের বছর বিচক্ষণায় আমার গান – আবার সেই বিধান নিবাসের ছোটবেলার দিনগুলোর ফিরিয়ে নিয়ে গেল। সেই রোজ তাড়াহুড়ো করে কলেজ থেকে ফিরেই রিহার্সালে যাওয়া, একসঙ্গে হৈ হৈ করে সময় কাটানো, রোজকার গতানুগতিক জীবনে একটু ব্যাতিক্রমের স্বাদ।

মারাঠীরাও প্রধানতঃ চৈত্র গৌরীর পুজো করে, মানে আমাদের বাসন্তী পুজো। তবে এই নবরাত্রিতেও বাড়িতে ঘটস্থাপন হয়। কিন্তু আমাদের মত অষ্টমীর উপোস নেই। মারাঠী উপবাস মানে রকম রকম ভাল ভাল খাবার – সাবুদানা খিচড়ি, সাবুদানা বড়া, আলুর বা রোতাড় (মানে রাঙাআলু)র নোনতা খাবার, থালপিঠ ( চিল্লা), ভোপড়া (কুমড়ো) দই দিয়ে smoothy। তবে উত্তর ভারতীয়রা নবরাত্রির উপোস করে। আর রাজস্থানী, গুজরাটি এরা মাতে ডাণ্ডিয়া নিয়ে। একবার আমাদের সোসাইটির সব মহিলারা বললেন নবরাত্রিতে ডাণ্ডিয়া করা হোক। তবে সবাই জানত আমরা বাঙালিরা ষষ্ঠী থেকে দশমী নিজেদের দুর্গা পুজো ছেড়ে আর কিচ্ছু করতে রাজি নই।

পুণায় এসে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বললুম সেকি তোমরা বিশ্বকর্মা পুজো করো না! যন্ত্রপাতি পুজো করবে না! বলল সে তো নবমীর দিন হবে আয়ূধ পূজন্‌। সে আবার কি? বলল ‘আরে সেই যে সেই বিরাটের যুদ্ধে অর্জুন আয়ূধ পুজো করে তারপর একাই পুরো কৌরব সেনাকে হারিয়েছিল জানো না!’ ‘হ্যাঁ সে তো জানি।‘ সেই, নবমীর দিন হল সেই তিথি। ওই দিন হবে সব যন্ত্রপাতি, কম্প্যুটারের পুজো – আধুনিক যুগের ‘আয়ূধ’। আর ওদের নাকি তুক আছে। নবমীর দিন সকাল থেকে সবাই খুব ভয়ে ভয়ে চুপচাপ থাকে। বলে ‘খন্ড নবমী’ কার ওপর দেবী চন্ডীর ভর হবে – তুলকালাম ঝগড়া হবে তার সঙ্গে। সকাল থেকে সব ওৎ পেতে থাকে। আর মাঝে মাঝেই খবর আসতে থাকে অমুক খেপেছে আজ। খুব চেঁচাচ্ছে। সেই শুনে বাকিদের কি শান্তি – এবারের মত ফাঁড়া কাটল!

তবে মারাঠী মেয়েদের সঙ্গে আমাদের কার্তিক ঠাকুরের মোট্টে সদ্ভাব নেই। সেই যে সেই গণেশ ঠাকুর পৃথিবী প্রদক্ষিণ করার সময় চালাকি করে মা-বাবার চারদিকে টুক করে (তাও একবার নয় তিন তিনবার) ঘুরে কার্তিক ঠাকুরকে গো হারান হারিয়ে দিয়ে কার্তিক ঠাকুরের বিয়ে করাটাই পণ্ড করে দিলেন না! আর এই মারাঠী মেয়েগুলো সেই গণেশকে নিয়েই মাতামাতি করে, কার্তিকের কি সহ্য হয়! কার্তিকঠাকুরও সেই রাগে মারাঠী মেয়েদের মুখদর্শন করেন না। আমাদের দুর্গা পুজো দেখতে এসে ওদের সব কি বিস্ময়! সেকি, তোমরা কার্তিক ঠাকুরের মুখ দেখো? ও মা, কেন দেখব না! কার্তিক ঠাকুর বলে কি না আমাদের হিরো! সুন্দর দেখতে ছেলে হলেই আমরা বলি আহা যেন ‘লব কাত্তিক’! কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে পুত্র কামনায় কতজনের বাড়িতে জোড়া কার্তিক পুজো হয়! ওরা বললে, না বাপু আমাদের তো পুণায় মাত্র একটাই কার্তিকেয় মন্দির আছে, তাও সে সেই পর্বতীর ওপরে এক পাশে। সেদিকে মেয়েদের এমনি সময় যাওয়া বারণ। কেবল দিওয়ালীর পরের পুর্ণিমায় ‘দেবদিওয়ালির’ দিন সারা রাত ধরে আমাদের মেয়েরা পুরো পর্বতী প্রদীপ দিয়ে সাজায় আর সেই দিন শুধু মেয়েরা কার্তিকেয়র মন্দিরে গিয়ে জন্মদিনে কার্তিকের পুজো করতে পারে।

দশমীর দিন হয় ওদের সরস্বতী পুজো। রঙ্গোলি দিয়ে সব সরস্বতী যন্ত্র আঁকে। সেদিন সবাই বাড়ির দরজায় ঝেণ্ডু (গাঁদাফুল) আর দেবদারু পাতা দিয়ে তোরণ লাগায়। আর সবাই পরস্পরকে সোনা দিয়ে সুখ-সমৃদ্ধি কামনা করে। আজকের এই মাগ্যি গন্ডার দিনে সোনা আর কি করে দেবে! তাই কাঞ্চন পাতা দিয়ে ‘কাঞ্চনদানের’ পুণ্য অর্জন করে।

পুণায় বিচক্ষণা দুর্গার সঙ্গে আমাদের যেন একটা অদৃশ্য বন্ধন আছে। আমাদের অনেক ভাল-মন্দের সাক্ষী ওই দুর্গামা। পুণার প্রথম সকালে ঘুম ভাঙ্গা যেমন ওই পুজোর ঢাকের আওয়াজে, তেমনি প্রথম ফাংসন করা, অষ্টমীতে অঞ্জলি, ভোগ খাওয়া, সন্ধিপুজোয় প্রদীপ জ্বালানো, দশমীতে মা কে সিঁদুরদান আবার ছেলে পুজোর সময় দেশের বাইরে গেছে বলে মায়ের অভিমানে চোখের জল ফেলা, কলকাতা থেকে সপ্তমীতে যখন খবর এল ঠাম্মা চলে গেছেন, তখন আমার মন খারাপ, কলকাতায় না যেতে পারার দুঃখ, অনেক নীরব চোখের জলের সাক্ষীও এই মা দুর্গা। আবার এই বিচক্ষণা দুর্গার সঙ্গেই ছেলেদের নিয়ে বিসর্জনে যাওয়া, নতুন বন্ধুদের সঙ্গে নদীর ঘাটে ওদের ঢাক বাজানো, ঠাকুর ভাসান দেখার অভিজ্ঞতা আমাদেরও আবার সেই পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া।

কোজাগরী পূর্ণিমার দিন মারাঠীরা খোলা আকাশের নিচে দুধ ফুটিয়ে তারপর চাঁদের দিকে তাকিয়ে সেই দুধ খায়। পূর্ণিমার চাঁদের কিরণের সঙ্গে ওদের জীবনেও সুখ-সমৃদ্ধি পূর্ণ হয়ে ওঠে। পুণায় লক্ষ্মীপুজো মানেই অমৃতাদের বাড়ি যাওয়া। ওদের বাড়ির পুজো মানে যেন আমাদের নিজেদেরই বাড়ির পুজো। ওদের বাড়ি ছেলেদেরও অবাধ স্বাধীনতা। কলকাতা থেকে আত্মীয়স্বজন এলে নির্দ্বিধায় আমরা তাদেরও নিয়ে চলে যেতুম ওদের বাড়ির পুজোয়।

আর কালীপুজো – সেও আরেকরকম মজা। দিওয়ালী মহারাষ্ট্রে খুব বড় উৎসব। মূলতঃ পাঁচদিন ধরে পুজো – ধনলক্ষ্মী, ধান্যলক্ষ্মী, মহালক্ষ্মীর কাছে সবার জন্যে কায়িক, মানসিক এবং আত্মিক মঙ্গল কামনা। শুরু সেই ত্রয়োদশীতে – ধনতেরাস। না সোনা কেনাই সেদিনের মূল উদ্দেশ্য নয়, মূলতঃ ওই দিন ধন্বন্তরির পুজো – সকলের সুস্বাস্থ্যের কামনায়, কারণ স্বাস্থ্যই সম্পদ। নরকচতুর্দশীর দিন নরকাসুর বধ অর্থাৎ জীবাত্মাকে অজ্ঞানরূপী নরকের হাত থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা। অমাবস্যায় মহালক্ষ্মী পুজো। পরের দিন বলিপ্রতিপদ – ওই দিন দৈত্যরাজ মহাবলির একদিনের জন্যে মর্ত্যে পুনরাগমন তিথি। ভগবানের প্রতি ভক্তের সম্পূর্ণ শরণাগতির চূড়ান্ত নিদর্শন। আর সব শেষে ‘ভাউ বীজ’ অর্থাৎ আমাদের ভাইফোঁটা।

স্কুল-কলেজ-অপিস সব ছুটি। দাদারা আর আমরা মিলে কাছাকাছি কোথাও বেড়াতে যেতুম। আমাদের বিজয়ার পর যেমন আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে মিলন উৎসব, মারাঠীদের দিওয়ালীতে সেই রকম রেওয়াজ। বাড়ি বাড়ি রকমারি নোনতা-মিষ্টি তৈরী করে পরস্পরের সঙ্গে আদানপ্রদান। মারাঠী বাচ্ছারা বাড়িতে সব মাটি দিয়ে ‘কিল্লা’ বানায়। তার গায়ে গায়ে ছোট ছোট পুতুল দিয়ে সিংহাসনে শিবাজী মহারাজ, চারপাশে তার সৈন্য সামন্ত, গাঁওয়ের লোকজন তাদের নানা পসরা নিয়ে, সঙ্গে গরু ঘোড়া – ওরা সবাই ফিরে যেত তাদের সেই বীরত্বের অতীতে।কালীপুজোয় বাজী পোড়ানোর পর রাতে আনন্দমের পুজোয়ও যাওয়া হত সবাই মিলে।

পরদিন হত আমাদের বাড়িতে ওই মা অন্নপূর্ণার অন্নকূট। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই পুজোয় অনেক পরিবর্তন হয়েছে, তবু দেবতা জানেন ভক্তের মনের কথা!

Posted in Uncategorized

ড্যামকুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে -৩

বড়িষা পর্বঃ

বাংলাদেশে প্রচলিত প্রবাদ দুর্গাপুজোর সময় মা দুর্গা ছেলে-মেয়ে নিয়ে সেই কৈলাস থেকে পাঁচদিনের জন্যে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসেন। আর বাংলার ঘরের মেয়েরাও সেই উপলক্ষ্যে তাদের বাপের বাড়ি যাওয়ার ছুটি পায়। বিধান নিবাসের পুজোয় এত্তো মজা যে এখানে দিদিরা, পিসিরা সবাই পুজোর সময় সপরিবারে এসে পুজোয় সামিল হতেন। কিন্তু পুজোর ম্যাজিক কাটিয়ে বৌদিরা কিংবা মা-কাকিমারা কেউই বিশেষ বাপের বাড়ি যেতেন না। নিজেদের ‘বাড়ির পুজো’ ছেড়ে কি কেউ কোথাও যায়! বিধান নিবাস তো সবাই মিলেই বিরাট এক পরিবার।

কিন্তু বিয়ের পর দেখলুম আমি বাপের বাড়ি চলে গেলে শ্বশুরবাড়িতে সবার ফাঁকা মনে হয়। আর সবাই আমায় অভয় দিলেন দেখবে এখানে তপোবনের পুজো একদম নিজেদের বাড়ির পুজোর মতই। ওদিকে বিধান নিবাসে কাকু-কাকিমারা দেখা হলেই বলেন, ‘কি রে পুজোর কদিন এখানেই থাকছিস তো?’ এই দোটানায় ভাগাভাগি করে একবার উল্টোডাঙা একবার বড়িষা করেই পুজো কেটে যায়।

কোন কিছুই শুধুই ভাল বা শুধুই মন্দ হয় না। প্রথম বছর ঠিক পুজোর সময় মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। কিন্তু সেখান থেকেই রোজ বাপীকে বলে দিতেন বাড়িতে নতুন বৌ এসেছে, কি কি বাজার হবে, কি কি রান্না হবে। সেই মত সপ্তমীর দিন বাপীও দু-তিন রকম মাছ বাজার নিয়ে এসেছেন। এদিকে রান্না করার পদ্মদি ডুব! বাপীর তো মাথায় হাত। আমি তো রান্নায় দ্রৌপদী! শেষে মুশকিল আসান আমার হাজারি ঠাকুর। অবশ্য প্রথমেই বাপীর ওপর বেশ একচোট চেঁচামিচি করে একটু এনার্জি করে নিল। তারপর নিজেই সমস্ত মাছ ধুয়ে বেছে সবজিপাতি কেটে কুটে তরিবৎ করে সব রান্না করে ফেলল। পদ্মদিকে থোড়াই কেয়ার!

বোসবাড়িতে দেখতে গেলে পুজো শুরু হত সেই মহালয়া থেকে। সেদিন মা ঘরে ঠাকুরের ‘নামগান’ করাতেন। তার দুচারদিন আগে থেকে কানাইকে দিয়ে ঘরদোর ঝাড়াঝাড়ি। টেবিল, সোফা নাড়ানাড়ি। ঘর খালি করে জায়গা করতে হবে। কদিন আগে থেকে মা হারমোনিয়াম বের করে নানান সুরে নানান রাগে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ গাইতেন। আমার তো চিরকালের ধারণা ‘হরে রাম হরে কৃষ্ণ’ একটাই সুর, থুড়ি বেসুর! তার আবার যে এত রাগরাগিনী এত সুর জানা ছিল না। বাংলা হিন্দি বহু প্রচলিত গানের সুরেও এই নামগান গাওয়া হত।

মা বাপী রাত থাকতে উঠে কোনরকমে এক কাপ চা খেয়ে মহালয়া চালিয়ে দিয়ে শুরু করে দিতেন ঠাকুরের আসন সাজানো। যাতে বৃষ্টি না হয় তার জন্যে মহাবীরের জন্য স্পেশাল কলার ছড়া আর লাড্ডু দেওয়া হত। একটু বেলা হতেই তর্পণের কাজ সেরে ‘মাধবীদি’ এসে নাম শুরু করে দিয়ে যেতেন। নাম একবার শুরু হলে মাঝে বন্ধ দেওয়া যাবে না। একের পর এক মায়ের দলের মহিলারা এসে নাম ধরতেন। কতলোক যে আসতেন এই নামে। কারুর কারুর আবার নাম করতে করতে ‘ভর’ হত। সে এমন মাথা দোলতেন যে প্রথম প্রথম দেখে অবাক হয়ে যেতুম বই কি! মা আবার একবার বললেন অহোরাত্র নাম দেব। মানে সুর্যোদয়ের ২৪ মিনিট আগে থেকে সুর্যাস্তের ২৪ মিনিট পর অবধি।

নামগানের সঙ্গে থাকত মায়ের এলাহি খাওয়ানোর ব্যবস্থা। একবার ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে, একবার নাতি হাওয়ার জন্যে। সারাদিন একদিকে নাম হয়ে যাচ্ছে আর একদিকে ময়দা মাখা হচ্ছে তো হচ্ছেই, লুচি, আলুরদম, ছোলার ডাল, মিষ্টি। যাওয়ার সময় আবার সবার হাতে হাতে জলখাবারের প্যাকেট। বাপী, কাকিমা, কাকু তো বটেই বড় জেঠু যতদিন সুস্থ ছিলেন ব্যবস্থাপনার কাজে, লোকজন সামলানোর দায়িত্বে সমানে সারাদিন ব্যস্ত থেকেছেন। শুনেছি বাড়িতে এই নাম দেওয়া মূলতঃ বড়মার উদ্যোগেই শুরু।

শ্বশুরবাড়ি এসে আবার সেই টালার দিনগুলোতেই ফিরে গেলুম যেন। বাড়ি থেকে মা-কাকিমা, রিয়া-রিম্পা সবাই মিলে গিয়ে সকালে তপোবনে অঞ্জলি দেওয়া। একেকবছর রেশমীরাও আসত, ছোড়দারা থাকতেন। সবাই মিলে বাড়িতেই হৈ-হুল্লোড়, গল্প-আড্ডা, খাওয়া-দাওয়া আর গান-বাজনা। ঘুরে ঘুরে পাড়ার ঠাকুর দেখা – প্রথমেই তো ওই কলকাতার জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের পুজো। প্রধান হল ‘আটচালা’। ওই আটচালাতে বসেই সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের সঙ্গে ইংরেজদের চুক্তিপত্র সই হয়ে সূতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতার মালিকানা হস্তান্তর হয় আর সেই সঙ্গে ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের বীজবপণ হয়। যাই হোক, কাল তার নিজের গতিতেই বয়ে চলে। ১৬১০ সালে এই আটচালায় প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয় আর আজ অবধি সেই একই কাঠামোয় প্রতিমা তৈরী করে পুজো করা হচ্ছে। সেদিনের সেই আটচালা আজ ভেঙ্গে গেলেও সেই পুরোনো থামগুলো এখনও সেই একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে ইতিহাসকে সাক্ষী দিতে। শুনলুম নবমীর দিন ওখানে মোষ বলি হয়।

আটচালা ছাড়াও কাছাকাছির মধ্যেই আরও চার-পাঁচটা পুজো সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের – বড়বাড়ি, মেজোবাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকি বাড়ি। এছাড়া আরও কিছু পুরোনো সাবেকী পুজোও আছে। বাপীর সঙ্গে তো আমার প্রথম থেকেই ঠাট্টা-তামাসা, পেছনে লাগা চলে। ঠাকুর দেখে বাড়ি এসেই আমি পুজো মণ্ডপের নকলে ঘোষণা করতুম – ‘আমাদের এই বড়িষা গ্রামের শারদীয়া শ্রী শ্রী দুর্গা পুজায় আপনাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাই’। বাপীও রুখে উঠতেন – ‘গ্রাম! জানো এটা কলকাতা সাতলক্ষ আট!’ মা অবশ্য আমার দলে থাকতেন। বলতেন ‘কলকাতা না আরও কিছু! গ্রাম, গ্রাম!’

বড়িষার আরেক ‘high-voltage’ পুজো হল সৌরভ গাঙ্গুলিদের প্লেয়ার্স কর্ণারের পুজো। গাঙ্গুলি বাড়িতে মা চণ্ডীর ঘট স্থাপন করা বলে বাড়ির মধ্যে দুর্গা পুজো করা যায় না। তাই বাড়ির গেটের ঠিক বাইরের মাঠে এই দুর্গা পুজো। পুজো মণ্ডপে গেলেই সৌরভের ভাইবোন, কাকা-কাকিমাদের দেখা মিলত। সৌরভের কাকারা আমাদের ন’কাকা, ছোটকাকার সঙ্গে একই ক্লাবে ফুটবল খেলতেন। আর এখনও নিত্যদিন বাজারে দেখা হয়। আমাদের কাকারা বিশেষতঃ নকাকা ওনাদের আমলের ক্লাবের স্টার প্লেয়ার, সবাই চিনতেন। তবে পুজোপ্যাণ্ডেলে সৌরভকে দেখার সৌভাগ্য আমার কোনদিন হয় নি। লাল বাড়ির বিরাট গেট সব সময়ই বন্ধ। যদিও সেই গেটের ফাঁক দিয়ে ‘দাদা’র গুণগ্রাহীরা অনেক উঁকিঝুঁকি মারার চেষ্টা করতেন। পাশেই ডোনাদের হলুদ বাড়ি। ডোনা অবশ্য পরোক্ষভাবে আমার গোখেল কলেজের অঙ্ক অনার্সেরই ছাত্রী। ডোনার পার্ট টুর টেস্টের ইনভিজিলেসন করার অভিজ্ঞতা আমার আছে।

বড়িষা থেকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চৌরাস্তা, ব্লাইণ্ড স্কুল, ম্যান্টন পার হয়ে বেহালা ট্রাম ডিপো। ব্রাহ্ম সমাজ রোডে ঢুকে একটু এগিয়ে গেলেই কমরেড সোমনাথ চ্যাটার্জীদের বাড়ির সাবেকী পুজো। আমাদের যখন বিয়ে হল সেই বছর থেকেই শুরু হল তপোবনের ‘থিম পুজো’। সে বছর বহু জায়গাতেই গ্রাম বাংলা থিম। হবি ত হ’ তপোবন ক্লাবের পুজো সেবার Asian Paints শারদ সম্মান পেল। ব্যস্‌, হয়ে গেল পাড়ার পুজোয় গিয়ে একটু বসা, আরতি দেখা! সারা কলকাতা থেকে তখন লোকের ঢল – তপোবনের ঠাকুর দেখতে আসছে। আর রাস্তা জুড়ে অন্ধকার অন্ধকার চারটি হ্যারিকেন ঝুলিয়ে রেখেছে। গলির মুখ থেকে বাড়ি যেতে গেলেও বলে ‘NO ENTRY’ – ঘুরে যান! এমনিতেই নবমীর রাত মন খারাপ। তখন সেই বুবাকাকাদের বাড়ির সামনের পুজো প্যান্ডেলে দাঁড়িয়ে আরতি দেখা হল। আবার তো এক বছরের মত মায়ের কৈলাসে পাড়ি!

তারপর এল সুরঞ্জনদের বাড়ির পুজো। এর আগে তো ঘরোয়া পুজো, বাড়ির পুজো বলতে ওই বিধান নিবাসের পুজোই ছিল। তবে আমাদের M.Sc.র প্রফেসর মঞ্জুষাদির সল্ট লেকের ফ্ল্যাটে দুর্গা পুজো হচ্ছে শুনে বিধান নিবাস থেকে পুরো দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছিলুম ‘ফ্ল্যাটের দুর্গাপুজো’ দেখতে। কিন্তু রঞ্জুদের বাড়ির পুজো তো প্রায় নিজেদেরই পুজো! বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে দুর্গাপুজোর মত এত বড় পুজোর সব আয়োজন, উপাচার, ভোগ, রান্না-খাওয়া – সে এক এলাহি ব্যাপার। যত দেখছি তত যেন বিস্ময়ে আমার বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে! ওদের বাড়ি সবার যেন অবারিত দ্বার। সক্কলের কি আন্তরিক, অমায়িক ব্যবহার। আর কাকু তো একাই একশো। যে যাচ্ছে তাকেই সামনে বসিয়ে এক্কেবারে কবজি ডুবিয়ে খাইয়ে তবে ছাড়ছেন।

ভীড় আমাদের মোট্টে পোষায় না। অথচ পুজোর কদিন আনন্দ তো ফাঁকি পড়তে পারে না। সকালবেলা হয়তো গাড়ি নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়তুম লং ড্রাইভে। অবশ্যই ভীড়ের উলটোপথে – ডায়মণ্ডহারবারে। হয়তো সঙ্গে ছোটমামু। ভাগ্নের গাড়ি করে কলকাতার ঠাকুর দেখতে যাবেন বলে এসেছেন। ফাঁকা রাস্তায় ডায়মণ্ডহারবার গিয়ে ঠাকুর দেখতে না পেয়ে রেগে আগুন!

তবে ঠাকুর দেখতেও যেতুম। রাত্তিরবেলা। রিয়া, রিম্পা, ছোটমামু আর আমরা দুজন। ভবানীপুর আর খিদিরপুরের ঠাকুর। আর ভবানীপুর যাওয়ার পথে নিউ আলিপুর চেতলার কিছু ঠাকুর। সেই দেখলুম ভবানীপুর ২৩ পল্লীর বিরাট অষ্টধাতুর মা দুর্গা।

ছোটমামু সঙ্গে থাকা মানে পুরো ভীড় ঠেলে রাস্তা করে এক্কেবারে আগলে আগলে সঙ্গে নিয়ে যাবেন। খিদিরপুরের কত পুরোনো সব পুজো – কবিতীর্থ, ২৫ পল্লী, ৭৪ পল্লী। তার আশে পাশে ছোট বড় আরও কিছু ঠাকুর। ছোটমামু বাদ দিতেন না একটাও। সেই প্রথম দেখা দুর্দান্ত সব প্যাণ্ডেল। পোড়ো বাড়ি, ঠাকুর দালান, ভাঙ্গা দেওয়াল, দরজা, শ্যাওলা ধরা পাঁচিল – আসল নকল বোঝার উপায় নেই! সিনেমার সেট যে কত নিখুঁত হয় এ যেন তারই একটা ছোটখাট নমুনা।

বিয়ের পর থেকে নবমীর দিন দুপুরবেলা কোনও বড় হোটেলে – যেমন তাজ বেঙ্গল, Main Land China, খেতে যাওয়া এখন আমাদের একটা নিয়মের মত হয়ে গেছে। নাঃ, বিধান নিবাসে নবমীর মাংস-ভাত লাজুক জামাইএর কোনওদিন খাওয়া হয় নি। এখনও মোটামুটি পুজোয় একদিন বাইরে খাওয়া হয়ই।

সেবার হঠাৎ সিটি সেন্টারে ব্রিটানিয়ার লটারিতে পুজো পরিক্রমার সুযোগ এসে গেল। লটারিতে কখনই কোনও কিছু আমি পাই না। কাজেই কিছুই পাবো না ভেবেই কার্ড ভরেছিলুম। তাছাড়া সংসারে তখন আরেক নতুন সদস্যর আসার অপেক্ষা। কাজেই দু বছরের এক ছেলেকে ছেড়ে সারাদিনের মত পুজো পরিক্রমায় যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। বাড়িতে বড়রা কেউ মানবেনই না!

কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল সবাই রাজী! সল্ট লেকে কার্ড ভরা হয়েছে তাই উল্টোডাঙ্গা থেকে আমাদের বাসে উঠতে হবে। আর আমাদের ভাগে সাউথ ক্যালকাটার ঠাকুর দেখা। ছোট্ট নীলকে তার দিয়া-দাদাইএর জিম্মায় রেখে সকাল সকাল আমরা দুজনে উল্টোডাঙ্গার মোড়ে গিয়ে হাজির। আরও লোকজনও সব জড়ো হয়েছেন। কিন্তু ঘণ্টা পেরিয়ে যায় বাসের দেখা নেই! যত সব জালিয়াতি-জোচ্চুরি! বহু উৎকণ্ঠার পর অবশেষে বাস এল। শুরু হল আক্ষরিক অর্থে আমার দক্ষিণ কলকাতার ঠাকুর দেখা।

একডালিয়া, ম্যাডাক স্কোয়ার, দেশপ্রিয় পার্ক, মুদিয়ালী, যোধপুর পার্ক – আরও কত ঠাকুর যে সারাদিন ধরে দেখা হল! বাসে করে ঘোরা, বেড়ানো, খাওয়া তারপর সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে নামার সময় সবার হাতে একটা করে ব্রিটানিয়ার assorted cookies এর বড় ডাব্বা। স্মরণীয় হয়ে রইল আমাদের সেই বছরের দুর্গা ঠাকুর দেখা।

দশমীর দিন সবারই মন খারাপ। পুজো শেষ, ছুটি শেষ, মজা শেষ, রোজকার গতানুগতিক জীবন থেকে মুক্তি শেষ। তাই শেষ পর্যন্ত যতটুকু আনন্দ নিংড়ে নেওয়া যায় তার জন্যে পারলেই গাড়ি নিয়ে বাবুঘাটে যেতুম বিসর্জন দেখতে। সেই হাইকোর্টের পাশে গাড়ি রেখে ছোট্‌ ছোট্‌ গঙ্গার ঘাটের দিকে! সেবার দশমীর দিন বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে মা বাপী এমন কি ছোট্ট নীল সহ আমরা গেলুম বাবুঘাটে ঠাকুর বিসর্জন দেখতে। সেখানে তখন সামনে দিয়ে হুস্‌ করে চলে গেল এক্কেবারে ফাঁকা চক্ররেল। মনে হচ্ছিল একবার চেপে পড়লেই হয়। টুক করে একচক্কর ঘুরে আসা যায়! আসলে ভীড়ভাড় পছন্দ না হলেও যে কোনও রকম হুজুগে আমি এক পায়ে খাড়া।

সেবারের দুর্গা পুজোয় যেমন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা চুটিয়ে আনন্দ করেছি, মনে হয় কলকাতায় আরও কিছু আনন্দ, কিছু অভিজ্ঞতা তখনও আমাদের বাকি থেকে গিয়েছিল। কালীপুজোয় রঙ্গোলি আর মোমবাতি দিয়ে সারা বাড়ি সাজানো বোসবাড়ির আরেক রেওয়াজের মধ্যে পড়ত। ব্যাঙ্গালোর থেকে রেশমী প্রতি বছর কালীপুজোর জন্যে বড় ‘দিয়া’ পাঠাত, সঙ্গে ভাইঝিদের জন্যে জোর হুকুম যেন খুব ভাল করে আলপনা, রঙ্গোলি দেওয়া হয়। বাড়ির কোনও অংশ যেন বাতি দিতে বাদ না পড়ে। আর তারপর সব ছবি তুলে পিসিকে পাঠাতে হবে। কালীপুজোর দিন বাড়িতে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো। অলক্ষ্মী বিদায়। একবার আমি বানালুম চালের গুঁড়ো আর রঙ দিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণ-কুবের। ছোট থেকে মামার বাড়ির পুজোয় শুধু দাদিকে আর মাইমাকেই ঠাকুর বানাতে দেখেছি, আমাদের তো হাত দেবার অনুমতিই ছিল না। কি যে আনন্দ হয়েছিল সেবার! কালীপুজোর দিন আমরা, কাকু-কাকিমা, বড়দারা, ছোড়দারা, দিদিরা সবাই মিলে বোসবাড়ি এক্কেবারে জমজমাট। আর বোসবাড়িতে জমায়েৎ মানেই তো গান-বাজনা। আর সবাই মিলে একসঙ্গে বাজী পোড়ানো।

ছোট্ট নীলকে নিয়ে দিওয়ালীতে বেনারস গিয়ে বাবা বিশ্বনাথ – মা অন্নপূর্ণার অন্নকূট উৎসব দেখে এসে কর্তামশাইএর ইচ্ছে হল আমরাও বাড়িতে অন্নপূর্ণা পুজো করব। পুজোপাঠ এ মায়ের তো কোনওদিনই কোন আপত্তি নেই। আর বাপীর তো সব ব্যাপারেই সমান আগ্রহ। সেই সেবার প্রথম আমাদের বাড়ি অন্নপূর্ণা পুজো। থার্মোকল দিয়ে মন্দির বানিয়ে আলপনা দিয়ে সেই মন্দিরের গায়ে লাড্ডু আর সোনপাপড়ি দিয়ে দেওয়াল বানিয়ে নানা রঙের রকমারী মিষ্টি-নোনতা মুড়ি-মোয়া-নাড়ু-বাতাসা সব দিয়ে আমরা আমাদের মত করে আমাদের সাধ্য অনুযায়ী অন্নকূট পালন করলুম। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। তবে পরের বছর থেকেই সব পুজো, সব অনুষ্ঠান পালন করা নতুন ভাবে, নতুন আঙ্গিকে, নতুন শহরে।