Posted in Uncategorized

বন্ধনে রাখী

rakshabandhan-2013

সম্প্রতি দেশ জুড়ে মহোৎসব পালিত হল – ‘রক্ষাবন্ধন’, আমাদের কথায় রাখী। বোনের রক্ষার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ভাইয়ের হাতে বন্ধন। এই অঙ্গীকারবন্ধন পরিবারের সীমানা ছাড়িয়েও এমনকি ধর্মের গণ্ডী পেরিয়েও এগিয়ে গেছে বহুদূর – সেই মেবারের রাণী কর্ণাবতীর তরফে বাদশা হুমায়ূনের হাত পর্যন্ত। বাঙালীর কাছেও এই রাখীবন্ধন দেশভাগের প্রতিবাদে হিন্দু-মুসল্মানের সম্প্রীতি বন্ধন। রবি ঠাকুরের হাত ধরেই এ উৎসব পরিণত হয়েছে মহোৎসবে।

তবে আমাদের ছোটবেলায় বাঙালীর কাছে ভাই-বোনের মিলন উৎসব মানেই ভাইফোঁটা। রাখীর সময় রাস্তার মোড়ে সুন্দর সুন্দর স্পঞ্জের রাখী দেখা যেত বটে, কিন্তু আমার তো ভাই-ই নেই! নদাদির বাপের বাড়ির রাধাকৃষ্ণের হাতে রাখী পরানো হোতো কিনা – তাই নদাদিই আজ রাখী, কাল রাসপূর্ণিমা এসব গল্প করত। আর ঠাকুরের ঝুলন উৎসবের পর যেমন প্রতিবার সোলার কাকাতুয়া-টিয়া এসব ঠিক আমার জন্যে এনে হাজির করত, তেমনি রাখীর পর দু-একটা স্পঞ্জের রাখীও আমার ঠিকই জুটে যেত। তাই বলে সেদিনই নয় কিন্তু। কি করে হবে! আমাদের খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে দোল-দুর্গোৎসব অবধি ঠিক আছে, তাই বলে রাখী-বিশ্বকর্মায় তো আর ছুটি হত না! বিশ্বকর্মা পুজোর ঘুড়িও কিন্তু আমার বাদ যেত না। যত্ত ঘুড়ি ভোঁ-কাট্টা হয়ে মামারবাড়ির চারতলার ছাদে কিংবা নিমগাছের ডালে এসে আটকাত, নদাদি ঠিক আঁকশি দিয়ে সেগুলো উদ্ধার করে আমার জন্যে রেখে দিত। আমি ঘুড়ি ওড়াতে না পারলে কি হবে! আহা, ছোট মেয়ে রংবেরঙের ঘুড়ি পছন্দ হবে না নাকি! পরে অবশ্য সেসব ঘুড়ি বিল্লুকে দিয়ে দিতুম। ও ঘুড়ি ওড়াতো আর আমি ওর লাটাই ধরে থাকতুম।

যা হোক, ক্লাস ফাইভে উঠে প্রথম মনে হল রাখীটা একটা বন্ধুদের মধ্যে পালন করার মতো উৎসব হতেই পারে। কারণ ততদিনে খেয়াল পড়েছে বাসের বড় দিদিরা বন্ধুদের দেবে বলে মহা উৎসাহে রাখী বানাতে ব্যস্ত। সাটিনের সুতো কিনে দিনরাত তাকে দাঁতমাজার বুরুশ দিয়ে আঁচড়েই চলেছে।

ক্লাস ফাইভে আমার প্রাণের বন্ধু ছিল সোমা দেবনাথ। ক্লাসে দুজনে পাশাপাশি বসতুম, আর প্রতি পিরিয়ডেই নাহোক একবার করে আমাদের ঝগড়া হতো আর ভাব হতো। বহু উদ্ভট পরিকল্পনাও হতো তারই মধ্যে। যেমন সেবার হাওড়ায় শৈলীমার বাড়ি গিয়ে বাবাদের ছোটবেলার হাতে লেখা ম্যাগাজিন দেখে খেয়াল হল আমাদেরও একটা হাতে লেখা ম্যাগাজিন বার করতে হবে। কদিন ধরে তাই নিয়ে দুজনে মত্ত। অনেক বন্ধু তারজন্যে অনেক লেখা-আঁকা-কবিতা-গল্পও দিয়েছিল।

তা সেই সোমার জন্যেই প্রথম রাখী বানিয়েছিলুম – বাবার সিগারেটের প্যাকেটের রূপোলী রাংতার ওপর গোলাপী তুলো বসিয়ে (সাটিন সুতো পাবো কোথায়!) তার ওপর চুমকি টুম্‌কি কিছু বসিয়েছিলুম হয় তো!

সেবারই প্রথম পাড়ায় এসে গুরুপদদাদা দাবি করে – “কি রে আজ রাখী, আমাদের রাখী পরালি না?” আমিও তেমনি বললুম, “আমার কাছে তো রাখী নেই”। বেচারা নিজেই সঙ্গে করে দোকানে নিয়ে গিয়ে নিজের গ্যাঁটের পয়সা খরচ করে আমার পছন্দমতো রাখী কিনে দিল। বলাই বাহুল্য দাদাদের য’টা না পরালাম তার থেকে বেশি আমি পেলাম। তারপর দাবি “রাখী পরালে মিষ্টি খাওয়াতে হয় জানিস না?!” পাড়ার সব দাদাদের মধ্যে আধখেপা গুরুপদদা কোনদিনই আমার বিশেষ পছন্দের ছিল না, কিন্তু আজও রাখীর দিন এলে সবার আগে আমার ওর কথাই মনে পড়ে।

এরপর ধীরে ধীরে যত স্কুলের ওপরের ক্লাসে উঠেছি রাখী তৈরী আর বন্ধুদের রাখী পরানোর উৎসবে মেতেছি। বন্ধুদের মধ্যেই কাউকে দিয়ে সম্রাট থেকে রেশমী সুতো, রাখীর ওপরের ফুল-পাতা জোগাড় হয়েছে। তারপর ক্লাস নাইনে আমার ঝুলিতেও বন্ধুদের দেওয়া অনেক রাখী ভরে উঠেছে। আজকের এই ‘Friendship Day’ আমাদের কাছে ছিল সেদিনের সেই রাখীবন্ধন।

কিন্তু সবচেয়ে বিশেষ ছিল ক্লাস টেনের রাখীর দিন। স্কুল থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে বন্ধুদের সঙ্গে সব দিদিমণি ও সিস্টারদের হাতেও রাখী বেঁধে দেওয়ার পরিকল্পনা। পুরো ক্লাসের পক্ষ থেকে রাখী আনা হল। খুব সুন্দর সুন্দর রাখী। যে সব দিদি ও সিস্টাররা খুবই পপুলার, তাঁদের হাতে কে রাখী বাঁধবে তার লড়াই। কিন্তু মুশকিল হল নীলিমাদি, শোভাদি এরকম যাঁরা একটু প্রাচীনপন্থী, মোটেই রাখী পরতে চান না তাঁদের নিয়ে। তাঁদের বক্তব্য একদিনের এই লোকদেখানো উৎসব না করে সারাবছর ভাল বাধ্য ছাত্রী পেলে তাঁরা বেশী খুশী হবেন। এদিকে আমরাও তখন নাছোড়বান্দা। ‘ছাত্রীর মেয়ে’ বলে আমার প্রতি শোভাদি একটু সদয়। তাই বহু ঘ্যান্‌ঘ্যানানির পর অবশেষে বললেন, “ও সব গদা-টদা ওলা রাখী পরতে পারব না”। মনে আছে তার বদলে আমার বাক্স থেকে একটা পিট্‌পিটে চোখ লাগানো রাখী নিজে পছন্দ করে পরতে রাজি হলেন। সেদিনের সেই ক্লাসসুদ্ধু বন্ধুর দেওয়া অজস্র রাখী আজও আমার অমুল্য সম্পদ।

তখন বাড়িতে বাবুদাদা হাজির। তাই রাখী-ভাইফোঁটা আমার জীবনেও তখন বিশেষ দিন। তবে সেই পাড়ার দাদাদের হাতে রাখী পরানোর পর থেকে আমার কোনোদিনই আর ‘রাখীভাই’এর অভাব হয় নি। কলেজে ঢুকে ‘জয়েশ-ভাস্কর’ থেকে পুণেতে এসেও ‘নলাওড়ে-মোরে’ জীবনের প্রতি বাঁকে আমি আমার রাখীভাইদের পেয়ে গেছি। পুণায় গিয়ে বাড়তি পাওনা ছিল ডাকুদাদাকে রাখী পরানো আর ছেলেদেরও ফুলনের থেকে রাখী পাওয়া। ছোট থেকে যে দাদা সবসময় দূরেই থেকেছে সেই কখন সবচেয়ে কাছের নির্ভরতার স্থান হয়ে গেছে। তার চেয়েও বড় পাওয়া বৌদির মতো হিতৈষী বন্ধু। তবে এবছর রাখীবন্ধন ‘Whatsapp’ র শুভেচ্ছা-বিনিময়েই সাঙ্গ হল এই যা।

P.C.: Google image

Author:

I do whatever I like and whenever I like :) ;P